নূর আপাকে যেমন দেখেছি

শামসুয জাহান নূর

মাহমুদা আকতার

১৯৯৯ সালের শেষ দিক। সবে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার নারী পাতায় জয়েন করেছি। তখন ওই পত্রিকায় নারী পাতা বের হতো চার পাতা, প্রথম দুই পাতা  রঙিন, বাকি দুটো সাদাকালো। তো প্রচুর লেখা প্রয়োজন। এত লেখক আর লেখা কোথায় পাই? তখন একজন বললেন শামসুয জাহান নূর আপার কথা। বললেন- তার সঙ্গে দেখা করো, তিনি অনেক নারী লেখকদের সন্ধান দিতে পারবেন। তিনি তখন সমবায় অধিদপ্তরে বড় পদে চাকরি করেন, থাকেন পুরান ঢাকায়। তো একদিন টেলিফোন করলাম। উনি বললেন-আস একদিন। তো একদিন সকালের দিকে আমার সোয়ামি শওকতকে নিয়ে হাজির হলাম তার ডেরায়। আমি তো ভেবেছিলাম-এত বড় পদে চাকরি করেন কত জানি হাইফাই তার জীবনযাত্রা। কিন্তু গিয়ে দেখি অতি সাধারণ তার জীবনযাপন। একটা পুরনো বাড়িতে থাকেন যেখানে একটা কাঠের সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়। তবে ওপরটা বেশ খোলামেলা। তার শোবার ঘরের সাথেই বিশাল ছাদ।

তিনি এমনভাবে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন-যেন কত দিনের চিন পরিচয় আমাদের। তার আন্তরিকতায় কাছের মানুষ হয়ে গেলাম নিমেষেই। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ, দুনিয়ার নানা প্রকার মানুষের সঙ্গে তার উঠা বসা। তো তিনি তার গল্পের ঝুড়ি উপুর করে দিলেন। আমরাও শুনতে লাগলাম। কথা বলতে বলতে কখন যে দুপুর হয়ে গেছে কারো খেয়াল নাই। তিনি তো আমাদের না খেয়ে কিছুতেই আসতে দিবেন না। তো আপার সঙ্গে তার বিছানাতে বসেই খেলাম আমরা তিনজনে। খাওয়ার পর দই খেতে হবে-এটা তার নিয়ম। কিন্তু বাসায় তো নেই। তাতে কি! ছেলেকে পাঠালেন হোটেল থেকে দই আনতে। আমাদের কোনও ওজর আপত্তিতে কান দিলেন না।

এই জীবনে কত জায়গায় কত অনুষ্ঠানে ভোজ খেয়েছি, নিমন্ত্রণও তো কম খাইনি। জীবনে ছোট বড় কবি-সাহিত্যিক বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত মানুষদের বাসাতে তো কম যাইনি, সাক্ষাৎকার বা লেখা নেয়ার জন্য। কিন্তু শামসুয জামান নূর আপা যে আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে আর শওকতকে খাইয়েছেন, আমাদের প্রতি যতটা মায়া দেখিয়েছেন- তেমনটা আর কোথাও পাইনি। উনি চাইলে তো আমাদের বাইরের ঘর থেকে কথা বলেই বিদায় দিতে পারতেন। কিন্তু এই মহিয়সী নারী সেটা করেননি। বরং তিনি আমাদের নিজের বেডরুমে যত্ন করে নিয়ে বসিয়েছেন, মন খুলে গল্প করেছেন। এখনও আমি সেই দিনটির কথা ভুলতে পারিনা, স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে।

নূর আপা কেবল বড় চাকুরি করতেন আর লেখালেখি করতেন, তাই নয়, নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য বিষয়ক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নারীদের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। এর বাইরে নানা বিচার সালিশেও যেতেন। গল্পচ্ছলে আমাদের কাছে তেমনই একটা ঘটনা খুলে বলেছিলেন সেদিন। তার পরিচিতি একজন নারী স্বামীর সঙ্গে রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেছেন। নূর আপা তাকে আনতে গেছেন-তিনি আসবেন না। তখন তিনি মেয়েটিকে বললেন- তুমি বাড়ি ছেড়েছে ক্যান, ওই বাড়ি কি তোমার স্বামীর একার, সেটা তো তোমারও বাড়ি। তারপর মেয়েটিকে তার বাড়িতে দিয়ে আসেন। আসার সময় তাকে বলেন- রাগ করো, ঝগড়া করো-কখনও বাড়ি ছেড়ে যাবা না। কারণ এই সংসারটা তোমার স্বামীর একার না, তুমিও অনেক পরিশ্রম করে সাজিয়েছ। তাহলে এত সহজে সংসার ছেড়ে যাবে ক্যান?
এরপর তিনি আমাকে বলেন, মাহমুদা নারীদের সমস্যা কি জান, তারা এখনও নিজেদের অধিকার কি সেটাই বুঝে না। কিছু থেকে কিছু না হলে তারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তুমি কিন্তু কখনও এমন করবা না। আমি তখন দুষ্টমি করে বললাম-
-আমার যদি অনেক রাগ হয়, যদি ওর থাকতে ইচ্ছা না হয়, তাহলে?
-তাহলে তুমি শওকতকে চলে যেতে বলবা, তুমি ঘর ছাড়বা না। এই ঘর এই সংসার তোমার। পুরুষরা তো কেবল টাকা এনে দিয়ে খালাস। আর মেয়েরা কত যত্ন করে এই সংসার সাজায়, তারা যে কত কষ্ট হলে সংসার ছাড়ে সেটা তো বুঝি। এরপর তিনি শওকতকে বলেন
-তুমি কিন্তু কখনও মাহমুদাকে কষ্ট দিবা না। এমন কথা বলবা না যাতে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ও খুব লক্ষ্মী  মেয়ে।
শামসুয জাহান নূর আপার এই কথাটা আমার সবসময় মনে হতো। হয়তোবা এ কারণেই আমি কখনও নিজের ঘর ছেড়ে কোথায় যাইনি, তা যত কষ্ট লাগুক না কেন। এমন পরিস্থিতিতে কেবল নূর আপার কথা মনে হতো- এটা তো আমার সংসার, আমি ক্যান যাব?

শামসুয জাহান নূর আপা নানা সামাজিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার পরও নিজের কোয়ালিটি টাইমটা সংসারে দিয়েছেন। ছেলেদের পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছেন. মানুষ করেছেন। তার তিন সন্তানের সবাই এখন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

এরপর বিভিন্ন সময়ে আপার সঙ্গে নানা স্থানে দেখা হয়েছে। আগেই বলেছি আপা নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি ইউএনবিতে কাজ করার সময় ঢাকা বিজনেস এন্ড প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব নামক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। নূর আপাও এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেক দিন ধরেই। তিনি বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশন উইমেন্স ক্লাব ঢাকা নর্থ ওয়েস্টের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রতি মাসে নিয়মিত মিটিং হতো বেইলি রোডের মহিলা হোস্টেলের অডিটরিয়ামে। মিটিংয়ে গেলে আপার সঙ্গে দেখা হতো। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরতেন সস্নেহে। দেখা হতো বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায়, এক টেবিলে বসে খেয়েছি কত বার। আপার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় টিএসসিতে, রোকেয়া হল অ্যালামনাইয়ের প্রোগামে, সম্ভবত ২০১৮ সালের নভেম্বরে। সেইদিন ছবিও তুলেছিলাম আপার সঙ্গে। কিন্তু মোবাইলের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে ছবিগুলোও। একই সঙ্গে সেল নাম্বারও । ফলে আপার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর আপা একটা প্রকাশনা সংস্থা খুলেছিলেন। সেটা দেখতে যাওয়ার কথা ছিলো আমার। কিন্তু নানা কারণে আর যাওয়া হয়নি। চাইলেও আর তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। কেননা সোমবার (২৮ আগস্ট) ভোর ৫টায় তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

আপা চলে গেছেন কিন্তু আপার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি রয়ে যাবে মনের কুঠরিতে। রয়ে যাবে আপার যত সৃষ্টি। আপার মতো এত সজ্জন আর আন্তরিক মানুষ আজকাল দুর্লভ। দোয়া করি- আমাদের প্রিয় শামসুয জাহান নূর আপা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আল্লাহ তাকে বেহশত দান করুন।

মাহমুদা আকতার

মাহমুদা আকতার: সাংবাদিক, লেখক ও অনুবাদক। প্রকাশিত গ্রন্থ ৬টি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/