আমাদের প্রাণের উৎসব বাংল নববর্ষ
বাংলাদেশে বাঙালি ও আদিবাসীদের প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ।এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনের সার্বজনীন উৎসবও।আমাদের আরও কয়েকটি জাতীয় উৎসবের দিন রয়েছে। সে-গুলোর কিছু ধর্মীয় উৎসব,কিছু বারো মাসে তেরো পার্বনের পিঠে পুলির দেশে ঋতু ভিক্তিক উৎসব- নবান্ন উৎসব, বসন্ত উৎসব; আবার আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত, যেমন- একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষার উৎসব, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের উৎসব। প্রাণের বিনিময়ে শহীদদের আত্মোৎসর্গে,লাখো মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষায় পাওয়া দিবসগুলো আমাদের জাতিসত্ত্বার সঙ্গে জড়িত তিনটি রাজনৈতিক উৎসবও বটে। কত শত,হাজার বছর ধরে বাংলার মাটিতে পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ পালন হচ্ছে ,তার কোনো সঠিক,ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না।
‘আমানি’ নামে একটি পারিবারিক উৎসব চালু ছিল।প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তির দিন গত রাতে বাড়ির কর্ত্রী একটি ঘটে পানি ভরে তাতে কিছু আতপ চাউল ঢেলে দিতেন এবং কচি আমপাতার ডাল ঘটে রাখতেন। পরদিন সকালে বাড়ির সকলের গায়ে সেই আমপাতা ভেজানো পানি ছিটিয়ে দেয়া হত। ভেজা আতপ চাউল সকলকে খেতে দেয়া হত।গৃহকর্তা এই চাউল খেয়ে মাঠে যেতেন কৃষিকাজে। লোকবিশ্বাস ছিল এতে সকলের মঙ্গল হবে। সবাই সুস্থ থাকবে।শরীর ঠান্ডা থাকবে,ফসল ভাল হবে।
মোগল বাদশাহগণ নববর্ষ উপলক্ষে ইরানি নববর্ষ ‘নওরোজ’ অনুকরণে দিল্লীতে উৎসব ও মীনাবাজারের আয়োজন করতেন। রাজা-বাদশাহরা এবং অভিজাত শ্রেণীর বণিক লোকজন এই উৎসবে আমন্ত্রিত হতেন। এই উৎসবের প্রভাব বাংলায় বৈশাখী মেলা আয়োজনে আয়োজকদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে।হিজরি সন অনুসারে মোগল দের রাজকার্য সম্পন্ন হত। হিজরি সন তৈরি হতো চন্দ্র বর্ষের উপর ভিত্তি করে। স¤্রাট আকবর তাঁর সময়ে হিজরি চন্দ্র বর্ষের পরিবর্তে সূর্য বর্ষের গণনা শুরু করেন কৃষকদের খাজনা প্রদানের সুবিধার্থে। কারণ চন্দ্র বর্ষের গণনায় বছর শেষ হলেও ফসল ঘরে উঠতো না। প্রতি বছরই দেরি হত। মোদ্দা কথা হল,বাংলায় সাল গণনায় জনজীবন চলতো না। যদিও সৌর পঞ্জি অনুসারে বাংলা মাস পালিত হত এবং বাংলা,আসাম,পাঞ্জাবসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ নববর্ষ পালন ও পূজা করতো। বাংলা পঞ্জিকাও ছিল। সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ক বাংলা পঞ্জিকার উদ্ভাবক। কিন্তু বঙ্গাব্দ ছিল না। খ্রীষ্টাব্দ ধরে,হিজরি সন হিসেবে প্রশাসনিক কাজকর্ম ও ব্যবসাবাণিজ্য চলত। ১৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মাচ থেকে প্রথম বাংলা সাল গণনা করা হয়। স¤্রাট আকবরের অনুরোধে তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ফসল কাঁটা ও খাজনা আদায়ের অর্থনৈতিক প্রয়োজন সুন্দর ভাবে মেটাতে ‘বঙ্গাব্দ’প্রবর্তন গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি আনে।
ইংরেজ আমলে এই রীতির পরিবর্তন হয় নাই। বৃটিশ শাসনকালীন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারী প্রথার প্রচলন করা হয়। ফলে জমিদাররা খাজনা আদায়ের জন্য তাঁদের বাড়িতে ‘পুণ্যাহ’ উৎসব করতেন। প্রজা এবং চাষিগণ নির্ধারিত খাজনা প্রদান করে মিষ্টিমুখে আপ্যায়িত হতেন। এই সময়ে বিভিন্ন রকমের ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসপত্রের দোকান গড়ে উঠে। সবসময় জিনিসপত্র নগদে বিক্রি হত না। বাকীতে বিক্রি করা জিনিস,দ্রব্যের মূল্য পরিশোধের জন্য দোকানিরা বছরের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’র আয়োজন করতেন। ক্রেতারা ধারে বা বাকীতে কেনা মূল্য পরিশোধ করে মিষ্টি খেয়ে বাড়ি ফিরতেন।এই উৎসবটিও পয়লা বৈশাখে গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে ভীষণ আনন্দ সঞ্চার করতো। এসবই ছিল পয়লা বৈশাখ পালনের অঙ্গ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ইংরেজদের নববর্ষ উদ্যাপনের আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন রীতি চালু করেছিল ১৮৯৪ সালে বেশ ঘটা করেই। এতে কলকাতার শিক্ষিত সমাজে এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য শহরে নববর্ষ পালনের রীতি চালু হয়।
বাংলাদেশ ভূখন্ডে এই আধুনিক ধারায় নববর্ষ পালন শুরু হয়েছে যুক্তফ্রন্টের আমলে ১৯৫০ দশকের প্রথম দিকে।তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ. কে.ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময় থেকেই পূর্ববাংলার বিভিন্ন শহরে বাংলা নববর্ষ উৎসব পালনের রীতি চালু হয়। তবে পশ্চিম পাকিস্থান সরকার বাঙালিদের এই জাতীয় উৎসব পালন ভাল চোখে দেখতো না।কয়েকবছরের মধ্যে তারা বাধা দিতে চেষ্টা করে। এই বাধার মুখেই বাঙালিরা বিদ্রোহ করে ওঠে। এই বাংলার বাঙালিরা তাদের শিকড় অনুসন্ধান করে নতুন ভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও সঞ্চারিত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়।এই ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ছায়ানট(১৯৬১)। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনার বটমূলে গানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ,পয়লা বৈশাখকে বরণের রীতি চালু করে। এখন এই রীতি বাংলাদেশের সর্বত্র পালিত হয় বিপুল উদ্যমে,প্রাণের উচ্ছ্বাসে। ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে পয়লা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়।অতীতে যে উৎসব ছিল একেবারেই কৃষক-কামার-কুমার-তাঁতীদের অর্থাৎ বিভিন্ন মাটি ঘেঁষা পেশাজীবীদের,তা এখন শিক্ষিত ও নিরক্ষর ,গ্রাম ও শহর, সকল স্থানের বাংলাদেশের বাঙালি ও আদিবাসীদের সর্বজনীন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।অসাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের অধিবাসীরা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণে সাধারণ মানুষের কৃত আচার-আচরণের কারণে ঘরে-বাইরে,অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবনে নানান ধরণের উৎসবমুখরতা তৈরি করেছে,করছে।দেশের আদিবাসী সমাজেও বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সুন্দর আয়োজন জনউৎসবে রূপ নেয়।অঞ্চল ও জাতিভেদে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসবের নামগুলিও ভিন্ন ভিন্ন। সমতলের কোচ ও হাজং আদিবাসীরা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসবকে ‘বিহু’বলেন।ভাওয়াল ও মধুপুরগড়ের বর্মণ ও কোচ আদিবাসীরা সন্যাসীপূজা,গাজন,চড়কপূজার মাধ্যমে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন এবং পরদিন নববর্ষ বরণ করেন পূজা-আচারের মাধ্যমে।। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ উৎসবকে বলেন ‘বিষু’।
ঋতু ভিক্তিক ফুলের সাথে এই বর্ষবরণ উৎসবের আছে অন্তর যোগ। সাঁওতালদের সাঁওতালি বর্ষ শুরু হয় ফৗগুন( ফাল্গুন) মাস থেকে। এই সময়ে গাছে গাছে সারজম,ইচৗক,মুরুপ,মহুয়া ফুল ফোটে। তারা এই সময়ে‘বাহা’ পরবে এসব ফুলের মধু পানের ও ব্যবহারের জন্য প্রকৃতির কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। ‘বাহা’ পরবের পূর্বে এসব ফুল ব্যবহার সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের এ উৎসবকে বলেন ‘বিজু’। সবচেয়ে বড় পরিসরের সামাজিক উৎসব শুরু হয় ফুল বিজু,মূল বিজু,গয্যাপয্যা এই তিন পর্বে বিভক্ত বিজু শুরু হয় বাংলা চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে। ভাতজরা ফুল বা বেইফুল ছাড়া বিজু জমে না। মারমা সম্প্রদায়ের মানুষেরা বলেন ‘সাংগ্রাই’। রাখাইনদের ভাষায় পয়লা বৈশাখের এই উৎসব ‘সাংগ্রেং’। ত্রিপুরারা বলেন ‘বৈসু’ বা বৈসুক’। ¤্রােরা এ উৎসবের নাম দিয়েছেন ‘চানক্রান’। চাক আদিবাসীরা বর্ষবরণের উৎসবকে বলেন‘সাংগ্রাইং’। তিন দিনের উৎসব। তারা এই সময়ে কাইনকো বা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহে মেতে ওঠেন। তারা এই দিনটিকে বলেন পাইংছোয়েত বা ফুল দিন। দ্বিতীয় দিন হল ‘আক্যাই’।এদিনে পাড়ার যুব সম্প্রদায় বাইক( ঢোল), লাংহোয়াক(ঝাঁঝ), ও হ্নে (বাঁশী) বাজিয়ে ক্যাং বা বৌদ্ধমন্দিরে যায় আর্শীবাদ গ্রহণের জন্য। ‘সাংগ্রাইংযের শেষ দিনকে চাক সম্প্রদায় বলেন আপ্যাইং।খিয়াং আদিবাসীদের অনেকেই এই উৎসবকে বলেন ‘সাংলান’।
বাংলাদেশে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষেরা,ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষেরা শীত ঋতু শেষে বসন্ত এলেই,বিশেষ করে বাংলা বছরের শেষ চৈত্র মাসেই পুরাতন হাড়ি-কুড়ি ফেলে,ঘর-দোর,উঠোন লেপামোছা করে; খৈ-মুড়ি ভেজে,চিড়া কোটে,মুড়কি মোয়া তৈরি করে; কুমার মাটির হাড়ি,থালা-বাটি-মালসা-কড়াই;কামার দা-বটি-খন্তা-কুড়াল-হাতুড়ি-কোদাল-শাবল-কাঁচি,ছুরি তৈরিতে নিমগ্ন ;তাঁত শিল্পীরা তাঁতে লুঙ্গি-গামছা-শাড়ি বুনতে মশগুল হয়ে পড়েন বর্ষশেষে চৈত্রসংক্রান্তি,গাজন ও চড়ক ও বর্ষশুরুর বৈশাখী আয়োজনে,বাংলা নববর্ষ আহ্বানে বৈশাখী মেলার আনন্দে। প্রাচীনকাল হতে এই সকল দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে উল্লেখিত দুটি দিন সামনে রেখে জনজীবনে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হত। নববর্ষের প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ হিসেবে মেলা হতো, মেলা। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা,পয়লা বৈশাখের মেলা। কারণ কৃষিভিক্তিক সমাজে মানুষের হাতে নগদ টাকা পয়সা ছিল না। দূর অতীতে তাদের বেচাকেনা হত প্রয়োজন নিরিখে উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে। পরবর্তী সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময়ে। গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে স্থানীয় বৈশাখী মেলার অবদান ছিল অপরিসীম। কারণ তখন উৎপাদিত পণ্য দূরে নিয়ে বিক্রি করার মতো যানবাহন বা রাস্তাঘাট ছিল না। দোকানপাটও কম ছিল। যখন তখন চাইলেই একটা কিছু কেনা যেতো না। তাই গ্রামের মেলা থেকেই তারা সারাবছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, তৈজসপত্র কিনে রাখতো।
চৈত্রসংক্রান্তির আচার-আচরণ,পুজো, গান-বাজনা, মেলা নববর্ষের উৎসব ডেকে আনতো। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামের হাটখোলায় বা বড় বড় খোলা মাঠে নিত্য প্রয়োজনীয় ও সৌখিন দ্রব্যাদির,বিভিন্ন ধরণের খাবারের মেলা বসতো। কারুকাজ করা কাঠের পালঙ্ক,চিনির তৈরি হাতি- ঘোড়া-বাঘ-ভালুক,গুড়ের বাতাসা,চিনির বাতাসা,বাঁশ ও বেতের জিনিষ-পত্র সবই মিলতো সেই বৈশাখী মেলায়। এক সপ্তাহ বা বেশি সময়ের জন্য মেলা বসলে সন্ধ্যায় গান-বাজনা হত।
ফুল, ফল ,নিয়মনীতি বাঙালি ও আদিবাসী জীবনকে ভরে রেখেছে নানা বিভঙ্গে। তিতাশাক ব্যতিত কি বাঙালি , কি আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় কৃত্য হয় না। এ দিনে গিমা তিতা,নিম,নিশিন্দা,নাইল্যা, তেলকুচা, থানকুনি,আমরুল,দন্ডকলস,মালঞ্চ এমন ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা অঞ্চলে, গ্রামে এবং শহরে। লোকবিশ্বাস এসব খাদ্য বসন্ত এবং অন্যান্য রোগ থেকে পরিবারের সকলকে ভালো রাখে,ভালো রাখবে।
বাংলা বছরের বর্ষশেষের দিনটি যেন ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো ’বলে নতুন বছরকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে নানা বৈচিত্র্যেময় কর্মে মুখর হয়ে থাকে। আমরাও আহ্বান জানাই আগত নতুন বছরকে, বলি- এসো হে বৈশাখ,এসো মোদের ঘরে; শুভ নববর্ষ-১৪৩০ ।
কবি পরিচিতি: কাজী সুফিয়া আখ্তার: কবি, লেখক ও মানবাধিকার নেত্রী। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি।
ওমেন্স নিউজ/