মন আনচান করা দিনের খেয়া

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

দিন দিন মন খুব বিষণ্ণ হয়ে থাকছে! বয়স বাড়লে এমনিতেই মন বিষণ্ণ হয়ে থাকে; মনে পড়ে পুরাতন সব কথা বিশেষ করে ছোটোবেলার কথা। প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পর যেমন বসে থাকি তেমনি খাওয়াদাওয়ার পরে বসে আছি। তখন মনে পড়লো, পাবনা যে বাসাতে থাকতাম সেই বাসার পেছনে মেথরপট্টির মেথরসর্দার ভকাইয়ার কথা। সেই ষাটের দশকে আমাদের ছোটোবেলাতে ল্যাট্রিন ছিল ইটের গাঁথনি দেওয়া, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতো। নিচে থাকতো চাড়ি অর্থাৎ মাটির গামলা। সেই চাড়ির ময়লা প্রতিদিন নিয়ে যেতো মেথরপট্টির মেথরেরা। এখন অবশ্য তা নেই; এখন স্যানিটারি ল্যাট্রিন; মেথর বা অস্পৃশ্য ওদের আর স্পৃশ্যজনদের প্রয়োজন নেই।

সেই ষাটের দশকে জেলা শহরগুলোতে মেথরপট্টির ওরা ছিল অস্পৃশ্য, সাধারণের ছোঁয়াছুয়ি থেকে দূরে থাকতে হতো ওদের, অনেকে ঘৃণা করতো ওদের অথচ ওরাই নোংরা-আবর্জনা  পরিষ্কার করে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন দুর্গন্ধমুক্ত রাখতো! ওদের অস্পৃশ্য ভাবা হতো বলেই ওরা মদ খেতো; ঐ মদ যা তা মদ নয় শুনেছি বাংলামদ, তাড়ি খেতো; সব ভুলে থাকার জন্য ওরা খেতো এই মদ। হল্লা করতো কাঁদতো। আমি যে ঘরটাতে থাকতাম সেই ঘরের পেছনে ছিল একটা মাঠ (এখন নেই) ঐ মাঠে সন্ধ্যা হলেই বসতো ওদের আসর! খুব কষ্ট পেতাম! কিন্তু কষ্ট পেলেও কিছুই করার ছিল না আমার। অনেকেই বলতো আদিখ্যেতা! সেসময় গ্রামে অবশ্য ঐরকম ল্যাট্রিন ছিল না। গ্রামে গর্ত করে পাটাতন দেওয়া থাকতো, ঐ গর্ত যখন ময়লাতে ভরে যেতো তখন সেটি বন্ধ করে আবার অন্য স্থানে আর একটি ল্যাট্রিন বানানো হতো। গ্রামের অনেকে তখন মাঠেঘাটে তাদের প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সেরে নিতো। এখন গ্রামেও স্যানিটারি ল্যাট্রিন হয়েছে। মানুষ এগিয়েছে উন্নত হয়েছে সভ্যতা। বর্তমান এগিয়েছে অনেকটা পথ। চাঁদ-মঙ্গল সবখানে পা রেখেছে মানুষ। সূর্যে গরম বেশি না হলে হয়তো বা সেখানেও যেতে চাইতো মানুষ। আমরা সূর্য থেকে কত্ত কত্ত দূরে থাকি তবুও পুড়ে কালো হয়ে যায় শরীরের চামড়া আর সূর্যে গিয়ে বাস করা! নাহ্! চিন্তা করা যায় না! সূর্যে যাওয়ার কথা  চিন্তার বাইরে হলেও একদিন সেখানে যাওয়া হতেও তো পারে!  

যাকগে ঐ সব বিজ্ঞানীদের বিদগ্ধ আলোচনা; বর্তমানে বিশ্বে একবছরের অধিককাল ধরে চলছে নভেল করোনা অতিমারি। এই অতিমারিতে কে কোথায় কখন যায় তার কিছুই ঠিক নেই তারপরে আবার অন্য কোথাও যাওয়া। তবে এটি ঠিক যে মানুষ এখন এই পৃথিবীতে থাকতে ভয় পাচ্ছে বড়ো নাজুক পরিস্থিতিতে আজ মানবসমাজ! এই অনিত্য সংসারে মানবসমাজের চারপাশে ঘিরে ফেলেছে নভেল করোনা নামের একটি ছোট্ট অণুজীব মারণকণা। মানুষ এখন কী করবে দিশে পাচ্ছে না। এর মধ্যে হয়েছে রোজা তারপর ঈদ। মুসলিম উম্মাহ্র প্রধান প্রথম ধর্মীয় উৎসব: ঈদুল ফিতর। হিজরি সন এবং বঙ্গাব্দের শুরু এবার একই দিনে। চলছে লকডাউন। মানুষ চলছে ঢাকা ছেড়ে জেলা শহরে। কোভিড ১৯ বা নভেল করোনা এমন এক ভাইরাসসৃষ্ট রোগ যে এটা একজনের নিঃশ্বাস থেকে, ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে সংক্রমণ। দফায় দফায় বাড়ছে লকডাউনের সীমা। কিন্তু আমরা মানুষ; মানুষের চৈতন্য হতে একটু সময় বেশি লাগে! আর বাংলাদেশের মানুষ ‘মন যা বলে তাই করতে চাই। কিংবা ‘উঠলো বাই, তয় কটক যাই।’ সেইজন্য ঈদ এসেছে; ঈদ পরবে বাড়ি যেতেই হবে, সবসময় তো যাই! নাড়ি পোঁতা আছে যেখানে, সেখানে যাওয়া ঝড়-জল-মহামারী-অতিমারী কোন কিছুই আটকাতে পারে না আমাদের! কে বলেছে পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে গেছে! বন্ধন যদি না থাকতো তাহলে কি এই অতিমারীর দুঃসময়ে মানুষ ছুটেতো গ্রামে স্বজন প্রিয়জন পরিচিত মানুষের সঙ্গে ঈদের আনন্দটুকু নিতে! পারিবারিক বন্ধন থাক না থাক মানুষ ছুটেছে কিন্তু সকলে স্বজন-প্রিয়জনের কাছে; অনেকে পৌঁছাতে পেরেছে, অনেকে পারেনি! ফেরি থেকে নামতে গিয়ে পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছে, বাল্কহেড এর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গিয়ে স্পীডবোট মারা গেছে মানুষ।

শুধু ঈদে বাড়ি যাওয়াই নয়, আছে পথদুর্ঘটনা, ক্যামিকেল বিস্ফোরণে মৃত্যু। হাসপাতালে আগুন, বেড খালি নেই, অক্সিজেন সংকট।  সারারাত্রি লাইন দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে হয়! অনিত্যের বাজারে মানুষের একমাত্র সৎসঙ্গী হলো মৃত্যু আর ঈশ্বর। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে মানুষ তুমি কার? নিজের না অন্যের? না ঈশ্বরের? কার? মানুষের মাঝে ষড়রিপু বিদ্যমান। মানুষ বেশিরভাগ সময় অন্যকে ডিঙিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য এক মানুষকে অবহেলা করে। এই করোনাকালে মানুষ কষ্টে আছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবাদিক দিয়েই সাহাস্য সহযোগিতা করছে তবুও এরমধ্যে মিয়ানমারে গৃহবুদ্ধ, ইসরায়েল আক্রমণে ফিলিস্তিন কাঁদছে, বিধ্বস্ত গাজা; মিয়ানমার-ফিলিস্তিনে মারা গিয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু; বাস্তুহারা হয়েছে মানুষ। স্বদেশেও মারামারি লাঠালাঠি মৃত মানুষের সারি। সম্প্রতি খবর নতুন মাদক আবিষ্কার। আমাদের বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থীদের মেধা শুভকাজে ব্যয় করলে দেশ-দশের উন্নতি বই অবনতি হতো না নিশ্চয়। আমাদের স্বাধীন দেশের উত্তর প্রজন্মকে সঠিকপথে চালিত করতে না পারার এই ব্যর্থতার দায় কার?   
এমনিতেই করোনাকাল এরপরে এসেছে ঘূর্ণিঝড়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বসবাসকারীদের ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে হয় সবসময়েই এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারের ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানী এবং বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ভারতে। বাংলাদেশে পাশ কাটিয়ে গেছে তবুও ভেসে গেছে উপকূলীয় অঞ্চল। পূর্ণিমাতে সাগর জোয়ারে ভাসায় উপকূল; ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে এবং পূর্ণিমার জোয়ারে ভেঙেছে বাঁধ, ভেসেছে মানুষ।

প্রকৃতির রোষ ঠেকাতে পারে না মানুষ। এই করোনা সময়ে নারী-পুরুষ-শিশু সবারই বেড়েছে মানসিক যন্ত্রণা। পারিবারিক সামাজিক যন্ত্রণা-কষ্ট বেড়েছে। চাকুরি হারিয়েছেন অনেকে। পরিবারে বেড়েছে অসন্তোষ; স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন হচ্ছে, স্ত্রীর হাতে স্বামী, বাবা-মায়ের হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে বাবা-মা! বাবা-মা-অভিভাবক কাজে বের হলে একা ছোট্ট শিশু (২/৩/৪/৫ বছর বয়সী) প্রতিবেশি বা নিকট আত্মীয়ের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে। ছিনতাই-হাইজ্যাক বেড়েছে। মানবমূল্যবোধ তলানিতে ঠেকেছে। এরপরে আসছে তৃতীয় ঢেউ। বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানকালে ভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্ট তা খুব ভয়ঙ্কর এবং এটি এসেছে ভারত থেকে। যেখান থেকেই আসুক কষ্ট তো পাচ্ছে মানুষ। পুরো বিশ্ব এখন করোনাভাইরাসের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে আছে। এর চাপে কষ্ট পাচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু। তবে সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছে নারী ও শিশু। কারণ বিপর্যয়ে কষ্ট বাড়ে দুর্বল মানুষের; আর নারী ও শিশু হলো দুর্বল। শুধু করোনাকাল নয় যে কোন বিপর্যয় তা হোক পারিবারিক, হোক সামাজিক, হোক রাষ্ট্রীয় এতে যন্ত্রণা-কষ্ট বাড়ে নারীর কারণ নারীর মন নরম এবং সামাজিক বা পারিবারিকভাবে পরিবারের সদস্যদের দেখভাল নারীকেই করতে হয়। তাছাড়া নারীর স্বভাবই হলো ভার কাঁধে নেওয়া এবং কোন কিছুতেই  সে দায়িত্ব এড়িয়ে থাকতে পারে না। তাই ঝড়-জল-টর্নেডো-জলোচ্ছ্বাস-মহামারি-অতিমারি সবকিছুতেই পরিবারের বোঝা টানতে হয় নারীকেই। এই করোনাকালেও ব্যতিক্রম নেই তার।

তবুও এতোকিছু করার পরেও নারীর কষ্টের শেষ নেই। নারীর প্রতি বাইরে যেমন সহিংসতা বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ঘরে। করোনাকালে পারিবারিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার ফলে পরিবারের সদস্যদের একে-অপরের সঙ্গে হচ্ছে সম্পর্কের অবনতি। অথচ নারী-পুরুষ যখন কাজ করে তখন আন্তরিকভাবেই করে। নারীকে অফিস-বাড়ি দুটোই সামলাতে হয় এবং একজন নারী অফিসে বাড়িতে সকল কাজের ব্যাপারেই আন্তরিক। আন্তরিক পুরুষও তবে অফিস ও বাড়ি মিলিয়ে কর্মঘণ্টা পুরুষের তুলনায় নারী অনেক বেশি। অফিসের কাজ একই থাকলেও বাড়িতে নারী পুরুষের তুলনায় কাজ করে বেশি। আমাদের এই দেশে কোন কারণে পরিবারের আয় কমে গেলে স্কুল ছাড়তে হয় কন্যাশিশুকেই। কারণ অবশ্যই আছে; সামাজিকভাবে বাবার অবর্তমানে পুত্র হয়ে ওঠে পরিবারের অভিভাবক এবং কন্যা যায় অন্যের বাড়িতে। তার নিজের বাড়ি নেই, হয়ও না কখনও (অনেকের মতে শ্বশুর বাড়িই নিজেদের বাড়ি)। মেয়েদের পক্ষে অনেক আইন পাশ হয়েছে তবুও আমরা সেই আদিস্থান থেকে নড়তে পারছি না কারণ তলিয়ে আছি অসচেতনা এবং দারিদ্রের অন্ধকারে! দারিদ্র বড়ো বাধা অগ্রগতির জন্য; দরিদ্র বাবা ভয়ে ভয়ে থাকে কখন কী হয়ে যায়!    

একজন মানুষ তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এটা ঠিক নয়। মানুষের এগিয়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মেই হয় এবং হবে। এর ব্যতিক্রম প্রকৃতি সহ্য করে না। যে বা যারা এই ব্যতিক্রম ঘটায় বা ঘটাতে চায় তাকে বা তাদের ফল ভোগ করতেই হয়। হয়তো সাময়িকভাবে তার উত্থান হয় ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে সব বিফলে যায়। কালের খাতা থেকে মুছে যায় নাম। তাই যা কিছু মানুষকে করতে হবে যেন সব সময় ভালো কাজ বা কর্ম হয়। ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’- এই আনন্দযজ্ঞ সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না-অভিমান ভালোবাসা-মান-অপমান সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিলেই তবে আনন্দযজ্ঞে সামিল হতে পারা যায়। তাই দুঃখ কষ্টকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে পথচলা, নিষ্ঠুরতা অবহেলাকে পাশ কাটিয়ে হাসিমুখে থাকা একজন মানুষের লক্ষ্য। মানুষকে ভালো রাখা, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের মঙ্গল কামনা করাই মানবজন্মের গতির উপাদান। ভালোবাসার অমল বীণা হাতে একজন মানুষ যদি পথ  চলে তাহলে ঈশ্বরের আশির্বাদ স্পর্শ করবে তাকে। রাগ-গোস্সা সবসময় নীচু করে দেয় মানুষকে। উত্তেজনা মানুষের ভালোত্বকে নষ্ট করে দেয়। যে মানুষ সংযমী হয় অর্থাৎ সংবরণ করতে পারে রাগ, উত্তেজনা সেই হবে জীবনের এই আনন্দযজ্ঞের সম্মানিত নিমন্ত্রিত অতিথি।

আফরোজা অদিতি: কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৫টি। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার যার মধ্যে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, কবি কামিনী রায় সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবননান্দ দাশ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটির পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/