আফরোজা অদিতির গল্প ‘অবশেষে তহিরন’

আফরোজা অদিতি

অবশেষে তহিরন

কয়েকদিন, গাঁয়ের লোক আর শুনতে পাচ্ছে না একটি কণ্ঠ। যে-কণ্ঠ ডেকে ডেকে ফিরতো তার ছোট সোনামণিকে। যে-কণ্ঠ এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে ঘুরে ডাকতো, ‘সোনামণি, ও সোনামণি কই গেলি বাপ? দুধ যে জুড়ায়ে গেলো সোনা। ও সোনা, তুই কি রাগ কইরে পলায়ে রইছিস? রাগ করে না সোনা বাপ আমার।’

ওই কণ্ঠ আর কারও নয়, তহিরনের। তহিরন এই গ্রামেই থাকে। একটা ঘর আছে। শত ছিদ্র খড়ের ছাপড়া। বৃষ্টিতে পচে গেছে কিছু খড়, কিছু গেছে জোর হাওয়ায়। ঘরে আসবাব বলতে কিছুই নেই। আগাছা-জঙ্গলে ভরে আছে উঠান। ভেঙে পড়েছে হেঁসেল, গোয়ালঘর। শতছিদ্র খড়ের ঘর যে ঘরে থাকে তহিরন সেটিও পড়ো পড়ো। এক বছর এই বাড়িতে হাত পড়েনি। না সারানো-পরানো, না নিকানো-ঝিকানো। কিছুই হয়নি।

তাহরিন থাকে এ বাড়িতে। পাঁচ-পাঁচটি দিন, তহিরন না খেয়ে আছে। পেটে দানা পড়েনি। পানি যেটুকু ছিলো তা গতদিন শেষ হয়েছে। পানি আনতে হবে পাশের গাঁ থেকে, সে শক্তি নেই গায়ে, যেতে পারেনি পুকুরে। জ্বরে তেতে আসে শরীর। বাড়িতে চাপকল ছিলো তাও ভেঙে গেছে।

একদিন তহরিনের সব ছিলো। ঘর ছিলো, বর ছিলো।  ছেলে ছিলো। গোয়ালঘরে ছিলো তরতাজা বলদ আর দুধালো গাই। রোজ সকালে রাতের রান্না করা ভাতের পান্তা খেয়ে বলদ নিয়ে মাঠে যেতো তহিরনের স্বামী, জহির আলী। দুপুরে জহিরের জন্য খাবার নিয়ে ক্ষেতে যেতো তহিরন। প্রায় মাইল খানেক পথ খাবার আর পানি নিয়ে হেঁটে গিয়ে, খাবার খাইয়ে আবার ফিরতো হেঁটে হেঁটে। কোন ক্লান্তি ছিলো না তহিরনের। এই কাজে মনে আনন্দ ছিলো, ছিলো স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, সুখ। শ্যামলা কিশোরী তহিরন, বউ হয়ে এসে ভালোই ছিলো। কিন্তু পারলো না। একবছর পেরোতে না পেরোতেই ভরা বর্ষার পদ্মার মতো খলবলে সুন্দরী হয়ে উঠলো তহিরন। স্বামী, জহিরের চোখের পলক পড়ে না। জহির ভুলভাল সুরে-বেসুরে  গাইতো,“পড়ে না চোখের পলক/ কি তার রূপের ঝলক”। গান হোক বেসুরো তবুও দুজনের মনেই আনন্দ, সুখ উপচে যেতো! কিন্তু জহির ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তহিরনকে দেখে ওরই সঙ্গে চোখের পলক পড়ে না আরও একজনের। সে-জন গাঁয়ের সব চেয়ে ধনী লোক। পরিবার নিয়ে থাকে ঢাকায়। বছরে একবার ফসল তুলতে আসে এই গ্রামে। একদিন গ্রামে এসে ক্ষেতের আইল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁর চোখ পড়ে তহিরনের ওপর। ঢাকার বাবুসাহেবের জমিতেই কাজ করে জহির। সেই বাবুসাহেব, আগে বছরে একবার আসতো, এখন সেই আসা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাসে দু’বার। আবার কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতর!

তহিরনের অস্বস্তি হয়। মাথায় কাপড় টানে, ঘরে যায়, আড়াল থেকে বলে, ‘উনি তো ক্ষ্যাতে, পরে—।’ ওকে কথার বলার সুযোগ দেয় না বাবুসাহেব। বলে, ‘না,না, আমি তো জহিরের কাছে আসি নাই। একটা পান খেতে এসেছি তোমার কাছে।’ তহিরন, পান বানিয়ে দেয়। পান নিতে গিয়ে তহিরনের হাত ধরে বাবুসাহেব।

তহিরন, স্বামীকে বলে এ সব কথা।  কিন্তু জহির ওর কথায় কান দেয় না। বলে, ‘জানিস কতো বড়ো দিল শহরের ওই মানুষটার। আমারে মালোয়েশিয়া পাঠাইবো।’
আকাশ থেকে পড়ে তহিরন। ‘তুমি বিদ্যাশ যাইবা। একলা থাকুম কেমনে? না, না, কোন ফন্দি নাই তো ? এত্তো ভালা মানুষ আছে এই দুনিয়াত! তাছাড়া ওহানে কী কামে যাইবা?’ তহিরনের স্বর কান্নায় জড়িয়ে যায়।
‘রান্ধনের কাম।’
‘রান্ধনের কাম তুমি কি পারবা? তার চায়া আমারে সাথে নিয়া চলো। আমার এ্যাই অবস্থা, আর তুমি চইলা যাইবা।’ কথা বলতে বলতে  স্বামীর বুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে তহিরন। ওকে আদর করে জহির। ‘কাঁদিস না তো তহি। বিদ্যাশ গ্যালে একটু কষ্ট তো হইবোই। কষ্ট না করলে কী টাকা আইবো। তোর কোনো চিন্তা নাই। সব ব্যবস্থা শহরের চাচাই কইরা দিবো।’
‘তুমার  শহরের চাচা, ওই বাবুসাবরে তো আমার ভালা লাগে না।’ তহিরন কাঁদতে কাঁদতে বলে।
জহির আদর করে। বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘শহরের চাচার কাছে তোর জন্যি টাকা পাঠায়া দিবো। আর বিমলার মারে চাচায় পাঠাইছে। ও থাকবো। তর কোন অসুবিধা হইবো না।’ তহিরন কথা বলে না। শুধু কাঁদে। জহির বিরক্ত হয়। ‘থামবি?’

একদিন শহরের চাচার হেফাজতে তহিরনকে রেখে উড়াল দেয় জহির। তহিরনের একা একা লাগে। ভয় পায়। ওর এই সংসারে কেউ নেই। বিয়ের আগে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র বাড়িতে কাজ করতো আর বিনিময়ে ছিলো থাকা, খাওয়া। ওখানে যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু জহির এ বাড়ি ছাড়তে না করেছে। বলেছে, অন্য কোথাও গেলে শহরের চাচা টাকা কোথায় পাঠাবে, কাকে দিবে? চাচা বলেছে এখানেই থাকতে। এসব কথা ভেবে তহিরনের আর কোথাও যাওয়া হয় না। ও ঘরেই থাকে আর ঘরের মেঝেতে থাকে বিমলার মা। বিমলার মাকেও ভালো লাগে না ওর। ভয়ে ভয়ে দিন কাটে তহিরনের। একদিন রাতে দরোজায় টোকার শব্দ পেয়ে চোখ খুলতেই দেখে বুড়ি দরোজা খুলে দিচ্ছে। বুড়িকে ধমক দিতেই বলে,‘বাইরে যাই বুজান।’

সেদিন আর কিছু ঘটে না। কিন্তু তহিরন সাবধান হয়ে যায়। মাছ কাটা বঁটি নিয়ে রাতে ঘুমায়। এদিকে মাস পূরণ হয়ে আসছে। ছয় মাস জহির উড়াল দিয়েছে; এরপর থেকে ওর  কোনো খবর পায় নাই তহিরন। শহরের বাবুসাহেব এখানেই থাকে এখন। নির্বাচন করবে, চেয়ারম্যান হবে। তোড়জোর চলছে। অনেক চ্যালা-চামুন্ডা তাঁর। গ্রামের লোকজন; সবই তার, সবাই হুজুর, হুজুর করে; তোয়াজ তোষামোদ করে; ঘিরে থাকে তাঁকে চ্যালাচামুণ্ডারা সবসময়! এই গ্রামের ভালো করার জন্য বড়ই ব্যস্ত সে। তবুও একদিন তহিরন ঘোমটাতে মুখ ঢেকে তার কাছে গিয়ে জহিরের খবর জানতে চায়। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ শহরের বাবুসাহেব। তারপর কন্ঠে ব্যস্ততা এনে বলে, ‘এসব কথা এখন না, পরে, এখন কাজ করছি যাও, রাতে আসবো তোমার বাড়িতে তখন বলবো।’

তহিরনের কথাগুলো ভালো লাগে না। কিছু বলতে ও পারে না। বাড়ি ফিরে আসে। অজানা এক ভয় বুকের মধ্যে ঘোরফেরা করতে থাকে। শরীরও খারাপ। জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো নিজেও জানে না। হঠাৎ অন্যরকম স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায়। ঘর অন্ধকার। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছিলো, নিভে গিয়েছে কেন? ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসেই বঁটিটা হাতে নিয়ে আন্দাজে কোপ দেয়। লোকটা চলে যায়। উত্তেজনায় রাত ভোর হয়। ভোরে ব্যথা শুরু হয়। বুড়ি, বিমলার মাকে ডেকে ডেকে পায় না।

ছেলে হয় ওর। ছেলের নাড়ি কাটা থেকে শুরু করে প্রসবের সব কাজ একাই করে। লক্ষ্য করে সারাদিন কেউ ওর বাড়িতে আসেনি! বিমলার মা, বুড়িকেও দেখতে পায় না আর আসে না! তহিরন লক্ষ্য করে বিমলার মা তো নয়ই, গ্রামের কেউই ওর বাড়িতে আসছে না; আর কোনো বাড়িতে ওকে ঢুকতেও দিচ্ছে না! গ্রামের দোকানে সদাইপাতি দেয় না ওকে। একদিন সকালে উঠে দেখে ওর গোয়ালঘর খালি। গোয়ালঘরে গরু নেই। ঘরও ভাঙা। থাকবে কোথায়, নিজে খাবে কী,  ছেলেকেই বা খাওয়াবে  কী ? চিন্তায় মাথা এলোমেলো। কারও কাছে একফোঁটা দুধ পেলো না। টাকা নেই যে দুধ কিনবে। নিজেও খেতে পায় না। ছেলেকেও খেতে দিতে পারে না। জহিরের কোনো খবর পায় না। কার কাছে গিয়ে খবর নিবে তাও বুঝতে পারে না।

ছোট ছেলে না খেয়ে খুব কান্নাকাটি করে; একদিন ছেলের কান্না সহ্য করতে না পেরে গলা টিপে ধরে। কি করছে খেয়াল হতেই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে বুকে চেপে ধরে। সোনা সোনা-রে সোনামণি। কাঁদতে কাঁদতে ছেলে নিয়ে হাটে যায়। ছেলেকে বিক্রি করে দেয়। বলে, ‘রাখবেন তো বাবা ভালো করে? আমার স্বামী বিদ্যাশ থাইক্যা ফিরলেই আমি আবার আপনার কাছ থন ফিরত নিয়া আসুম।’ কিন্তু ওর চোখের সামনে ওই লোক যখন ছেলেকে আবার বিক্রি করে দেয় তখন স্থির থাকতে পারে না তহিরন। লোকটার জামা খামচে ধরে। আশে পাশের লোকজন কেউ ওর পক্ষে যায় না। বরঞ্চ ওকে পিটিয়ে বের করে দেয় হাট থেকে। এরপর থেকেই বাটি হাতে রাস্তায় হাঁটে। আর ডাকে, সোনা, সোনামণি কই গেলি? দুধ যে জুড়ায়া গেলো।

এভাবেই চলছিলো ওর দিন। পাঁচদিন কোনো সাড়া নেই তহিরনের। গাঁয়ের লোকেরাও কোনো খবরাখবর করেনি। যদি শহুরের বাবুর নেক নজর তাদের ওপর থেকে সরে যায়। ছয়দিনের দিন ‘তহিরন’, ‘তহিরন’ ডাকতে ডাকতে বাড়িতে আসে জহির; জহিরের সেই আগের চেহারা আর নেই। ওখানে সে জেলে ছিলো। জহির বুঝেনি ওটা গলা-কাটা পাসর্পোট ছিলো। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ছুটে এসেছে। বাড়ির অবস্থা দেখে জহির চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। চোখ মুছতে মুছতে ভেতরে আসে। এসেই ছুটে আসে তহিরনের কাছে- ‘তহি, তহি, কি হইছে তোর?’ বুকে তুলে নেয় ওকে। পানি খেতে চায় তহিরন।
-পানি পানি। কোথাও পানি নেই। মালোয়েশিয়া থেকে ফেরার সময় ওরা একটি পানির বোতল কিছু খাবার দিয়েছিলো, তাও খায়নি; খেতে ইচ্ছে করেনি। ঐ বোতল থেকে পানি দেয় তহিরনের মুখে।
‘তহিরন ক’ কেডায় এমন করছে?’
শহরের বাবু …আর কোনো কথা বলতে পারে না তহিরন। জহিরের বুকের ওপরেই মাথা এলিয়ে পড়ে; জহির ডেকেও আর সাড়া পায় না তহিরনের। যেনো এটুকু কথা বলার জন্যই তহিরনের দেহের মধ্যে প্রাণটা ধুকপুক করছিলো।

তহিরনকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে জহির।  কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তুই-ই ঠিক কইছিলি তহি, আমি সময় থাকতে বুঝবার পারি নাই! আমার তখন তো  ক্যাবলই স্বপন, দুই চক্ষু ভরা স্বপন ছিলো তহি; ছিলো ভালো থাকার, তরে ভালো রাখার, আমাগো সন্তানরে ভালো রাখার স্বপন। আমি একটা গিদ্দর মানুষরে তহি, গিদ্দর মানুষ।’ অনেকক্ষণ কাঁদে জহির। দুঃখ স্তিমিত হয়ে এলে মৃতদেহ দাফনের চিন্তা মাথায় আসে। কিন্তু টাকা কোথায়? বাড়ি বাড়ি ধর্না দিলো জহির কিন্তু কেউ ওকে টাকা দিতে রাজি হলো না।  শেষে বাড়ি ফিরে উঠানেই পুঁতে রাখে তহিরনকে। তারপর দা হাতে বের হয়ে যায় শহরের বাবুসাহেবের বাড়ির দিকে।

আফরোজা অদিতি: কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৫টি। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার যার মধ্যে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, কবি কামিনী রায় সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটির পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/