যারা পেলেন ‘অনন্যা শীর্ষ ১০ সম্মাননা’

শুরুটা হয়েছিলো ১৯৯৩ সালে। এরপর থেকে প্রায় ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি দিতে দেশের ১০ জন নারীকে নিয়মিত পুরস্কৃত করে চলেছে পাক্ষিক অনন্যা। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শনিবার (১৯ নভেম্বর) জাকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের ‘অনন্যা’ ১০ নারীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ‘অনন্যা শীর্ষ ১০ সম্মাননা’।

শনিবার বিকাল ৪টায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে ‘অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা ২০২১’ তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও পাক্ষিক অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। এতে সভাপতিত্ব করেন পাক্ষিক অনন্যা ও দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন।

এবার যারা অনন্যা পুরস্কার পেয়েছেন তারা হলেন-অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ, করপোরেট ব্যক্তিত্ব বিটপী দাশ চৌধুরী, মঞ্চাভিনেতা ও নির্দেশক’ত্রপা মজুমদার, সময়ের অদম্য সাহসী মা শাহিনুর আক্তার, , বিজ্ঞানী সালমা সুলতানা, প্রযুক্তিবিদ রুদমীলা নওশীন, আলোকচিত্রশিল্পী শাহরিয়ার ফারজানা, মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক সান্ত্বনা রানী রায়, নারী উদ্যোক্তা মোছা. ইছমত আরা এবং প্রথম ফিফা নারী রেফারি জয়া চাকমা। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিচে তুলে ধরা হলো।

অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ

নাজনীন আহমেদ-মেধাবী নাজনীন আহমেদ ১৯৯০ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসিতে এবং ১৯৮৮ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসিতে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে নাজনীন প্রথমে ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ (সিপিডি)—তে যোগদান করেন। গত বছর তিনি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট হিসাবে যোগ দিয়েছেন। তিনি হলেন প্রথম বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ যিনি এই আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন।

বিটপী দাস চৌধুরী

বিটপী দাশ চৌধুরী- তিনি একটি মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকের হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স এবং ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিংয়ে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এবং পরবর্তী সময়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এবং ফিন্যান্স নিয়ে দেশের বাইরে এমবিএ করেন। তিনি ব্যাংকের মধ্যে নন—ব্যাংকিং কাজ করে থাকেন, যেখানে প্রতিটি দিন আসলে নতুন চ্যালেঞ্জ ও নতুন কর্মপরিকল্পনার।

নাট্য ব্যক্তিত্ব ত্রপা মজুমদার

ত্রপা মজুমদার-দেশের কিংবদন্তি অভিনয় দম্পতি ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদারের কন্যা ত্রপা মজুমদার একজন ভালো অভিনেত্র। পাশপাশি মঞ্চ অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনাতেও সুনাম অর্জন করেছেন। থিয়েটারের ‘পোহালে শর্বরী’ নাটকটিতে বাবা রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে সংযুক্ত নির্দেশনা দিয়েছেন ত্রপা। এর আগে তিনি নিদের্শনা দিয়েছেন লালন ফকিরের জীবনীভিত্তিক নাটক  ‘বারামখানা’।

সাহসী নারী শাহিনুর আক্তার

শাহিনুর আক্তার- তার ছেলে ইয়াকুব লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়ে যান। ছেলেকে উদ্ধারের জন্য কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একা লিবিয়ায় ছুটে যান মা শাহিনুর। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় মাফিয়াদের হাত থেকে ছেলেকে উদ্ধার করে আনেন এই সাহসী নারী। সাহসিকতার পুরস্কার হিসাবে এবার পেলেন অনন্যা শীর্ষ ১০ সম্মাননা।

কৃষি বিজ্ঞানী সালমা সুলতানা

সালমা সুলতানা– সালমা সুলতানা একজন কৃষি বিজ্ঞানী। তিনি ২০১০ সালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ওপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি তামিল নাডু ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে সিভাসু থেকে ২০১৪ সালে ফার্মাকোলজির ওপর স্নাকতোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

কৃষিক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে অবদান রাখার জন্য ২০২০ সালে নরম্যান ই বোরলগ পুরস্কার লাভ করেন, যা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও ফজলে হাসান আবেদের পর তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০২১ সালে, সিঙ্গাপুর ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়ীকিতে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। সালমা সুলতানা বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি প্রাণিস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রশিক্ষণকেন্দ্র মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন।

প্রযুক্তিবিদ রুদমীলা নওশীন

রুদমীলা নওশীন-স্কলাসটিকা থেকে এ লেভেল শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান জোস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন রুদমীলা নওশীন। পরবর্তী সময়ে মাস্টার্স অব সায়েন্স ইন ডিজিটাল কমিউনিকেশন অ্যান্ড মালটিমিডিয়া বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কনফিগ—ভিআর ও কনফিগ—আরবোটের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও।

]

শাহরিয়ার ফারজানা

শাহরিয়ার ফারজানা-চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার মেয়ে শাহরিয়ার ফারজানা আলোকচিত্রে ইতিমধ্যে শতাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার জীবনের দুর্বিষহ সময়ে সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে হাজির হয় আলোকচিত্রশিল্প। প্রতি বছরই অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের বিরল পালক জমা হচ্ছে তার মুকুটে। ফটোগ্রাফি ছাড়াও শাহরিয়ার ফারজানা গত ৯ বছর ধরে ‘নারীকণ্ঠ’ নামের একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনায় যুক্ত রয়েছেন।

সান্ত্বনা রানী চাকমা[

সান্ত্বনা রানী রায়– তিনি ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পাঁচটি মার্শাল আর্টের আসরে স্বর্ণ জিতে নিজেকে সেরা প্রমাণ করেন। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০তম বিশ্ব তায়কোয়নদো প্রতিযোগিতায় তিনি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচটি ঘরোয়া প্রতিযোগিতা ও দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পাঁচটি স্বর্ণ এবং একটি করে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন।

নারী উদ্যোক্তা ইসমত আরা

মোছা. ইছমত আরা-নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া করা অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় মোছা. ইছমত আরার (২৯)। একদিন বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পরচুলা তৈরির কারখানার সন্ধান পান তিনি। সেখানে ভর্তি হয়ে সেই কাজ রপ্ত করেন। পরে এলাকায় এসে একেক করে অনেক নারীকে সেই কাজ শেখান। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে এক হাজার নারী এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। নারী উদ্যোক্তা হিসাবে ইছমত আরা ২০১৮ সালে উপজেলা পর্যায়ে জয়িতা নির্বাচিত হন।

ইছমত আরার বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নন্নী ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া গ্রামে। স্বামী আবু তালেব (৩৯) স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পিয়নের চাকরি করেন। ঘরে তাঁদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।

ফিফা রেফারি জয়া চাকমা

 জয়া চাকমা– রাঙামাটির মেয়ে জয়া ক্লাস ফোরে পড়ার সময় শিশু একাডেমিতে খেলার মাধ্যমে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেন। একপর্যায়ে জাতীয় নারী দলে জায়গা পান জয়া। খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার শেষ ২০১০ সালে রেফারিংয়ে মনোনিবেশ করেন। এর আগে লেভেল ৩, ২ ও ১ কোর্স সম্পন্ন করে জাতীয় পর্যায়ের রেফারি হন তিনি।  ২০১৯ সালে ফিফার রেফারি হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করার মাধ্যমে তিনি অর্জন করেন বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি হওয়ার বিরল গৌরব। বর্তমানে বিকেএসপির নারী ফুটবলের কোচ হিসেবে কাজ করছেন এই মেধাবী ও বিচক্ষণ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে ২৭০ কৃতী নারীকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, শিক্ষা মন্ত্রী ডক্টর দিপু মনি এবং স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীসহ বহু আলোকিত নারী এই সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/