রুমানা সোবহান পরাগের গল্প ‘ভালোবাসাহীন জৈবিক সম্পর্ক’

রুমানা সোবহান পরাগ

ভালোবাসাহীন জৈবিক সম্পর্ক

মিসেস রিনা সারা রাত পায়চারী করেছেন। কিছুইতে ঘুম আসছিল না। একটা আতঙ্ক আর সম্মান হানীর ভয় তাকে কূরে কূরে খাচ্ছে। বারবার ভাবছেন এই রাতটা যেন শেষ না হয়। ভোরের আলোয় যেন তার প্রকৃত অবস্থান সবার কাছে পরিস্কার না হয়। ঘুম না হওয়ার কারনে বারবার পেশাব ধরছে। রাতে ঘুমানোটা জরুরী তার জন‍্য। না হলে দেখা যাবে সকালে ব্লাড সুগারও বেড়ে গেছে।

মিসেস রিনা একজন গৃহবধু। ওনার দুই মেয়ে এক ছেলে। এরা সবাই প্রতিষ্ঠিত এবং যার যার সংসারে ব‍্যস্ত। উনি আর ওনার স্বামী জনাব মোখলেস সেগুনবাগিচায় নিজেদের ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকেন। সাদা চোখে সবকিছুই সুন্দর,  বাড়ির গেটে লাগানো বাগানবিলাস ফুলের মতোই সব মাধুর্যমন্ডিত। কিন্তু এই সুন্দর গেট আর আলিশান বাড়ির ভেতরের মানুষ গুলো যেন বহু আগেই পচে নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও পদবী আর কেতাদুরস্ত পোশাকের আড়ালে ঢাকা পরে যায় তাদের ভেতরের কদর্যতা।

মিসেস রিনা আর আমি একসাথে ইয়োগা আর মেডিটেশন কোর্স করেছি। একদিন ইয়োগা ক্লাস শেষে উনি আমাকে বললেন পরাগ তুমি কিছু করছনা কেন? পরে আফসোস করবে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওনার কথায় কারB ওনাদের বয়সD প্রায় সব মানুষই আমাকে এপ্রিশিয়েট করে শুধুই ঘর সংসার করার জন্য। বললাম, 'কেন আফসোস হবে আন্টি'! স্বামী, সন্তানের জন্য নিজের হাতে রান্না করি ভালোবেসে সামনে বসিয়ে খাওয়াই। যত্ন করি ওদের। আমার তো ভালোই লাগে। আফসোস হবে কেন?'

-শোনো মা, আমিও তোমার মতোই আমার সংসারকে আগলে রেখেছিলাম। ওদের জন্য সব বিসর্জন দিয়েছিলাম।
-ভালোই তো করেছিলেন আন্টি। আমিও সে জন্যই সংসারে পরে আছি ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-এমন সময় আফসোস হয় যখন মানুষের ঘুরে দাড়ানোর  ‍ুযোগ থাকেনা। আমি জানি তুমি লেখালেখি করো। তোমার লেখাতেই বেঁচে থাকুক আমার জীবনের না বলা কষ্টের কথাগুলো ।

-শোনো। তখন উনিশ'শ আশি সাল। তোমার আঙ্কেল সবে মাস্টার্স পাশ করেছেন। আমি তখন ল'তে পড়ি। আমাদের প্রেমের বিয়ে। দুই পরিবারের কোনো অমত ছিল না আমাদের বিয়েতে। সংসারে সম্পদ না থাকলেও সুখের কমতি ছিলনা। ধীরে ধীরে আমাদের সংসার বড় হয়। আমি ল’ পাশ করে কোর্টে প্রাকটিস করি। তিন বাচ্চা নিয়েছি পরপর। তোমার আঙ্কেল মজা করে আমাকে হাইকোর্টের উকিল সাহেবা বলে ডাকতো সেই সময় । আমি তখন সিনিয়রদের এসিস্ট‍্যান্ট হিসেবে কোর্টে কাজ করছিলাম । অনেক প্রেসারে থাকতে হতে। ড্রাফট লেখা থেকে সব কাজই আমাকে করতে হতো। একদিকে তিন বাচ্চার পড়ালেখা, অন‍্যদিকে সংসারের কাজের চাপ সব কিছু মিলিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছিলাম। ঠিক করলাম চাকরিটা ছেড়েই দেই। কারণ বাচ্চাদের মানুষ করাও তো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর তোমার আঙ্কেলেরও সরকারি চাকরি হয়ে গেছে ততদিনে। মোটামুটি অর্থনৈতিক ভাবে আমরা তখন স্বচ্ছল। ঘোরের মধ‍্যেই কেটে যাচ্ছিলো আমার জীবনের সেই স্বর্নালী সময়গুলো। যখন বোধোদয় হলো তখন তো আর নতুন করে ভাববার সুযোগ ছিল না।

জীবনের প্রথম ধাক্কা আসে আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ের পর। আমার ছোটভাই পাওয়ার প্লান্টে চাকরি করতো। প্রায়ই ওকে ঢাকার বাইরে থাকতে হতো। তখন ও ওর স্ত্রী সাবিহাকে আমার কাছে রেখে যেতো। আমিও ভাবতাম আমার কাজে সাহায্য হবে। তাই আমিও খুশী হতাম সাবিহা আসলে। তোমার আঙ্কেল ও তেমন কিছু বলতোনা ওরা আসলে। বরং একটু বেশিই কর্তব্য পালন করতো যা কখনও কখনও দৃষ্টিকোটু লাগতো আমার চোখে। পরে ভাবতাম আমার মনের সংকীর্ণতা। সহজ স্বাভাবিক ভাবেই দেখার চেষ্টা করতাম বিষয়গুলোকে। সাবিহা আর টুটুলকে তোমার আঙ্কেল কিছুটা জোড়াজুড়ি করেই আমাদের বাড়িতে এনে রাখলো। প্রায়ই টুটুল পাওয়ার প্লান্টের কাজে ঢাকার বাইরে যায়, সাবিহা একা বাসায় থাকে। নিরাপত্তার কথা ভেবে টুটুলও রাজি হয়েছিল।

একদিন রাতে আমার ভীষণ পিপাসা লাগলো। আমি পানি খেতে উঠতে গিয়ে খেয়াল করি তোমার আঙ্কেল বিছানায় নেই। ভাবলাম ওয়াশরুমে গেছে। পানি খেতে ডাইনিং রুমে যেতে গিয়ে খেয়াল করি ওয়াশ রুমের দরজা খোলা। তখনও খারাপ কিছু চিন্তা মাথায় আসেনি। ভাবলাম থানা থেকে  কল এসেছে, তাই আমি বিরক্ত হবো দেখে তিনি হয়তো পিছন থেকে  তালা দিয়ে চলে গেছেন। আমার আর ঘুম আসছিল না। ড্রইংরুমে পানির গ্লাস নিয়ে বসেছিলাম। ভাবলাম ও ফিরুক তারপরে একসাথে ঘুমাতে যাবো।

ঘন্টাখানেক আমি ছোফায় বসেছিলাম। একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে কিছুইতে আর ঘুম আসেনা আমার । ছোফায় বসে টুটুল সাবিহার কথাই ভাবছিলাম। মেয়েটা আমার রন্টির বয়সীই হবে। খুব মায়া লাগে ওকে দেখলে। ভাবছিলাম ওর জন‍্য একজোড়া বালা বানানোর টাকা চাইবো তোমার আঙ্কেলের কাছ থেকে। মেয়েটা এতো যত্ন করে আমাদের। ও বেড়াতে আসলে তো আমাকে রান্না ঘরে যেতেই দেয় না। বাচ্চাদের, আর তোমার আঙ্কেলের দেখভাল ওই করে। আমার একটু তন্দ্রার মতো হয়েছিল। এর মধ‍্যে দেখি সাবিহার রুমের দরজা খোলার শব্দ। ভাবলাম আমার মতো ওরও বোধহয় পানির পিপাসা পেয়েছে। যাক ভালোই হলো। কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে ওর সাথে  এই ভেবে উঠে ডাইনিং রুম পর্যন্ত আসতেই দেখি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দেখি তোমার আঙ্কেল সাবিহার রুম থেকে পা টিপে টিপে বের হচ্ছে। সেও আমাকে দেখে চমকে উঠলো। কোনো কথা না বলে দ্রুত বেডরুমে চলে গেল। আমি কিছুই বলিনি। আসলে এতোটাই অবাক হয়েছিলাম যে কি বলবো, কি করবো কিছুই ভাবতে পারিনি। এর মধ্যে দেখি সাবিহা খোপা বাধতে বাধতে ডাইনিং রুমের দিকে আসছে।  আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তীব্র ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও চোখ নামিয়ে ওর ঘরে চলে গেল।

 কী যে একটা বিভিষিকাময় রাত! আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছিল, দৌড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল, তোমার আঙ্কেলের গায়ে খামচি মেরে রক্তাক্ত করতে ইচ্ছা করছিল, তাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করছিল। সাবিহাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে হেঁচড়ে ঘর থেকে বের করে দিতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু আমি কিছুই করিনি। ছোট ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে। এ মুহূর্তে আমার  আউটবার্সট ওর চিন্তার জগতটা এলোমেলো করে দেবে। বড় মেয়ে দুটো ওদের বাবার সাথে কি ভাবে স্বাভাবিক আচরণ করবে এ ঘটনা জানার পরে। এতো জঘন্য ঘটনা ওদের এই কোমলমতি মনে জায়গা করে নিক এটা আমি চাইনা।

সাবিহাকে আমি নিজের সন্তানের মতোই মায়া করতাম। কিন্তু ও এটা করলো কি ভাবে! আর তোমার  আঙ্কেলই বা কি রুচিতে নিজের মেয়ের বয়সী মেয়ের ঘরে গেল! নীতিহীন বর্বর একটা মানুষ সে। তার এই পরিচয় কখনও টের পাইনি আমি আগে। তবে আমি নিজের কষ্টের চাইতেও ছোট ভাইয়ের কষ্টের কথা মাথায় আনতে পারছিলাম না। সবচেয়ে বড় আঘাতগুলো মানুষ তার কাছের মানুষের কাছেই বোধহয় পায়।

সেদিনের সেই রাতটা ভয়ংকর দীর্ঘ মনে হচ্ছিলো। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ মুহূর্তে আমার উপরে নির্ভর করছে দুটো সংসারের কাঠামো। এ মুহূর্তে আমার মন যা চাচ্ছে আমি যদি তাই করি তাহলে প্রথমে টুটুলের সংসারটা ভাঙ্গবে। শুধু ভাঙ্গবেই না, আমি যতদুর চিনেছি সাবিহাকে তাতে এই মেয়ে আত্মগ্লানিতে আত্মহত্যাও করতে পারে। এরপর আমার দুজন বিবাহযোগ‍্যা মেয়ে আছে। কোনো ভালো ফ‍্যামিলির সাথে সম্বন্ধ করতে পারবোনা যদি এই কেলেঙ্কারির কথা জানাজানি হয়ে যায়। আমার ছেলেটার পড়ালেখায় ব‍্যাঘাত ঘটবে। আদৌ আর পড়া লেখা করতে পারবে কি না আমার সন্দেহ আছে। তাহলে আমি কি করবো? এমন আচরণ করবো যাতে কিছুই দেখিনি গতরাতে!

আমি সারারাত পায়চারি করেছি। টুটুলের কথা বারবার মনে আসছিল। মা মরা ভাইটা আমার। সাবিহাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। সাবিহার আচরনেও কোনো দিন কোনো অবহেলা প্রকাশ পায়নি ওর প্রতি। তাহলে কি সাবিহাকে শুধরে যাবার সুযোগ দেবো। মেয়েটাকে এতো স্নেহ করেছি। মানতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর এই আচরণ।  আমি সারারাত পায়চারী করলাম। রাতের অন্ধকারকে গ্রাস করে তীব্র সূর্যের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। অথচ আমার মনের ভেতরের ঝড় আর নিকশ কালো অন্ধকার কিছুতেই পরিস্কার হচ্ছে না। আমি কিছুই করিনি যা যা করতে মন চেয়েছিল সে রাতে। প্রকৃতির হাতেই সমর্পন করেছিলাম সেই রাতের বিচারকে।

সাবিহা ভোরে চলে গিয়েছিল ওর বাবার বাড়িতে। যাবার সময় আমার পা জড়িয়ে বলেছিল-আপা আপনি আমার মায়ের মতো। আপনি যে শাস্তি দেবেন তাই মেনে নেবো। আমি কোনো উওর দেইনি। ও চলে গিয়েছিল। তোমার আঙ্কেল একটু বেলা করে উঠেছিল। সে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে কাজা নামাজ পড়ে নাস্তা খেয়ে আফিসে গিয়েছিল। তার চোখে কোনো অপরাধ বোধ দেখিনি সেদিন।

আমিও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করিনি। সময়  আর সমাজ সবকিছুই একসময় হজম করে আবার স্বাভাবিক গতিধারা ফিরিয়ে আনে। তবে মনের ঘরে সেই সঞ্চিত কষ্টগুলো আমৃত্যু অবিকল সেরকমই  থাকে।

সেই রাতের পর থেকে আর একটা রাতও আমি ঘুমাতে পারিনি। প্রতিটা রাত আমার কাছে বিভিষিকাময় রাত মনে হয়। রাত হলেই আমার সেদিনের সেই রাতের  কথা মনে পরে। আমি সারা বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে রাখি সারা রাত। পায়চারী করি। বুক ধরফর করে। মনে হয় সকাল হলেই সবাই জেনে যাবে সেই রাতের ঘটনাগুলো। আমার স্বামীর কাছে আমি নিগৃহীত। সে অন‍্য নারীতে আসক্ত। এটা আমার জন্য অসম্মানের। আমি ঘুমাতে পারিনা আর। আজোও আমার মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঘোরাফেরা করে মানুষ কিভাবে ভালোবাসাহীন জৈবিক সম্পর্ক করে!

লেখক পরিচিতি: রুমানা সোবহান পরাগ কবি, লেখক ও গবেষক। বিভিন্ন পত্রিকায় তার গল্প প্রকাশিত হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে Corporate Social Responsibility in Bangladesh: Practice and Perpetuity. শিরোনামে একটি গবেষণা গ্রন্থ বেরিয়েছে এই লেখকের। তিনি বিভিন্ন সময়ে ব্রাকসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে দায়ত্বশীল পদে কাজ করেছেন।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/