আনজু আনোয়ারা ময়না
মানসম্মত শিক্ষা সুনাগরিক গড়ে তোলার অন্যতম প্রতিজ্ঞা । যা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। প্রাথমিক শিক্ষা হলো তার সুতিকাগার। বর্তমান বাংলাদেশে সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম অংশ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষক নিয়োগ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণসহ রয়েছে নানামুখী কর্মকাণ্ড।
যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত সকল রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারিকরণ, এছাড়াও ১৫০০ নতুন বিদ্যালয় স্থাপন ও সরকারিকরণ। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া। আছে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি। স্থানীয় প্রশাসনের মনিটরিং ব্যবস্থাপনা।
একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এলাকার শিক্ষানুরাগী, হিতৈষী ব্যক্তিবর্গ। সেখানে থাকে তাদের ত্যাগ, ভালবাসা আর সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন। কিন্তু বিদ্যালয়টি সরকারি হওয়ার পরেই অদৃশ্য কারণে তারা বিদ্যালয় থেকে দূরে সরে যান। নিজেদের মালিকানাবোধ হারিয়ে ফেলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি তাদের নিয়মিত কর্তব্য পালন থেকে দূরেই থাকেন। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী সকলের সুষম সমন্বয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
গড় হিসেবে শহরকেন্দ্রিক কিছু স্কুল বাদে বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষকের পদ সংখ্যা ৫ /৬টি। সেখানে প্রতি বছর অবসরগ্রহণ, বদলিসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষকের পদ শূন্য হয়। সরকারি নিয়োগে নতুন শিক্ষক পদায়ন হয় যা শূন্য পদের তুলনায় অপ্রতুল।
এবার আসি বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বিষয়ে। এক শিফটের স্কুলগুলোতে একসাথে ৬ টি শ্রেণিতে পাঠদান চলে। দুই শিফটের স্কুলে একসাথে ৩ টি শ্রেণিতে পাঠদান চলে। এসময় দিনের শুরুতেই শিক্ষকগণ বিদ্যালয় পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে পাঠের প্রস্তুতি নেন, শ্রেণি পাঠদান পরিচালনা করেন, হোমভিজিট করেন, মোবাইল ভিজিট করেন, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করেন, মূল্যায়নসহ আরও বৈচিত্র্যময় কাজ করেন। প্রধান শিক্ষকগণ এর বাইরে প্রশাসনিক কাজ, তথ্য আাদান প্রদান, অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ, কমিটির সদস্যদের সাথে যোগাযোগসহ বহুবিধ কাজে যুক্ত থাকেন।
এখানে একটি কথা না বললেই নয় তা হলো ক্ষুদ্র পরিসরে ভাবলে দেখা যায়, কোন উপজেলায় প্রায় ৮০০/ ১০০০ জন শিক্ষকের এই পরিবারে সকলেই একই মেধা, দক্ষতা, সম্পন্ন নয়। তা হওয়াও সম্ভব নয়। তবে বড় একটা অংশ সুষম নির্দেশনা মেনে চলতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে। যারা এখনও তাদের চিন্তায়, চেতনায়, মননে মনীষায় অগ্রগামী নয় পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদেরকে নিয়ে পথ চলতে হবে এটিই হলো বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের ব্রত।
অন্যদিকে সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে অভিভাবক নিশ্চিন্তে থাকেন। প্রয়োজনে ডাকলেও সাড়া দিতে চান না। আমাদের দেশে দীর্ঘদিনের অনুশীলন এটা। এছাড়া সমাজের পিছিয়ে পরা ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ছেলেমেয়েরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। যারা স্বপ্ন দেখতে জানে না। পরিস্থিতির কারণে স্বপ্ন দেখতে পারে না। বাকিরা তাদের ছেলেমেয়েদের বেতন দিয়ে পছন্দমতো স্কুলে ভর্তি করেন। সেখানে তারা শিক্ষার্থীদের সাথে করে নিয়ে যান, বসে থাকেন, সময়ে অসময়ে টিফিন করান, সাথে থেকে পড়া মুখস্থ করান। শিক্ষকদের সাথে বহুমুখী যোগাযোগ করেন। পাশাপাশি জটলা পাকিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কুৎসা রটান।
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড১৯ এখন ইতিহাস হলেও এর ক্ষত এখনও শুকায়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যা দগদগে ঘা হয়ে আছে। কিছু বুদ্ধিজীবি মাছি তাতে পুষ্টির যোাগান দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। অজ্ঞাত কারণে কোভিডের সময়গুলোতে অন্যান্য বিদ্যালয় ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাদান, পরীক্ষা চলমান ছিল। যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরাসরি ছিল না। সে সময় শিক্ষকগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সাথে যুক্ত রেখেছেন। সরকারিভাবে সরবরাহকৃত পড়ার শিট পৌঁছে দিয়েছেন ঘরে ঘরে। সরকারি নির্দেশে রেডিও, টেলিভিশনে, ইউটিউবে, গুগলমিটে শ্রেনিপাঠদান সচল রেখেছিলেন। কিন্তু অভিভাবক তাতে তুষ্ট হলেন না। তারা তাদের সন্তানদের মাদ্রাসাসহ অন্যসব প্রতিষ্ঠানে পাঠালেন। সে সময় এলাকার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজ, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় নি। অপরদিকে প্রবল ধর্মীয় অনুভূতির কারণে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সন্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করেন তার বাবা মা, আত্মীয় পরিজন। ফলে সে পরবর্তীতে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। মাদ্রাসাগুলোও স্থানীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশেপাশেই স্থাপিত হয়। যা দেখার বলার কেউ নেই।
লোকমুখে চাউর হওয়া মুখরোচক গল্পের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী হ্রাস পাওয়া। পড়া লেখার মান কমে যাওয়া। সেই সাথে এর দায় পুরোটুকুই শিক্ষককে দিয়ে পুরো সমাজ যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। একটু গভীরে ভাবলে দেখা যায় ক্যাচমেন্ট এলাকা ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছে। মানুষ হয়ে যাচ্ছে শহরমুখী। ঘরে ঘরে সন্তান সংখ্যা একটি অথবা দুটি। তাও আবার পরকাল সুখের আশায় মাতৃগর্ভেই তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করা। অপরদিকে অপরিকল্পিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা। এছাড়াও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকা অভিন্ন না হওয়া ।
অবস্থাদৃষ্টে সত্যিই কি মনে হয় পুরো দায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের? এলাকাবাসী, স্থানীয় প্রশাসন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজের কি কোন দায় নেই? যদি শিক্ষকরা দায়ী হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে তা সংশোধনের উত্তম সহজ উপায় কোনটি? কৌশলগত কারণে স্কুলগুলোকে চিহ্নিত করে তা বন্ধ করে দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে কে বেশি ক্ষতি গ্রস্ত হবে সরকারি কর্মকর্তা / কর্মচারি না-কি স্থানীয় জনগণ? কোন স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে সেই এলাকার ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা কোথায় ভর্তি হবে? নতুন করে আরও অপরিকল্পিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে কি না? বিশ্বমানের নাগরিক গড়ে তুলতে কোন অন্তরায় সৃষ্টি হবে কি না? বিজ্ঞানমনস্কতা, সৃজনশীলতার যথাযথ বিকাশ না হলে নতুন করে লাল সালুর মজিদদের আবির্ভাব হবে না তো?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিদ্যমান সমস্যার টেকসই ও জনকল্যাণমুখী সমাধানে কাদা ছোঁড়াছুড়ির চেয়ে স্থানীয় পরিকল্পনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষা কমিটি, উপজেলা প্রশাসন, শিক্ষক প্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্মী, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বর, সুশীল সমাজ ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। বেতনভুক্ত সেবা প্রদানকারী হিসেবে শিক্ষকদেরও হতে হবে আরও বেশি জনমুখী ও দায়িত্বশীল ।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সমস্যা চিহ্নিত করে তা ধরে ধরে সমাধানের পথ তৈরিতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুর শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগ অনুভূতির বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞানমনস্কতায়, সৃজনশীলতায় ও উন্নত স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সকলকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে।
লেখক পরিচিতি: আনজু আনোয়ারা একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হলেও লেখালেখির জগতেও তার সরব পদচারণা লক্ষ্যনীয়। তিনি নিয়মিত কবিতা লেখেন । এছাড়া আর্থ সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে থাকেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমূলক সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক, জেলা শাখা টাঙ্গাইলের সভাপতি।
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/