সুলতানা রিজিয়ার গল্প ‘অপেক্ষার তিয়াস’

অপেক্ষার তিয়াস

পৈষালি শীতের কাকডাকা ভোরে আজ আর জামিলার উঠতে ইচ্ছে করে না। রাতভর নেতানো কম্বলের জমাট ওমটুকু ধরে রাখতে গুটিসুটি মেরে পাশ ফিরে। বয়সী শরীরের বিষবেদনা কনকনে হিমঠান্ডায় উসকে ওঠে। এরমধ্যে বাসি এঁটোকাঁটা জড়ানো বাসনের গায়ে সাবান জলের ঠাণ্ডার কামড় বড়ই নিদারুন।

সকাল থেকে একমুহূর্তের অবসর নেই, দিনভর তাকে গনগনে আগুনের পাশেই থাকতে হয়। নদীর পাড় ঘেঁষে রেলস্টেশনের বারোযারী হোটেল। ট্রেনে কত মানুষ আসে, যায়! কেউ হোটেলে এসে বসে, খায়, বিশ্রাম নিয়ে চলে যায়, কেউ ষ্টেশনে নেমেই আপন গন্তব্যে ফিরে যায়।

জামিলার কাজ হোটেলের ভাত তরকারি রান্না করা আর সকালের এঁটো বাসনমাজা। কুটাবাছার জন্য পাশের বাড়ির হানুফা বেওয়া আসে। দিনভর জামিলার পাশেই থাকে, সন্ধ্যার পরে আর থাকে না। আপন ঠিকানায় ফিরে যায়। কেবল জামিলারই কোনও ঠিকানা নেই। সকাল থেকে রাত, রাতের পর সকাল! ঋতুর পালাবদলের তোয়াক্কা ছাড়াই এটি এখন তার জীবনের সাথে জুড়ে গিয়েছে।

হোটেলমালিক দীদার মুন্সির বাড়িও পাশেই। দুই ছেলে, ছেলে বৌ, নাতী, নাতনী আর পরিবার নিয়ে তার সংসার। বড়ছেলে মাঝেমধ্যে হোটেলে আসে, ক্যাশে বসে, নজরদারি করে। বাপের অবর্তমানে মালিকানা বুঝে নেয়ার পাঠ আরকি। দীদার মুন্সির ভালোঘরের লক্ষীমন্ত একটা এতিম মেয়েমানুষের খুবই দরকার ছিলো। রান্নার কাজতো আর যাকে তাকে দিয়ে হয়না। বছর বছর মানুষ বদলালে হোটেলের বদনাম, রান্নারও ক্ষতি। তার জহুরির চোখ, বানের পানি নেমে যেতে না যেতে কত মানুষ এলো গেলো! কার কতক্ষতি হলো সে হিসাবে তার আগ্রহ ছিলোনা। তিনি খুঁজতেন সহায় সম্বলহীন দুখী মেয়েমানুষ। আপন অভিজ্ঞতায় মনে করতেন সর্বহারা দুখীরাই বিশ্বাসী হয়। জামিলার ক্ষতি একটু বেশি হওয়ায় তিনি তাকে নিয়ে দ্বিতীয়বার আর ভাবেননি। হোটেলের রান্নার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবে, এই অঙ্গীকারে তাকে আপন বাড়িতে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বারান্দার কোনে একটা ঘর জামিলা জন্য বরাদ্দ দেয়া নিয়ে স্ত্রী রাবেয়ার সাথে প্রায় যুদ্ধই বেধে গিয়েছিলো। একুশ, বাইশ বছরের মেয়েমানুষকে কেউকি আপন সংসারে ঠাঁই দেয়! দীদার মুন্সী স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়েও সুবিধা করতে পারেনি। বৌয়ের সন্দেহ, নিত্যঝগড়ার প্যাঁচে দীদার মুন্সি হোটেলঘরেই জমিলার জায়গা করে দেন। রাত এগারোটার ট্রেন চলে গেলে জামিলার ছুটি, দীদার মুন্সিরও ঘরে ফেরা। স্টেশন চৌকিদার আজমল খাঁ জামিলাকে বুবুর চোখে দেখতো। জামিলা দীদার মুন্সীকে চাচাই ডাকে। খুঁজে পাওয়া লতায়পাতায় চাচাশ্বশুর। তাইতো এই আশ্রয়টা জামিলা শত কষ্টেও হারাতে চায়না। আরও একটা আশায় জামিলা ষ্টেশনকেই আপন ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছে। হাজার কাজের মাঝেও জামিলা রেলস্টেশনের মানুষের স্রোতে তার চেনামুখের তালাশ করে।

জমিলা আলগোছে ঘুমের মাঝে হাত বাড়ায়। পাশের খালি জায়গায় হাত পরতেই তার বুকের মাঝে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। আচমকা ঘুমের আবেশও ছুটে যায়। গত আটাশির বানের পর থেকেই তার পাশের জায়গাটা শূন্য। অপেক্ষার কানাগলির পথ শেষ হয়, জামিলার বুকের মানিক ও ঘরের মানুষটার ফেরার পথ এইদীর্ঘ সময়েও খুঁজে পায়না।

গ্রামের তিনকানি জমির বসতভিটা, বাড়ির নামানে বকনা বাছুর নিয়ে দুধেল গরুর গোয়াল, লতানো শাকসবজির মাচাংএর পাশে হাঁস-মুরগী নিয়ে জামিলার সংসারে সুখ, আল্হাদ থৈথৈ করে। বছর না ঘুরতেই কোলজুড়ে আসে আসমানের চাঁদ, জামিলা সোহাগ করে নাম রাখে আদুরী। আদুরীর বাপ হেলালুর রহমান ডাকে ময়না। পায়ে পায়ে পথ বাড়ার মতোই বাড়ে ময়না।বাড়ে সংসারের আয় উন্নতি। জামিলার কপালে এইসুখ বেশিদিন সইলো না। আটাশির বানের পানি দেখতে না দেখতে বাড়ির চারপাশে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো। গ্রামের মানুষজন নৌকা, তালগাছের ডোঙা, কলার ভেলায়, যে যেমন পারলো আশেপাশে সরতে গেলো। হেলালুর রহমানও গ্রামের অন্যদের সাথে গরু, বাছুর মালসামান যতোটা পারে নিয়ে নদীপাড়ের রেলস্টেশনের উপর আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা করতে গেলো। প্রতিবেশীদের পরামর্শে জামিলা বাপের সাথে ময়নাকেও পাঠালো। বছর পাঁচেক মেয়েকে এই দুর্যোগ থেকে বাপের সাথে পাঠিয়ে  নিজে যা পারে বাঁচার রসদ বাধতে থাকে। পলে পলে  রাত গাঢ় হয়। জামিলা ঘরের মেঝেয় চৌকির উপরে টুল নিয়ে ঠাঁই বসে  অপেক্ষা করে একটা সংবাদ পাওয়ার আশায়।

রাতের অন্ধকারে ঘরের মাঝে বানের জোয়ার যেনো আপন খেয়ালে খলবল করে বাড়তেই থাকে। বুকের উপর দিয়ে ঘোলাপানির ছলাৎ ছলাৎ নাচন জামিলার আর সহ্য হয়না। সে টুলথেকে চৌকি, চৌকি থেকে পানিতে নামে। ঘরের মেঝের মাটি মাখনের মতো নরম আর পিচ্ছিল।পরে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়। পা টেনে টেনে বুকপানি ঠেলে ঘরের বাইরে আসে জামিলা। আকাশ জুড়ে মেঘের কোল ঘেঁষে আলোর রেখায় বুঝতে পারে ভোর হতে চলেছে। বৃষ্টি আর পাগলা হাওয়ার শব্দ ছাড়া আশেপাশে কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। শুধু অথৈ জলের বুকে ভেসে চলেছে মৃত্তিকার জঞ্জাল, উপড়ে পরা গাছগাছালির শব। কোথাও মাটির কোন নিশানা নেই। গোয়ালঘর, সবজির মাচাংও ভেসে গিয়েছে। চারপাশে অবাধ ঢলের গোঙানির শব্দে অমঙ্গলের কুয়াশা তেড়ে আসে। বুকের মাঝে স্বামী, সন্তানের মুখ জ্বলে উঠতেই জামিলার কণ্ঠ চিড়ে উঠে আসে সব হারানোর হাহাকার। জলের স্রোতে মিশে যায় জামিলার চোখের জল, ভেসে যায় তার জীবনের সবসঞ্চয়।

রেলরাইনের উপরে যেনো জনমানুষের হাট বসেছে। পানি নেমে গেলেও অনেকে আপন ভিটায় ফিরে যেতে পারেনি। জলকাদায় মাখামাখি আঙিনা এখন নিজেরাই আর চিনতে পারেনা। জল কাদা মাড়িয়ে জমির সীমানা ঠিক করা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথাও নেই। পেটের মাঝে জ্বলছে যে ক্ষুধা, সেই ক্ষুধার আগুন নিভানো নিয়েই সবাই নাজেহাল। এরই মাঝে কেউ কেউ তাদের মাঝে আপন জনের তালাসে হাক ডাকে এমাথা থেকে সেমাথা ছুটাছুটি করে। কেউবা ভেজা নেতানো সংসার রেল লাইনের উপরে শুকাতে ব্যস্ত। অনেকে ইট, কাঠ জোগারে অকারণ হৈ চৈ বাধায়। রান্নার আনাজপাতি, চাল, ডালের আশায় অপেক্ষা আছে। গ্রামের জমির মণ্ডলের লোক সূর্য ওঠার আগেই ত্রাণের ঘোষণা দিয়ে গেছে। সবাই খোলা আকাশের নিচে চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছে কখন আসবে ক্ষুধার রসদ।

এদের এক কোনে জামিলা ভাবলেশহীন উদাস মনে একাকি ঠাঁয় বসে থাকে। যেনো তার ক্ষুধা, তৃষ্ণার কোন অনুভূতিই নাই। এক মনে বুকের মানিক আদুরীর মা ডাকের আশায় আর স্বামীর মুখটা দেখার তৃষ্ণায় জামিলা বুদ হয়ে বসে থাকে। দীদার মুন্সী জমির মণ্ডলের লোক। তার জহুরির চোখ পরে জামিলার দিকে। শোকে পাথর জামিলাকে শোকার্ত মানুষের হাট থেকে নিয়ে আসে নিজের কাছে। আপন স্বার্থে। আশ্বাস দেয় তার মেয়ে ও স্বামীকে খুঁজে দেয়ার। বুঝিয়ে বলে রেলস্টেশনে মানুষের স্রোতে একদিন না একদিন তার স্বামী ও কন্যা রেলগাড়ি থেকে নামবেই। হোটেলের রান্নার কাজের বিনিময়ে যে বেতন পাবে, তাই দিয়ে তারা আবার আপন সংসার গড়ে তুলতে পারবে। জামিলা সেই থেকে এই ঠাঁই ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি। আশায় আশায় তার দিনকাটে, রাত ফুরায়। জামিলার অপেক্ষার শেষ হয়না।

আজও ঘুমের মধ্যে জামিলার বুকভাঙ্গা শোক ছাপিয়ে সকালের প্রথম রেলগাড়ি চারপাশ কাঁপিয়ে স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। জামিলা আকুল তিয়াশে ট্রেনের অগণন মানুষের মাঝে আপনজনের মুখ খুঁজে পেতে অশ্রুস্নাত তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি মেলে ধরে।

সুলতানা রিজিয়া: কবি, লেখক, সংগঠক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নন্দিনী নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করছেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে অনেক নতুন লেখক তৈরি হয়েছে।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/