বলধা গার্ডেন: কবিতার মতো সুন্দর যে বাগান

নূরহাসনা  লতিফ

মানুষের দেখার শেষ  নেই। সারা পৃথিবী ঘুরে  শুধু দেখতেই  ইচ্ছে  করে। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতূতার কথা মনে পড়ে। ঘুরে বেরিয়েছিলেন পৃথিবীর পথে পথে-শুধু দেখার জন্য।  কতটুকূ দেখতে পেরেছেন  জানিনা, তবে তার ভ্রমনের কথা  লিখে  গেছেন । আমরা ভাবি দূরে-বহু দূরে গেলেই দেখতে পারবো  অনেক কিছু। এ প্রসংগে সত্যজিৎ রায়  ও রবীন্দ্রনাথের কথা  মনে হয়।.সাত বছর বয়সে সত্যজিৎ রায় মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন দেখা করতে, রবীন্দ্রনাথের   সাথে। ওনার আবদার ছিল-কবির  কাছে-কবিতা লিখে নেবেন।রবীন্দ্রনাথ  খাতাটা রেখে দিলেন। খাতায় কবিতা লিখে  দিয়েছিলেন কবিগুরু। কবিতাটা—
                                 ‘বহু দিন ধরে বহু      ক্রো শ দুরে
                                   বহু  ব্যয়   করি বহু  দেশ  ঘুরে
                                   দেখিতে গিয়াছি  পর্বতমালা
                                দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু
                                 দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া
                                    ঘর হতে শুধু দুই পা  ফেলিয়া
                                         একটি  ধানের শিষের উপরে
                                     একটি  শিশির বিন্দু।’

এই কবিতা বলে দেয় শুধু  দূরে নয়,  কাছেও আছে অনেক কিছু  দেখার। বলধা এস্টেটের জমিদার নরেন্দ্রনারায়ন রায় চৌধুরীর  শখের পরিচায়ক  এই বলধা গার্ডেনটি তেমনি পর্যটন কেন্দ্র  হতে পারে। ঢাকার  ওয়ারীতে এর অবস্থান। বাগানটি দুটি অংশে বিভক্ত। গ্রিক  পূরাণ  ঘেটে এর  নাম  রাখা  হয়েছে সাইকী আর সিভিলি। একদিন দেখতে গেলাম এই শখের বাগান।  সাইকী অংশে অর্কিড দিয়ে  বাগান পরিদর্শন শুরু করলাম । ঘরের মত শেড  দিয়ে  অর্কিড  সংরক্ষণ  করা হয়েছে ১০৪  রকমের অর্কিড  স্থান পেয়েছে  এখানে। ফুল  ফুটেছে কিছু  কিছু অর্কিডে। এবার এলাম ক্যাক্টাস  সংরক্ষিত  এলাকায়। সূর্য এবং বৃষ্টি  থেকে দূরে  রেখে এই ক্যাকটাসের  পরিবেশ গড়ে দেয়া হয়েছে । প্রায় দুহাজার  রকমের  ক্যাক্টাসের সাথে  পরিচিত হলাম। সবচেয়ে আকুর্ষণীয় গোল্ডেন ব্যারেল  ক্যাকটাস। কাণ্ড গোলাকৃতির। মাথার  অংশটি  চ্যাপটা। ৪০  থেকে৮০ সেঃমিঃ ব্যাসার্ধের এবং উচ্চতায় ১মিটারের উপরে।এর বয়স  ২৪  বছর। একে দেখে  আমার  মনে হয়  ড্রইংরুমে রাখা ফ্যাণশী  মোড়া। অদ্ভুত চিত্রল  পাতার  বকুল  গাছ  দেখলাম।  পাতাটাই  এর  বিশেষত্ব। আমাদের  দেশের  সাধারণ  বকুল  গাছের  মত  নয়। তবে  ফুলগুলো  আমাদের  দেশীয়  ফুলের  মত।

আমাদের  জাতীয় ফুল শাপলা।এখানে   ওখানে  শাপলা ফুলের  ছড়াছড়ি।এফুল  সবাই চেনে ।পানিতে ফোটা  প্রিয়  ফুল  শাপলা । সাধারনতঃ দুতিন প্রকারের  শাপলা  দেখা যায় কিন্তু এর ব্যতিক্রম  পাওয়া  গেল। বল্ধা  গার্ডেনে আছে  বাইশ  রকমের  শাপলা । শাপলা হাউসে এসব  সংরক্ষিত। সবুজ  শ্যাওলা  ভরা  পানিতে  ভাসছে। ফুলও   ফুটেছে কোন  কোন  শাপলায়। আমাজান  লিলির  নাম  শুনেছি।বড়  আকারের  ভারি  পাতা সাদা ফুল কিন্তু  এ  সময়টা  লিলির  জন্য  নয় ছোট  আকারের  লিলির  পাতা  ভাসছে পানিতে। তবে  রবি  ঠাকুরের  ক্যামেলিয়া ফুলকে  পাওয়া গেল।  ক্যামেলিয়া  ঝোপ  জাতীয়  উদ্ভিদ।  ঘন  সবুজ  পাতা ।  চা  ও  ক্যামেলিয়া   গাছ  একই  পরিবার   ও  গোত্রভুক্ত।এই বাগানে  ক্যামেলিয়া  গাছের  সংখ্যা৫২  টি  । .৪  রঙের  ফুল হয়। সাদা,  গোলাপীও  বাইকালার।  শীতকালে  এ  ফুল  ফোটে ।   ফুল্গুলি  অনেকটা  গোলাপের   মত। মোমের মত সাদা বড়  পাপড়ি  ওয়ালা  ফুল্গুলো   মন  কাড়ে।

এবারে  এলাম ফার্নের রাজ্যে।বিভিন্ন  প্রজাতির  ফার্ন।   ফার্নের একটা  প্রজাতি যার  পাতা  হাতে  চেপে  ধরলে  পাতার  নকশা   ওঠে  ্রূপালি  রেখায়।   অনন্ত  ডেনিয়া  শ্রী লংকার ফুল।  গাছটায়  তখনো  ফুল  ফোটেনি।  শুনলাম   হলুদ  রঙের  ফুল  হয়।   আফ্রিকান   টিউলিপ ,লতা   গন্ধরাজ,  স্বর্ণ অশোক, বারডস    অব  প্যারাডাইস। আর  কত  নাম  না জানা  ফুলের  গাছ।  আর জানলেও  এত সব  মনে  রাখা  সম্ভব  নয়।  গাছ  ছাড়াও      বল্ধা  গার্ডেনে  আর  আকর্ষণ     আছে।  শঙখ্নদ   পুকুর। শঙখে্র  মত  সাদা  সিঁড়িগুলো  নেমে  গেছে  পানিতে। এর সৌন্দর্য  মন  কেড়ে  নেয়ার  মত।এর  পানিতেই  ফোটে আমাজান  লিলি। প্রকৃতির এক  অপরূপ সৌন্দর্য।  সূর্যঘড়ি বল্ধা  গার্ডেণের  আর  এক  বিস্ময় ।   একালের  বিজ্ঞানীদের  ভাবনার  খোরাক  যোগায়।  প্রায়দুশ  বছর  আগেও  বিজ্ঞান  যে  চমক  দিয়েছে ও  তারই  প্রমান  এই সূর্যঘড়িটি।   শঙখ্নদ   পুকুরের  পাশে  জয়  হাউস।

১৯৩৬  সালে রবীন্দ্রনাথ  এসেছিলেন  বাগান  পরিদর্শনে।  ক্যামেলিয়া  ফুলের  রূপে  মুগ্ধ হয়ে তিনি এই জয়  হাউসে বসে  তাঁর  বিখ্যাত     ক্যামেলিয়া”  কবিতাটি লেখেন।  ঐতিহ্যময়     জয়  হাউজের   সিড়ি  ভেঙ্গে  উঠোলাম।প্রায়  ষাটবছর  আগে  বিশ্ব কবি  এখানে এসেছিলেন।  হয়তো বসেছেন এখানটায়,    লিখেছেন তার ক্যামেলিয়া কবিতাটি।। এমুহূর্তে আমার কবিতাটির  কয়েকটা লাইন  মনে  পড়ছে।
             ‘তনুকা বললে, ‘দামি দুর্লভ গাছ,
                 এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।'
                     জিগেস করলেম, ‘নামটা কী?'
                         সে বললে ‘ক্যামেলিয়া'।
            চমক লাগল—
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
               হেসে বললেম, ‘ক্যামেলিয়া,
                     সহজে বুঝি এর মন মেলে না।'
তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে,
                                 খুশিও হল।’
যতই  ঘুরে  ঘুরে  গাছ  দেখছি   ততই সেই  উদ্ভিদপ্রেমী নরেন্দ্রনারায়ণ  রায়  চৌধুরীর কথাই  ভাবছি। মহাকাব্যের মত কি মহান সৃষ্টি না করে  গেছেন। ১৯০৯ সাল  থেকে ১৯৩৬  সাল পর্যন্ত ২৭  বছর  ধরে একটু  একটু  করে  চয়ন  করে  সাজিয়েছেন  এই দুর্ল্ভ  বাগান। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ  সংগ্রহের  জন্য  রায়  চৌধুরী  ঘুরেছেন বিশ্বের  নানা জায়গায়। ইংল্যন্ড,আমেরিকা,শ্রীলঙ্কা,বার্মা,জাপান,চীন ,আফ্রিকা,ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুর প্রভৃতি প্রায় ৫০টির মত দেশ  থেকে  এসব  দুস্প্রাপ্য গাছ  সংগ্রহ করেছেন। ১৯২২  সালে জাপান থেকে  এনেছেন ক্যামেলিয়া; গোলাপ  ও অর্কিড এনেছেন  ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। …ম্যাক্সিকো থেকে এনেছেন ক্যাক্টাস। এসব  গাছ  সংগ্রহের  মজার  মজার  ইতিহাস আছে। একবার দুর্লভ গাছের চারা  দেশে  আনার স্ ময়  হারিয়ে গেল। কিভাবে যেন  চারাটি  চলে  যায়  অন্য  দেশে। অনেক  হয়রানির পর  তা  উদ্ধার  হয়।

এই বাগানের  বিশেষেত্ব হলো এখানে  কিছু  গাছ  আছে তা  বাংলাদেশের  অন্য  কোথাও  নেই।এইসব  গাছগুলোর জন্য টিস্যু  কালচার,কলম চারা বা  উপযুক্ত  বৈজ্ঞানিক  পদ্ধতি গ্রহন  করা  প্রয়োজন।

বাগান  রচনা  অনেকের শখ, কিন্তু  রায়  চৌধুরীর শখ  অতুলনীয়। তার  শখ  আর গভীর সাধনাই আমাদের পাইয়ে  দিয়েছে এই দুর্লভ  সংরক্ষণ-যা বিস্ময় আর আনন্দে ভরিয়ে দেয় প্রতিদিনের  দর্শকদের।

নূরহাসনা লতিফ[
 
 নূরহাসনা লতিফ: কবি ও লেখক।  তার প্রকাশিত বই এর সংখ্যা ৩৪টি।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/