যে কারণে মুসলিম বিদ্বেষী পোস্ট আমলে নিচ্ছে না ফেসবুক

ভারতীয় নেতাদের মুসলিম বিদ্বেষী পোস্ট সরানোর ক্ষেত্রে নিজেদের হেইট স্পিচ পলিসি বা ঘৃণা সংক্রান্ত নীতি অনুসরণ করছে না ফেসবুক। ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিভিন্ন হিংসাত্মক বক্তব্যগুলো না সরিয়ে রেখে দিচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের এই জনপ্রিয় মাধ্যমটি। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলেছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।

শুক্রবার (১৪ আগস্ট) প্রকাশিত নিবন্ধে ওয়াল স্ট্রিট জানায়, ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)  নেতারা এবং অন্যান্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো যেসব মুসলিম বিদ্বেষী পোস্ট দিচ্ছে সেগুলো ডিলিট করতে অস্বীকার করেছেন ভারতের ফেসবুক নির্বাহী আঁখি দাস।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ওই প্রতিবেদনে বলছে, বিজেপি নেতা রাজা সিং-সহ আরো কিছু হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে মারাত্মক সব সাম্প্রদায়িক পোস্ট দিয়ে আসছেন। ফেসবুকের নীতি অনুযায়ী ওইসব পোস্ট ডিলিট করার কথা থাকলেও ভারতের ক্ষেত্রে ওই নীতি প্রয়োগ করছে না ফেসবুক।

রাজা সিং হচ্ছেন তেলেঙ্গানা রাজ্য থেকে  নির্বাচিত পার্লামেন্টের একমাত্র বিজেপি সাংসদ। তিনি তার মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, এই ডানপন্থি নেতা একবার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের, যাদের অধিকাংশই মুসলিম, গুলি করে হত্যা করার দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি তার আরেক ফেসবুক পোস্টে ভারতীয় মুসলিমদের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে উল্লেখ করে সে দেশের সমস্ত মসজিদ ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কেবল ফেসবুক নয়, বিভিন্ন জনসভাতেও মুসলিমদের লক্ষ্য করে নানা হুমিক দিয়ে থাকেন তিনি।

এসব সাম্প্রদায়িক ও ঘৃণামূলক পোস্ট দেয়ার কারণে, চলতি বছরের মার্চে ফেসবুক কর্মীরা রাজা সিংয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বাতিল করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু ফেসবুকের ভারত, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর হিসাবে দায়িত্বে থাকা আঁখি দাস রাজা সিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানান। কেননা ওই বিজেপি নেতার ফেসবুকের ফলোয়ার সংখ্যা লক্ষাধিক এবং তিনি সামাজিক মাধ্যম ইনস্টাগ্রামের সত্ত্বাধিকারী।

ফেসবুক কর্মচারীদের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আাঁকি দাসের কাজ হচ্ছে ফেসবুকের পক্ষে ভারত সরকারের সাথে লবিং করা। তাই তিনি ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও মোদির দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেন। আর এভাবে তিনি ফেসবুকের ব্যবসায়িক  সম্ভবনাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।

আঁখি দাস যে রাজা সিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাননি এ কথা স্বীকার করেছেন ফেসবুকের মুখপাত্র অ্যান্ডি স্টোন-ও। তিনি বলেন, ভারতের সার্বিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই তিনি ওই বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে কঠিন কোনও পদক্ষেপ নেননি। তবে ফেসবুক ইতিমধ্যে তার কিছু পোস্ট সরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া রাজা সিংয়ের অ্যাকাউন্টের সম্মানজনক নীল টিক চিহ্নটিও কেড়ে নিয়েছে ফেসবুক।

ওই প্রতিবেদনে কমপক্ষে আরও দু'জন বিজেপি নেতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।  আমেরিকাভিত্তিক ওই সংবাদপত্র এ নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর পর মুসলিম বিদ্বেষমূলক পোস্টগুলি ফেসবুক থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

গত মার্চে বিজেপির সংসদ সদস্য অনন্তকুমার হেগদে ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করেছিলেন যে, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে মুসলমানরাই ভারতে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে এবং তিনি ওই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নাম দিয়েছিলেন ‘করোনা জিহাদ’।

কেবল ওই বিজেপি নেতা একা নন, মার্চে ভারতে প্রথম করোনার প্রার্দুর্ভাব হওয়ার পর সে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোও করোনা বিস্তারের জন্য তবলিগ জামাতকে দায়ী করেছিল। তখন একাধিক তবলিগ জামাতের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যাদের মধ্যে অনেক বিদেশিও ছিলেন।

শুধু তাই নয়, গত ডিসেম্বরে ভারতীয় পার্লামেন্টে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দিল্লিতে বিক্ষোভ চলাকালে বিজেপি সাংসদ কপিল মিশ্রার এক বিবৃতিকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ভয়াবহ দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। তার ওই বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুক থেকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার পরই দিল্লির ওইভয়াবহ দাঙ্গাটি অনুষ্ঠিত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ভিডিওতে তিনি পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার ওই বক্তব্যের জের ধরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা বিক্ষোভরত সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দিল্লির ওই দাঙ্গায় কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হয়েছিলেন যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম।

ওয়াল স্ট্রিট বলেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে তিন দিনের ওই দাঙ্গা টিফেসবুকের মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিল। ভারতে পুলিশি প্রতিবেদন ও স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিতে ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত আদালতের নথিতেও এ ঘটনার উল্লেখ আছে।

গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের টাউন হল বৈঠকে মিশ্রের ওই পোস্টের কথা উল্লেখ করে মার্ক জাকারবার্গ স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, কোনও রাজনীতিবিদের কাছ থেকে এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞনহীন বক্তব্য সহ্য করবে না ফেসবুক।

ইতিমধ্যে ফেসবুক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদানের কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু পোস্ট সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় নেতাদের ক্ষেত্রে ফেসবুক তার নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারছে না, অভিযোগ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/