মহিলা পরিষদের মুক্তিযুদ্ধ ও নারী বিষয়ক অনলাইন আলোচনা সভা

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে গত বুধবার ( ২৩ ডিসেম্বর) বিকালে ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নারী’ বিষয়ক অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. ফওজিয়া মোসলেম।  সভার শুরুতে সংগীত পরিবেশন করেন তরুণ সংগীত শিল্পী মৃদুলা সমদ্দার।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সহস্র বছরের অর্জন। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে পাই। এই মুক্তিযুদ্ধে গ্রামীণ বাংলার অগণিত নারীরা সাহস আর দৃঢ়চেতা মনোবল নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, চিকিৎসা –খাদ্য সহযোগিতা করে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে, গেরিলা বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে সহায়তা করেছে। তাদের এই গৌরবগাঁথার ইতিহাস এখনও অনেকের অজানা। তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য এই সকল নারীদের এই গৌরবগাঁথার ইতিহাসকে সংকলিত করার আহ্বান জানান। একই সাথে এই সংকলন আপামর জনগণের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে, নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে সহায়ক বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।   

রেকর্ডকৃত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানম বলেন আমাদের জন্মই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। নারীর মমতাময়ী, ঘরমুখী এমন ধারণার বদল হয় নারীর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও নারী আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা। নারীর বীরত্ব, সাহসিকতা,অধিকারের পরিচয় পাই মুক্তিযুদ্ধের  মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ এখনো চলছে, এটা চলতেই থাকবে। তিনি সংগঠনের সকল কর্মকর্তাদের গণনারীর মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার বিষয়টি জানতে যুক্ত করার আহ্বান জানান।

সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, উদ্যোক্তা,  নারী নেত্রী ও সমাজ সেবক বেগম মুশতারী শফী । তিনি  বলেন-আমাদের প্রথম প্রেরণা ছিলো প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তার জীবনী এক বৈপ্লবিক চেতনার জন্ম দেয়। তার অনুসারীদের নারী আন্দোলনে ভূমিকা ছিলো, মাস্টার দা সূর্যসেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্রভাগে ছিলেন। চট্টগ্রামের নারীদের আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারীদের অবদান শিরোনামে লেখা বইটির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন চট্টগ্রামের কথা লিখলেই যেন মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র মানুষের কথা বলা হয়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, নারী প্রথম বেরিয়ে এসেছিলো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। তার বহুমুখী ভুমিকাও ছিলো।  বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ২০০৯ থেকে গবেষণার কাজ করি। কাজ করতে যেয়ে তাদের আত্মপরিচয়ের সংকট দেখে পরে ১৫০ জনের জন্য আর্থিক সহযোগিতা এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাই। ১৩২ জন স্বীকৃতি পেয়েছে। এর জন্য তিনি সরকার ও সহযোগী সংগঠনকে আন্তরিক ধন্য বাদ জানান।

একুশে পদকপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধা ডালিয়া নওশিন বলেন, ২৫ শে মার্চ জনগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে আমরা এই দেশ পেতাম না। গণসংগীতের উদ্দেশ্য ছিলো পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের আমাদের সম্পর্কে জানানো। এর মাঝে আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ডাকা হয়। আামদের রেকর্ডিং হয়,এই গানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধদের উদ্বুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতার ৫০ বছর হল কিন্তু যে চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো তা এখনো এতটা বজায় আছে বলতে পারিনা।

বরিশালের  বেগম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, কবি ও গবেষক আসমা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও নারী বিষয়টি প্রতিদিন চর্চার। এখানে নারীরা যে  স্বশস্ত্র যুদ্ধ করেছে তা অনেকেই জানেনা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের কথা বলতে গিয়ে ভাগীরথীর অসম সাহসিকতার অবদানের কথা, তাকে পৈশাচিকভাবে হত্যার কথা বলেন, এছাড়াও সুধারানী, আলমতাজ বেগমের কথা বলেন। শিরিন বানু মিতিল ও বেগম ওসমান এর অবদানের কথা তুলে ধরেন। বীরাঙ্গনাদের আজ মর্যাদা দেয়া হয়েছে তবে তাদের যুদ্ধের পর অনেক বিড়ম্বনা সহ্য করেছেন। তাদের ত্যাগকে উপলব্ধি করে প্রকৃত সম্মান দিতে অনেক সময় লেগেছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রুনু  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, সার্বিক অবস্থা দেখে সকলকে সাথে পাঁয়ে হেটে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। ভারতে পৌছানোর পর মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিই। যুদ্ধের জন্য ভীতি কাজ করেছে তবুও সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছি। পাশপাশি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা-সাহায্য করেছি। গত এক দশকে নারী পুরুষের সমান অবদানে দেশ এগিয়েছে। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে নারীর তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো লড়াই করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের সঠিক তথ্য চিত্র এখনো লিপিবদ্ধ হয়নি।

সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয় ৭১ এর আগে থেকেই। নানা আন্দোলনের আবহের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হতে থাকে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেন। যদি কোনো আন্দোলনে নারীরা যুক্ত না হয় তবে তা পূর্ণতা পায়না। অথচ নারীদের অবদানের স্বীকৃতি নেই। মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে অনেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ করেছেন এগুলোকে সংগঠিত করতে হবে। সেজন্য নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে নতুন প্রজন্মের গবেষকদের সহযোগিতা করার আহবান জানান। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন করার দাবিতে পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয় তবে তা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি। এটি নারী আন্দোলনের একটা ব্যর্থতা। তাদের মুলধারায় আমরা আনতে পারিনি। অনেক অর্জন নারীদের হয়েছে তবে এখনো দুস্তর বাধা আছে নারীদের জীবনে এবং বাংলাদেশের পথে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল যাত্রার উপরে বাধা আছে, এজন্য ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। কেননা সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ঘটেছে প্রবলভাবে, একে নির্মূল করার জন্য সরকারকে এবং জনগণকে নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।  

উক্ত আলোচনাসভায়  সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, ও আলোচকগণ উপস্থিত ছিলেন। সভা সঞ্চালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক  উম্মে সালমা বেগম।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/