দিলারা মেসবাহর গল্প ‘ফৈজাবাদির সাথে জোছনা রাত’

দিলারা মেসবাহ

ফৈজাবাদির সাথে জোছনা রাত

নাবিলা খোলস বদলেছে। সাপ যেমনটি করে! ছকে বাঁধা শহর ঢাকায় ফেলে এসেছে জীর্ণ খোলস। এখানে রাত পোহালেই অঢেল পাখ পাখালি। পা বাড়ালেই তুলসিমালা ধানের শীষ। আহা বাতাসের আলতো স্পর্শে নেচে ওঠে মণিপুরী নৃত্যের স্বভাব। আর ওই অফুরন্ত আকাশ? এই হাটিকুমরুলে উপুড় হয়ে ঢলে পড়েছে। মগ্ন মৃত্তিকার সোঁদা গন্ধ ভালোবেসে। রাতের আকাশ বুটিতোলা বেনারসি।

নাবিলা অবচেতন মনের কোঠাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে এক অনিঃশেষ প্রেমময় নাবিলা। দোল পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছে উঠোন,পুকুরের ঘাটলা। আজ দুইদিন দাদাবাড়ির দিনরাতের উদযাপনে কন্যা রসের পানতোয়া। ল্যাপটপ ছুঁতে হয় না। অনলাইনে মগজ মনোযোগ বন্ধক রাখার বালাই নেই। আছে কেবল বেগম আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি। দাদীমা এখনো হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানিতে পারঙ্গম। বাদামি ত্বকের জেল্লার ঘাটতি হয়েছে বটে। তবু মানুষটার ইষৎ আলুলায়িত ব্যক্তিত্ব অস্তমান সৌন্দর্য নাবিলাকে বিস্মিত করে। মেজাজ খানিক খাপ্পা হয়েছে। কিন্তু মেজাজের উষ্ণ প্রতাপের নিচে ঠাণ্ডা স্নেহের ফল্গুধারার খবর নাবিলা ভালো করেই জানে। আজ টেবিলে জ্বলজ্বল করছে চিতলের পেটি ভুনা। মজেছে রসেবশে পেঁয়াজা মশল্লায়। হাসেন যখন, ঝরে পড়ে আদরের এক দুর্লভ স্থাপত্যকলা। এখনো গজদন্ত বাহার। বেজে চলেছে অক্লান্ত,

' জোছনা করেছে আড়ি, আসে না আমার বাড়ি।

গলি দিয়ে চলে যায় — লুটিয়ে রূপোলি শাড়ি।'

নাবিলা আকণ্ঠ বেগম আখতারি সুরা পান করে মত্ত।

' ওই জোছনাবিবি খাইতে আয়। তোরে খিলাইয়া শুইতে যাবো। কী নাকি গানের গলা! খরখরা,না মধু না মিছরি!' বেগম মেহেরজানের আদুরে ডাক। নাবিলা ধ্যানমগ্নতা থেকে জেগে ওঠে! ' তুমি বুঝবে না পিয়ারি। আমার ফেভারিট।' ঠুমরি,গজল আখতারি বাঈ। তাঁর শতেক অশ্রুজল, ফানা ফানা জীবন — খ্যাতির বৈভব! নাবিলার মুখস্ত এক অমল পুঁথির পাতা। কাটারি ভোগ চালের চিকন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ। গাওয়া ঘিয়েভাজা সুজির মোহনভোগ। এতো মায়া। দাদাজানের প্রত্ন সিরামিকের বাসন বের করেছেন মেহেরজান। আঙুরলতা খোদাই করা আলমারি থেকে।  আলতা ঠায় দাঁড়িয়ে। দাদীজানের সাথে আহার পর্ব সগৌরবে শেষ। পানের নকশি বাটায় মন দিলেন দাদী। তারপর মেহগনি পালঙ্ক জুড়ে শায়িতা প্রাচীনা।…

বেজে ওঠে আখতারি বাঈ, গজলের গহন,

'মোর টুট গেয়ি আব আছ-

মোর বালমোয়া নেহি আয়ে

জপতে জপতে প্রীতম প্রীতম

গীত গায়ে কিতনি মওছুম।'..

নাবিলার যুবতী মনের উজানে জোয়ার। ফুলে ফুলে দুলে দুলে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে ওকে। আলতার নামমাত্র স্বামীধন মজে আছে এক নস্ট মেয়েলোকের ঘোরে। ও খান বাড়ির 'মেহের মহলে' গৃহকর্মী। পেটা স্বাস্থ্যের শ্যামলা মেয়েটি নাবিলার মেদুর মধুর অবকাশ যাপনে বাড়তি একমুঠো আনন্দ যোগ করেছে। জোছনায় তলিয়ে গেছে ঝোপলো কামিনী। দেবদারু গন্ধভাদালের পাতা হলদি মেখেছে। কী মাতামাতির হাটিকুমরুলের রাত! ফিসফিস করে নাবিলা, বেগম আখতারি বাঈ জোছনার টেরাকোটা চারু রাতের সাথে, আজ আমার আশনাই। আড়ি না ভাব।

আলতা এক পাঁজা চিনামাটির বাসন কোসন ধুতে বসেছে কলের পাশে। টিকির  উপর পোক্ত করে বেঁধে নিয়েছে মস্ত খোঁপা। আলতো আহ্লাদে নাবিলা বলে, 'এই আলতা উঠে আয় জলদি। আমরা ঘাটপাড়ে যাবো না! দুধে আলতা জোছনায় দীঘিতে দেখবি কেমন দুধসর। উঠে আয়। দাদীমার নাক ডাকা শুরু হয়েছে।' আলতা শহুরে আপার আদিখ্যেতা দেখে বাঁচে না। চেয়ে থাকে একদণ্ড। ওর চোখে নাচে কৌতুক। উঠতেই হয়। দাদীর বিদ্বান নাতনি। খানিক আলাভোলা। আপারে কী যে ভালো লাগে পোড়াকপালি আলতার।

ওরা হাঁটতে থাকে। ভাঁটফুলের ঝোপ, ঢেঁকি শাকের হাতিশুঁড়, ঘাট কচু পাতায় পাতায় আত্বীয়। আলতার হাতে টর্চ।সাপ খোপ থাকে।কামিনীর সুগন্ধে মাতোয়ারা বাতাস। ঝিঁঝি পোকারা গলা খুলে রাতের নিঝুম সাজ এলোমেলো করে দিচ্ছে। লুনাটিক নাবিলা।চাঁদে পাওয়া উদভ্রান্ত কেউ। ঘাটলার শেষ ধাপে বসে আছে। কন্যারাশির জাতিকা। গ্রহ নক্ষত্রের আজব ফেরে কেঁপে কেঁপে ওঠে অন্তরাত্মা। ফিরে ফিরে কে বলছে ,আপনাকে এই চেনা তোমার ফুরাবে না। নাইবা ফুরালো। এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় জানা?… জোব্বা দুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কবি,অকস্মাৎ।

শাপলা ফুটে আছে, কয়েক গুচ্ছ নক্ষত্র। কচুরিপানার বেগুনি ফুল মাথা উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে, আমরাও আছি গো।আমাদেরও যৌবন থৈথৈ। রাত চরা কী পাখি ডেকে যায়, আনমনা। নাবিলা উচ্ছন্নে গেছে?

ওকে গিলে খায় যাবতীয় জোছনার নামতা। এসব কী তার সাহিত্যের পাঠ। ছিলো কিনা মগজের অতলে। চোখে ধাঁধা লাগে। পাড় ধরে হেঁটে যায় কে? ওকি মোহসিনা। ছোট বেলার এক্কাদোক্কার  সাথী। ক্রন্দসী বেহুলা। জনম দুখী।' মোহসিনা এই যে আমি আয় সই।' ঘোর লাগে– লাগে ঘোর। আলতা বিড়বিড় করে,'আফা হেয় তো কোন জন্মে মইরা ভূত। গলায় ফাঁস নিছিলো।'

নাবিলা শূন্যে কি খোঁজে, শৈশব! মোহসিনার দুস্টুমিভরা চোখের তারা। নাবিলা বোকা বোবা হয়ে বসে থাকে। নিকারি পাড়ার মেয়ে মোহসিনার ডুরে শাড়ির আঁচলের আঁশটে গন্ধ। নাবিলা তবু জোছনা মাখে সর্বশরীরে। মগজের ভেতর জেগে ওঠে রাধা। কালা কেষ্টর মোহন বাঁশি। মোহসিনা ডুবে গেল দীঘির অতলে। তুলোর পুতুল। আঁচলে আঁশটে গন্ধের আতর। নাসারন্ধ্রে গোত্তা খায়।

আলতা ধৈর্যের সুতো ছিঁড়ে গেছে, 'আফা বাড়িত চলেন। চলেন যাইগা। মনে লয় জিন পরীর আছর নামছে। দেহেন আমার আত পাও সমানে কাঁপতাছে'!..

নাবিলা আনমনে বাটন টেপে মোবাইলে। বেজে ওঠে প্রিয় স্বর তার, 'কোয়েলিয়া গান থামা এবার/ আমার বাগানে আজ নাই কোন ফুল/ ফিরে যা ফিরে যা বনে/ কালো বুলবুল।'..

পুরনো কড়ই গাছটির ওপারে চৌধুরীদের 'চিত্রা ভিলা'। ও বাড়ির ছোট ছেলেটি কবি। সে স্থাপত্য বিদ্যায় উচ্চশিক্ষার নিয়তে প্যারিসে বাস করছে। এবার দেশে এসে কোভিডের ফেরে ফেরত যেতে পারছে না। রাজপুত্রের নাম আকাশ। মাথা ভরা কালো চুলের ঢেউ। উজ্জ্বল চোখদুটো বিশদ ঘোরে প্রায় মুদ্রিত। ঘাটলা থেকে দেখা যায় দোতলার দক্ষিণ দিকের ঘরে আলো জ্বলছে। জেগে আছে সেও কি? অকারণে নাবিলার চোখে স্বপ্নমায়া। বেজে চলেছে ফৈজাবাদি,
'মোর বালমোয়া নেহি আয়া/ মোর
বালমোয়া নেহি আয়া-/ জপতে জপতে প্রীতম প্রীতম / গীত গায়ে কিত্ নি মওসুম।'..

গ্রীক দেবতা এ্যাপোলো শান বাঁধানো ঘাটলায়! আকাশ কখন পাশে এসে বসেছে। কী মেদুর মৃদু গন্ধ! তীব্র অহংকার তার জোছনায় ধুয়ে গেছে। এক থরথর প্রেমিক পুরুষ। বাতাসের ঝিমুনি এখন ঘুচে গেছে। তিরতির করে বইছে। নাবিলার পৃথিবী আনন্দময়।

'একা এখানে! চমৎকার জোছনা ধোয়া চারপাশ। কতোদিন পর তোমাদের দীঘির ঘাটে এলাম! বেগম আখতার শুনছো? আমারও ফেভারিট।' বেজে ওঠে ঝমঝম সগৌরবে, ' মোর বালমোয়া নাহি আয়ে… মোর টুট গায়ি আব আছ।' আকাশ গাঢ় কণ্ঠে বলে, ' মল্লিকা– ই– গজল, এই মধুকণ্ঠীর লড়াকু জীবন আমাকে বিস্মিত করে। কী সমাজ সংসার। ছোট্ট বোনটিকে মেরে ফেলেছে পিতৃবংশের শত্রুরা। খাবারে বিষ মিশিয়ে। মা আখতারি বাঈকে বাঘিনীর মতো আগলে রেখেছিলেন! সে কী আজকের কাহিনি! ১৯১৪ সালের কথা। ব্যারিস্টার স্বামী পাঁচ বছর গানের বুলবুলির কণ্ঠ রোধ করে  রেখেছিলেন। গাইতে দেন নি। সুরের রানি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একসময় ফিরে এলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। আমিও ওঁর গজলের ভক্ত। তোমার সাথে এখানে আমার মিল।' কখন জানি নাবিলার পাঁচ আঙুলে জড়িয়ে গেছে রাজপুত্রের উষ্ণ আঙুলের আগুন। ওরা এই দুধে আলতা রাতে ডুবে যাবে!..

আচমকা একটা রাতচরা পাখি যেন কলহাস্যে উড়ে যায়।নাবিলা চমকে ওঠে।একটি রঙিন আংরাখা খসে পরে ওর চোখ থেকে সহসা।  ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকে, 'আলতা আলো কই তুই?' আলতা কখন সটকে পড়েছে।

রাজপুত্র! এতো সুন্দর মুহুর্তের মেদুর মধুর বেদনা। নাবিলা ডান হাত মেলে ধরে। এখনো লালিমা আর সুগন্ধ লেগে আছে! আকাশের শার্টের মৃদু ঘামের গন্ধ,কস্তুরি সুবাস!.. 

দুই ধারি তরোবারি ঝলকে ওঠে, চৌধুরী আর খানেরা বংশ পরম্পরায় শত্রু! সাপে নেউলে।

লেখক পরিচিতি: দিলারা মেসবাহ দেশের স্বনামধন্য কবি ও কথাসাহিত্যিক। সাহিত্যের নানা শাখায় তার সাবলীল পদচারণা পাঠকদের মুগ্ধ করছে কয়েক দশক ধরে। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ৪০য়ের বেশি বই। নিভৃতচারী এই লেখক কমর মুশতারী স্মৃতিপদক ও তাইবুন নাহার স্বর্ণপদকসহ পেয়েছেন ১৫টি সাহিত্য পদক সম্মাননা। ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য বিষয়ক সংগঠন লেখিকা সংঘের সভাপতি ও সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে।

ওমেন্স নিউজ/