কাজী দিলরুবা রহমানের বড়গল্প ‘মুনিয়া’

কাজী দিলরুবা রহমান

মুনিয়া

শেষ অংশ

কিন্তু তৃষা সবসময় এ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যায়। সে জানে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে, আর সেটা তার জন্যে অনেক বেশি কষ্টদায়ক হতে পারে।
রাসেল হাত ধুয়ে এসে আবার চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে একটি হাত দাঁড় করিয়ে তার উপর থুতুনিতে ভর দেয়। তৃষা টেবিলের আঁশটে প্লেটগুলো কিচেনে বেসিনের উপর রাখতে রাখতে আড় চোখে খেয়াল করে রাসেল কিছুর অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝে তার বুক আর নিতম্বের দিকে ফিরে চেয়ে দেখছে। এটা তার চেনা বিষয়, একটু পরেই রাসেল তৃষার একটি হাত ধরে এক রকম টানতে টানতেই বিছানায় নিয়ে যায়। ইদানিং রাসেলের স্পর্শ তৃষার একেবারেই ভাল লাগে না। দেহটা কোনো রকম প্রতিক্রিয়া করে না, রাসেল তার মতো করে উত্তেজনার সময়টুকু কাটিয়ে দেয়। উত্তেজনা পড়ে গেলে রাসেল সেই আগের মতোই এক অচেনা মানুষ হয়ে যায়। এক দুর্বিসহ জীবন চলছে, যেন এটাই প্রতিনিয়ত তৃষার মনে হতে থাকে। দিনরাত কেবলই স্রষ্টার কাছে একটাই প্রার্থনা করে দেন তাকে এই নারকীয় জীবন থেকে মুক্তি দান করেন।
পরেরদিন সকালে মুনিয়া ঠিক সময়েই কাজে আসে। এসেই কাজে হাত লাগায়, গতকাল যে কথাগুলো বলেছিল তৃষার তা মনে পড়তে থাকে। কিন্তু মুনিয়াকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। একটু-আধটু মুনিয়াকে লক্ষ্য করছে আর মনে মনে ভাবছে মুনিয়া কি আজও আবার তার গল্পগুলো শুনাবে। নিজ থেকে মুনিয়াকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে চায় না, তাতে যদি বেশি প্রশ্রয় পেয়ে যায়। “আপা ইটটু চা দিবেন আমারে? মুনিয়া মুখ খুলে এবার।” তৃষা মনে মনে ভাবতে থাকে এটাই সুযোগ ওর গল্পে ওকে ফিরিয়ে আনার। “হ্যাঁ দিচ্ছি, আমিও খাব” দু-কাপ চা বানায় মুনিয়া, চা দু-কাপ টেবিলে রাখে সাথে দুটো টোস্ট বিস্কিট।
একটি কাপ বাড়িয়ে দেয় মুনিয়ার দিকে, মুনিয়া গরম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে গরম কাপের গায়ে ঠোট মিলায়। এইবার সে চোখ তুলে তৃষার দিকে তাকায়, তৃষা অপেক্ষা করে। আফা আগের দিন কইছিলাম না যে হেয় আমারে বিয়া করনের লাইগ্যা পাগল আছিল। ঢাহায় তো আমার আপন লোক কেউ নাইক্কা, আপন কইতে ফাতেমা। হ্যায় আমার খালাতো বইন লাগে, হের লগেই ঢাহা আইছিলাম। বাপে ছোড থাকতেই একটা বিয়া কইরা ঢাহার কোথায় যেন থাকে। মায় এবাড়ি ওবাড়ি কাম কইরা আমাগো ভাই-বোনরে খাওয়াইতো। শইলে এত কষ্ট কি সহ্য হয়, এমনি যৌবন জ্বালা হের পরে খাওনের কষ্ট সব মিলাইয়া মায়ে রোগে পড়ল। চিকিৎসার অভাবে মইরা গেল। হেরপর আমি ঢাকায় আইসা পরি, বাড়িতে ছোড একটা ভাই আর বইন আছে, ওরা স্কুলে যায়। ওগো খাওন খরচ আমারেই জোগাড় করন লাগে। আমার খালতো বইনে গার্মেছে যায়, হের যন্ত্রণায় বাড়ির থাইক্কা বাইর হইছে। ভাই-বোন দুইডা পর্যন্ত আননের সময় পাই নাই। একদিন গার্মেছের ছুটির পর বস্তির সামনে যাইতে দেহি হেয় খাড়াইয়া হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগে কিছু লইয়া অন্য হাতে বিড়ি টানতাছে। আমারে পলিথিনের ব্যগটা দিয়া কইল ঘরে যাইয়া এই কাপড়টা পইরা আয়, আমরা এহন কাজী অফিসে যামু, আমি হেরে ফিরাইতে পারি নাই। আমার ঘরেই হইল আমাগো বাসর, আমার খুব শরম করতাছিল। আফা কমু হেই রাইতের কথা? তৃষা মুখ টিপে হাসে, মুখে কিছু বলে না। মুনিয়া বুঝতে পারে তৃষা ঐ গল্প শুনতে চায়। আমার বুকের উপর প্রথম যেই হের হাতখানা রাখলো আমার মনে হইল জীবনের সব থাইক্কা আপন মানুষটিই হেয়। আফা হেই প্রথম বুঝলাম একমাত্র ভালবাসার মানুষ খানরে সব খুইলা দেওন যায়, তাতে কোনো লজ্জা ভয় কিছুই যেন থাহে না।
আমগো জীবন আফা অনেকটা কুত্তা বিলায়ের মতো। ছোড কাইল হইতেই বাপের বয়েসি পুরুষ হইতে শুরু কইরা পিচ্চি পোলা পাইনডির হাত হইতেও রেহাই পাই নাই। হেইদিন থাইক্কা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছিলাম জীবন দিয়া হইলেও তারে আগলাইয়া রাখুম।
মনিরে প্রথম প্রথম আমারে অনেক ভাল পাইতো, গার্মেন্স ছুটির পর আমরা দু’জন মিইল্লা মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যাইতাম। আবার যেদিন বিকেলে ছুটি হইতো হেইদিন বোটানিতে ঘুরতে যাইতাম। বালাই আছিলাম হের পর দেহি সংসারে খরচ বাইড়া গেছে, গার্মেন্সের পয়সায় চলে না আর, হেরপর চারকি ছাইরা বাসাবাড়ির কামে ঢুকলাম, বাসা বাড়িতে কাজ করলে একটু-আধটু খাওন পাই, হেইডা দিয়াই পেট চইলা যায়। তারপর দিয়া মনিরের লাইগ্যাও ভালাভালা খাবারডি লইয়া আসি, হেই মনিরে আফা এইডা কি করল? “কি করেছে?” কি করে নাইক্কা আফা, বলেই মুনিরা সুর করে কান্না জুড়ে দেয়। মনে হলো মনিরের প্রতি তার ভালবাসা রক্ত হয়ে চোখের জলে ভাসছে। তৃষার চোখ দুটিও আজ অজানা কোনো কারণে ভিজে উঠতে চাইছে। তৃষার বেদনা আর মুনিয়ার বেদনা হয়তো একই ধরনের কেবল প্রেক্ষাপট ভিন্নতর। তৃষার মুনিয়ার মতো বাসর হয়নি। তৃষা অপেক্ষায় ছিল, এই অপেক্ষা তার বহুকালের অপেক্ষা। অপেক্ষায় ছিল রাসেল তার শরীরের প্রতিটি গহনা একে একে খুলে দিবে, হাতে ধরা ধোঁয়া ওড়া সিগারেট। চোখে নেশার জলন্ত আগুন, সে আগুনে পুড়ে যাবে তার সলাজ আকুতি। কিন্তু সেদিন সেরকম কিছুই ঘটেনি। রাসেল একজন অপরিচিত লোকের মতোই তৃষাকে বলেছিল পোষাক পাল্টে শুয়ে পড়তে। বড় নিস্প্রাণ আর শীতল ছিল তার সেদিনের সেই কণ্ঠস্বর। তার কোনো হাতই ছুঁয়ে দেয়নি সেদিন তার শরীর, নাভীমূলে কোনো শিহরণ জাগেনি সেদিন। শুধু মনের পৃথিবীটা ওলোট পালট করে দিচ্ছিল প্রচ- এক ঝড় ক্রমে।
বিবাহিত জীবনে সহবাস হয়েছে অনেকবার, সন্তানও এসেছে। কিন্তু সেটা ছিল কেবল ক্ষুধা নিবৃত্তের মতো।
মুনিয়া ততক্ষণে কান্না থামিয়ে ওড়নার একটি প্রান্ত দিয়ে চোখের আর নাকের পানি মুছতে থাকে। তৃষা কিছুক্ষণের জন্যে আনমনা হয়ে গিয়েছিল। মুনিয়া সেটা লক্ষ্য করে আর বলেÑ আফা আপনি কি কিছু ভাবতাছেন? তৃষা বাস্তবে ফিরে আসে, ‘তুমি কি এখন যেতে চাও?’ “আফা অহন যামু, আরো চাইর বাসায় কাম করন লাগবো।” তৃষার দুনিয়াটি ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে যেন। এপার্টমেন্টের অন্য ফ্ল্যাটগুলোতেও যাওয়া-আসা হয় না। এই ফ্ল্যাটে প্রথম যখন আসে তখন দু-একজনের সাথে নিজে গিয়ে পরিচিত হয়। সারাদিন তৃষা বাসায় একা একা কাটায় আর রাসেল যদিও বাসায় থাকে তখনও তৃষার একাই লাগে, বরং তখন আরো বেশি কষ্ট হয়। তৃষা অনেক কিছুই বুঝতে পারে কিন্তু কিছুই বলতে পারে না বা হয়তো বলার অধিকার রাখে না। রাসেল নিজ থেকেই তৃষা আর নিজের মধ্যে একটি দেয়াল তুলে দিয়েছে, গভীর রাতে রাসেলের ফোন বেজে ওঠতো, প্রথমে কিছুদিন তৃষা বুঝতো না, সরলভাবে জানতে চাইতো কার ফোন? ব্যবসার কাজে কেউ ফোন দিয়েছে বলে এড়িয়ে যেত, তৃষা সেটাই মেনে নিত, হয়তো কোনো ধরনের ঝামেলা হোক সংসারে সেটা চাইতো না বলেই। আস্তে আস্তে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আসলে ফোনগুলো মোটেই ব্যবসা সংক্রান্ত ছিল না, ওগুলো অন্য ধরনের ফোন কল ছিল। রাসেল ফোন এলেই তৃষাকে এড়িয়ে অন্যরুমে চলে যেত, তৃষা কখনো রাসেলের ফোন চেক পর্যন্ত করতো না। এই ভেবে জেনে গেলে তুমুল কিছু হতে পারে।
তৃষা ইদানিং বেশ বুঝতে পারছে তার কোনো কিছুতেই কোনো আগ্রহ নেই আর। এক সময় গান শুনতে খুব পছন্দ করতো, গত কয়েক বছরে কোন কোন নতুন শিল্পির গানের রেকর্ড বেরিয়েছে তৃষার সে সম্পর্কে এখন আর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। বেড়াতে যেয়ে কিংবা নিজের পরিবারের লোকজনের সাথে দেখা করা বা কথা বলা কোনো কিছুতেই তৃষা আর আগ্রহ পাচ্ছে না। একটি জার্নালে পড়েছিল এধনের লক্ষণ সাধারণত মেন্টাল ডিজঅর্ডারের কারণে হবে। মাঝে ডাক্তারও দেখিয়েছিল, ডাক্তার শুধু ম্লিপিং পিল দেয়।
তৃষা বুঝতে পারে ভেতরে ভেতরে সে ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, যেন এক রোবট মানুষ অনুভূতি শূন্য চলমান কোনো যান কেবল কিছু কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো ইচ্ছে বা স্বাদ থাকতে নেই তার। এতো কিছুর পরও তৃষার কখনো আত্মহত্যার কথা মনে আসে না, ঠিক আসে না বললে ভুল হবে, আসে, প্রায়ই ইচ্ছে করে জীবন থেকে মুক্তি পেতে কিন্তু তৃষা খুব যুক্তিবাদী শক্ত মনের মানুষ, তাই কঠিন সব যুক্তির আঘাতে সেই চিন্তাকে পরাভুত করতে সক্ষম। তৃষা বাঁচতে চায়। সৃষ্টির প্রতিটি রূপ-রস-গন্ধ এখনো তাকে কোনো অদৃশ্য স্থান থেকে যেন হাতছানি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে পাখির মত ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন সে তা করতে পারে না? তবে কি রাসেল তার ডানা দু’টি ভেঙে দিয়েছে অতি সুকৌশলে? ‘মা মণি খেতে দাও ক্ষুধা পেয়েছে।’ ছেলের কণ্ঠ শোনা গেল। আজানের ধ্বনি শোনা যায়। দিনের শেষ ভাগ এখন। ছেলে অরিন হয়তো খেয়েই খেলতে যাবে। চটপট ফ্রিজ থেকে চিকেন দিয়ে তৈরি কিছু নাগেট বের করে ভেজে দেয় ছেলেকে। নিজে এক কাপ চা সাথে একটু মুড়ি মাখিয়ে ছেলের পাশে এসে বসে তৃষা। অরিনটা দুষ্ট হয়েছে অনেক, তাই অধিকাংশ সময়ই কাটে ওর পিছনে। আজকালকার বাচ্চাগুলো খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে এতোটা উদাসিন যে ভাবাই যায় না।
ফাস্ট ফুড আর বিচ ফুড ছাড়া এরা কিছু পছন্দই করে না, অরিনেরও একই অবস্থা। তৃষা চেষ্টা করে ওর পছন্দের খাবারগুলো যতটা সম্ভব বাসায় তৈরি করে দিতে। এভাবেই কেটে যায় তৃষার দিনগুলো বৃষ্টিবিহীন এক রূঢ় বৈশাখী তপ্ত দুপুরের মতো।
প্রতি রাতের মতোই দুটো বিছানা, নিঃশব্দে যে যার মতো করে ঘুমাতে যাওয়া, চোখের কপাট দুটো কিছুতেই বন্ধ হয়ে চায় না। বুকের হাহাকারগুলো মাঝে মাঝে চিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। একটা সময় ছিল যখন অনেক কিছুর কোনো গুরুত্ব ছিল না তৃষার কাছে। কলেজ জীবনে যখন পাড়ার বান্ধবীদের মধ্যে অনেকেই ব্যস্ত সময় পার করেছে প্রেমিকদের সাথে, সেই সময় তৃষা পার করেছে গল্পের বই-এ মুখ গুছে। মনে মনে সব সময় ভাল মেয়ের খেতাব পেতে চাইতো, তবেই তো একটা ভাল বর পাবে? যে ব্যাপারগুলো তৃষা কখনো আমলেই নেয়নি সেগুলোই এখন কেবল স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বেড়ায়। কবে কখন কে তাকে প্রোপোজ করেছিল, কে রাস্তায় রোজ দাড়িয়ে থাকতো, একবার এক প্রাইভেট টিচার তৃষার প্রেমে পড়ে, তখন তৃষা ক্লাস টেনের ছাত্রী ছিল। খুব ক্যালকুলেটিভ ছিল তৃষা। তখন বুঝতে পারে এই বয়সে প্রেমে পড়লে তা কখনো পরিণতি পাবে না। আজ সে সব কথা মনে করে অজান্তে চোখের কোণ বেয়ে কখনো কখনো দু’এক ফোঁটা গরম জল অনুভব হয় বৈকি। এভাবেই অতীত স্মৃতিকে ভাবতে ভাবতে এক সময় তৃষা ঘুমিয়ে যেত। ঘুম ভাঙতো আবার সেই পরের দিনের নিরাসক্ত সকালে। নাস্তা রেডি করা, ছেলের টিফিন, ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, মাসে দু’একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাজার করে বাসায় ফেরা। আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
বাসায় ফিরতে না ফিরতেই মুনিয়া এসে হাজির। কাপড়-চোপড় ছেড়ে মুখে পানির একটু ঝাপটা দিয়ে ফ্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে তৃষা বিছানায় শুয়ে পড়ে। মুনিয়া খাটের পাশে মেঝেতে বসে একটি হাত বিছানার উপরে রাখে।
“আফা আপনার শইলডা ভালা তো।” “হ্যাঁ ভালই আছি, একটু কাজের চাপ বেশি।” মনে অয় বাজারে গেছিলেন আপনাগো তো অফিসের পিয়ন আছে হেরে দিয়া করাইতে পারেন না। তৃষা কোনো উত্তর দেয় না, তৃষা বাজারে না গেলে বাসায় কখনো বাজার হতো না, তাই বাধ্য হয়ে তৃষাকেই বাজার করতে হয়। তৃষা সংসার খরচের জন্যে যে টাকাটা পায় তা দিয়েই কোনো রকম বাজার খরচটা এদিক ওদিক করে চালিয়ে নেয়। অথচ রাসেলের টাকার কোনো অভাব নেই, রাসেলের কোনো কিছুতেই তৃষার কোনো অধিকার নেই যেন। কেবল নিজের একটু আশ্রয়ের জন্যে সে রাসেলের ঘর আগলে পড়ে আছে।
“বসো মুনিয়া, তোমার স্বামী তারপর কি বলল? আজকে আবার বলো।” “জানেন আফা আমাগো দিনগুলো বাতাসের লাহানই ফুরফুর কইরা উড়তে লাগল, এরমধ্যে হের বাপ-মায়ে দেশের থাইকা আইসা পড়ল, আমি হেগোর ভালাভালা খাওন রাইন্ধা বাইরা খাওয়াইলাম। তবুও হেগোর মন পাওন গেল না। বুঝতে পারছিলাম আমাগো এই বিয়েতে হেরা খুসি না। হের বাপ-মায় আলাদা রুম ভাড়া লইন। হেয় তাগোর লগেই থাহেন শুরু করল, খাওনের সময় আর রাইতের বেলায় আমার ধারে আসে। এইভাবে ৬ মাস গেল, মাঝে মাঝে কামের কথা কইয়া স্যাভার যাইত, তিনদিন আগে যেসব আফনের লগে কামের কথা হইল, বস্তিতে ফিরনের পথে পথে হগলে আমারে আকারে ইঙ্গিতে কি জানি বুঝাইতে চাইল। আমি সোজা হেগো রুমের মধ্যে ঢুইকা গেলাম। হেরপর আফা যা দেখলাম, কথাটা শেষ না করেই মুনিয়া সুর করে কান্না শুরু করে। আফা দেহি চৌকির কোণায় পিন্দনে লাল শাড়ি একজন কেউ ঘোমটা দিয়ে মাথাখান নিচু কইরা বইসা আছে। আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়া উঠল। আমি জোরে জোরে জিগাইতে লাগলাম ‘কেডা, এইডা কেডায়? কেউ আমারে কিছু কইল না, হগলে চুপ মাইরা রইল। আমার যা বুঝবার আমি বুইঝা ফালাইলাম, এক দৌড়ে নিজের রুমের মধ্যে আইসা দরজা বন্ধ কইরা দিলাম।
আর মনে মনে মইরা যাওনের ফন্দি আটতে থাকলাম, মরন কি এত সহজে হয় আফা। পরদিন ভাবলাম কাম-কাইজ ছাইড়া দেশে চইলা যাবু, কিন্তু যাওয়া আর হইল না দেশে যাইয়া কি খামু হেই চিন্তায়। এহন হেয় আমাগো দুইজনের লগেই থাকে ভাগাভাগি কইরা।”
আজ-কাল রাসেলের সাথে তৃষার কোনো কথাই হয় না বলতে গেলে। সংসারের টুকিটাকি প্রয়োজনের কথাগুলো একঘেয়েভাবে বলে যাওয়া ছাড়া। রাসেল তৃষার হাতে কিছু টাকা দেয়া ছাড়া আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে ভাবেই না। বিছানায় শুয়ে আজ বড্ড ছটফট করছে তৃষা, কিছুতেই ঘুম আসছে না। ঘুরে ফিরে মুনিয়ার কথাগুলো মনে আসছে। নিজের উপর নিজেরই রাগ হয়, যবে থেকে মুনিয়ার জীবন কাহিনী শোনা শুরু হলো তার থেকেই মুনিয়ার সাথে বার বার নিজেকে গুলিয়ে ফেলছে। আজ কি মুনিয়ার স্বামী মুনিয়ার সাথে শোবে? মুনিয়া হয়তো একটু অভিমান করবে, মনির সেই অভিমান ভাঙানোর জন্যে নানান রকমের দুষ্টামি করবে।
আবারও তৃষা দু’জনের মধ্যকার মিল অমিল গুলি খুঁজতে থাকে। রাসেলের দ্বিতীয় কোনো স্ত্রী নেই ঠিকই তবুও অনেকেই আছে মনে, শুধু মনে নয় তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। তৃষা ভেবে দেখে তার আর মুনিয়ার মধ্যে হয়তো কিছু কিছু অমিল আছে ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগটাই মিলে যায়। এই যেমন তাদের দু’জনারই ফিরে যাবার কোনো জায়গা নেই। “আফা কাউলকা একটা মজার ঘটনা ঘটেছে, আফনারে কই বলেই মুনিয়া হাসতে থাকে। তৃষা চেয়ে থাকে মুনিয়া খানিকটা মাথা নিচু করে আবার এপাশ ওপাশ তাকায়। চোখগুলি টিপ টিপ করে। আফা আমারে হুগনা দেহাইলে কি অইবো আমার কি যৌবন নেই? কাইল রাইতে আমার লগে থাহনের তারিখ আছিল।
সন্ধ্যার পর মুকরার মাংস দিয়ে ভাত খাওয়াইছি, হেরপর রাইতে যখন ঘুমাইতে গেছি দেহি এক কোণায় হান্দাইয়া রইছে, কন আফা আমার কি যৌবন নাই? এমনিতেই সপ্তাহ তিনদিন হেরে পাই, তাও আবার দুইদিন থাকে বুতরাইয়া। কালকা আর সহ্য হয় নাই, যেই দাও লইচি হেরপর দেহি মোচর দিয়া উঠছে।”
রাতে তৃষার কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না, মুনিয়ার কথাগুলো বার বার ঘুরপাক খেতে থাকে। মুনিয়ার চাওয়া-পাওয়া ইচ্ছে এ সবই যে তৃষারও। না আর ভাবতে পারে না তৃষা, সে কি করবে? সে কি অন্য নারীদের মত পরকীয়ায় আসক্ত হবে? কি তৃষা তা চাইলেও করতে পারে না, কাররণ তৃষার মন এগুলোতে কখনো সায় দেয় না। তৃষা ভাবতে থাকে কেন সে কিছুই করতে পারে না? ঘর ভাঙতে পারে না, মুনিয়ার মত ভালবাসা ছিনিয়ে নিতে পারে না, অন্য কোনো পুরুষকে অবৈধভাবে ভালবাসতেও পারে না। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়। একদিন গভীর রাতে রাসেলকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। রাসেল অনেকটা অবাক হয়, এতো রাতে? তৃষা থামিয়ে দিয়ে বলে, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। চোখে মুখে বিরক্তি তখনো রাসেলের। কি কথা বলো? আমি অনেক ভেবে দেখলাম আমাদের এই সম্পর্কটি আর দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। আমি তোমার কাছে মুক্তি চাইছি। রাসেলের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই হয় না। ঠিক আছে বলে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। রাসেল হয়তো অনেক আগেই চেয়েছিল তৃষা চলে যাক, তৃষার খুব ভালো ঘুম হয় বাকি রাতটুকু। শুধু এই ভেবে একদিনে অন্তত একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।
 
লেখক পরিচিতি:  কাজী দিলরুবা রহমান একজন সার্বক্ষণিক লেখক। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিনটি।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/