বাংলা ভাষা আন্দোলনে ঢাকাইয়া ছাত্রীদের অংশগ্রহণ

মোসম্মাৎ হুরবানু

হোমায়রা হুমা

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী বাংগালী বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান সংবিধান সভায় 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' দাবি উত্থাপন শুরু করেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে চকবাজার ছিল ব্যবসার মূল কেন্দ্র। এমন কি আন্দোলনের গতিপথও ছিল জিঞ্জিরা থেকে শুরু করে মিটফোর্ড, চকবাজার, নাজিমুদ্দিন রোড,নবাবপুর। এ সময়ে মেয়েদের জন্য শহরের ওপর স্বনামধন্য একটিই স্কুল ছিল নাম-মুসলিম গার্লস স্কুল। নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত এ স্কুলে আশেপাশের সম্ভ্রান্ত ঢাকাইয়া মুসলিম পরিবারের মেয়েরা এ পড়াশোনা করতন। ভীষণ কড়া নজরদারির মধ্যেও এ স্কুলের ছাত্রীদের মনে বাংলাভাষার প্রতি অন্তর্নিহিত আকর্ষন ছিল।

এ এলাকার ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা হিসাব টালিখাতা বাংলায়, বৈশাখি হালখাতা, ফাগুন,পৌষকে উৎসবের আমেজে পালন করতেন। এই উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল ব্যবসাপাতিতে বাংলা ব্যবহার। ওই সময়ে ব্যবসায়ীসহ সকলের মনে মূল প্রীতিভাজন স্নেহ ভালবাসার একমাত্র কারণ ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

বাংলা ভাষার প্রতি এই দরদ থেকেই নিশ্চয়ই মুসলিম গালর্স স্কুলের ছাত্রীরা উৎসাহিত হয়ে স্কুলের ছাদে উঠে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত শ্লোগানে মুখোরিত হয়ে উঠতেন । হুরবানু আপার কাছে জেনেছি যে, তিনি ও তার অন্যান্য ক্লাসের ছাত্রীরা এই দুঃসাহসী কাজে নিবেদিত হয়েছিলেন আনন্দচিত্তে। হুরবানু ১৯৪৮ সালে মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন।

তখন বঙ্গবন্ধু ঢাকা জেলে। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতে তুলনাহীন বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষায়,–" আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভেতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল,তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরে মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে শ্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করতো। মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না।

‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই ',
'বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই', 'পুলিশি জুলুম চলবে না'–

নানা ধরণের শ্লোগান দিত। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি ডেকে বল্লাম,হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেড়িয়ে এসেছে,আর বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা না করে পারবে না।’

সুপা সাদিয়ার বায়ান্নর ৫২ নারী পুস্তকে ঘটনার উল্লেখ পাই যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে ড. শাফিয়া খাতুন ও ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সারা তৈফুরের ওপর দায়িত্ব ছিল মুসলিম গালর্স স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করে নিয়ে উক্ত সমাবেশে নিয়ে যাওয়ার। সে কাজটি সহজ ছিল না। হুরবানু আপা জানালেন যে,তবু হুরবানুসহ অন্যান্য ছাত্রীরা, সালমা বেগম, জোহরা বেগম, মেহেরুন্নেসা, রোকাইয়া খাতুন, প্রমুখ অদম্য ছাত্রীরা তাদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে এসে জমা হয়েছিলেন, তারা সবার সাথে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।

সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ও বাংলা ভাষার জন্য পুলিশের ভয়কে দুরে ঠেলে স্কুলের ছাদে উঠে শ্লোগানে মুখরিত হওয়া এবং বাংলা ভাষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলে অংশ গ্রহন করে ইতিহাসে নিজ আসনকে নিশ্চিত করে নিয়েছেন মুসলিন গার্লস স্কুলের ঢাকাইয়া ছাত্রীরা, নিজেদের অজান্তেই। আজ ভাষা দিবসে মুসলিন গার্লস স্কুলের সাহসীকা সেই ছাত্রীদের জানাই অভিবাদন।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/