মানবিক পৃথিবী-প্রথম পর্ব

ফরিদা ইয়াসমিন

ডাঃ প্রশান্তের গত দুই দিন ধরে শুকনা কাশি, আজ হালকা জ্বর। প্রিয়ন্তী হাসপাতালে ডাঃ রায়হানের সাথে কথা বলে-
-রায়হান ভাই আমি প্রিয়ন্তি
-ভাবি, প্রশান্ত কেমন আছে?
-ওর শরীরটা ভালো নেই, সকাল থেকে হালকা জ্বর, কাশিটাও বেশি!
-আপনি চিন্তা করবেন না, আমি এখনই এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাসায় রাখা ঠিক হবে না।
-ঠিক আছে ভাই, যেভাবে ভালো হয় তাই করেন।
প্রিয়ন্তির ছোট ভাই পবন রুমে এসে ওর সাথে কথা বলে-আপু তোমার এ রুমে থাকাটা ঠিক না।
-কেন রে, কোথায় যাবো?
-তুমি বুঝতে পারছো ভাইয়ার সমস্যাটা?
-পবন, আমাকে নিয়ে ভাবিসনে। এখনই এ্যাম্বুলেন্স আসবে হাসপাতাল থেকে। টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে হবে, হাতে বেশি সময়ও নেই। তুই বরং এ রুম থেকে দূরে থাক।
-আপু-একই ভয় তো তোমাকে নিয়েও, তাই না?
-ভয় থাকলেও আমি তো আমার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবো না!
-কাছে না গিয়ে দূর থেকেও তো দায়িত্ব পালন করা যায়। তাছাড়া তুমি নিজেও যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো তাহলে ভাইয়ার পাশে কে থাকবে বলো?
-আমাকে নিয়ে চিন্তা করিসনে, আমার কিছু হবে না বরং তুই সাবধানে থাক ভাই। আর শোন-প্রশান্তের সাথে আমিও হাসপাতালে যাবো, তুই বাসায় একা থাকবি। বাসায় বাজার আছে, রান্না করে খেতে হবে।
-আপু, আমাকে নিয়ে ভেবো না, তোমাকে তো হাসপাতালে যেতে দেবে না।
-সে আমি দেখবো।
পবনের সাথে কথা শেষ না হতেই এ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। প্রশান্তকে নিয়ে প্রিয়ন্তি বের হয়ে যেতে যেতে বলে- ভাই, মন খারাপ করিসনে, এখন মন খারাপের সময় নয়, শক্তভাবে আমার পাশে তোকেই থাকতে হবে। চাবিটা রাখ, ঘরে সব আছে। ফ্রিজের রান্না করা খাবার দুই একদিন যাবে, শুকনো খাবারও আছে। ম্যানেজ করে চলিস ভাই। বাবা-মাকে কিছু বলিসনে, ফোন দিলে বলিস আমি একটু ব্যস্ত আছি পরে কথা বলবো। আসি, ভালো থাকিস।
হাসপাতালে ডাঃ রায়হান আগে থেকেই ওদের অপেক্ষায় ছিল। যাওয়ার সাথে সাথে প্রশান্তকে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় স্যাম্পল সংগ্রহ করা সবই যথাসময়ে সম্পন্ন হয়। হাসপাতালে ভর্তির পর শুরু হয় নতুন ঝামেলা। হাসপাতালের নিয়ম এবং বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষ প্রিয়ন্তিকে কিছুতেই হাসপাতালে থাকতে দেবে না। কিন্তু প্রিয়ন্তিও নাছোড় বান্দা, সে প্রশান্তকে একা রেখে কিছুতেই বাসায় যাবে না। ডাঃ রায়হান প্রশান্তের বাল্যবন্ধু। প্রশান্ত ও রায়হান প্রাইমারি থেকে এমবিবিএস পর্যন্ত একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছে। বন্ধু মহলে তাদেরকে মানিকজোড় হিসেবেই সবাই জানে। তারপরও প্রিয়ন্তি কিছুতেই ডাঃ রায়হানকে রাজি করাতে পারলো না। অগত্যা প্রশান্তের শরণাপন্ন হয়। দুরত্ব বজায়ে রেখে প্রশান্তের সাথে আলোচনা করে।
প্রশান্ত উল্টো বেঁকে বসে- প্রিয়ন্তি, প্লিজ এখান থেকে যাও, বোঝার চেষ্টা করো, রিপোর্টগুলো আসতে দাও। তোমার উচিত এই মূহুর্তে রায়হানকে সহযোগিতা করা। দোস্ত, প্রিয়ন্তী পাগল হয়ে গেছে, ওকে এখান থেকে নিয়ে যা। ও যদি আমাদের কথা না শুনে  তাহলে বলে দিলাম, আমি কিন্তু চিকিৎসাই নেবো না।
প্রিয়ন্তি মানসিকভাবে বড় একটা ধাক্কা খেলো কারণ প্রশান্তকে সে অনেক কাছ থেকে বোঝে, সে একবার কিছু বলে ফেললে সেখান থেকে তাকে সরানো খুব কঠিন। প্রশান্ত খুব অগোছালো একজন মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় পুরোটাই সে প্রিয়ন্তির উপর নির্ভরশীল। আর এখানেই প্রিয়ন্তির ভয়। এই সময়ে অনিয়ম করলে ওকে বাঁচানোই যাবে না। এমন একটা জটিল পরিস্থিতির জন্য প্রিয়ন্তি মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। মনটাকে শক্ত করে রায়হানের সাথে কথা বলে-রায়হান ভাই, আপনি তো প্রশান্তকে জানেন ও কতটা অগোছালো। আমি না হয় ওর কাছে যাব না কিন্তু ওর কাছাকাছি থাকার কী কোন ব্যবস্থা করা যায় না, যাতে মাঝে মাঝে ওর ক্যাবিনের দরজায় দাড়িয়ে ওর সাথে কথা বলতে পারি, দেখবাল করতে পারি। এইটুকু সহযোগিতা তো আমি চাইতেই পারি।
– ভাবি, আমি না হয় তা করলাম কিন্তু হাসপাতালে থাকাটাই আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
– ভাই, আপনারা যদি আমাদের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে পারেন আর আমি আমার স্বামীর জন্য এই ঝুঁকিটুকু নিতে পারবো না? আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এই ঝুঁকিটুকু না নিলে প্রশান্তের অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। সব বুঝেও স্ত্রী হিসেবে আমি এটা মেনে নিতে পারি বলেন?
– আমি একটা ব্যবস্থা করতে পারি এক শর্তে।
– আপনার সব শর্ত আমি মেনে নেবো ভাই।
– আপনি আমার রুমেই থাকতে পারবেন। আমার একটা নতুন পিপিই আপনাকে দেবো, দিনে একবার পিপিই পরে প্রশান্তের ক্যাবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখে আসবেন।
– কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না।
– ভাবি, প্রশান্তের ভালোর জন্য আমি সব পারি।
– সে আমি জানি কিন্তু আপনি কোথায় থাকবেন?
– আমাকে নিয়ে ভাববেন না,আমার থাকার সমস্যা হবে না। চলুন আপনাকে রুমে দিয়ে আসি, আপনার বিশ্রাম দরকার।

পরদিন প্রশান্তের রিপোর্ট দেখে প্রিয়ন্তির হার্টবিট বেড়ে যায়। রিপোর্ট নিয়ে যদিও আগে থেকেই তার একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল তারপরও বুকে ব্যথা অনুভব করে। প্রশান্ত আগেই বুঝতে পেরেছিল কী হতে যাচ্ছে।
-আজ থেকে আমার সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, এ যুদ্ধে আমাকে জয়ী হতেই হবে। হে প্রভু, তুমি আমাকে শক্তি দাও, সাহস দাও। আমি যেন এই কঠিন পথ কঠিন মনোবলের সাথে খুব সহজভাবেই পাড়ি দিতে পারি। আমার জীবন প্রদ্বীপ শুরুতেই নিভে গেলে এই অন্ধকার পিচ্ছিল পথ আমি কিভাবে পাড়ি দেবো! এখনও অনেকটা পথ আমাকে অতিক্রম করতে হবে, আমার একার পক্ষে এই লম্বা পথ অতিক্রম করা সম্ভব নয়। হে প্রভু, এই কঠিন শাস্তি তুমি আমাকে দিও না। যে করেই হোক ওর মনোবল চাঙ্গা রাখতেই হবে, আর তার জন্য আমাকে সুস্থ থাকতে হবে, শক্ত থাকতে হবে। এক সাথেই আমরা বাসায় ফিরবো, ইনশাল্লাহ্।

প্রিয়ন্তি গোসল করে বিশ্রাম নেয়। ঘুমানোর চেষ্টা করে, না কিছুতেই ঘুম আসছে না। যতসব এলোমেলো চিন্তা মাথায় ভর করছে। চোখ বন্ধ করেই ভাবতে থাকে-
এই তো সেদিনের কথা বই মেলায় ধ্রুব প্রশান্তের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। দুই জনের নামের মিল দেখে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ধ্রুব কী একটা কাজে তাড়াতাড়ি চলে গেল, যার জন্য সেদিন প্রশান্তের সাথে খুব একটা কথা হয়নি কিন্তু এর মাঝেই প্রশান্ত আমার মোবাইল নম্বর নিয়ে নেয়। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আর প্রশান্ত ঢাকা মেডিকেলের ফাইনাল ইয়ারের।
বাসায় এসে কেন যেন অস্থির  লাগে । ঠিক বুঝতে পারছিলাম না অস্থিরতার কারন। প্রশান্ত খুব সুন্দর করে কথা বলে। অসাধারণ বাচনভঙ্গী। ওর সাথে কথা বলতে আমার নিজের খুব লজ্জা লাগছিলো। অল্প আলাপচারিতায় বুঝতে পেরেছিলাম প্রশান্ত স্মার্ট, রুচিশীল ও সাহিত্যমনা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। মোবাইলের রিং এ ঘুম ভাঙ্গে। এত ভোরবেলায় অপরিচিত নম্বর থেকে কে ফোন দিল! ভাবতে ভাবতেই লাইন কেটে যায়।একটু পর একই নম্বর থেকে আবার কল। কল রিসিভ করতেই অন্য প্রান্ত থেকে অভিযোগ-
-কী,কল ধরছেন না কেন?
এত ভরাট মিষ্টি গলা, কী এক মাদকতা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। প্রশান্ত কথা বলতেই থাকে- কী হলো চুপ করে আছেন যে? হ্যালো, আমার কথা শুনতে পারছেন?
এতক্ষণে আমার ঘোর কাটে-জ্বী, প্রশান্ত শুনতে পারছি।
-তাহলে চুপ করে আছেন যে? এত ভোরে কল করে বিরক্ত করলাম?
আমি কী করে বোঝাব এই কলের জন্য প্রশান্তি সারারাত অপেক্ষা করতে পারে। কিছু বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলি
-আরে না, আমি অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠি। এবার বলেন কেমন আছেন?
-ভালো, তবে গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি, তাই ভাবলাম আপনার সাথে কথা বলি।
চলবে…

লেখক পরিচিতি: ফরিদা ইয়াসমিনের জন্ম ১৪ মার্চ ১৯৬১ খ্রিস্টা‌ব্দে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলাধীন মেন্দারবেড় গ্রামে। বাবা-মার চতুর্থ সন্তান। বাবা মোঃ ইয়াকুব আলী পেশায় শিক্ষক। মা রোকেয়া বেগম গৃহিণী। তিনি ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য় থেকে বাংলায় সম্মানসহ স্নাত‌কোত্তর ক‌রেছেন। প্রথ‌মে এক‌টি কলেজে শিক্ষকতা পেশা দিয়ে কর্মজীবন শুরু ক‌রেন। এরপ‌র পরামর্শক হিসেবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে দীর্ঘ‌দিন কাজ ক‌রেছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত গল্প ও কবিতা লিখে থাকেন।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/