নূরহাসনা লতিফের স্মৃতিচারণ ‘আমার বাবা’

নূরহাসনা লতিফ

আমার বাবা

আমার বাবার নাম মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন খাঁন । তার পৈত্রিক নিবাস   রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায়। গ্রামের নাম গঙ্গারামপুর তার পূর্বপুরুষ আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ছিলেন। অবশ্য আমার বাবা সরকারি চাকুরি করতেন। বাবার চাকরির কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়  আমাদের থাকতে হয়েছে।।সবশেষে ছিলাম রংপুরে। রংপুর শহরের কামাল কাছনায় আব্বা বাড়ি বানিয়েছেন।  আমার বর্তমান পৈত্রিক নিবাস এটাই। আমি তার  একমাত্র সন্তান। আব্বা গোছানো পরিপাটি একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ। সৎ জীবন ছিল তার কাম্য। সুন্দর চেহারার একজন মানুষ। তাকে দেখলে শ্রদ্ধা  হতো। ধর্মীয় ব্যাপারে গোঁড়া ছিলেননা। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অগ্রগামী । আমাকে সবসময় বলতেন্‌,মা তোমাকে এম,এপাশ করতে হবে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এম এ পরীক্ষা দিতে পারলামনা চলে যেতে হলো পাকিস্তানে তখন আব্বা মনে কষ্ট পেলেন।  মনে  মনে ভাবলেন আমার মেয়ের আর এম এ পাশ হলোন।

তাই স্বাধীন বাংলাদেশে এসে আমার প্রথম চিন্তা ছিল কীভাবে মাস্টার্স পরীক্ষা দেব। লতিফের কর্মস্থল ঢাকায় এলাম। আল্লাহ আমাকে সুযোগ দিলেন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  ভর্তির। নতুন করে একবছর পড়াশুনা করে এম এ পরীক্ষা দিলাম। তারপর এম এড করেছি। ইচ্ছে ছিল পিএইচ ডি করার কিন্তু নানা কারণে পারিনি। তবুও আমার মনে শান্তি আব্বার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। ছোটবেলায় যখন  লিখতে শুরু করি ভয় ছিল মনে যদি আব্বা কিছু বলে। বরংআব্বা বললেন, দৈনিক আজাদে পাঠিয়ে দাও ছোটদের আসরে। বাসায় তখন দৈনিক আজাদ নেয়া হতো। আমিও একটা উপায় যেনো পেলাম। একসময় আজাদের নিয়মিত লেখক হলাম। আমার  দ্বিতীয় উপন্যাস—একদিগন্তে দৃষ্টি—আব্বাকে উ ৎসর্গ করেছিলাম। উনি এ বই বালিশের নিচে রাখতেন। দেখাতেন সবাইকে – ‘এ বই আমার মেয়ে লিখেছে’।

আমার পরীক্ষার সময়ের কথা খুব মনে পড়ে। পড়ার জন্য অনেক সময় রাত জাগতাম। আব্বাও জেগে থাকতেন আমার সাথে। ফ্লাক্সে রাখা গরম পানি দিয়ে আমাকে ওভাল্টিন, চা বানিয়ে দিতেন। পড়তে পড়তে ঘুম লাগলে বলতেন-‘একটু  হেঁটে হেঁটে পড় মা। ঘুম চলে যাবে।’অনেক ভোরে ওঠার হলে আব্বা আমাকে জাগিয়ে দিতেন সময় মতো। মা আগে মারা গেলেন। বাবা কোথাও গেলেননা। থাকলেন সেই বাড়িতে। আমি ঢাকায় থাকতে বলেছিলাম আমাদের সাথে। তিনি বললেন-‘আমার চারপাশে সব আপনজনদের সাথে মিলেই আমি থাকবো। তাছাড়াআমাদের পাড়ার মসজিদে আমি সব সময়  নামাজ পড়ি। আমাকে মসজিদের সেক্রেটারী বানিয়েছে জনগন এ দায়িত্ব ছেড়ে কোথায় যাব ‘

তার মৃত্যুটাও এক আশ্চর্য ঘটনা। কিছুক্ষনের মধ্যে তার মৃত্যু হতে যাচ্ছে সেটা বলতে পেরেছিলেন। বাসায় কেউ ছিলনা। বুয়াকে বললেন, তুমি আশপাশের লোকদের ডেকে আনো আমি মারা যাচ্ছি। রাত ১০টা তখন, পাশের লোকদের ডেকে আনে বুয়া। কয়েক মিনিটের মধ্যে উনি মারা যান। তার মৃত্যু দিবস ৩ মার্চ।

নূরহাসনা লতিফ: কবি ও লেখক। তার প্রকাশিত বই এর সংখ্যা ৩২টি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/