শরৎঋতু প্রকৃতিকে সাজায়: বাঙালিকে সর্বংসহার দীক্ষা দেয়

সুলতানা রিজিয়া

সুলতানা রিজিয়া

উদলা আকাশ ফুল্ল হাওয়া রৌদ্রছায়া
দিগন্তজুড়ে কাশ বাথান দোদুল দুলে,
শেফালিকা উষার ছোঁয়ায় পড়ছে ঢলে
ফিরছে ভ্রমর প্রজাপতি হাজার ফুলে।

শরৎঋতুর মায়াবী আবহাওয়া বাঙালির জন্য বয়ে আনে  প্রকৃতিমাতার এক অনুপম আর্শিবাদ। শরৎ ঋতু তাদের মানবিক ও পারিবারিক কর্মময় ব্যস্ত জীবনে মুক্তির খােলা বাতায়ন। ভােরের নরম আলােয় যখন জগৎ সংসার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তখন আচম্বিত পুলকে ভরে উঠে মন- প্রান! আকাশ জুড়ে কুয়াশাপ্রপাতে বিন্দু বিন্দু শারদীয় শিশির উপহার দেয় রংবাহারী আলোকচ্ছটা! শরতের সকাল স্নিগ্ধতার প্রতিমূর্তি। শরতের প্রভাত এক অনির্বচনীয় আনন্দের ডালি নিয়ে অত্যন্ত ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। শরতের আগমন অতুলনীয় সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতাকে বিদীর্ণ করে না। তার চারপাশের সজ্জিত রূপরাশি ক্ষণে ক্ষণে বাতাসের আওলা প্রবাহে কিছুটা দিক পরিবর্তন ঘটায়। উত্তর-পশ্চিম থেকে বাতাস প্রবাহের ফলে তাপমাত্রার আধিক্য কিছুটা কমে আসে। ভাদ্রমাসে শরৎ ঋতুর যাত্রা শুরু হলেও আশ্বিন মাসে এসে বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশে শরতের আসল রূপ রস, গন্ধসুধা পাখা মেলতে শুরু করে। সাদা সাদা মেঘ আকাশে ভেলার মতাে ভেসে বেড়ায়। শরতের সকালের সাথে আর কোন ঋতুর তুলনা চলে না। শারদীয় সকাল বাংলার নিজস্ব রূপবৈচিত্র্যের স্মারক। ঝকঝকে নীলাকাশের বুকে ধবধবে সাদা মেঘের ভেলা। মাটির বুকে নানাবিধ ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলিমা।
নদীর কোল ঘেঁষে ফুটে থাকা কাশবনে শারদীয় সকাল বুলিয়ে দেয় তার অনুপম সােহাগ। মৃদুমন্দ-সমীরণে দুলে ওঠে কাশবনের সাদা মাথা- যেন শুচি স্নিগ্ধ নির্মল সফেদ  সাগরে ঢেউ উঠেছে। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে আকাশ। এই নীল-সাদা আসমানের ছায়া পড়ে নদীর বুকে। শরতের ঝিলের বুকে পদ্ম ফোটে, ফুটন্ত পদ্মের ওপর শিশির ও কোমল সূর্যরশ্মির যুগপৎ আদুরে স্পর্শ। নদীর নিস্তরঙ্গ জলের বুকে গাড় সবুজ পদ্মপাতার বুকে দল বেঁধে ছুটে বেড়ায় পানকৌড়ি ও ডাহুক পাখি। জলজ উদ্ভিদে সবুজের ঢল বয়ে যায়, মাঠে জমে থাকা ঝিপঝিপে জলে কিম্বা নদীর তীরে পা ঢুবিয়ে ভিড় জমায় সাদা বক, কানা বক ও সারস পাখি তাদের শিকারের ছলে। শারদীয় চাঁদ তার অতুল জ্যোৎস্না, কিম্বা ভরা পূর্ণিমা জলের বুকে সোনালি স্রোতের ঢেউ তুলে জলতরঙ্গে নিশিযাপনে আত্মহারা হয়ে উঠে।

শরৎশশী অতল গাঙে জ্যোৎস্না মেখে
জলকেলিতে ঘুঙুর বাজে আপনহারা,
পানকৌড়ি ডাহুক ডাকে জলজটলায়
নিশিপদ্মের আতরসুবাস হৃদয়কাড়া ।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এক একটি ঋতু এক এক রকম বৈশিষ্ট্যের। কথায় আছে বাংলার বারোমাসে তেরো পার্বণ। এইসব পার্বণের উৎসে আছে ছয় ঋতুর মাহাত্ম্য।  একটার সাথে অন্য ঋতুকে প্রায়শ মেলানো যায় না। কিছুটা মিলে গেলেই শুরু হয় অনাসৃষ্টি!  বাংলা বছরের  প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম প্রহরে গ্রীষ্মঋতুর আর্বিভাব ঘটে। শুরু হয় তার তাণ্ডব লীলা। ছন্নছাড়া বালকের মতো তার দুর্দান্ত দুর্দমনীয় একরোখা উপস্থিতি।

তাপসনিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আর্বজনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।

                  -কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিগত বছরের প্রাকৃতিক যাবতীয় জঞ্জাল,জীর্ণ শীর্ণ তরুলতা, ধূলি ধূসরতার জটাজাল – মানবিক দুঃখ, দুর্দশা, না পাওয়ার ব্যর্থতা, বঞ্চনা, সুখ -স্বপ্ন ভঙ্গের হুতাশনের জ্বালা উড়িয়ে, পুড়িয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে নিশ্চিহ্ন করতেই যেনো গ্রীষ্মঋতুর আগমন ঘটে। গ্রীষ্মের দাবদাহে, ঝড়- ঝঞ্ঝাবায়ে পুরাতনের বিদায় বার্তায় পৃথিবীতে নতুন স্বপ্ন অঙ্কুরিত হওয়ার সুযোগ আসে। মানুষ নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায়, সুখের আশার বাসা বাঁধে।

গ্রীষ্মের পরেই আসে বর্ষা ঋতু তার জলতরঙ্গে মৃদঙ্গ বাজিয়ে। ঝড়ঝঞ্ঝার ডঙ্কায় তটস্থ করে তোলে চারপাশ। বাংলাদেশে বর্ষাকাল তার নির্ধারিত দুই মাসের কোঠা পেরিয়ে হেমন্তকে কজ্বা করে প্রবল প্রতাপে। প্রায় চার মাস জুড়ে বর্ষার বৃষ্টি, বাদল, ঝড় ঝঞ্ঝা, বন্যায় ফসলের ক্ষয় ক্ষতি করা থেকে উজান বানের তোড়ে সংসারের সুখ স্বস্তি, জীবন – জীবিকা ভাসিয়ে দেয়, তলিয়ে দেয় ভূপৃষ্ঠ,  ফলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষয়- ক্ষতি প্রকট আকার ধারন করে। পানি বাহিত নানাবিদ রোগ বালাই, ক্ষুধার জ্বালা উপশমের, অভাবের তাড়না মিটানোর লড়াই মানুষকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। বর্ষাকাল মানে শুধুমাত্র মেঘ বৃষ্টি, কাদামাটি, উজান জলের ঢল, জলজ পরিবেশ, চারপাশে সবুজ সতেজ বনবনানী, ঝোপঝাড়, নদী নালায় জলের স্রোত, ডোবা পুকুরের পাশে ব্যাঙের সমবেত গান  (চিৎকার ), স্কুলের পথে বৃষ্টিতে ভিজে ছুটিতে মা’দের হাতে রান্না খিচুড়ি, বেগুন ও ইলিশ ভাজা খাওয়া নয়, বর্ষকাল মানে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা, উজান স্রোতের বিপরীতে হেরে না গিয়ে উঠে দাঁড়ানো এবং পুনরায় জীবনের শক্ত ভিত্তি স্থাপন করা।
বন্যার ঢল প্রকৃতির স্থাবর অস্থাবর সম্পদকে ভাসিয়ে  নিয়ে যায় বটে, কিন্তু বিদায় ক্ষণে সে ধরিত্রীমাতার বুকজুড়ে দিয়ে যায় তাল তাল সোনা স্বরূপ উর্বরা পলিমাটি, সোনালী রুপালী ফসলের সমারোহ।

বাংলা মায়ের তৃতীয় ঋতু মায়াবতী শরৎকাল! ভাদ্র, আশ্বিন- এ দুমাস নিয়ে এই ঋতু। শরৎ ঋতু বাঙালির হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের এক ঋতু। এক কথায় আনন্দের পুরোধা। এই ঋতুর নিজস্ব একটা মৌ মৌ আনন্দময় সৌরভ রয়েছে। শিউলি ঝরার আনন্দ, কাশ ফুলের দুলুনি, মেঘমুক্ত নীল আকাশ জুড়ে তুষার শুভ্র হালকা মেঘের সমারোহ। ভাদ্র-আশ্বিনে শরৎঋতু লুকোচুরি খেলার আনন্দে মৃদুমন্দ বাতাসের চৌদোলায় উঠে বসে। আকাশময় তার ধীর মন্থর উড়াউড়ির জুড়ি মেলাভার। শরৎ ঋতুর রানী। তার সৌন্দর্যে কোনো মলিনতা নেই, আছে শুচি স্নিগ্ধ আনন্দধারা, অবিরাম তৃপ্তি ও গভীর প্রশান্তি। শরতের সকালটা খুবই মোলায়েম এবং নরম মাখনের মতো। সবুজ ঘাসের ডগায় শিশিরের ফোঁটা জমে। যেন ঘাসের উপর মুক্তার কণা! নদীর দু'কূলের মাঝ দিয়ে জলধারা বয় নিরবধি। মাঝির উদাস কণ্ঠে সুর উঠে ভাটিয়ালি গানের। রংবেরঙ পাল তোলা নৌকার আধিক্য চোখে পড়ে। পূবের আকাশ আবীর আলোয় রক্তিম হয়ে উঠে। বলাকার দল গাঢ়নীল আকাশে উড়ে বেড়ায়। আকাশের নীল সাগরে সাদা মেঘের মনোহরা খেলায় আমরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। শরতের সাদা মেঘে চড়ে মন উড়ে যেতে চায় বহুদূরে। কবির কবিতা স্তবক আওড়াই-, নতুবা আনন্দে গেয়ে উঠি-

আজি ধানের ক্ষেতে রোদ্র ছায়ায়
লুকোচুরির খেলা,
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলারে
ভাই সাদা মেঘের ভেলা।

শরৎ ঋতুতে প্রকৃতি সেজে উঠে প্রকৃতি ফুলের জলসায়। শাপলা, পদ্ম, শেফালী, জুঁই, চামেলি, হাস্নাহেনা, কামিনী, বেলী, দোলন চাঁপা, নাগকেশর, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ ফুলের রঙ ও সৌরভে আমাদের মনকে মাতোয়ারা করে তোলে, প্রকৃতি আঁচল ভরে দেয় নানান রঙের বৈচিত্র্যময় ফুলের আলপনায়।

কবির ভাষায়-
কে এলো গো আমার দ্বারে শারদ প্রাতে
শিউলী ফুলের মালাগাছি লয়ে হাতে।
কাশের বনে রাশি রাশি
ছড়িয়ে দিয়ে শুভ্র হাসি
চরণ রেখে শিশির ধোয়া ঘাসের পাতে।  

শরৎ ঋতু হলো হেমন্তের প্রস্তুতি পর্ব। শরতের সফল আয়োজনে হেমন্তের শুরুতে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতজুড়ে পলিমাটির কল্যাণে ফসলের সমাহারে কৃষকের গোলা ভরে উঠে। এ সময় নদী-নালা রকমারি মাছে ভরে যায়। বাজারে দেখা যায় সোনালী- রুপালী মাছের অধিক্য। আর্থিক স্বচ্ছলতায় কৃষকের মনে আনে সুখ-শান্তি। এসময় মাছের উপর অধিকাংশ সংসারের জীবিকা নির্ভর করে। পাট ও আউশ ধান কাটা আগেই শেষ হয়ে গেলেও  কিছু এলাকায় আমন ধানের চাষ করা হয়। এই সময়টায় ঘরে ঘরে নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি জাগ দেওয়া পাটগাছ থেকে ( পানিতে চুবিয়ে রাখা পাটগাছ ) পাট ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। একই সাথে পাটখড়ি শুকিয়ে ঘরে তোলায় হাত লাগায়। এইসব পাটখড়ি বাড়ির সীমানা জুড়ে ঘের দেওয়া ( প্রাচীর)  এবং জ্বালানি স্বরূপ ব্যবহৃত হয়। ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে সময় দেওয়াটা বেশ উপযোগী। বর্ষাঋতুর আগ্রাসনে ছিন্নভিন্ন সংসার নতুন করে সাজায় গুছায় এই শরৎ ঋতুতেই।

শরৎ ঋতুতে সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। অনেক সময় এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করে। তারপরও "ঋতুরাণী" শরৎ আপামর বাঙালি তথা কবি-সাহিত্যিকদের অন্তর্গত কাব্যকলায় সুধা সিঞ্চন করে, তারা ভাব প্রকাশে উন্মুখ হয়ে উঠেন। শরতের মন মাতানো রূপের বাহার সৌন্দর্য-পিপাসুদের মনকে উদাস করে তোলে। আর এই কারণে শরৎ ঋতু সকলের কাছেই আদরনীয়। বাংলাদেশে শরৎঋতু শুধুমাত্র প্রকৃতিক সৌন্দর্যের শোভা বর্ধনই করেনা, শরৎ তার রূপের ডালি সাজানোর পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়, সুযোগ ও প্রেরণাও যোগায়।  

শরৎ ঋতু হলো হেমন্তের প্রস্তুতি পর্ব। শরতের সফল আয়োজনে হেমন্তের শুরুতে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতজুড়ে পলিমাটির কল্যাণে ফসলের সমাহারে কৃষকের গোলা ভরে উঠে। এ সময় নদী-নালা রকমারি মাছে ভরে যায়। বাজারে দেখা যায় সোনালী- রুপালী মাছের অধিক্য। আর্থিক স্বচ্ছলতায় কৃষকের মনে আনে সুখ-শান্তি। এসময় মাছের উপর অধিকাংশ সংসারের জীবিকা নির্ভর করে। পাট ও আউশ ধান কাটা আগেই শেষ হয়ে গেলেও  কিছু এলাকায় আমন ধানের চাষ করা হয়। এই সময়টায় ঘরে ঘরে নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি জাগ দেওয়া পাটগাছ থেকে ( পানিতে চুবিয়ে রাখা পাটগাছ ) পাট ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। একই সাথে পাটখড়ি শুকিয়ে ঘরে তোলায় হাত লাগায়। এইসব পাটখড়ি বাড়ির সীমানা জুড়ে ঘের দেওয়া ( প্রাচীর)  এবং জ্বালানি স্বরূপ ব্যবহৃত হয়। ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে সময়টা  বেশ উপযোগী। ঘাটে, মাঠে, ক্ষেত খামারে কাজের স্বল্পতার কারণে শ্রমজীবীরা হাতে অনেকটা সময় পান। অবকাশ, অবসরে আপন সংসারে, পরিবারিক ক্ষয় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এই সময়ে জলজ শাক- সবজি, শাপলা – শালুক জাতীয় সবজির ব্যবসায় জড়িত থাকেন। ক্ষুধার রসদ জোগান। বর্ষাঋতুর আগ্রাসনে ছিন্নভিন্ন সংসার সাজিয়ে গুছিয়ে নেন। শরৎ ঋতুর এটাই বড় প্রাপ্তি। তাই বলা যায় বাংলাদেশে শরৎঋতু শুধুমাত্র প্রকৃতিক সৌন্দর্যের শোভা বর্ধনই করেনা, শরৎ তার রূপের ডালি সাজানোর পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়, সুযোগ ও প্রেরণাও যোগায়।

হে মাতঃ বঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ
জ্বলিছে অমল শোভাতে।

পারে না বহিতে নদী জলভার
মাঠে মাঠে ধান ধরে না’ক আরÑ
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
তোমার কানন সভাতে!
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী
শরকালের প্রভাতে।

-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওমেন্স নিউজ/