প্রবীণদের নিয়ে ভাবনা

প্রতীকী ছবি

সুলতানা রিজিয়া

আজ পহেলা অক্টোবর। বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে প্রবীণ দিবস। বিভিন্ন দিনে যেমন পালিত হয় মা দিবস, বাবা দিবস, শিশু দিবস, শ্রমিক দিবস, সেই রকম প্রবীণ দিবস নামেও বছরে একটি দিন পালিত হচ্ছে। সংসারের সর্বময় কর্তৃত্ব থেকে বিচ্যুত, কর্মজীবন থেকে বহিস্কৃত (অন্য অর্থে অবসর), হেলা-অবহেলার গ্রন্থিতে আবদ্ধ এইসব প্রবীণরা বেঁচে থাকাকে অপমানের মনে করেন। নিজেদের বর্তমান অবস্থার প্রতি, দেহের ক্ষমতা হারানোর প্রতি, নানান রোগব্যাধির আধিক্যের প্রতি তারা কমবেশি হামেশায় বিতশ্রদ্ধ। কবিতার মতো ভালোবেসে নয়, অবহেলায়, অপমানে বেঁচে থাকার কারাগার থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার তৃষ্ণাও তারা অনুভব করেন।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর পহেলা অক্টোবর প্রবীণদের জন্য ঘটা করে প্রবীণ দিবস পালন করে। আমরা অনেকেই মনে করে থাকি, আহ্! বুড়ো, বুড়িদের নিয়েও বিশ্বখ্যাত একটা দিন পেয়েছি। এইদিনে কেউ কেউ প্রবীণদের কাছে তাদের প্রয়োজনীয় উপহার পাঠান, আত্মীয় স্বজন তাদের কাছে সময় কাটাতে আসেন, হাসি গল্পে, রকমারী খাদ্য খানার আয়োজনও করেন। ইদানীং প্রযুক্তির কল্যাণে কারণে, অকারণে মোবাইলে ছবি তোলার রেওয়াজ চালু হয়েছে। সাথে সলেফিও। জনপ্রিয় ও সহজ মাধ্যম ফেসবুকে প্রবীণদের সাথে তোলা ছবি হাতের মুঠোয় মোবাইলের পর্দায় পাঠিয়ে দেয়ার সুযোগও ছাড়েননা। রোগক্লিষ্ট, জরা, ব্যাধি ও বার্ধক্যের ভাঙ্গাচোরা অবয়বসমৃদ্ধ প্রবীণদের পাশে ষোলআনা পরিপাটি নিজের ছবি দেখেন, মনে মনে পুলকিত হন কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করায়। তারপর? প্রবীণরা যেখানে ছিলেন সেখানেই রয়ে যান এই দিনের অপেক্ষায়।

বিশ্বজুড়ে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, এই আয়ুর কারণে প্রতিবছরই প্রবীণদের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রবীনদের জন্য সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি। এদের কেউ কেউ অবসরকালীন ভাতা পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা খুব কম। সেই কমসংখ্যক নারী যদি স্বামী বা পুত্রের অধীনে থাকেন, তার প্রাপ্য টাকাটা তোলার অধিকার ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর কোনও অধিকার তারা পাননা। টাকা সংক্রান্ত খবরাখবরে যদি তিনি কখনো নাক গলান-তাহলে তার চারাপাশ থেকে অশ্রাব্য কথার বাণ ছুটে আসবে। হয়তো এই অজুহাতে দুই, তিন বেলা তাকে অভুক্তই থাকতে হবে।

এটাই বাস্তবতা। সংসারে প্রবীণ স্বামী স্ত্রীর যৌথজীবন যেভাবে কাটে, একক জীবনে তেমনটি কাটেনা। এখানে স্বামী বা পিতা, স্ত্রী বা মাতা একা হয়ে গেলে তখনকার চিত্র সম্পূর্ন ভিন্ন। আপন ভিটা বাড়ির ক্ষেত্রে মালিকানার বিষয়টি প্রবীণ পুরুষের জীবনের পট পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা না রাখলেও নারীর ক্ষেত্রে সেটি শাঁখের করাতসম হয়ে ওঠে। একই ভাবে জমিজমা, ব্যবসাপাতি, ব্যাঙ্ক বীমার মতো সহায়সম্পত্তি প্রবীণ নারীর জন্য ভালোর চেয়ে মন্দটাই ধেয়ে আসে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় সেটি আসে আপন পরিবার তথা সন্তানদের কাছ থেকে। যাদের কিছুই নাই তাদের কপালে জোটে সন্তানদের হাতের তোলা খাবারের গ্লানি, লাঞ্ছনা আর গোপন অশ্রু। যাদের সংসার কিম্বা পরিবার ছিলো না, অথবা কোলজুড়ে সন্তানই আসেনি, তাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধটা জলে বাসের মতোই। নিঃসন্তান দম্পতিরা শখের বশে, প্রয়োজনে, প্রবীণ বয়সের কথা ভেবে দত্তক গ্রহণ করেন, তারা বেশির ভাগ চোরাবালিতে হাতড়িয়ে জীবন পার করেন। কেউ কেউ অপমৃত্যুর ভয়ে কাঠ হয়ে থাকেন। প্রবীণদের জন্য আমরা কেউ আর তেমন গরজ দেখাই না। তাদের পথের ভিক্ষুকের সমমর্যাদাও দিতে কার্পণ্য করি।

এমনটা কি গত পঞ্চাশ বছর আগে ছিলো? আমাদের পূর্বপুরুষরা একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে তখন জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন, তারা তাদের বৃহৎ পরিবারকে সুশৃংখল পদ্ধতিতে, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছেন। তখন জন্মশাসনের কোনো সুযোগ ছিলোনা। পিতা-মাতার স্নেহচ্ছায়ায়, গভীর মমতায়, শাসনে, তোষনে সন্তানরাও পরিশীলিত এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি জীবনাচারের গুণাবলী পিতা-মাতা, সংসারের অন্যান্য মুরব্বীদের ( চাচা-মামা) অভিজ্ঞতার আলোকেই পরিচালিত হয়েছে। তখন পরিবারের মাথাদের (গুরুজন বা প্রবীণ অভিভাবক) প্রতি ছোটদের ছিলো অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। পরিবারের তখন প্রবীণদের (বুড়ো, বুড়ি) পৃথকভাবে ধরা হতোনা। হেলা-অবহেলার বালাইও ছিলোনা আর তাদেরকে পরিবারের বাড়তি সদস্য হিসাবে ভাববার কোন অবকাশ ছিলোনা। কারণ সবাই প্রবীণদের আজীবন কর্মের স্বীকৃতি দিতে এবং সংসারের মালিকানার বিশ্বাস কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতেন। ফলে তখন প্রবীণদের নিয়ে কেউ বিড়ম্বনায় পরতেন না, প্রবীণরাও সন্তানদের তত্বাবধানে তাদের সংসারে সুষ্ঠু স্বাভাবিক ভাবে জীবন কাটাতেন।

সেইসব একান্নবর্তী পরিবার যুগের প্রয়োজনে, আধুনিক সভ্যতার অজুহাতে টুকরো, টুকরো হওয়ার মাঝ দিয়েই আজকের এই সমস্যার উদ্ভব, প্রজন্মের অবক্ষয়ের বিস্তার। দিনে দিনে এর আকার প্রকার বাড়বে বৈ কমবে না। আধুনিক সভ্যতায়, শিক্ষায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের গড় আয়ু যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে তাদের সৃজনী ক্ষমতা, মেধা, শারীরিক শক্তি কিন্তু কমে যাচ্ছে না। বেশিরভাগ প্রবীণই কর্মক্ষমতায় সৃজনশীল তারুণ্যে ভরপুর থাকেন। তাদের মানসিক সক্ষমতাকে আমরা এড়িয়ে যাই, ভাবি অনেকতো হলো, এবার রাস্তা ছাড়ো, অপেক্ষারতদের সুযোগ দাও। আমরা তাদের অবশিষ্ট তারুণ্যকে অগ্রাহ্য করি, তাদের ঘরের কোনায় পাঠিয়ে দিয়ে, সংসারের দায়দায়ত্বি থেকেও অব্যহতি দেই। পদে পদে তাদের সিদ্ধান্তকে, মতামতকে, ভুল প্রমানিত করি। আপন সন্তানদের সামনে অবহেলায়, অপমানে জর্জড়িত করি।

বর্তমানে প্রবীণদের সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকাটা প্রায় অনশ্চিতি হয়ে পরছে। সন্তানরা অসম প্রতিযোগিতার যুগে আপন আপন কাজ, ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ে, প্রবাস জীবন নিয়ে যেমন ব্যস্ত, তেমনি তাদের সংসার, সন্তানরাও নিজ নিজ শিক্ষা, আচার অনুষ্ঠান, অন্য অর্থে প্রয়োজনে দিশেহারা। ঘরে বাইরে আজ আর কারোরই সময় নেই, একই সাথে সংসারিক পরিবেশে বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব। ফলে তারা নিজেরটা ছাড়া অন্যেরটা নিয়ে ভাবতে পারছে না। এটাই আজকের একক পরিবারের বৈশিষ্ট, অন্য অর্থে ট্যাটাস। সেখানে প্রবীণের ঠাঁই নাই। মা, বাবা যেই হোন, সেখানে আত্মার সম্পর্কের চেয়ে “সমানে সমানে লড়াই”টাই (সামাজিকতা পদ মর্যাদা ও টাকার বড়াই ) বড়, বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য বা সন্তান হিসাবে তার দায়িত্ব পালন, নেহায়েতই তুচ্ছ সেন্টিমেন্ট!!

সময়ের অলি, গলি পেরিয়ে জীবনের বয়স বাড়ে, এই বিশ্বপ্রকৃতিই জীবনের রশি টেনে নিয়ে যায় বয়সী বলয়ে। এটাই প্রাণের ধর্ম, সৃষ্টির মাহাত্ম, স্রষ্টার অলঙ্ঘ বিধান। এই নিয়মেই মানুষ প্রবীণ হয়, তখন তার দেহের স্বাস্থ্য-শক্তি কমে যায়। এসময় তারা বড়ই বিদিশা ও অসহায় হয়ে পরেন, নির্ভর করতে চান সন্তানদেরই উপর। আপন সন্তানদের সেবা, যত্নে তারা জরা-ব্যাধিকে জয় করতে চান, অসুখ-বিসুখের নানামুখী আক্রমনেও হাসি-খুশি থাকতে চান। বাঁচতে চান আপন সংসারের ছায়ায়, সন্তানদের মায়ায়। মৃত্যুভয় থেকে, দৈহিক অকর্মন্যতার গ্লানি থেকে নিরাপদে প্রবীণ পিতা-মাতাকে রাখার দায়িত্ব সন্তানদের। একমাত্র সন্তানদেরই। এটা অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই, নেই কোনো বিধি- বিধান অথবা বিকল্প পথ।

সুলতানা রিজিয়া

সুলতানা রিজিয়া: সুলতানা রিজিয়া: কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘নন্দিনী’নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করছেন। এছাড়া তার রয়েছে প্রকাশনা হাউস সম্রাজ্ঞী। তার প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থ ৩১ টি। সাহিত্য ও সাংগঠনিক অবদানের জন্য পেয়েছেন ত্রিশটির বেশি সম্মাননা পদক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/