হোমায়রা হুমা
গত সপ্তাহের গোটা সময়টিই কেটেছে গৌরবের আনন্দে; পাশাপাশি লজ্জাষ্কর বেদনাক্লিষ্ট তথাতথিত ক্ষমাতায়নপ্রাপ্তির নোংরামির বর্হিপ্রকাশও দেখেছি উচ্চ বিদ্যাপীঠে ।
আনন্দে উল্লসিত ছিলাম এজন্য যে নারী সাফ ফুটবলজয়ীরা বাংলাদেশের সম্মানকে আরো বহুগুণে গৌরবাণ্বিত করেছেন। জীবনযাপনের কতশত প্রতিকূলতা ও পক্ষপাতদুষ্ট বুলিং ও সুবিধাবঞ্চিত আদিবাসী, পাহাড়ী ও দারিদ্রতায় নিষ্পষিত অতি সাধারন ঘরের অষ্টাদশির কন্যারা অসাধারণ নৈপুণ্যে আন্তজার্তিক ফুটবল সাফগেমস প্রতিযোগিতায় জয়িতার পালক, গোল্ডের বুট প্রাপ্তির সম্মাননাসহ গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ান হয়েছেন। যে কন্যারা ছিলেন সর্বদাই প্রচারের আড়ালে। এছাড়াও পরিবারের দারিদ্রতা তাদের পিছু টেনে রাখতে পারে নি। দেশপ্রেম, পরিবারের জন্য কিছু করার প্রত্যয় আর কিছু করে দেখানোর মনের দৃঢ়তা তাদেরকে খেলার মাঠে দক্ষতা নৈপুণ্যতায় পূর্ণতা ও কোচের নির্দেশনায় তারা ছিনিয়ে এনেছেন ফুটবলে সকল প্রতিযোগীতায় জয়লাভের বিজয়মুকুট।
এশিয়া কাপ ও সাফ গেমস জয়ের মাধ্যমে এশিয়া ফুটবল চ্যাম্পিয়নস জয়ীরা এই প্রথম গণমাধ্যমে বিপুল প্রচার-প্রচারণা পেয়েছেন। আজ এই মেয়েরা ছাদখোলা বাসে ঢাকা রাজধানীতে প্রবেশ, সংবাদ সম্মেলন, বিপুল অর্থপ্রাপ্তির ঘোষনাসহ তাদেরকে নিয়ে নিজ জেলা সম্বর্ধনাসহ নানানভাবে সম্মান ও উৎসাহ পাচ্ছেন । তবু কেবল নারী বলেই তাদের প্রতি হীনদৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন পক্ষপাতদৃষ্টতা দেখা গেছে খোদ ফুটবল ফেডারেশন সভাপতির কাছ থেকেই। তিনি এই বিজয়ীদলকে বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বপ্নের উৎসাহ দেয়া ব্যতিত, বিবাহের খরচের যোগানোর চিন্তায় ছিলেন ব্যতিব্যস্ত। তবু সুখের বিষয় যে, এই জয়ীতারা বিয়েকে পাশ কাটিয়ে মাঠে ফেরার প্র্যাকটিসে ফিরে গেছেন।
চলুন দেখি নারীর ক্ষমতায়ণের মত উৎকৃষ্ট সুযোগ ও উপায়ণকে কিভাবে কলুষিত করেছেন ঢাকার খ্যাতিমান ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের কতিপয় অবৈধ উপায়ে ক্ষমতালোভী, নষ্টসময়ের ক্ষমতালিপ্সু, কিছু ছাত্রীর নোংরামির ব্যতিব্যস্ততার দৃশ্যপট।
সকল সরকারি আমলেই ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে ঘিরে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে সিট বাণিজ্যের আড়ালে ছাত্রীহলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি, যুগের পর যুগ মিথ্যে চাকচিক্যে নেতৃত্ব তোষণে নিমজ্জিত করে রাখেছে। যদিও কলেজে ভর্তি হওয়া হলে সিট পাওয়া ছাত্রীদের সহজতর আবাসন অধিকার। এই অধিকার প্রাপ্তির জন্য ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়ার নেশাকে নিশ্চয়ই ক্ষমতায়ণ বলে না। ছাত্ররাজনীতি তো সর্বময় একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এই রাজনীতি সুষ্ঠধারার নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। যুগে যুগে ইডেন কলেজ আজ ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়েছে। তবে কেন সিট বরাদ্দ কলেজ কর্তৃপক্ষের হাত থেকে রাজনীতির প্রেক্ষণে যুক্ত হলো? নোংরামীর উপকরণে পরিণত হলো?
যে ছাত্রীরা ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রাঙ্গণে ক্ষমতায়ণের ব্যানারকে গায়ে জড়িয়ে সিট বরাদ্দের ব্যবসা করছেন আর রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার লোভে সাধারণ ছাত্রীদের অনৈতিক কর্মে ব্যবহার করছেন তারা এই ইডেন কলেজে পূর্ববর্তী ইতিহাস জানেন কি?
ক্ষমতায়ণের সত্য ও ন্যায়ের শক্তিতে পৌঁছানো এতো সহজ ছিল না কখনোই। স্বদেশী আন্দোলনের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর সাহসী আত্মত্যাগে গৌরবাণ্বিত এই ইডেন কলেজ শিক্ষাপীঠকে যারা সুষ্ঠরাজনীতির নামে লোভ লিপ্সা, ক্ষমতার অপব্যবহারের নোংরামিতে নিজেকে জড়িয়ে নিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিতবোধ করেনি, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানাই। ক্ষমতায়ণের আর্দশকে, সুনীতি লক্ষ্য, গণতান্ত্রিক গতিধারাকে তারা জানবে কি করে। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামন মোহন রায়, কবি সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীম, জাহানারা ইমাম, মনোরমা বসু, আশালতা সেন, সাজেদা চৌধুরী, সুলতানা কামাল, মালেকা বেগম তাদের নাম কি তারা জানে? রাজনৈতিক সুষ্ঠধারার ক্ষমতায়ণের পটভূমি গঠনে তাদেরকে কতশত নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে এরা জানে কি? কোনো ইতিহাস তারা পড়েছে কি?
প্রকৃতপক্ষে স্বদেশী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে দুইলক্ষ নারীর আত্মবিসর্জনের ইতিহাস, চারলক্ষ বীর সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও তাদের আত্মৎসর্গের ইতিহাস এই প্রজন্মের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া নব্য নেতানেত্রীরা জানেন কি? প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ এদের দুষ্কর্মকে স্থগত ও বহিস্কার করেছেন তিনি।
এই সপ্তাহটি ছিল শিশুদিবস। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিশুদের জন্য কি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ও তা বাস্তবায়নে কত বাজেট বরাদ্দ হয়েছে কে কেউ জানে না ? শিশুর সঠিক সংখ্যা তা কি সঠিক কেউ জানে? স্বাস্থ্য,আবাসন, পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা, বিনোদন আরো কতশত অধিকার শিশু অধিকার সনদে লিখিত আছে কে তার খোঁজ রাখে। আচ্ছা আন্তজার্তিক শিশুসনদে শিশুর তো বয়স ১৮। কিন্ত দুঃখজনকভাবে কয়েকমাস পূর্বে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় কন্যার বয়স আরো কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন ১৮ থেকে ১২ করার প্রস্তাব করেছিলেন। কন্যার বাল্য বিবাহ তড়াণ্বিত করাই কি এর মূল উদ্দের্শ ছিল। যদিও বাল্যবিবাহে নিরোধ আইনেও কন্যাশিশু বিবাহ নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট ফাঁকফোকর বিদ্যমান।
পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত ও সুযোগভোগী শিশু সকলের অবস্হান ও অধিকার প্রাপ্তির মান কিন্তু এক নয়। যদিও সংবিধানে একই অধিকার প্রাপ্তি কথা বলা হয়েছে। প্রতিভাবিকাশে শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী সকল শিশুদের জন্য কি সুযোগ রেখেছেন?
শিশুদের নিরাপত্তার জন্য পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঘরে বাহিরে কি কোনো সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে। শিশুরা কি অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তায় দিনযাপন করছে তা আমরা জেনেও কিছুই করতে পারছি না। এরা কিভাবে কি শিখে আগামীর দিনে এগিয়ে আসছে আমরা তার সবই জানি। জেনেও কিছু না করতে পারা এ বড়ই পরিতাপের বিষয়। শিশুর পুষ্টিহীন জন্মলাভ ও অনিরাপত্তায় বেড়ে ওঠা-সবই নিশ্চিত অশনিনির্ঘাত।
আমরা জানি আমাদের সচেতন হতে হবে কিন্তু কতটুকু কীভাবে তা করতে পারি না। কারণ ঘরেই যে অযুতসংখ্যক সর্পের বাস।
হুমায়রা হুম: কবি, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/