এ কেমন অরণ্য যেখানে মিলেমিশে একাকার প্রকৃতি আর নারী!

নারীদের জঙ্গল

অরণ্য যেন এক পুরুষালী শব্দের প্রতিচ্ছবি। এই শব্দটা শুনলেই মনের অগচোরে কিছু প্রচলিত চিত্রকল্প চোখে ভাসে। তলোয়ার কিংবা বন্দুক হাতে ছুটে চলেছে এক দল শক্ত সামর্থ্য ঘোড় সওয়ারি এবং অবশ্যই তারা পুরুষ। ইয়ার দোস্তদের নিয়ে রাতভর মৌজমাস্তি করছেন। তলোয়ার বা বন্দুক দিয়ে হিংস্র বাঘ না হউক নিদেনপক্ষে কিছু নিরীহ হরিণ শিকার করতে পারছে তারা। এরপর আগুনের কুণ্ডে সেগুলো ঝলসে আয়েশ করে ভক্ষণ করছে শিকারি দলটি। কিন্তু পৃথিবীতে এমন একটা জঙ্গল আছে যেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেখানে যেতে পারে কেবল নারী, তাও প্রকৃতির সন্তান হয়ে। তাই বুঝি সেখানে প্রকৃতি আর নারী মিলেমিশে একাকার। তাই এর নাম টোনোটিওয়াটের যার বাংলা করলে দাঁড়ায় নারীদের অরণ্য। অবশ্য টোনোটিওয়াটের আরেক অর্থ ‘ম্যানগ্রোভে স্বাগত’ও হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া রাজ্যে অবস্থিত এটি আদতে একটি ম্যানগ্রোভ জঙ্গল।

পাপুয়ার বাসিন্দাদের পছন্দের খাবার ঝিনুক এবং নানারকম ফলের জোগান দেয় এই অরণ্য। সে সব সংগ্রহ করে আনার কাজও মেয়েরাই করে থাকেন। রাজধানী জয়পুরার ক্যামপাং এনগ্রোসের মাঝামাঝি ওই ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছড়িয়ে আছে প্রায় ৮ হেক্টর এলাকা জুড়ে। এই অরণ্যে পুরুষেরা প্রবেশ করতে পারেন শুধুমাত্র কাঠ সংগ্রহের জন্য। তবে তার আগে তাদের নিশ্চিত হতে হবে সেসময় জঙ্গলে কোনও নারী নেই।

নারীদের জঙ্গল, ছবি-২

নারীদের উপস্থিতিতে ভুল করে যদি কোনও পুরুষ ওই জঙ্গলে প্রবেশ করেন তবে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় উপজাতি আদালতে। এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি আর অর্থদণ্ড গুণতে হয় ওই পুরুষকে। কোনও নারীর উপস্থিতিতে ওই জঙ্গলে প্রবেশ করার জরিমানা নেহাৎ কম নয়, স্থানীয় মুদ্রায় ১০ লাখ রুপাইয়া। যা ভারতীয় মূদ্রায় পাঁচ হাজার টাকার কাছাকাছি। আর বাংলাদেশি মুদ্রায় আরও বেশি।

জঙ্গলে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারীদেরও বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এখানে প্রবেশের সময় নারীদের দেহে কোনও পোশাক থাকতে পারবে না। ওই জঙ্গলে তারা প্রবেশ করে আদিম অবস্থায়। সেখানে তারা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় কিংবা ফল-ফুল সংগ্রহ করে। জলাভূমিতে দল বেঁধে ঝিনুক কুড়ায়। আর এখানে প্রবেশের পরপরই সবাই একসাথে মিলে শপথ নেয়-জঙ্গলে থাকাকালীন কেউ কাউকে ছেড়ে যাবেন না। অবশ্যই দলে বলে এই অরণ্যে প্রবেশ করতে হয় নারীদের। একাকী কারো প্রবেশের নিয়ম নেই।

এইসব নিয়ম কবে থেকে চলে আসছে কেউ জানে না। বহু যুগ ধরে বংশ পরস্পরায় এ নিয়ম চলছে বলে জানান স্থানীয়রা। সেখানকার প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়-এই জঙ্গলের সঙ্গে স্থানীয়দের সখ্যতা সম্ভবত ১৮০৮ সাল থেকে।

সাগরের তীর ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা জঙ্গলের জলাভূমিতে নেমে ঝিনুক সংগ্রহ করে নারীরা। মূলত ঝিনুক সংগ্রহের ধারণা করা হয়-কাদা পানিতে পোশাক নষ্ট হতে পারে ভেবেই চালু হয়েছিল পোশাকবিহীন জঙ্গলে প্রবেশের এ নিয়ম। আর নারীরা উলঙ্গ অবস্থায় এখানে যান বলেই জঙ্গলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পুরুষদের প্রবেশ।

তবে কারণ যাই থাক না কেন এই অরণ্য যে পাপুয়ার নারীদের খুব প্রিয় তা না বললেও চলে। তা তিনি ১৫ বছরের নেলা হাবাবুক বা ৬২’র মারিয়া মেরাউদজ-যিনিই হউন না কেন! এই জঙ্গল তাদের কাছে খোলা আকাশের মতো যেখানে তারা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারেন। পাশপাশি পরস্পরের সঙ্গে নিজেদের সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনার কথা ভাগাভাগি করেন নিঃসঙ্কোচে। তাই তো টোনোটিওয়াটের জঙ্গলে প্রকৃতি আর নারী মিলেমিশে একাকার। এটা তাদের কাছে এক পবিত্র আয়না-যার কাছে নিজেদের মনটাকেও তারা অনাবৃত করতে পারেন আলগোছে।

]

নারীদের জঙ্গল-ছবি ৩

বিদেশি পত্রিকা অবলম্বনে

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/