স্বপ্নদ্বীপে স্বপ্নের মতো একদিন

মাহমুদা আকতার
মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর। ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে ৫টায়। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার কারণে সূর্যি মামা আলো ছড়ানোর আগেই বিছানা ছাড়তে পারলাম, কারো সাহায্য ছাড়াই। তাড়াতাড়ি স্নান করে তৈরি হতে শুরু করলাম। আজ সাংবাদিকদের পর্যটনভিত্তিক সংগঠন গাঙচিলের সদস্যরা যাচ্ছি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ‘স্বপ্নদ্বীপ’ ভ্রমণে। এটি মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা একটি দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই রিসোর্ট যার অবস্থান ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুরের চরশিবপুর এলাকায়। তবে আমরা সেখানে যাচ্ছি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা হয়ে। ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। শহরের যান্ত্রিক কোলাহল থেকে কিছু সময়ের জন্য যারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিরিবিলি কিছুটা সময় কাটাতে চান তাদের জন্য একেবারে পারফেক্ট স্থান এই স্বপ্নদ্বীপ।

বিসনন্দী ফেরিঘাটে আমরা সবাই

বরাবরের মতো এবারও আমাদের যাত্রা শুরু হবে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে। সকাল সাড়ে ৮টা মধ্যে সবার সেখানে থাকার কথা। তবে সেখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে পৌণে ৯টা বেজে গেল আমার। গিয়ে দেখি ক্লাবের দক্ষিণের বারান্দায় বসে নাস্তা করছেন গাঙচিলের সভাপতি নাসিমা সোমা এবং সিনিয়র সাংবাদিক মাছানি ভাই। আমিও যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। খেতে খেতেই খবর পেলাম গাঙচিলের অন্যান্য সদস্যরাও এসে গেছেন এবং আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন ক্লাব চত্বরে। দ্রুত খাওয়া শেষ করে আমরা তিনজন গিয়ে মিলিত হলাম অপেক্ষমানদের সঙ্গে। আমাদের এবারের ভ্রমণে সবমিলিয়ে সঙ্গী হয়েছেন গাঙচিলের নয়জন সদস্য। তারা হলেন নাসিমা সোমা (বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাদেশের আলো), সিনিয়র সাংবাদিক আবু মোঃ মাছানি, মোহাম্মদ আবদুল অদুদ (সিনিয়র সাব-এডিটর দৈনিক ইনকিলাব), ইউসুফ আলী বাচ্চু (সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ভোরের পাতা), জামান সৈয়দী (বার্তা সম্পাদক, বাংলা৭১নিউজ.কম), মোঃ শহিদুল ইসলাম (স্টাফ রিপোর্টার, সকালের সময়), এম জহিরুল ইসলাম (মফস্বল সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর), শাখাওয়াত হোসেন মুকুল (সিনিয়র রিপোর্টার, আমাদের নতুন সময়) ও মাহমুদা আকতার (সম্পাদক, ওমেন্স নিউজ২৪.কম)। প্রেসক্লাবের বাগানে ফটোসেশনের পর শুরু হলো আমাদের স্বপ্নযাত্রা, মানে স্বপ্নদ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা। প্রেসক্লাব থেকেই ভিডিও করতে শুরু করেছেন সাংবাদিক শহিদুল ইসলাম ওরফে শ্যামল। তিনি তার ভ্রমণবিষয়ক ব্লক শ্যামলস ওয়ার্ল্ড ট্যুরসে এই ভিডিও পোস্ট করবেন।

আছে তাঁবুতে রাত কাটানোর ব্যবস্থাও

প্রেসক্লাব থেকে আমরা সবাই মিলে গুলিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই গুলিস্তান ফ্লাইওভারের কাছে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকেই বিআরটিসির কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে এসি বাসে উঠে পড়লাম। বাসে ওঠে গল্প করতে করতে কখন যে দুই ঘণ্টা কেটে গেল টেরই পেলাম না। আড়াইহাজারের বিসনন্দী ফেরিঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ ভাই। তিনি আমাদের জন্য ট্রলারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এই ভ্রমণটা আসলে আমাদের জন্য এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতোই ছিলো। সবুজে ঘেরা স্বপ্নদ্বীপ যাওয়ার জন্য যেভাবে মেঘনা নদী পাড়ি দিতে হলো তাতে নৌভ্রমণের দারুণ এক অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল আমাদের। এই নৌভ্রমণের অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করার নয়। মেঘনার উত্তাল জলতরঙ্গ সূর্যের আলোয় রূপার মতো চকচক করছে। দুপাশে ছবির মতো শ্যামলিমা গ্রামের চিরন্তন দৃশ্যাবলী, সারাদিন ধরে দেখলেও যাতে ক্লান্তি আসে না। । সেই রূপালি স্রোতের খেলা দেখতে দেখতে চলেছি আর মনে মনে আবৃত্তি করছি জীবনান্দ দাসের বিখ্যাত কবিতার লাইন।

আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউএ ভেজা বাংলারই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।

… ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।

ট্রলারের ছইয়ের ভিতর বসে কমলা খেতে খেতে আমরা মেঘনার দু তীরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছি, সঙ্গে চলছে ফটোসেশন। আর শ্যামলের ক্যামেরা তো অবিরাম চলছেই। ভিডিও করার এই গুরুদায়িত্ব স্বেচ্ছায় বহন করার ফলে অনেক গ্রুপ ছবিতে তাকে আমরা মিস করেছি। এনিয়ে তার কোনও আফসোস নাই, সে তো সব সিনারি জীবন্ত ধরে রাখায় প্রচেষ্টায় বিভোর। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক নৌভ্রমণ শেষে পৌঁছালাম স্বপ্নদ্বীপ-আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে। জনপ্রতি ৩০ টাকা করে টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করতেই নয়ন জুড়িয়ে গেল। মেঘনার তীর ঘেষে গড়ে ওঠা এই স্পটটিকে গুছিয়ে তুলতে তেমন কোনও কসরৎ করতে হয়নি কর্তৃপক্ষকে, প্রকৃতি যেন নিজ হাতেই একে সাজিয়েছে। বিশাল আকৃতির এই রিসোর্টে ঢুকতেই চোখে পড়লো বাচ্চাদের পার্ক, যাতে সাজানো আছে স্লিপার, চরকি, দোলনা, ঢেঁকি আরও অনেক কিছু। আরও আছে খেলার মাঠ আর বাঁশের তৈরি ছোট ছোট কটেজ। এছাড়া এখানে চাঁদনি রাতে তাঁবুতে রাত্রীযাপনের ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া এর ভিতরটা নানা ধরনের গাছপালায় ঠাসা, ফাঁকে ফাঁকে সিমেন্ট, কাঠ আর বাঁশের তৈরি ছোট ছোট বেঞ্চ। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারবেন।

ঘাসফুল আর কাশফুলের মেলা

স্বপ্নদ্বীপ আসলেই যেন স্বপ্নের মতো। যেখানে তাকাই সেখানেই সবুজ আর সবুজ। পায়ের নিচে অকাতরে ফুটে আছে কত না রংবেরংয়ের ঘাসফুল। এর দুইপাশে মেঘনার উন্মুক্ত জলরাশি, যেখানে ছোট ছোট নৌকায় করে মাছ ধরছে জেলেরা। এই অবারিত সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপভোগ করতে পারবেন প্রকৃতির সৌন্দর্যা। নদীর তীরের বিস্তীর্ণ এলাকা কাশফুলে সাদা হয়ে আছে। যেন বা শরৎ চলে যেতে যেতে রেখে গেছে তার স্মারকচিহ্ন। কাশফুলের বনে নানা রকম পোজ দিয়ে ছবি তুললাম আমরা। সঙ্গে চলছে মাসুদ ভাইয়ের আপ্যায়ণ। চা, বিস্কুট, ঝালমুড়ি আরও কত কি! ঘোরাঘুরির পাশাপাশে চলছে প্রাণখোলা আড্ডা। সবার একটাই কথা-‘না আসলে খুব মিস করতাম।’ সবার আরও অভিমত- ‘কৃত্রিমভাবে সাজানো রিসোর্টের চেয়ে এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ানোর মজাই আলাদা।’

এরই মধ্যে অদুদ ভাইয়ের ফোন- তিনি ফেরিঘাটে এসে পৌঁছেছেন। ঢাকায় বিশেষ কাজ থাকায় তিনি আমাদের সঙ্গী হতে পারেননি, পরে একাই এসেছেন। টেলিফোনে তাকে আসার উপায় বাতলে দিলেন আমাদের ইউসুফ বাচ্চু আর এম জহির। কিছুক্ষণ পর অদুদ ভাই এসে যুক্ত হলেন আমাদের সাথে। এরই মধ্যে জহির, বাচ্চু, মুকুল চলে গেলেন মেঘনায় গোসল করতে। বাকিরা বসে বসে গল্প করতে লাগলাম।

এদিকে বেলা বাড়ছে, খিদেও পেয়েছে-কিন্তু স্বপ্নদ্বীপ ছেড়ে যে ছেড়ে যেতে যে মন চাইছে না! কিন্তু ফিরতে তো হবেই। শেষে আমরা একই ট্রলারে করে ফিরতে শুরু করলাম। শীত বিকেলের নরম আলোয় মেঘনা আরও মায়াময় আরও অপরূপ। তাই আমরা কেউই আর ছইয়ের মধ্যে গেলাম না। বাচ্চু, জহির, শ্যামল, মুকুল, মাশানি আর অদুদ ভাই ছইয়ের মাথায় চড়ে বসলেন। আমি আর সোমা আপা নৌকার গলুয়েই ওপর দাঁড়িয়ে মেঘনার অপরূপ সৌন্দর্ উপভোগ করতে লাগলাম। সঙ্গে চললো ফটোসেশন আর আড্ডা। ফেরিঘাটে পৌঁছে আমরা গেলাম ভাই ভাই বিরিয়ানি হাউজে। এখানে আমাদের জন্য খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলেন হোটেল মালিক আব্দুল কুদ্দুস। না, হোটেলের কোনও গতানুগতিক খাবার নয়, আমাদের জন্য অর্ডার দিয়ে বিশেষভাবে রান্না করানো হয়েছে। বাসমতি চালের ধোয়া ওঠা ভাত, চিংড়ি করলা, বেগুন ভাজি, পাঁচমিশালি মাছ, মুরগির তরকারি আর গরু মাংস ভুনা  এবং সবশেষে ডাল আর গরম গরম দুধ চা। সবাই এতটা তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিলো- ভাত নয়, অমৃত খাচ্ছি। সবার একটাই কথা-অসাধারণ রান্না, অনেকদিন পর এরকম সুস্বাদু খাবার খেলাম!

খাওয়া দাওয়া শেষে মাসুম ভাইয়ের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়ে আবারও উঠে বসলাম বিআরটিসির এসি বাসে। আসতে আসতে কত কিছু যে ভাবছিলাম। বিখ্যাত ধর্মগুরু ও দার্শনিক সেন্ট অগাস্টাইন সত্যিই বলেছেন- ‘পৃথিবী একটি বই। যারা ভ্রমণ করে না তারা কেবল এর একটি পৃষ্ঠাই পড়ে।’ কিন্তু আমরা তো কেবল একটা পৃষ্ঠায় পড়ে থাকতে চাই না, ঘুরে দেখতে চাই পৃথিবী নামক গোটা বইটি। তাইতো ভ্রমণপিপাসু একদল সাংবাদিক মিলে ২০১৪ সালে গড়ে তোলা তুলেছেন  গাঙচিল সাংবাদিক ফোরাম। এই ফোরাম থেকে ১-২ মাস অন্তর করা হয় ভ্রমণের ব্যবস্থা। আসলে ঘোরাঘুরির জন্য খুব বেশি অর্থ আর সময়ের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল সদ্দিচ্ছা আর যুতসই প্ল্যানিংয়ের। ঢাকার আশেপাশে এমন অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে ইচ্ছে করলেই আমরা সেগুলো দেখতে পারি, সপরিবারে বা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে। সবাই ঘুরে বেড়ানোর মজাই আসলে আলাদা।

পানকৌড়ির জলকেলি, ইনসেটে গাঙচিল সাংবাদিক ফোরামের ভ্রমণসঙ্গীদের কয়েকজন

যেভাবে যাবেন স্বপ্নদ্বীপ
গুলিস্তান থেকে বিআরটিসি এসি বাসে করে বিশনন্দী ফেরিঘাট পযন্ত আসতে হবে, জনপ্রতি ভাড়া ১৬০ টাকা। ননএসি বাসে ভাড়া আরও কম। সায়েদাবাদ থেকে অভিলাস পরিবহণের বাসে করেও যেতে পারেন। ঢাকার অন্যান্য রুটেও আড়াই হাজার যাওয়ার বিভিন্ন বাস আছে। তবে এসব বাস সরাসরি বিসনন্দী ফেরিঘাটে যায় না। সেক্ষেত্রে আড়াইহাজার নেমে সিএনজি নিয়ে আসতে হবে বিসনন্দী। ফেরিঘাট থেকে নৌকা বা ট্রলারে করে আসতে পারবেন স্বপ্নদ্বীপ। ১০০০-১২০০ টাকায় রিজার্ভ নিতে পারবেন ট্রলার। স্বর্ণদ্বীপে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি মাত্র ৩০ টাকা করে।
এখানে সারাদিন প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। মেঘনা নদীতে গোসল আর মাছ ধরার মাধ্যমে পেতে পারেন নির্মল আনন্দের ছোঁয়া। এখানকার ছোট ছোট কটেজে রাতে থাকারও ব্যবস্থা আছে। চাইলে তাঁবুতে ক্যাম্প করেও রাত কাটাতে পারবেন। সেক্ষেত্রে খাবার দাবার সরবরাহ করবেন স্বপ্নদ্বীপ কর্তৃপক্ষ। তবে এসব কিছুর জন্য আপনাকে আগে থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুকিং দিতে হবে। অতিথিদের জন্য দেশি, বিদেশি সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা আছে এখানে । চাইলে এখানে সারাদিন ঘুরাঘুরি শেষে বিসনন্দী বাজারে গিয়েও লাঞ্চ বা ডিনার করে নিতে পারেন।

মাহমুদা আকতার

মাহমুদা আকতার: লেখক, অনুবাদক ও সাংবাদিক। প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/

লাইক, কমেন্টস, শেয়ার দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন