বোধিবৃক্ষ
বয়োবৃদ্ধ এক নিমগাছের কচি একটি ডালে হাত দিতেই মিজানুর রহমান শুনতে পেলেন একটা আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর-
: এই, এই করছ কী?
থমকে যান তিনি। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে দেখেন আশে-পাশে মানুষজন নেই। রাস্তার এমাথা-ওমাথা ফাঁকা। মনের ভুল ভেবে আবারও ডালটি ভাঙতে হাত বাড়ান মিজান। তখনই শুনতে পান সেই স্বর-
: আমাকে ভেঙো না, প্লিজ।
নিমগাছের ধরে রাখা ডালটি যেন কারেন্টের শক দিয়েছেÑ এমন ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে হাতটা সরিয়ে নেন তিনি। দুপা পিছিয়েও আসেন গাছের থেকে। বিস্ময়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে তার। নিমগাছটি কথা বলেছে! একদম মানুষের গলায়!!
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু অনেক আগেই প্রমাণ করেছিলেন গাছের প্রাণ আছে। গাছও তার ভালো-মন্দের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। তাই বলে কি মানুষের মতো করে কথা বলে! মিজানুর রহমান চূড়ান্ত অবিশ্বাস নিয়ে নিমগাছটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ওঠে।
গ্রামের নাম খাবাশপুর। অজপাড়াগাঁ বলতে যা বুঝানো হয়, খাবাশপুর তেমন নয়। এখানে বিদ্যুৎ আছে। বড়ো গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত পাকা সড়ক আছে। প্রায় প্রত্যেক গৃহস্থবাড়িতে টেলিভিশন আছে। মোবাইলের নেটওয়ার্কও পর্যাপ্ত। গাছপালাঘেরা প্রতিটি বাড়ি আলাদা আলাদা ছবির মতো। প্রকৃতি যেন এই গ্রামকে নিবিড়ভাবে ঘিরে রেখেছে। গতকাল রাতেই এ গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন মিজানুর রহমান। হাঁস-মুরগির কলকাকলিতে খুব সকালেই ঘুম ভেঙেছে তার। টুথব্রাশে পেস্ট লাগাতে গিয়েই তার মনে হয়েছে, গ্রামে এসে টুথপেস্টে দাঁত মাজা কেন? নিমের ডালেই বরং দাঁতের পরিচর্যা হোক। একটা জুতসই নিমগাছ খুঁজতে বেরিয়ে মিজানের চোখে পড়ে এই পুরনো গাছটি। বর্ষার শেষ- শরৎ আসি আসি করছে। নিমগাছটির শ্যামল-সবুজ পাতাগুলো সকালের পবিত্র বাতাসে মৃদুমৃদু দুলছে। মিজানের মনে হয় পাতাগুলো তাকে ডাকছে। তিনি এগিয়ে যান নিমগাছটির দিকে। গাছের নিচের দিককার কচি একটি ডালকে নিজের দাঁতের পরিচর্যায় নিযুক্ত করার বাসনায় হাত বাড়ান ভাঙতে। আর তখনই এই বিপত্তি! নিমগাছের কণ্ঠে [?] সকরুণ সুর- ‘আমাকে ভেঙো না!’
মিজানুর রহমান কিছুটা ধাতস্থ হয়ে এদিক-ওদিক দেখে নেন। গাছের সাথে কথা বলবেন, এটা তো স্বাভাবিকের লক্ষণ নয়। কেউ দেখে ফেললে পাগল ভাববে নিশ্চয়। কাছে-পিঠে কেউ নেই দেখে নিজের গলাটিকে পরিষ্কার করে নেন তিনি। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেন-
: আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন নিমগাছ?
নিজের কথা বলার ধরনে নিজেই অবাক হন মিজানুর রহমান। একজন অপরিচিত ভদ্রলোকের সাথে যেমন করে কথাবার্তা হয়, তেমন ভাবেই তিনি বলেছেন। কিন্তু এটা তো গাছ! গাছকে কি তুমি কিংবা আপনি করে বলার দরকার আছে? তুই করে বললে গাছ কি মাইন্ড করে? তবে কেন তিনি বললেন?- ভাবেন মিজান। ভাবেন গাছটি বয়স্ক। তার উপরে কথা বলে! সে বিবেচনা থেকেই হয়তো তার অবচেতন মন গাছটিকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে কথা বলেছে! মিজানের ভাবনায় ছেদ পড়ে গাছটির উত্তরে-
: হ্যাঁ, আমি তোমাকেই বলছি।
একটু দম নিয়ে নিমগাছ আবার শুরু করে-
: দেখো, আমার বয়স হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পেতে, মানুষের দেওয়া আঘাতে আঘাতে আমি জর্জরিত। আমার সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত। তরুণ বয়সেÑ যৌবনে, মুখ বুজে সেসব আঘাত সহ্য করেছি। অপেক্ষা করেছি এই ভেবে যে, একদিন মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। শুধু আমি নই, যে কোনো গাছই মানুষের কাছ থেকে সামান্য সিমপ্যাথি আশা করে। আমরা জীবনভর মানুষের কল্যাণেই জীবনপাত করি। তাই ভাবি, মানুষের সুবুদ্ধির উদয় হলে আমার মতো কোনো অশক্ত-দুর্বল-ভাষাহীন জীবনধারীকে অনাবশ্যক আঘাত করা থেকে তারা বিরত হবে। কিন্তু হায় আমার অপেক্ষা!- শেষই হয় না তা!
নিমগাছের বুকচিরে যেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে যায়। একটা অনাকাক্সিক্ষত অপরাধবোধে মিজানুর রহমানের মাথা নত হয়ে আসে।
অনেকদিনের জমানো কথা বলার লোক পেয়েছে নিমগাছটি। প্রতিদিন তো কতজনকেই সে ডেকে ডেকে কথা বলে। তার কথা তারা শোনে না। বরং একটা না একটা আঘাত দিয়ে যায়। এই প্রথম কোনো মানুষ তার কথা শুনতে পেয়েছে। তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলেছে। আজ সে তার সমস্ত কথা এই ভালো মানুষটিকে শোনাতে চায়। তাই কিছুটা সময় চুপ থেকে আবার শুরু করে-
: আমার জীবনের পুরোটাই জীবজগতের জন্য উৎসর্গ করেছি। জন্মের পর থেকেই আমার পাতা, ডাল, শিকড়, ছাল সবই মানুষের রোগ-ব্যাধি ও স্বাস্থ্যের জন্য দিয়ে চলেছি। এমন কি, আমার পাতা ছুঁয়ে যে বাতাস প্রবাহিত হয়- সেই বাতাসও মানুষের মঙ্গলের জন্য নির্ধারিত। বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে কিছুই আশা করি না। আমার সবই নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্তে দান। আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। কিন্তু দেখো, আমাকে ভালোবেসে যত্ন করার কেউ নেই! আমার দুঃখের কথা দুদ- বসে শোনারও কেউ নেই। আমি অরক্ষিত, রক্ষা করারও কেউ নেই।
মিজানের চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। বয়োবৃদ্ধ নিমগাছের বলা প্রতিটি শব্দ তার বিবেককে শূলের মতো বিদ্ধ করতে থাকে। মনে পড়ে, অনেক আগে পড়া ‘নিমগাছ’ গল্পটির কথা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক বনফুল লিখেছিলেন, একজন কবির সাথে অনেক দূরে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল নিমগাছটির। কেননা, সেই কবি তাকে ভালোবেসেছিল। তার কর্মের মর্ম বুঝে তাকে সত্যিকারে প্রশংসা করেছিল।
মিজানুর রহমান কবি নন। কবিরাজও নন। তবে এটুকু বুঝেছেন, শুধু নিমগাছ নয়, সমস্ত গাছপালা, লতা-গুল্ম মানুষের উপকারেই নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে চলেছে অনাদিকাল থেকে। বিনিময়ে অকৃতজ্ঞ মানুষ তাদের ধ্বংস করতে সব সময়ই ব্যস্ত। তারা জানতে পারছে না, প্রকৃতির গুরুত্ব। প্রকৃত সমস্যা কী। আর এভাবে অজান্তেই মানুষ ডেকে আনছে তার বিপদ।
মিজানুর রহমান নিমগাছটির গায়ে পরম মমতায় হাত রাখেন। যেন দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে দুই বন্ধুর মিলন হয়েছে, এমনভাবে বলে ওঠেন-
: আজ থেকে আপনি আমার পরম বন্ধু হলেন নিমগাছ। শুধু আপনি নন, এই জীবজগতের সমস্ত প্রকৃতি আমার বন্ধু। আমার বন্ধুদের জীবন বাঁচাতে, তাদের সুরক্ষা দিতে আমি জীবনপণ লড়াই করব। আপনি বয়োবৃদ্ধ নিমগাছ, আপনার জ্ঞান আমার এই বিরাট কাজের অনুপ্রেরণা হবে। আমাকে আশীর্বাদ করুন।
নিমগাছটি যেন মিজানুর রহমানের এই কথায় আশান্বিত হলো। সহসা তার কয়েকটি পাতা ঝরে পড়ল মিজানুর রহমানের মাথায়। তিনি অনুভব করলেন, নিমগাছটি আনন্দের সাথে তাকে আশীর্বাদ করছে। খাবাশপুরের বড়ো রাস্তার পাশে বয়োবৃদ্ধ নিমগাছটির তলায় মিজানুর রহমান জীবনের নতুন দর্শনে দীক্ষিত হলেন।
লেখক পরিচিতি: মিলন রায় একজন কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। মিলন রায় গল্প লিখছেন বেশ ছোটবেলা থেকেই। তার গল্পে সমসাময়িক সময় ও সমাজ বেশ স্পষ্ট। ইতিমধ্যে তার বেশ কিছু জীবনী ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়ার পর কলেজে শিক্ষকতা করছেন এই লেখক।
ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/