উজ্জ্বল, উচ্ছল আর প্রানবন্ত এক মেয়ে। হাত নেড়েচেড়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের ভালো থাকার কথা বলেন। ইউটিউবে তার হাজার হাজার ফ্যান ফলোয়ার। তিনি তার ফলোয়ারদেরকেও প্রতিদিন ভালো থাকার রসদ জোগান। আর সেই মেয়েটিকেই কিনা লজ্জার কারণ মনে করতো তার পরিবার। সম্প্রতি সেই মেয়েকেই নিজে হাতে খুন করলেন তার বাবা। প্রথমে শ্বাসরোধ, তারপর গুলি। নিজের বাড়িতেই মারা যান এক তরুণী ইউটিউবার। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই হইচই পড়ে গিয়েছে তার ইউটিউব ভক্তদের মধ্যে। ইউটিউবারের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়ে।
ওই ইউটিউবারের নাম টিবা আলি খান। বয়স ২২ বছর। নিজের দৈনন্দিন জীবনের নানা মুহূর্ত তিনি ইউটিউবে ভিডিয়ো পোস্ট করে জানাতেন টিবা। ইদানীং ভক্তসংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছিল তার। ইরাকের মেয়ে টিবা। রক্ষণশীল সমাজে বড় হয়েছেন। পরিবারও রক্ষণশীল। সেই পরিবার থেকে বেরিয়ে ইউটিউব সেলিব্রেটি হওয়ার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছিল তাকে। নিজের বাড়ি এমনকি নিজের দেশও ছেড়েছিলেন টিবা। থাকতেন তুরস্কে। সঙ্গে থাকতেন তার সিরীয় বংশোদ্ভূত প্রেমিকও। ইউটিউবেই নিজেদের বাগ্দানের কথা ঘোষণা করেছিলেন টিবা।
সম্প্রতিই তুরস্ক থেকে ইরাকে নিজের বাড়ি ফিরেছিলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এসেছিলেন বাবা-মায়ের কাছে। তবে টিবা বাড়িতে আসার পর থেকেই তাকে নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। অশান্তি মেটাতে পুলিশকেও আসতে হয়েছিল টিবার বাড়িতে। ইরাকের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী সাদ মানও সে কথা জানিয়েছেন। একটি বিবৃতি দিয়ে সাদ বলেছেন, ‘‘টিবা আলি এবং তার আত্মীয়দের সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ।’’ কিন্তু সেই সমাধানসূত্র যে কোনও কাজেই দেয়নি তা স্পষ্ট হয়ে যায় গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে টিবার রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হওয়ার পর। পুলিশ জানিয়েছে, গত ৩১ জানুয়ারি রাতে মেয়েকে ঘুমের মধ্যেই শ্বাসরোধ করে খুন করেন তার বাবা। তার পর গুলিও করেন।
তবে খুন করার পর তা গোপন করেননি টিবার বাবা। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি নিজেই এসে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, খুন তিনিই করেছেন। কেন খুন করেছেন, তার কারণও জানান। টিবার বাবা প্রকাশ্যেই খুনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘লজ্জা ধুয়ে ফেললাম।’
প্রেমিকের সঙ্গে টিবা
টিবার মৃত্যুর খবর পেয়ে চমকে যান দু’দিন আগে তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আসা পুলিশ কর্মকর্তারাও। ইরাকের এক সংবাদ সংস্থাকে তারা বলেন, ‘‘আমরা শুনে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। এমনটা যে হতে পারে ভাবতেই পারিনি। জানলে হয়তো অন্য পদক্ষেপ নিতাম।
এর পরেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে আগুনের গতিতে। দেশের ইউটিউব প্রভাবীর মৃত্যুর খবর এবং মৃত্যুর ধরনে চমকে যান ইরাকের মানুষ। মেয়েরা প্রতিবাদে প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নামেন। বিক্ষোভের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমেও।
২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে তুরস্কে বেড়াতে গিয়েছিলেন টিবা। শোনা যায়, তার পর আর সেখান থেকে ফিরে আসতে চাননি তিনি। তার এই সিদ্ধান্তে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিল পরিবার। কিন্তু টিবা জেদ ছাড়েননি। তার পর থেকে তুরস্কেই স্বাধীন ভাবে থাকতে শুরু করেছিলেন টিবা। তবে পরিবার কখনওই তা মেনে নেয়নি। টিবা অবশ্য সেই আপত্তিকে গুরুত্বও দেননি। টিবা ইউটিউব ভিডিয়োয় তাঁর নিত্যদিনের যাপনের যে সমস্ত ভিডিয়ো পোস্ট করতেন, তাতে রক্ষণশীলতা ছিল না একেবারেই। প্রতি মুহূর্তে নিজের দেশের রক্ষণশীল মনোভাবকে ভেঙে বেরোচ্ছিলেন টিবা। টিবার ভিডিয়োয় যেমন তাঁর খোলামেলা পোশাকের ছবি থাকত, তেমনই প্রেমিকের সঙ্গে বিভিন্ন মুহূর্তের দৃশ্যও থাকত। সেই সব মুহূর্তের বেশ কিছু তাঁদের একান্ত যাপনেরও। টিবার সঙ্গে তাঁর প্রেমিকের ওই রসায়ন পছন্দই করতেন ইউটিউবে তাঁর অনুরাগীরা। গত বেশ কয়েক মাসে টিবার অনুগামী সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছিল ইউটিউবে। টিবাও নিয়ম করে পোস্ট করতেন তাঁর ভিডিয়ো।
ইরাকের মেয়েরা এই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘‘আমাদের সমাজে মহিলারা আসলে কিছু পুরুষের অহং আর পিছিয়ে পড়া রীতির খাঁচায় বন্দি। মেয়েদের বাঁচানোর জন্য যে হেতু যথাযথ আইন এবং সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে, তাই এ ভাবেই নিজেদের বাড়িতেই অত্যাচারিত হতে হয় মেয়েদের।’’ পোস্টার হাতে এই সমস্ত পুরুষদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের দাবি তুলে ইরাকের মেয়েরা বলেছেন, যত দিন না এঁদের বিরুদ্ধ কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে, ইরাকে এ ভাবেই খুন হতে হবে মেয়েদের।
এই দাবিতে রবিবারও বাগদাদে পথে নেমেছিলেন ইরাকের মেয়েরা। বিশ্ব জুড়ে উঠেছে টিবার সুবিচারের দাবি। তবে তাঁদের সেই দাবিরও জবাব আগেই দিয়েছেন টিবার বাবা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিবার বাবা তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, তিনি পরিবারের সম্মানরক্ষায় হত্যা করেছেন মেয়েকে। ইউটিউবারকে হত্যার অপরাধে যদি বা তিনি শাস্তি পান, তবে সেই শাস্তিও কম হবে। কারণ ইরাকে সম্মানরক্ষায় কোনও অপরাধ করলে অপরাধীকে কম সাজা দেওয়া হয়। (বিদেশি পত্রিকা অবলম্বনে)
প্রতিবাদে উত্তাল গোটা ইরাক
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/