আলেখ্য
‘আপা, আপনার শাড়িটা তো ভারি সুন্দর! বেশ মানিয়েছে আপনাকে। দুলাভাই কিনে দিয়েছেন বুঝি?’
দুঃসহ রাগে লাল হয়ে ওঠে নাসিমা। রোষকষায়িত নেত্রে তাকায় প্রশ্নকারী রকিবের দিকে। তার লোভাতুর চাহনির সাথে দৃষ্টি মিলতেই চোখ নামিয়ে ফেলে। তীক্ষ্ন যন্ত্রণায় সমস্ত অন্তর ছেয়ে যায়। হাজিরা খাতায় সই করে লাইব্রেরি কক্ষের দিকে পা বাড়ায় সে।
‘হুঁ! দেমাক কত! গরবে পা মাটিতে পড়ে না।’ অস্ফুট কণ্ঠধ্বনি ভেসে আসে দূর থেকে। আহত সাপের ত্রুদ্ধ গর্জন! কানে গরম সিসা ঢেলে দেয় নাসিমার। পাখাটা খুলে দিয়ে সিটে এসে বসে। কপালে দু’ ফোঁটা ঘাম জমে ওঠে এই শীতেও।
সমস্ত আত্মীয়স্বজনের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে নাসিমা অফিসে চাকরি নিয়েছে। প্রথম যখন সে চাকরির নিয়োগপত্র পায় তখন সবাই মুখর হয়ে উঠেছিলো নাসিমার সিদ্ধান্তে।
ছি-ছি! শেষ পর্যন্ত অফিসের চাকরি! নিদেনপক্ষে একটা মাস্টারিও কী জুটল না? শখের চাকরি। তাহলে অফিসে চাকরি করবার কী দরকার ছিল?
অফিসে ভালো পুরিবেশ নেই। তুমি সেখানে খাপ খাওয়াতে পারবে না। তাছাড়া ফ্যামিলি প্রেসটিজ বলেও তো একটা কথা আছে।
নাসিমা কর্ণপাত করেনি কারো কথায়। বরং স্বামী হাসানের কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছিলো।
‘তুমি অফিসে যাবে, অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞ হবে, বৃহৎ একটা অজানা জগতের সঙ্গে পরিচিতি হবে, সেটাই আমাদের লাভ। তোমাকে আমি শুধু অর্থ উপার্জন করতে দিতে চাইনে। আমাদের দেশের মেয়েরা বাইরের জগৎ সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ। তোমাকে সেই অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করতে চাই।’
স্বামীর উৎসাহে প্রেরণা পেয়েছিল নাসিমা। তবে অফিসে যেদিন প্রথম এসেছিল, চারশো জোড়া অনুসন্ধিৎসু চোখের সামনে অস্বস্থি বোধ করেছিল সত্যিই। পরে অবশ্য আস্তে আস্তে সয়ে গেছে সব।
‘আপা, এই বইটা কী আছে? এস্টাবলিশমেন্ট সেকশনের রহমতুল্লাহ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।
‘এই নিন চাবি, একটু খুঁজে আনুন। আমি ইস্যু করে দিচ্ছি।’
রহমতুল্লাহকে বই ইস্যু করে দিয়ে নিজেও একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে। না, আজ আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। রকিবের মন্তব্য যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ ওর নামটা কানে আসতেই সচেতন হয় নাসিমা। ‘আরে এ-সমস্ত মেয়ে কী ভালো? শুধু স্বামীর সাহচর্যে কী এদের মন ওঠে?’
‘যা, কী যে বলিস, কত বড় ঘরের মেয়ে। জানিস ওর স্বামী একজন অধ্যাপক!’
‘রাখ, রাখ ভাতে মরা অধ্যাপক, তা না হলে বউকে অফিসে চাকরি করতে পাঠায়!’
‘ধ্যাৎ, ওর পোশাক-পরিচ্ছদ লক্ষ করিসনি! গরিব হলে কী এভাবে চলাফেরা করতে পারত?’
যা, যা, বাজে বকিস না। ভালো মেয়ে হলে কী শাড়ির এমন বাহার হয়?’
‘কেন শাড়িটা তো বেশি দামি মনে হয় না। গুছিয়ে পরেছে, এই যা।’
‘তুই যা বুঝিস না তা নিয়ে বেশি বকবক করিস না তো!’
পাশের টেবিলে দুই বন্ধুর সরস আলোচনা থেমে যায় সম্পাদক সাহেবের উপস্থিতিতে।
‘বিমর্ষ হয়ে এত কী ভাবছেন?’ প্রশ্নটা নাসিমার প্রতি।
‘তো ভারি বেরসিক! এমন সরস আর মুখরোচক আলোচনাকে আপনি বিঘ্নিত করলেন।’
‘কেন, কী ব্যাপার?’
‘ব্যাপার আর কী? আপনাদের নিত্যকার ঘটনা। আপনি তো সবই জানেন।’
‘ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।’
‘মাথা ঘামাতে কী চাই! শুনতে না চাইলে কী হবে! শুনিয়ে ছাড়বে। আসলে চাকরি করতে এসে মহা অপরাধ করে ফেলেছি।
‘বলতে দিন, বলে বলে মুখ আপনিই ব্যথা হয়ে যাবে। তা পড়াশোনা কতদূর হলো, রবীন্দ্র রচনাবলী কী শেষ হয়ে গেছে? আমারও এক খণ্ড নিতে হবে।’
‘হ্যা, রবীন্দ্র রচনাবলী শেষ হয়েছে। এখন গিরিশ ঘোষের নাটকগুলো পড়ছি।’
এজন্যই, বিশেষ করে এই কারণেই নাসিমা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলো। এখানে ওর সঙ্গীর দরকার নেই। দরকার নেই কারো সঙ্গে আলাপ করবার। লাইব্রেরিতে যারা বই পড়তে ইচ্ছুক, তাদেরকে বই ইস্যু করে দেবে আর পড়বে। পড়বে ওর যা খুশি।
লাইব্রেরি ছোট। কিন্তু মূল্যবান বই কম নয়। বইয়ের জগৎ ওকে আকর্ষণ করছে চুম্বকের মতো। রবীন্দ্র রচনাবলী দেখে উল্লসিত হয়েছিল নাসিমা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে সে কত চেষ্টা করেছে সেসব পড়ে ফেলতে কিন্তু পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে পড়তে পারেনি আরও বহু মূল্যবান বই। একান্ত নিজস্ব করেও গড়ে তুলতে পারেনি বএয়র ভাণ্ডার।
মধ্যবিত্ত ঘরের বধূ। সংসারের দাবি মিটিয়ে পড়াশোনা করা সে তো আকাশকুসুম কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ পাওয়াটাই তো অনেক সৌভাগ্য। হ্যা, সেই অতুলনীয় সৌভাগ্যের অধিকারিণী হয়েছিল সে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নামের সাথে অলঙ্কার বিশেষ। এর বেশি কিছু তো নয়।
পড়াশোনার জগৎ যে আপন হাতে গড়া নিজস্ব জগৎ। সেই রতনেরই পিয়াসী নাসিমা। সেই জ্ঞান অতলের তলে তলিয়ে যাওয়ার সাধনাই তো তার সারা জীবনের স্বপ্ন।
নাসিমার গাম্ভীয, পড়ার আগ্রহ, একাগ্রতা আহত করেছে সহকর্মীদের। ওর মিতবাক্য, সংযত আচার-আচরণ অহরহ সহকর্মীদের ঈর্ষার ইন্ধন জুগিয়েছে। ভেবেছে এটা ওর অহঙ্কার, এটা ওর দেমাগ। নাসিমা পুরুষদের মনস্তত্ত্ব জানে। জানে ওদের দুর্বলতা কোথায়। তারপরও মাঝে মাঝে ওর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ভাবে, কী দরকার সহকর্মীদের উত্যক্ত করা? দরকার কী এমন সমালোচনার পাত্রী হওয়ার? তার চেয়ে চাকরিটা ছেড়েই দেবে সে। কিন্তু হাসান! একটি বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, একটি দুর্দম পৌরুষ ওকে সাহস জোগায়।
‘কেন তুমি ওদের কথায় চাকরি ছেড়ে দেবে? এই জন্য বুঝি তোমাকে আমি লেখাপড়া শিখিয়েছি? না, তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। ওরা তো ওরকম করবেই। ওদের এতদিনের অভ্যাসকে দু’ একদিনেই কী বদলে দেওয়া সম্ভব? খালি গলাবাজি করে নিজেদের অধিকার আদায় করা যায় না। অধিকার আদায় করবার জন্য নিজেদেরও তৈরি হতে হয়। গঠন করতে হয় নিজেদেরকে।’
‘তাহলে তুমিও তো পুরুষ? তবে কি তুমি আমাকে করুণা করছ?’ ক্ষেভে গলা ভারী হয়ে আসে নাসিমার।
পরম আবেগে ওর মুখ তুলে দরে হাসান। ‘চেয়ে দেখ তো আমার দিকে। বলো, এখনও কি মনে হয় আমি তোমাকে করুণা করছি।’
তাকাতে পারে না নাসিমা হাসানের দিকে। গর্ব মিশ্রিত আনন্দে বুকটা ওর দুরু দুরু করে কাঁপে।
‘তুমি যে আমার সৃষ্টি। তুমি আমার সাধনা। তোমাকে আমি সমাজের সকল কুসংস্কার, সকল জীর্ণতার উর্ধ্বে তুলে ধরতে চাই। তোমাকে দেখে আরও দশটা মেয়ে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে আসবে, আত্মপ্রতিষ্ঠ হতে উৎসাহ পাবে, নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হবে। পরিবেশের কথা বলছ? নিজেকে সেখানে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করো, দেখবে ঝড় আপনি থেমে গেছে।’ হাসানের কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়। সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। দশটার মধ্যেই ওকে অফিসে পৌঁছাতে হবে। দ্রুত হাতে নিজেকে গুছিয়ে নেয় নাসিমা। বাচ্চারা স্কুলে।
এই গল্পটি লেখকের নওয়াব মিয়ার নবজীবন গল্পগ্রন্থ থেকে নেয়া
ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/