আমি তরুণদের কবিতা পছন্দ করি

কবি আসাদ চৌধুরী ষাটের দশকের অন্যতম কবিদের একজন। তার কবিতার বইয়ের সংখ্যা প্রায় আঠারো। অনুবাদসম্পাদনা ও মৌলিক লেখা মিলিয়ে আরো বিশটির মতো শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। তার কবিতা সহজবোধগম্যপ্রাকৃতিক ও সমাজসচেতন। প্রথম কবিতা লিখেছিলেন প্যাট্রিক লুলুম্বাকে নিয়ে। তিনি একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্বও। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি। তার কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন জাহেদ সরওয়ার

আপনার শৈশব কীভাবে, কোথায় কেটেছে জানতে চাই। ফ্রয়েডকে স্মরণ করে বলা যায়। আপনার কবি হওয়ার বীজ শৈশবে রোপিত হয়েছিল কিনা?

আসাদ চৌধুরী : আমার শৈশব আসলে কেটেছে অনেক জায়গায়। আমার জন্মবরিশালের উলানিয়ায়। আমাদের পরিবারটাকে বলা হতো বড় হিসসা। বিরাট জমিদারি। গ্রামে কেটেছে আমার অনেক দিন। একবার খুব পাগলা জ্বর হওয়ার ফলে আমাকে বরিশাল নেয়া হলোসেখান থেকে কলকাতা। এটা ৪৭ সালের কথা বলছি। কলকাতায় আমি মাস দেড়েকের মতো ছিলাম সে সময়। আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম। ৪৭-এর দাঙ্গার আবহটা দেখলাম। আব্বা তখন এমএলএ ছিলেন। মোঃ আরিফ চৌধুরী। যুক্তবঙ্গের শেষ এমএলএদের একজন। পুলিশ পাহারা থাকতো। তারা আমাকে ধরে নিয়ে আসে।

ক্লাস টুতে যখন উঠলাম তখন আমাকে ঢাকা আসতে হলো। বাবার অ্যাসেমব্লি ছিল। জগন্নাথ হলের উল্টোদিকে যে দালানটা ছিল তখন ওখানেই অ্যাসেমব্লি হলো। থাকতাম শহীদ মিনারের প্রায় উল্টো দিকে। প্রথমে ২২/২৩ দিনের মতো নৌকাতে ছিলাম। পরে কলতলায় একটা বাড়ি পাওয়া গেল সেখানে আমরা মাস সাতেক ছিলাম। পরে বাবু বাজার চলে আসলাম। অই একটা বছর আমার পড়াশোনা হয়নি। সেন্ট গ্রেগরিতে বাবা পড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমার ভেতরে ভেতরে ইংরেজ বিদ্বেষের কারণে হয়নি। আমি আব্বাকে বললাম যে আমি ইংরেজি স্কুলে পড়ব না। আব্বা খুব খুশি হয়ে বললেন যে পড়তে হবে না তাহলে থাক। তবে এতে বাসায় পড়ার চাপটা বাড়ল। তবে তখন প্রচণ্ড স্বাধীনতা ছিল। আমরা কার সঙ্গে খেলছি কোথায় যাচ্ছি মা-বাবারা এখনকার মতো এত কড়াকড়ি করত না। তারপর ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমি পুরান ঢাকা পুরাটাই চিনে ফেলেছিলাম। তবে কয়েক মাস থাকার পরপরই গ্রামে যাওয়ার জন্য আমার মনটা কেমন কেমন করত। গ্রামে কয়েক মাস থাকার পর আবার শহরে আসার জন্য পাগল হয়ে যেতাম।

তখন তো ঢাকা আর আজকের মতো ছিল না। এটা কি এই কারণে যে আপনাদের গ্রাম ঢাকার চেয়ে উন্নত মনে হতো?

আসাদ চৌধুরী : নানা। সে কারণে না। গ্রামের একটা আলাদা মজা আছে না গ্রামলগ্ন বন্ধুবান্ধব। একটু নিরিবিলি সবুজ। এই যে ঈদে লোকে বাড়ি যায় এত কষ্ট করে। শুধুমাত্র তো মা-বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার জন্য নয়তাই না! বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাখালের পাশে বসাপরিচিত গাছপালাগুলোর কাছে ফিরে যাওয়া। ওই গ্রামীণ অ্যাসোসিয়েশনটাই আমাকে টানত বেশি। যেটা ঢাকায় পেতাম না। যখন আমি ক্লাস টুতে পড়তাম তখন গ্রামে চলে গেলাম সেখানে পরীক্ষা দিলাম। পাস করলাম। আবার ঢাকা চলে আসলাম। কারণ আব্বার অ্যাসেমব্লি চলছিল। ক্লাস ফোরে আরেকবার গ্রামে গেলাম স্কলারশিপ পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা দিলাম। স্কলারশিপ পেয়েও গেলাম। ওটা ছিল একটা জুনিয়ার মাদ্রাসা। প্রাইমারি স্কুলের সঙ্গে দুটো ক্লাস যোগ করে জুনিয়র মাদ্রাসা করা হয়েছে। নাইনে আমার পড়াশোনাটা আবারও সমস্যার মুখে পড়ল। আমিই দায়ী—আর কেউ না। কারণ প্রচুর সিনেমা দেখতাম। বইপত্র বিক্রি করে ফেলেও সিনেমা দেখতাম। স্যারের বই পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলাম। মারামারিও করেছি তখন। ধনু বলে এক গুণ্ডা ছিল শাঁখারীপট্টিতে। আমরা রাধিকাগ্রামের বাসায় থাকতাম। এই বাসায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন কয়েক মাস। আব্বা এনে রেখে দিয়েছিলেন। উনিমোল্লা জালাল পরে মন্ত্রী হনআব্দুল হামিদ চৌধুরী সিপিবির লিডার ছিলেনআনোয়ার হোসেন তৎকালীন বিখ্যাত ছাত্রনেতা। এরাও এই বাসায় ছিলেন।

তো যেটা বলছিলাম আমরা বল খেলতাম। শাঁখারীপট্টির লোকেরা চাইত না আমরা ওখানে গিয়ে খেলি। আমরা যারা খেলতে যেতাম তাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা থেকে আসা। বিহার থেকে আসা। অবাঙালি মুসলমান। ধনুর সঙ্গে মারামারি হয়ে গেল। সূত্রপাতটা আমিই করেছিলাম। আমরা ক্রিকেট খেলছিলাম। ধনু এসে গালাগালি করল। আমি একটা স্টাম্প নিয়ে তার মুখের একপাশে মারি। ও তখন বিশ্বাসই করতে পারেনি তার গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে। ওর এই অবিশ্বাস্যতা বজায় থাকতে থাকতে আমি আবার ওর মুখের অন্যপাশে মারি। ও পালিয়ে যায় ওর বাহিনীসুদ্ধ। ওই মাঠে ও আর কখনো আসেনি। তবে সে সময়ের কথা বলতে গেলে সিনেমা দেখেছি প্রচুর। ওই সময়ের হলের অনেক টিকিট বিক্রেতারাও আমাকে চিনত। তখন মানসীটার নাম নিশাত ছিল। তারপর মায়া সিনেমা হলে চিনতাম। ক্লাস নাইনে তখন। আবার আমি গ্রামে গেলাম। কিছু করি না তখন। তারপর আমি ক্লাস নাইনে পরীক্ষা দিলাম। থার্ড হলাম। ক্লাস টেনে সব পরীক্ষায় ভালো করেছি। টেস্টেও খুবই ভালো হলো। এরপর এক স্যারের কাছে পড়তাম। মিন্টু স্যার। উনি বললেন, ‘অঙ্কে ও পঁয়তাল্লিশ পাবে।’আমি আসলে ওই পঁয়তাল্লিশই পেয়েছিলাম।

পরে আমি ভর্তি হয়েছিলাম বরিশাল বিএম কলেজে। থাকতাম ফুফুর বাসায়। তিন মাইল দূরে হেঁটে যেতে হতো। পাস করার পর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম বাংলায়। মোহাম্মদীতে প্রুফ দেখার চাকরি দিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।

 ওইটাই আপনার প্রথম চাকরি?

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁ। ওইটাই প্রথম। প্রুফ দেখার চাকরি। আমি আর কি দেখতাম গাফফার ভাই দেখে দিতেন। আমি বসে চা ডাল পুরি খেতাম। গাফফার ভাই যেদিন চাকরি ছেড়ে দিল সেদিন আমার চাকরিও নট। চলে গেল। পরের দিন গিয়ে দেখি যে আমার চাকরি নেই। ওইখানে মাসতিনেক ছিলাম। ডিপার্টমেন্টে একটা স্কলারশিপ পেতাম পঁয়তিরিশ টাকা।

সাহিত্যের ঝোঁকটা কীভাবে এলো?

আসাদ চৌধুরী : সাহিত্যের ঝোঁকটা পারিবারিকভাবেই ছিল। আবদুল গাফফার চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখেছি তার আকর্ষণকালাপাহাড়সুপারহিট উপন্যাস এগুলো। উনি ছিলেন আমার নানির আপন ছোট ভাই। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের জামাতা। সবচেয়ে বড় কথা কি আমাদের বাসায় অনেক পত্রিকা রাখা হতো। প্রবাসীমোহাম্মদীভারতবর্ষমাহে নওসওগাত। আমার এক মামা শিশু সওগাত রাখত। যতটা মনে পড়ে শিশুসাথী বলেও একটা পত্রিকা ছিল। আরো অনেক পত্রিকা থাকত বাসায়। নাম মনে পড়ছে না। আমার খুব প্রিয় ছিল মোহন সিরিজ।

আমাদের পারিবারিক পরিবেশটাও বিশালজমিদারি পরিবার। কনজারভেটিভ। কিন্তু খুবই সেকুলার ছিল। ক্লাস ফোরে আমি প্রথম নজরুলের বিষের বাঁশী বইটা পাই। পাগলের মতো পড়েছিলাম। এরপর অগ্নিবীণা পাই। এগুলো কিন্তু ব্রিটিশরা নিষিদ্ধ করেছিল। ৬৪-এর প্রথম শেরেবাংলা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। আর আমাদের গ্রামে আমার কাজিন আজিম ভাই বিরাট একটা ব্যাটারি চালিত রেডিও এনেছিলেন। অনেক বড় টেলিভিশনের তিনগুণ সাইজ হবে। ব্যাটারিটাও অনেক ওজন ছিল। দুজনকে বহন করতে হতো। নাটক আবৃত্তি আমরা তখনই শুনি। ক্লাস ফোরে আমি নজরুলের বইগুলো পড়লাম। এরপর কবিতা পড়লেই ওগুলো আমি পড়ি। কবিতাগুলো জোরে জোরে পড়তাম। ফলে ছন্দটা তখন মনে হয় কানে গেঁথে গিয়েছিল। যখন আবোলতাবোল পেলাম তখন আমি ক্লাস সেভেনে। তখন আমাকে আর পায় কেসুকুমার রায় আমার অসম্ভব প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ নজরুল এরা না। আর মেট্রিক পরীক্ষা যখন দেই তখনই আমি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পড়ি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়লাম। আর সমর সেন আমার ভাইয়ের খুবই ফেভারিট ছিল। তার পরামর্শে আমি সমর সেন পড়ি। কিন্তু তখন অসম্ভব ভালো লেগে যায় জীবনানন্দ দাশ। এই ভালো লাগার আমি ব্যাখ্যা দিতে পারব না। জীবনানন্দ দাশ পড়ার পর আমার মনে হলো যে আমিও তো ইচ্ছে হলে লিখতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি বাংলা বিভাগে তখন আগা সুলতান এমদাদিয়া লাইব্রেরির মালিক ছিলেন বরিশালের। উনি আমাকে বললেন যে প্যাট্রিক লুলুম্বার ওপর একটা কবিতা লিখতে হবে। প্যাট্রিক লুলুম্বার মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। যদিও বিশ্বায়নের চাপের ভেতর ঢুকিনি তখনো আমরা। আমার মনে হয়েছিল আমার কোনো কাজিন মারা গেছে। খুবই অপমানিত বোধ করছিলাম তখন। স্টেডিয়ামে বুকস অ্যান্ড ম্যাগাজিনস বলে একটা দোকান ছিল। ওটা ছিল খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের। ওখানে এক ভদ্রলোক এলেন দেখলেন কোনো মন্তব্য করলেন নাকবিতাটা নিয়ে চলে গেলেন। পরে জানলাম উনি ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। এই কবিতাটা পরে আফ্রিকার হৃদয়ে সূর্যোদয় বলে লুলুম্বাকে নিয়ে একটা সংকলনেও ছাপা হলো। পরের দিনই সংবাদে কবিতাটা এডিটোরিয়াল পেজে ছাপা হলো। এর আগে আমার কোনো কবিতা সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়নি। একেবারে এডিটোরিয়াল পেজে। পরে খবর পেলাম যেতখন তো আর এখনকার মতো ছিল না। সাহিত্যপাতা আগে ছাপা হয়ে যেত। আমি রাতারাতি কবি খ্যাতি পেয়ে গেলাম। এটা খুব কম লেখকের ভাগ্যে জোটে। তখন থেকেই এটা আমার কবিতার প্রবণতা। সমাজ এবং মানুষ আমার কবিতার বিষয় হয়ে উঠল। সংগীতের ক্ষেত্রে আমার রুচি একেবারেই এলোমেলো। আমি রাগ পছন্দ করিলোকসংগীত আমার অসম্ভব প্রিয়। একবার আমরা হাওরে গেলাম। আমরা সেখানে শুনলাম রাধারমণ ও শাহ আব্দুল করিমের গান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা শাহ আব্দুল করিম শুনলাম।

হুম। হাওরের সঙ্গে মানে ওইসব আবহে থেকেই তো শাহ আব্দুল করিমের বাউলগিরি। হাওর আর শাহ আব্দুল করিম একসঙ্গে হলে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। আমি দিরাই নদী পার হয়ে আব্দুল করিমের বাড়িতে গিয়েছিলাম ওনার জীবদ্দশায় একবার।

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁতা ই। শাকুর মজিদের সঙ্গে গিয়েছিলাম তার বাড়িতে তারই কল্যাণে। একটা পরিপূর্ণ সন্ধ্যা কাটালাম বলতে গেলে শাহ আব্দুল করিমের সঙ্গে। যা হোক এভাবেই আরকি শুরু হলো বলা যায়। ব্রজমোহন কলেজে একসময় পাগলা ছাত্রলীগ করতাম। বদরুল হক পরে সুপ্রিম কোর্টের জজ হন। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন কলেজে। আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। একসময় ছাত্র ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকলাম। একসময় বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকলাম। তারপরও আসলে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত হইনি কখনো। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যখন পড়াই তখন কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। এর আগে আমি কখনোই ভাবতে পারিনি কৃষকরা সন্ধ্যার সময় খেয়ে ফেলে রাতে তেল বাঁচানোর জন্য। আরেক বাড়িতে গিয়েছিলাম পাশের বাড়ি থেকে গ্লাস এনে তারপর আমাকে পানি দিয়েছিলেন। তাদের বাড়িতে কোনো গ্লাস ছিল না। বিশ্বাস করো এ সমস্ত ব্যাপার আমার আগে জানা ছিল না। এটা চৌষট্টি পঁয়ষট্টির দিকের কথা বলছি। ছয় দফা আসছে তখন। এগারো দফা তো ঊনষট্টিতে। তখন আমি ঢাকায় ছিলাম না। তবে এই বাইরে থাকাটা আমার নিজেকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এরকম আরেকটা অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের কৃষক-শ্রমিকদেরই এক কর্মীর কাছ থেকে। তার বাড়ি ছিল খরোলের দিকে। একটু জঙ্গিমার্কা লোক মানে অতিবিপ্লবী আরকি। সে এসে উদাসীনভাবে কথাবার্তা বলছে। আমি ভাবছি কারণ কীএই লোক তো এ রকম ছিল না। এ কয়দিনে কি এমন হলো উনি আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলছেন কেন প্রতিনিয়ততারপরই বুঝলাম কোনো একটা বিয়ে বাড়িতে আবদুল আলীমের গান বেজেছিল। এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়ে এই জাতীয় গান। অনেকগুলো শুনেছে তারপর তার ভেতর এটার প্রভাব পড়েছে। তখন আমি আবার নতুন করে সংস্কৃতিকে আবিষ্কার করলাম। সংস্কৃতির শক্তিটাকে। এটা শুধু বিনোদনের ব্যাপার না। সংস্কৃতির যে সোলপাওয়ারটা। এটা শুধু মানুষকে কমিউনিকেট করে নামানুষকে ভেতর থেকে নাড়িয়েও দিতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থাকতে এই অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল। এরপর তো ঢাকায় চলে এলাম। স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে যুক্ত হলাম। জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করলাম। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হলাম। এবার বিয়ে করলাম। আমার স্ত্রী পরিবারের পাল্লায় পড়ে ঢাকায় পার্মানেন্টলি চলে এলাম। আবার সেই গাফফার চৌধুরী। দৈনিক আওয়াজ পত্রিকা বের করলেন। আমাকে নিয়ে এলেন।

যদিও আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সাংবাদিকতা করার। পরে জার্মানিতে যাওয়ার কথা ছিল বিবিসিতে যোগ দিতে। কিন্তু পরে উনি আবার বললেন যে খবরদার সাংবাদিকতা করো না। কারণ পত্রিকার মালিকের স্বার্থ রক্ষা করতে করতে কলমটাও সেরকম হয়ে যাবে। তোমার কোনো স্বকীয়তা থাকবে না। নিয়ত আপোস করতে হবে তোমাকে। পারবে না তুমি। আর তোমাকে আমি চিনি যতটা তোমার খুব কষ্টকর হবে ব্যাপারটা। বরং তুমি লেখালেখি করো। তুমি বাংলা একাডেমিতে যোগ দাও। আমি বাংলা একাডেমিতে যোগ দিলাম।

আচ্ছা এখানে একটা ব্যাপারে একটু বলি। আপনি সেই যে লুলুম্বাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখলেন। এরপর লেখাটা কন্টিনিউ করেননি। মানে নিয়মিত লিখছিলেন তো?

আসাদ চৌধুরী : না। কন্টিনিউ হচ্ছিল না তবে লেখা থেমে ছিল না। সৃজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সৃজন একটা সংকলন করবে। ফ্রাঙ্কলি বলছি আমার অধিকাংশ লেখাই সম্পাদকদের তাগিদে লেখা। এখানে লিখলাম এজমালি শান্তির সপক্ষে নামের একটা কবিতা। এরপর এই কবিতাটা আর কোথাও ছাপা হয়নি। আমার কাছেও সংকলনটা নেই যে অগ্রন্থিত কবিতা বলে এটাকে চালিয়ে দেব। এরপর যখন রফিক আজাদ টাঙ্গাইল থেকে এলেন। প্রশান্ত ঘোষাল ছিলেন মুন্সীগঞ্জের। ইমরুল চৌধুরী মুন্সীগঞ্জের। অর্গানাইজ করলেন। স্বাক্ষর বের হলো। স্বাক্ষরে যখন লেখালেখি করি তখনি আমার ভেতরও তাগিদ পেলাম। স্বাক্ষর ৪টি বেরিয়েছে সারাজীবনে। আমি যখন ৭১-এ কলকাতায় গেলাম এটা আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল যে বিষ্ণু দেসুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাকে চেনেন। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না কি এমন লিখেছি তাই না। কটাই বা লেখা ছাপা হয়েছে।

বছর খানেক পর ঢাকায় ফিরে এলাম। এরপর আসলে লেখালেখিটা নিয়মিত হলো। সমাজের প্রভাব সম্ভবত আমার ওপর সবচাইতে বেশি। সমাজকে আমি সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিই। স্বাভাবিকভাবেই সমাজকে গুরুত্ব দেয়া মানে হচ্ছে রাজনীতি প্রসঙ্গটা আসবেই। আমার পক্ষে রাজনৈতিক আনুগত্য কোনো দলের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হলো না। যে দলই ক্ষমতায় গিয়ে যখন উল্টাপাল্টা কাজ করে তখন আর সহ্য হয় নাবিরক্ত লাগে।

রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হওয়া কি স্বাভাবিক কবি স্বভাবঅনেক কবিকেই দেখা যায় তারা মতামত দেয় কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কোনো প্লাটফর্ম থাকে না। বা শেষপর্যন্ত সেই প্লাটফর্ম তাদের ধরে রাখতে পারে না। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে দেখা গেছে যে বিশেষ করে যদি পোলিশ কবিদের কথা বলি চেশোয়াভ মিউশ বা ভিসোয়ার্ভা সিম্বোরোস্কা ওনারা মার্কসিজম কায়েম করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে লড়াই করলেন। কিন্তু দল যখন ক্ষমতায় এলো চেশোয়াভ মিউশ চলে গেলেন আমেরিকায়। তিনি লিখলেন কোনো দেশকে ভালোবেসো নাদেশগুলো খুব দ্রুত মানচিত্র বদলায়। কোনো মানুষকে ভালোবেসো না দ্রুত বদলে যায়। বা  সিম্বোরোস্কা লিখলেনমানুষকে ভালোবেসো না তুমি বরং তাদের পছন্দ করতে পারো। যেকোনো পাওয়ার পছন্দ না করার একটা ব্যাপার মনে হয় কবিদের জন্মগত। প্রকৃত কবিদের কথা বলছি। কবিতা যে আসলে একটা শক্তি। যে শব্দের স্তম্ভের ওপর ভর করে দাঁড়ায়। কবিতার শক্তির ব্যাপারটা কখন উপলব্ধি করলেন?

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁকবিতার শক্তির ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম প্যাট্রিক লুলুম্বাকে নিয়ে কবিতাটা যখন ছাপা হলো। জেলখানা থেকে আমি অভিনন্দন পেয়েছিলাম। ওরা বন্দী কমিউনিস্ট। আর সংবাদও তখন বহুল প্রচলিত সংবাদপত্র। আধুনিক ও প্রগতিশীল দুই পক্ষই সংবাদ পড়ে। এবং আমি এটাও বলব ধনী-গরিবের পার্থক্য। গরিব হওয়াটা যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। এটা কোনো উত্তরাধিকার নয়। এটা আমার বুঝতে খুব দেরি হয়নি। এটা আমি সেভেন এইটেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। যদিও জমিদার বাড়ির ছেলে বলে আমি অনেক বেশি ফেভার পেয়েছি। আব্বা এমএলএ ছিলেন সেই জন্যও আমরা মনোযোগ পেয়েছি। তারপরও বলব সাম্প্রদায়িকতা আমাদের পরিবারে ছিল না।

না, যেহেতু উনি এমএলএ ছিলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তো হিন্দু-মুসলিম সবাই ওনার কাছে আসতেন।

আসাদ চৌধুরী : এমনিতে পরিবারটা রক্ষণশীল। কিন্তু কখনোই সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পায়নি। প্রত্যেকেই প্রায় ধার্মিক কিন্তু ধর্মান্ধতা কখনোই প্রশ্রয় পায়নি আমাদের পরিবারে। এই ব্যাপারটা আমার পারিবারিক ট্র্যাডিশন। আমি বই পড়ে শিখিনি। আব্বা পাকিস্তান আমলে এমএলএ ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন কিন্তু এই মনোভাবটা আমাদের কখনোই ছিল না। আমি আল্লামা রাফির বাসায় কয়েকদিন ছিলাম। উনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

মানে সচ্ছল সামন্তীয় পরিবার হওয়াতে মাল্টিকালচারের ব্যাপারটা ছিল আরকি। আচ্ছা আপনি তো উর্দু কবিতা বা ফিলিস্তিনি কবিতা অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন। আমরা জানি দুইটা বইও আছে আপনার উর্দু কবিতা ও ফিলিস্তিনি কবিতার ওপরে। তবে এখানে একটা কথা বলা যায় সেটা হলো ইউরোপের বা আমেরিকার কবি সাহিত্যিকদের লেখা যে পরিমাণ অনুবাদ হয় বাংলায় সেই তিরিশের দশক থেকে শুরু হয়েছে। যা এখনো চলছে। কিন্তু আরবি কবিতা, পারশিয়ান কবিতা বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই কিন্তু শক্তিমান কবিরা আছে। এটাও কি একধরনের পলিটিক্স? মডার্নিজমের পলিটিক্স? আমরা ওমর খৈয়াম অনুবাদ করেছি ফিৎজেরাল্ডের ইংরেজি থেকে। অথচ ফার্সি উর্দু কত কাছেই ছিল আমাদের। কত চর্চাই না হয়েছে উপমহাদেশে।

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁ, ভালো বলেছেন। ফার্সি তো একসময় রাষ্ট্রভাষাই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের। রুমি সোসাইটি বলে একটা গ্রুপ এটা নিয়ে কাজ করছে। শুধু রুমির ওপরে না মরমি সাহিত্য নিয়েই কাজ করছে। যদিও চট্টগ্রাম বেজড কাজ করছে এরা। তারপরে এখানে ইরানিয়ান অ্যাম্বেসি কাজ করছে বিভিন্ন জায়গায় ফার্সি ভাষার কোর্স চালু করার ব্যাপারে। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থাটা তো ভালো না। কাজেই যতটা করার কথা ততটা পারে না। ওদের ইচ্ছামতো পারছে না। উর্দুর ব্যাপারে বলতে হয় স্কুল কলেজগুলোতে তো উর্দু পড়ায় না। মাদ্রাসায় যারা পড়ে তাদের কেউ কেউ পড়াশোনা শেষ করে ইউনিভার্সিটির ভাষা বিভাগে উর্দু পড়তে যায়।

 এখানে একটু যোগ করি যে পরিমাণ ইংরেজি শিখছি আমরা সেই পরিমাণ উপমহাদেশের ভাষাগুলো শিখছি না। এটা এই কারণেও হতে পারে যে আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছি। পাকিস্তানের ভাষা উর্দু এই জন্য? কিন্তু উর্দুভাষার যে শক্তিশালী লেখাজোকা। উর্দুকেন্দ্রিক যে সুফি সাহিত্য বা বিভিন্ন লিটারারি ডাইমেনশন। তা থেকে তো আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। 

আসাদ চৌধুরী : উর্দু সাহিত্য আমাদের এখানে বিকশিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরের বা সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলা দখল করল এরপরই একটু একটু উর্দু চর্চা কমতে লাগল। জাহাঙ্গীরনগর থেকে কিন্তু অনেক আগেই মুর্শিদাবাদ চলে গিয়েছিল রাজধানী। সেটা মুর্শিদকুলি খানের আমলে। তারপর রাজধানী যখন কলকাতা হলো ১৯০৫ পর্যন্ত অলইন্ডিয়া রাজধানী তো কলকাতাই ছিল। এরপরও কিন্তু ঢাকাতে উর্দু সাহিত্যের চর্চা ছিল। পাকিস্তান আমলে তারা বাড়াবাড়ি করায় উর্দুর ওপর একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তো আরোপিত হলোই। আন্দালিব শার্দানির মতো কবি চলে আসছিলেন। রেজা আলি বারসাতের মতো কবি চলে আসছিলেন। নওশাদ নূরির মতো কবি চলে আসছিলেন এই ঢাকাতে। আতাউর রহমান জেমিল চলে এসেছিলেন। কাজেই এখানে উর্দু সাহিত্য চর্চা বিকশিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কিন্তু এরাও যেমন আসলাম উদাসের  একটা বই ১৯৬৫ সলে বেরোয়। ঢাকা থেকে বেরোয়। নিশ্চয়ই মাগরিবে পাকিস্তান বা মাশরিকে পাকিস্তান লেখার কথা ছিল লিখছে বাংলাদেশকি মশহুর শায়ের। ৬৫-তে বাংলাদেশি মশহুর শায়ের বলাটা উর্দু বইতে এত সহজ ছিল না। এদের মধ্যে সেই চেতনাবোধটা ছিল। কিন্তু যে কথাটা আপনি বললেনফয়েজ আহমদ ফয়েজের রুশ অনুবাদক যিনি। তার একটা লেখা কিছুদিন আগে আমার পড়ার সুযোগ হলো। সেখানে তিনি বললেন। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলেছিলেন যে উর্দু মুসলমানের ভাষা না। উর্দু ভারতেরও বড় ভাষা। কিন্তু অনেকেরই ধারণা যে উর্দু মুসলমানদের ভাষা। যেমন একটা বইয়ের কথা বলি যেটার নখ থেকে চুল পর্যন্ত আগাগোড়াই আমার প্রিয়শঙ্খ ঘোষ ও আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত সপ্তসিন্ধু ও দশদিগন্ত। সেখানে কিন্তু ইরানের বা আরবের কোনো কবিতা নেই।

হ্যাঁ আমি তো সেটাই বলছি যে এটা মডার্নিজমের রাজনীতি কিনা? 

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁএই কথাটা এতদিন পর আমার কেন মনে পড়লযে ইরান নেই কেনআরব নেই কেনভারত নেই কেনতাহলে মুসলিম দেশ বলেই কি এদের কবিতা খারিজ হয়ে যাবেএটা আমার মনে হয়েছে যে একটা কারণ আছে এর। তাদের কাছে মনে হয়েছে ইরানি আরবি ইত্যাদিকে অনাধুনিক মনে হয়েছে তাদের।

তাহলে এখানে সেই কথাটিই আসবে যে আধুনিকতাও পলিটিক্যাল টার্ম। যেটা বিশেষ করে লিটারারি মুভমেন্টগুলোর ভেতর দিয়ে রিফর্ম করেছে। আধুনিকতার নির্দিষ্ট প্রডিউসাররা আছেন। যারা আধুনিকতার স্ক্রিপ্ট লিখেছেন।

আসাদ চৌধুরী : হুম। আমি একটা কথা বলি আমাদের এখানে যখন বলা হয় মধ্যযুগ তখন কিন্তু ইউরোপীয় মধ্যযুগের কথাই বলা হয়। যখন ডাইনি পোড়ানোর নাম করে নারীদের পোড়ানো হতো। ক্রুশিফাই করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মধ্যযুগ হচ্ছে মোস্ট ব্রিলিয়ান্টকালারফুলএনলাইটমেন্ট। রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্য রচিত হয়েছে। আজকে পাহাড়পুর বা ময়নামতির খবর আমরা জানি। কিন্তু সারা বাংলায় এ রকম দশ থেকে পনেরোটা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন। বলতেই হয় বৌদ্ধদের পরিচালনায়। মুঘল আমলে বাংলাভাষার অগ্রগতিটা কিছুটা রুদ্ধ হলো। মুসলমানদের ভেতর আশরাফ আতরাফ এসে গেল।

 না আমার মনে হয় এটা তো শ্রেণিপ্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। সামন্তীয় যুগের পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে তখন এখানে। অথচ ইউরোপে তখন বুর্জোয়া যুগের শুরু।

আসাদ চৌধুরী : সৈয়দমিরখন্দকার এরা ওপরের ক্লাসের যারা কনভার্টেট মুসলিম আহমদ ছফার ভাষায় যারা ভেড়া। আমরা তো ভেড়া থেকে মুসলমান হওয়া। ভেড়াটা আহমদ ছফার ভাষা মানে চট্টগ্রামের ভাষা। এই পার্থক্য এল মুঘল আমলে কিন্তু তার আগে সুলতানি আমলে এই পার্থক্য ছিল না। ইংরেজদের আমলে একধরনের ক্লাস ডেভেলপ করল। মিডল ক্লাসের প্রসার ঘটল। এই মিডল ক্লাসে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। যদিও সৈয়দ আমীর আলীর মতো লোক এসে গেছে। কী ব্রিলিয়ান্টপ্রিভি কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন অনেক বছর। তিনি উর্দুর সপক্ষে ছিলেন। আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব তিনি একটা জায়গায় সৈয়দ আহমদকে সম্মান দেখালেন যে তিনি উর্দু চর্চা করেছিলেন। বাঙালি মুসলমান বাংলাভাষাকে নিয়েছে অনেক পরে। এমনকি বাংলা বর্ণমালাকে পর্যন্ত হিন্দুয়ানি বলা হয়েছে। যে কারণে আলাওলের অধিকাংশ ম্যানুস্ক্রিপ্টই আরবি অ্যাকসেন্টে লেখা। সেখান থেকে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহআহমদ শরীফ এরা কিছু কিছু কম্পাইল করেছেন। আমাদের এই যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসবিশেষ করে এখন যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস সেটা সোসিওপলিটিক্যাল রিজনে হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে আমরা চাই বা না চাই ভারতের যেকোনো তরঙ্গ এসে আঘাত করে আমাদের। আমাদের তরঙ্গ ভারতের মতো একটা বিশাল দেশের কোথাও কোনো আঘাত করার কারণ নেই। কাজেই আমরা খুব সহজেই প্রভাবিত হই। আমাদের এখানে চাই বা না চাই পাখি জামার জন্য মেয়েরা আত্মহত্যা করে। কিরণমালা জামার জন্য পাগল হয়ে গেছে মানুষ। এই যে ভারতের টেলিভিশনের সিরিয়ালগুলোর জন্য পাগল এখানে মানুষ এবং আরেকটা কথা হচ্ছে ওখানকার সিরিয়াল বা সিনেমায় কোনো না কোনোভাবে তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকে। কিন্তু তাতে তাদের সেকুলারিজমের কোনো হ্যাম্পার হয় না। কিন্তু আমাদের কোনো একটা নাটকে বা সিনেমায় কেউ টুপি পরে আসছে বা হাতে তজবি নিয়ে আসছে তাকে ভিলেন বানানো হচ্ছে। সে একটা ভিলেন হয়ে যাচ্ছে। এটা কি আইডেন্টিটি ক্রাইসিসযেকোনো কারণেই হোক না কেন এই বিশ্বায়নের যুগে আমেরিকা বা অন্যরা মিলিয়ে আমাদের ভেতর এই ক্রাইসিস তৈরি করেছে। এবং এটা আমাদের মতো ভুল রাজনীতির দেশে চাউর হয় বেশি। মানতেই হবে। মানুষকে তো সম্মান দিতে জানতে হবে। রাজনীতির প্রথম শর্ত হচ্ছে মানুষকে কর্মভিত্তিক কর্মসূচি দিতে হবে। রাজনীতি তো জনগণের জন্যইজনগণকে নিয়েই রাজনীতি করতে হবে। আমাদের এখানে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকব এটাই হচ্ছে রাজনীতি। এবং ক্ষমতায় যাবই এটা হচ্ছে রাজনীতি। আর সাম্প্রদায়িকতা বা জাতীয়তাবাদ এগুলো তো রাজনৈতিক হাতিয়ার।

আমি একটু ইন্টারফেয়ার করি আসাদ ভাই। দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক দেশেই এই বিশ্বায়নের মোড়লরা তাদের নাকগলায়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। যেমন বিশ্বায়নের মোড়লদের যে ডেমোক্রেসির ফর্ম এটা আসলে ফেক মনে হয়। এটার ভেতরে কিছু নেই। ডেমোক্রেসি আসলে একধরনের ফেনোমেনা। রপ্তানিযোগ্য পণ্য। এটা সারাবিশ্বে সাপ্লাই করছে কর্পোরেটোক্রেসি। এটার নামে অনেক আকাম করা যায়। এটাকে পশ্চিমা মিডিয়া প্রায় ঈশ্বর সমতুল্য করে ছেড়েছে। সারা দুনিয়ায় গরিব দেশগুলো ডেমোক্রেসি ডেমোক্রেসি বলে গলা ফাটাচ্ছে। বস্তুত এটার ছত্রছায়ায় যেভাবে মোড়লরা লাভবান হবে সেই চিন্তাটাই লুকিয়ে থাকে। একদিকে মুনাফা অন্যদিকে তাদের সমর্থন বাড়ানো। তো এই যে কথায় কথায় ভারতকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ। সে গণতন্ত্র কোথায়? বাংলাদেশে আমাদের নাভিশ্বাস উঠছে অথচ ভারতের চেয়ে নাকি বিভিন্ন দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে তাহলে বোঝেন ভারতীয় জনগণের কী অবস্থা? এগুলো মোড়লদের ব্যাংক বিশ্বব্যাংকের মনগড়া পরিসংখ্যান। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নাগাল্যান্ডের নাগারা, ঝাড়খন্ডে মাওবাদিদের যে তৎপরতা সেটা তো ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার দখলের জন্য নয়, সেটা তাদের জাতীয়তাবাদ রক্ষার জন্য। রাষ্ট্রের হাতপা থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু সাবকন্টিনেন্টে ভারতের বিশাল পুঁজি তৎপর। আপনি যে কথাটা বললেন যে মেয়েরা সিরিয়ালের পোশাকের জন্য আত্মহত্যা করছে। আমি আরেকটু যোগ করতে চাই যে আমাদের এখানে দূরপাল্লার বাসে, বিয়েবাড়ির মেহেদি অনুষ্ঠানে, এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারি বা ষোলোই ডিসেম্বরও এখন উদযাপন করা হচ্ছে রাস্তার মাঝখানে বিশাল সাউন্ড সিস্টেমে ভারতীয় সিনেমার আইটেম সং শিলা কি জওয়ানি, মুন্নি কি বদনামি ইত্যাদি বাজিয়ে। শুধু কি তাই বাংলাদেশের এমন একটা পণ্যের নাম বলেন যেটার একটা অলটারনেটিভ ভারতীয় পণ্য নেই?

আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁএটা ডেভেলপমেন্টের নামে করা সড়ক ব্যবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বিপুল পরিমাণ টাকা রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য ব্রিজ নির্মাণের জন্য ব্যয় হয়েছে। প্রধানত এগুলো করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এবং বিশ্বব্যাংক চেয়েছে জাপানি গাড়ি হোক ইউরোপের গাড়ি হোক গাড়ি বিক্রি করতে হবে। পরিষ্কার হিসাব। অথচ এর একশ ভাগের এক ভাগ যদি খরচ হতো নদী পরিবহন উন্নয়ন করার জন্য তাহলে যাতায়াতটা স্লো হতো কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু লাভ যেটা হতো সেটা হচ্ছে পরিবহন খরচ কমতো। নদীর নাব্যতা থাকত। পরিবেশের ক্ষতি হতো না তেমন। পেট্রোলের গাড়ি বা গ্যাসের গাড়ি বা ট্রেনের বগির যেই পরিবহন কস্ট সেটা যে কোনো ধরনের নৌকায় পরিবহন করলে তার দশ ভাগের এক ভাগ খরচ পড়ত।

এটাই বোধহয় মার্কস কমিউনিস্ট মেনোফেস্টোতে বলেছিলেন বুর্জোয়ারা তাদের পণ্য ও উৎপাদনের কাঁচামালের জন্য সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। পৃথিবীজুড়ে পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

আসাদ চৌধুরী : বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রেও তাই। এত ইলেকট্রিক্যাল গুডস কোথায় বিক্রি করবেএত টেলিভিশন সেট উন্নত বিশ্বে কয়টা করে কিনবেঅনেক ধরনের ইলেকট্রিক্যাল পণ্য তারা কোথায় বেচবে। যেহেতু তৃতীয় বিশ্বে এই সুযোগটা আছে। কিছু লোকের হাতে এজেন্সি নেয়ার মতো পয়সা আছে। আমাদের এখানে আসলে এটা শুরু হয়েছে আইয়ুব খানের আমলে। কন্ট্রাকটরির নাম করে কিছু লোক ধনী হয়েছে। ওখানে নাজমুল করিমের মতো একজন সমাজবিজ্ঞানী মন্তব্য করেছেন বিশ বছর পর রাজনীতি এদের হাতে থাকবে। আজকে যখন আমরা রাজনীতি দেখি ১৯৭৭-এর অ্যামেন্ডমেন্ট জিয়াউর রহমান করে গেছেন সেটা কীসমাজতন্ত্র বাদ। তার মানে কীআমরা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ঢুকলাম। আর বিএনপি যখন বলে যে আমরা একাত্তরের চেতনায় উদ্দীপ্ত এটা তো ভুল। এই মুক্তবাজার অর্থনীতি একাত্তরের চেতনার মধ্যে ছিলই না। জিয়াউর রহমান ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করলেন। এরশাদ এটা পাকাপোক্ত করে ফেললেন। সেখান থেকেও আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসতে পারছে না। তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির পার্থক্য কোথায়উভয়ের অর্থনৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে খুব বেশি যে পার্থক্য আছে তা না।

একাত্তরের পরে সত্তর আশির দশকের দিকে আমাদের সাহিত্য যেভাবে এগিয়ে গিয়েছিল যে প্রবল একটা জীবনমুখী ছিল। পেইন্টিংয়েকবিতায়সাহিত্যে সেটা পরে মন্থর হয়ে গেল কেনপেইন্টিংয়েই সম্ভবত সবচাইতে বেশি এগিয়েছে আমাদের সংস্কৃতি কিন্তু সংগীতেএখন তো ক্যাওটিক ছাড়া মনে রাখার মতো কোনো কিছু পেয়েছি বলে মনে হয় না।

সংগীতের কথা যদি বলা হয় তাহলে মিডিয়ার মানে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রভাবের কথা আসবেই। কারণ সারাক্ষণ আমাদের দর্শকরা তো ইউ ইউ হানি সিং মিকা সিং এগুলোই দেখছে। ফলে তাদের অজান্তেই তাদের মননে প্রবেশ করছে এই সব। 

আসাদ চৌধুরী : বিশেষ করে সারগাম বলে একটা প্রোগ্রাম দেখলাম আমি কদিন ধরে। সেখানে দেখলাম আমাদের ফোক গানের সঙ্গে তারা ওয়েস্টার্ন মিউজিক মিশিয়ে গান করছে। আমাদের লোকসংগীতের শুদ্ধতাও ওরা রাখতে দেবে না। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের গান নজরুলের গানের ওপরও হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছে। জানি না শেষ পর্যন্ত এদের হাত থেকে এরাও রেহাই পাবে কিনা। এগুলোও বিশ্বায়নের প্রভাব। তবে একটা ভরসা মাঝে মাঝে মনে হয় করা যায়। সেটা হচ্ছে এই আকাশ সংস্কৃতির শিকড়টা নেই। এরা আকাশেই শেষ হয়ে যাবে। দূরের প্রতি তৃষ্ণা থেকে হোকরোমান্টিসিজম থেকে হোক একসময় বব মার্লি বা বব ডিলান এদের গান কিন্তু আমাদের ভালো লেগেছে কিন্তু সেসব কি আছে এখন। এখন তো চিৎকার এটা সেটা। মিডিয়াই এগুলো তৈরি করে। যেমন পরশুদিন রাতে শুনলাম আমি কোরিয়ান এক শিল্পী ফুংচাং। একটা বাচ্চা মেয়ে। তিনি গান করলেন ব্লুচ করলেন। আমার কাছে অবাক লাগছে তিনি অনেকগুলো ব্লুচ করলেন। আমার মনে হলো এ মেয়ে না হয়ে পুরুষ হলে অ্যালভিস প্রিসলির মতো ঝুঁকে ঝুঁকে করতেন গানগুলো। ফুংচাং একটা বাংলাগানও করলেন। একদম নিখুঁত করলেন।

কোন গানটা করলেন তিনি?

আসাদ চৌধুরী : ওই যে প্রতুলের একটা গান আছে না আমি বাংলার গান গাইআমি বাংলার গান গাই। ওটা। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয় এবার আমি সরাসরিই বলব রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে সমাজ পলিউটেড হয়েছে। আমাদের দেশে অন্যায় প্রশ্রয় পাচ্ছে। আমাদের দেশে ঋণখেলাপি আমাদের দেশে স্মাগলারদের যে ইকোনমি তাদের যে সিন্ডিকেট। তাদের কাছ থেকে মিডিয়া মুক্ত হতে পারছে না। এবং আমরা চাই বা না চাই এক ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে গেছি। এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব বড় রকমের দার্শনিক মুভমেন্ট ছাড়া সম্ভব না। আর আমাদের দেশের বড় বড় আন্দোলন—ভাষা আন্দোলনএকাত্তর ইত্যাদির অর্জন সুবিধাবাদীদের দিকে চলে যায়। এটা ভুল রাজনীতির ব্যর্থ রাজনীতির ফলাফল আমাদের। এখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণ আপাতত আমি দেখছি না। এখানে যারা মার্কসবাদ পড়েছেন তারা ওই কেতাবে-কলমে আছেন। তাদের সঙ্গে জনগণের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তারা তাত্ত্বিক আলোচনা করতে পারেন বিশ্লষণ করতে পারেন। এগুলো সব মানি কিন্তু যেটা সত্য কথা জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সরকারের সঙ্গেও নেই বিরোধীদলের সঙ্গেও নেই। এটা আমরা গত অবরোধের সময়ও লক্ষ করেছি এবারও লক্ষ করছি। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে সরকার পুলিশ দিয়ে পেটাবে কেনজনগণের সঙ্গে যদি সম্পর্ক থাকে তাহলে বিরোধী দল হাওলাত করা লোকজন দিয়ে পেট্রোল বোমা মারবে কেনএগুলো প্রমাণ করে রাজনীতির সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা নেই। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা সাহিত্যেও কমে গেছে। সেলিনা হোসেনসৈয়দ শামসুল হকশওকত আলীমাহমুদুল হক—এদের লেখায় যতটা আমি জীবনকে পাই। হুমায়ূনের লেখায় আমরা কি সেভাবে পাইআমার মনে হয়েছে এটা। জনগণ আসলে এগুলো চায় নাএগুলোর কাছ থেকে মুক্তি চায়।

 এখানে আমি একটু বলতে চাই আসাদ ভাই। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যদি জনসম্পৃক্ততা না-ই থাকত তাহলে তার এত জনপ্রিয়তার কারণ কী? জনপ্রিয়তার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততার কোনো সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় কিনা?

আসাদ চৌধুরী : অনেকগুলো কারণ আছে বলে মনে হয় হুমায়ূনের জনপ্রিয়তার পেছনে। প্রথমত তার অসাধারণ গদ্যের হাত। যেটা শরৎচন্দ্র ছাড়া বাংলাসাহিত্যে খুব বেশি লোকের ছিল না। যা-ই লিখুক পড়তে হবে। ধরলে ছাড়া যায় না। পাঠককে সম্মোহন করার শক্তি এটা কম কথা না। এটা একটা বিশাল ব্যাপার। তারপর তার ভেতর ছিল অদ্ভুত এক তারুণ্য। একধরনের অ্যাবসার্ডিটি হিমু এবং মিসির আলি। এরা তো আর আকাশ থেকে আসে না। তার নায়ক-নায়িকাদের অনেকের মধ্যে হিমুকে পাওয়া যায়। এ সবকিছু মিলিয়ে কিছুটা বাস্তবতা থেকে দূরে।

না আমি একটু দ্বিমত পোষণ করব। এটাকে যদি আমরা বাস্তবতা থেকে দূরে বা বাস্তবতা না বলি আমার মনে হয় তাকে আমরা অন্তর্বাস্তবতা বলতে পারি। একটা বিষয় দেখেন মানুষ সম্মোহিত হয় এমন বিষয়ে যাতে তার প্রচুর আগ্রহ আছে। না হলে তাকে আপনি সম্মোহিত করতে পারবেন না। হুমায়ূনের এই সম্মোহনের পেছনে আমার মনে হয় একটা অ্যান্টিডায়লগের খেলা আছে। এটা ক্লাসকনসাসনেসও বলতে পারি। যেমন হুমায়ূনের নাটক-নভেলের অনেক চরিত্র আছে যাদের ক্লাস আলাদা। ধরেন একটা চাকর মেয়ে বদরাগী মনিব হয়তো সে বুর্জোয়া অথবা ফিউডাল। তার সামনাসামনি সে হয়তো প্রতিবাদ করে না। কিন্তু যখন সে বকা দিয়ে বা আদেশ দিয়ে চলে যায় তখন ক্যামেরার সামনে চাকরটি তার এক্সপ্রেশন দেয়। বলে তুই রাজাকার, বলে তোর শরবতের মধ্যে একটা মরিচ ভাইঙ্গা দিমু। যে বাস্তবতার কারণেই আমরা বলতে অপারগ তা হুমায়ূনে বলা যায়। আমার মনে হয় এই জন্যই সব শ্রেণির মানুষের কাছে হুমায়ূন এতটা গ্রহণীয়। এটাও একধরনের জনসম্পৃক্ততা মনে হয়। তা না হলে যাদের নাম আপনি বলেছেন তাদের লেখার উচ্চমান মেনে নিয়েও বলতে পারি যাদের জন্য তারা লিখেছেন খোদ তাদের কাছেও কি তারা পাঠ্য?

আসাদ চৌধুরী : না আমি বলতে চাইছিলাম যে বিষয়টা সেটা হচ্ছে আমার হার্ডলাইফের খুঁটিনাটি যে বিষয়গুলো। সেগুলো হুমায়ূন দেখাননি। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেগুলো আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে একটু নাড়া দিয়ে গেছে। আমি যেটা মনে করি এখন টেকনোলজির এই যুগে এসে। মানুষ এখন বই পড়ছে না কিন্তু জানছে সব। এটা বলতেই হবে প্রকাশকদের দিকে তাকিয়ে বাংলা বই সেভাবে পড়ছে না। বাংলাদেশে অনেক বিষয়ে গবেষণা হয়েছে। বাংলা একাডেমির তালিকা দেখেইউপিএলের তালিকা দেখেশুদ্ধস্বরের তালিকা দেখেগতিধারা এ রকম কিছু কিছু প্রকাশনী আছে। এরা যথেষ্ট চেষ্টা করছে পাঠক টানার। কিন্তু পাঠক সেভাবে আসছে না। কাজেই সাহিত্যে একটা দুর্বলতা কিন্তু এর মধ্যে ধরা পড়ে যাচ্ছে। সাহিত্যে আমার আরও যে বিষয়টা খারাপ লাগে তা হচ্ছে সাহিত্যে দলবাজিটা খুব বড় আকারে দেখা দিচ্ছে। সাহিত্যে একজনের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা থাকতেই পারে মত থাকতেই পারে। তার রচনাটাকে সেভাবেই দেখা উচিত। রচনাটা ভালো হয়েছে কি হয়নি এই বিবেচনায় দেখা উচিত। একেবারে রাজনৈতিক চেতনার কারণে করছে তাও না। একেবারে নিরেট দলবাজি। এটা সাহিত্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিভাজিত করে ফেলা।

তাহলে কি আমরা বলব সাহিত্য আখের গোছানোর সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে? একজনকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলো বা কর্পোরেট হাউসগুলো সে পুরস্কার দিচ্ছে। কিন্তু যাকে পুরস্কার দিচ্ছে তার লেখা পড়ে আমরা কিছুই বুঝলাম না, সবার ক্ষেত্রে না। তাহলে কেন দেয়া হচ্ছে এই পুরস্কার। কেন এই অসাহিত্যকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে আসলে আমার মনে হয় যারা পুরস্কার দিচ্ছে তারা সাহিত্যকেন্দ্রিক তাদের অবদানের একটা প্রচার দিচ্ছে। কাকে দিচ্ছে সেটা বিষয় না। হতে পারে সেটা তাদের আত্মীয় বা নিজস্ব লবির লোক।

আসাদ চৌধুরী : কোনো কোনো ক্যারিয়ারিস্টের ক্ষেত্রে সত্য হতেও পারে। হয়তো সবার ক্ষেত্রে সত্য না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে পাঠক কমে যাচ্ছে। তাহলে সাহিত্যের একটা দুর্বলতা কিন্তু এর মধ্যে ধরা পড়ে যাচ্ছে। তবে কর্পোরেট কালচারেরও একটা প্রভাব আছে। এখন একটা প্রোগ্রাম এমনকি লোকসংগীতের প্রোগ্রামও স্পন্সরড বাই অমুক। পাওয়ার্ড বাই তমুক। দেখা গেল যে শাহ আব্দুল করিমের গানের অনুষ্ঠান স্পন্সরড করছে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি।

আমি সেটাই বলছিলাম যে এটা তাদের একটা কৌশল। সে দেশীয় সংস্কৃতিকে প্যাট্রোনাইজ করার ভান করে আসলে কাস্টমারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সামাজিক সিস্টেমের অংশ হয়ে পড়তে চায়। এতে করে তার বাজারটা বিস্তৃত করতে চায় সে।

হ্যাঁএগুলো হচ্ছে নিয়মিত। এটা মুক্তবাজারের ফসল। এবং এগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া বা এগুলো থেকে মুক্ত হওয়াটা খুব সহজ হবে না। আমাদের রাজনীতিও যেমন সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমার মনে হয় আমাদের সংস্কৃতির ভুবনটাও সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বা হবে। এখনো পুরোপুরি পারেনি। কিন্তু প্রসেসটা অব্যাহত আছে।

কিন্তু এটা আমাদের কন্টেম্পরারি সমস্যা। যেমন আপনি একটু আগে বললেন যে আমাদের এখানে অনেক ভালো গবেষণাধর্মী বই হচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে অ্যান্টি গ্লোবালাইজেশন বা মুক্তবাজারের সমালোচনা করে লেখা টোটাল একটা বই খুঁজছিলাম। গ্লোবালাইজেশনের পুরা চিত্র পাওয়া যায় সেরকম একটা বই কেন লেখা হলো না। কলোনিয়ালিজমের ওপর কোনো পূর্ণাঙ্গ বই আপনি পাবেন না। অথবা ইম্পেরিয়ালিজমের প্রেজেন্ট ফর্মের ওপর কোনো বই পাবেন না আপনি। বিচ্ছিন্নভাবে বদরুদ্দীন উমর কিছু কলাম লিখেছেন। বা আনু মুহাম্মদও কিছু লিখেছেন। কিন্তু কোনো পূর্ণাঙ্গ কাজ নেই। ক্লাইমেট চেঞ্জের ওপরে কোনো বই নেই। অথচ বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন যে শুধু কোনো ফেনোমেনা নয় সেটা তো এবারের বন্যা পরিস্থিতি দেখেই বোঝা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রকাশনাগুলোও কম দায়ী নয়। অথচ নেটে সার্চ দিলেই এসব বিষয় নিয়ে শত শত ইংরেজিতে লেখা বইপত্রের ছড়াছড়ি। এবং ওগুলো ওরা পিডিএফ করে ছেড়ে দিয়েছে। যেন ফ্রি পড়তে পারেন। এখানে শুধু অতীতের ইতিহাস। এটা ওটা। এগুলো করে তো আসলে সাহিত্য বা চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। বর্তমানের পৃথিবীতে চিন্তার গতি কোন জায়গায় সেটা বুঝে কাজ করতে হবে। কিন্তু আমাদের সেই প্রকাশক সেই সম্পাদক কোথায়? ক্লাসিক বইগুলোর পুনর্মুদ্রণ, রাশিয়ান রাদুগার বইগুলোর পুনর্মুদ্রণ এগুলো আর কত নতুন লেখা কোথায় তাদের।

আসাদ চৌধুরী : হুম। নদী বিষয়েই বা কয়টি বই আছে। আজকে নদী বিষেশজ্ঞ বলতে ঘুরেফিরে আইনুন নিশাত। আছেন একজন নভেরা উনি লেখেন না উনি বক্তৃতা দেন। তা হলে কী দাঁড়াল?

 হ্যাঁ, আমিও সেটাই বলতে চাই যে এত এত বইয়ের পুনর্মুদ্রণ। এত এত  আজেবাজে বই ছাপে তারা বইমেলায়। এত কাগজের অপচয়। এই যে এবার সারাদেশে যে বন্যা পরিস্থিতি যে জলাবদ্ধতা আগামীতে তো আরো খারাপ অবস্থা হবে সে সবের ওপর বাইরে কত কাজ হয়েছে। একটা ফোল্ডারে আমার কাছে প্রায় এই একই বিষয়ে ৪৫০টি ইংরেজি বই আছে। বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের বান্ডেল করে ওরা নেটে ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। তাহলে প্রকাশকরা কি তাদের দায়িত্ব পালন করছে?

আসাদ চৌধুরী : আমাদের এখানে চিন্তার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমাকে ভাবায়। একটা হচ্ছে আমাদের দেশে চিন্তার ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আছে। ধর্মের যে সেকুলার জায়গা সেটার চর্চা এখানে নেই বললেই চলে। কিন্তু বাহ্যিক বাধ্যবাধকতার চর্চাই বেশি। কেউ যখন ধর্মের ফিলোসফিকাল জায়গাটা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছে। প্রশ্ন তুলেছে সেটা নিয়ে কিন্তু তার কপালে অনেক দুর্ভোগ নেমে আসছে। কারণটা কীকারণটা হচ্ছে আমরা এই কাঠামো থেকে কিছুতেই বেরিয়ে যাব না। ইরানে একসময় এটা হয়েছিল। স্পেনে হয়েছিল। চিন্তায় একটা বিপ্লব এসে গিয়েছিল তখন। এগুলো ইউরোপকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে আনতে সাহায্য করেছে। আমাদের দেশে সেই প্রয়াসটাই কখনো হয়নি। শিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কাজ করছেআহমদিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কাজ করছে। চট্টগ্রামে টুপি পরা নিয়ে মানে টুপি তিন ফালি না পাঁচ ফালি এ নিয়ে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে গেছে। কীভাবে পরা উচিত। কিন্তু এগুলো ধর্মদর্শনের মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় নিয়েই কোনো কাজ হয়নি। আমাদের এখানে শেয়ারিং নেই। তাহলে বুঝতে হবে আমাদের মধ্যে অনেকগুলো গ্যাপ আছে। এই গ্যাপের পেছনে কোনো হ্যান্ড আছে। এই সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের ভেতর যে উত্তেজনা। যে কারণে তাদেরকে টেররিস্ট বলা হচ্ছে। অথবা তাদেরকে টেররিস্ট বলার মতো পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হচ্ছে সেটাও তো ভেবে দেখা দরকার। এসব বিষয় নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করছে তারাও সাহস নিয়ে লিখছে না। আমি এ বিষয়ে কিছু লেখা পড়লাম এ পর্যন্ত তা ফরহাদ মজহারের লেখা। যেখানে তিনি চিন্তার ব্যাপারে খুবই পোলাইটলি কাউকে আহত না করেখুব ভালো লাগল। কিন্তু তাকে তো আর শিক্ষিত লোকজন পড়বে না তাকে তো পলিটিক্যালি দেখা হবে। কিন্তু আমার মনে হয় এরকম চিন্তার একটা ব্যাচ থাকা উচিত। যেখানে নিজেকে আইডেন্টিফাই করা যাবে। পশ্চিমে আমি দেখেছি আমি টরন্টোতে দেখেছি প্রত্যেক জুমাতে তিনজন চারজন মুসলমান হচ্ছেএবং তারা বই পড়ে হচ্ছে। আমাদের এখানে যারা ইসলাম চর্চা করেন তারা বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সেভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করতে পারছেন না বলে আমার মনে হয়।

 আচ্ছা আমার মনে হয় আমরা কবিতা নিয়ে কথা বলতে চেয়ে একটু ভিন্ন দিকেই চলে যাচ্ছি। কবিদের তো অনেক রাষ্ট্রচিন্তকরা তাদের আদর্শ রাষ্ট্র বা ইউটোপিয়া থেকে বহিষ্কার করেছেন। সেটা রিপাবলিক বা ধর্মগ্রন্থগুলোতেও আছে। প্লোটোনীয় সক্রেটিস রিপাবলিকে বলেন যে কবিতার নাটকীয়তা যেখান থেকে মানে মানবমনের যে স্তর থেকে উৎপন্ন হয় সেটা নাকি নিম্নমুখী আবেগ। তা আদর্শ রাষ্ট্রকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেছেন তিনি। আপনি কীভাবে দেখেন ব্যাপারটাকে?

আসাদ চৌধুরী : একজন কবি যখন লেখালেখি করেন সেখানে তার চিন্তা তার সৃজনশীলতা এসবের বাহন হচ্ছে কবিতা। তিনি সমকালীন কাব্যভাষায় সমকালীন পরিবেশে তিনি যখন লেখেন তখন তার বিশ্বাসের জায়গা থেকে লেখেন। বা তার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে তিনি সেটা নিয়ে লেখেন। এর ফলে হয় কী তার ব্যক্তিগত অনুরাগ অনুভূতি যখন শিল্পরূপ পায় তখন কিন্তু এটা সম্মোহনিক অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়। পরাধীন ভারতে বিদ্রোহী কবিতা রচনা সম্ভব হয়েছে। এবং বিদ্রোহী কবি বললেই এক নজরুল ইসলামকেই মনে করি। তার বয়স তখন কতকিন্তু তিনি অনুভব করেছিলেন যে মানুষের ভেতর প্রচুর সম্ভাবনা আছে। তিনি সেই সময়ের প্রতিটি মানুষের ইচ্ছে বাসনাকে এক আমির মধ্যে ধারণ করেছিলেন। এখন এই আমি যদি আরো বেশি সর্বপ্লাবী হতে পারে। যেমন কোনো একটা সমাজে স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নিয়ে যদি লিখি তাহলে কয়জন মানুষ গ্রহণ করবেআবার যদি ইসলাম নিয়ে লিখি তাহলে সেটার এরিয়া আরো বড় হবে। যেহেতু মুসলমানের সংখ্যা বেশি। কিন্তু আমি যদি মানুষকে নিয়ে লিখি সেটা আরো বেশি বড় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এটা এতটা হবে না। কথা হচ্ছে কবির সবচাইতে বড় দায়িত্ব হচ্ছে জাতি যখন দুঃস্বপ্নে নুইয়ে পড়ে কবি তখন স্বপ্ন দেখান। স্বপ্ন সে দেখে না শুধু দেখায়। এটি কোনো অত্যাচারী শাসক কখনোই পছন্দ করবে না। র‌্যাবো যেমন বোদলেয়ার সম্পর্কে বলেছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্নের দেবতা। স্বপ্ন দেখার বা দেখানোর ব্যাপারটা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। সুনীলের একটা কবিতা আছে সম্ভবতক্ষমতা কি আমার হাতেক্ষমতা তো আসলে কবির হাতে না। এটা হয়তো কবির কাজও না। এটা রাজনীতিবিদদের কাজ। সুভাষ বসু স্পষ্ট বলেছিলেন আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন নজরুলের গান সঙ্গে নিয়ে যাব। কারণটা কীকারণ হচ্ছে নজরুলের গান তাকে প্রেরণা দেয়। উৎসাহিত করেঅনুপ্রেরণা জোগায়।

 টেকনোলজি ও কবিতা কীভাবে পাশাপাশি চলছে?

আসাদ চৌধুরী : আগেকার দিনে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যেতে লোকজন চিড়ামুড়ি নিয়ে যেত। এখন লোকজন কলকাতায় যায় পকেটে কটা টাকা নিয়ে ডলার ভাঙিয়ে। চিড়ামুড়ি নেয়ার প্রয়োজন এখন আর নেই। পৃথিবী ঘুরে আসছে তিন দিনের মাথায়। এই যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অস্বাভাবিক অগ্রগতি। পার্টিকুলারলি এই যে ইলেকট্রনিক্সের অগ্রগতিইনফর্মেশন টেকনোলজির অগ্রগতি এগুলো তো প্রচণ্ডশক্তিমান এখন। কিন্তু অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদের ফিলোসফিটা কি এগোচ্ছেফিজিক্স কি সেভাবে এগিয়েছেফিজিক্সের যে অগ্রগতি তা আমরা এখন এক মোবাইলের ভেতরই পেতে পারি। সাহিত্য কি এভাবে এগিয়েছেহয়তো সাহিত্য এ রকম না। কবিতার স্বভাবটাও এরকম না। তার একটা ধারাবাহিকতা আছেপরম্পরা আছে। তা মেনে নিয়েই এগিয়ে চলার ব্যাপার আছে। কাজেই একথা বলতে হয় যে শেক্সপিয়র যখন একটা চরিত্র দিয়ে বলায় কথাটা তখন কিন্তু সে নিজেই বলে। একটা গান আছে না আমার মধ্যে বসত করে কয়জনা মন জান না। এই যে ইন্টিভিজুয়ালিটির ভেতর মাল্টিভিজিবলিটি এটা স্বাভাবিকতা আসলে। সাহিত্যে অনেককে জায়গা দিতে হবে। যে সাহিত্যে অনেকের জায়গা নেই সেটা আগাতে পারে না। আমাদের বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করে এখন। এরা লেখাপড়া করে কী করে বেশি মার্কস নিয়ে পাস করতে পারবে সে চিন্তায় ব্যস্ত। এর ফলে সাহিত্যের যে প্রধান পৃষ্ঠপোষক তরুণ সমাজ। তারা কমে যাচ্ছেপাঠক অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটা ভালো আলামত না। এরপরও বিপুল আয়তনের ঈদসংখ্যা বেরোচ্ছে। খারাপ ভালো মিলিয়ে লেখা হচ্ছে।

আচ্ছা আরেকটা ব্যাপারে কথা বলতে চাই সাহিত্য পুরস্কার। বিশেষ করে পুরস্কার হচ্ছে একটা উত্তেজনাকর ব্যাপার আর সাহিত্য কেমন যেন একটা মগ্নতার বিষয়। এ দুটোকে কীভাবে মেলানো যায়?

আসাদ চৌধুরী : আমিও দুয়েকটা পুরস্কার পেয়েছি। আমার ক্ষেত্রে বলা যায় যে কিছু টাকা-পয়সা পেয়েছি। সেটা লাভজনক ব্যাপার। পুরস্কার পেলে একটু কাগজে-টাগজে ছবিটবি ছাপা হয়। একটু প্রচার হয়। এ ছাড়া এটার আর কী দাম আছে আমি জানি না।

আপনার প্রায় আঠারোটা কবিতার বই। শিশুসাহিত্যে অনুবাদ ও সম্পাদনাসহ আপনার প্রায় সমসংখ্যক বই আছে। এই দেশে ক্রিয়েটিভ রাইটাররা শিশুসাহিত্যকে এড়িয়েই চলেন বলা যায়। ম্যাক্সিমামেরই শিশুসাহিত্য নিয়ে কোনো কাজ নেই। তারা শিশুসাহিত্য পড়েন কিনা আমার সন্দেহ হয়। আমাদের এখানে শিশুসাহিত্য নিয়ে তেমন গবেষণাও চোখে পড়ে না। সম্প্রতি শিশুসাহিত্যে বিশ্বায়ন বা কলোনিয়ালিজমের প্রভাব নিয়ে একটা বই পড়লাম শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোপাল রাখাল দ্বন্দ্বসমাস খুব ভালো কাজ। অথচ শিশু অবস্থা থেকে যদি ভালো পাঠক গড়ে না ওঠে তাহলে সাহিত্যের পাঠক কারা হবে?

আসাদ চৌধুরী : হুঁ। অনেকেই পছন্দ করে না শিশুসাহিত্য। আমার আরো বেশি হবে শিশুসাহিত্য। শিশুসাহিত্য সাহিত্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। শিশুদের জন্য যদি আমরা ভালো বই লিখতে না পারি। বা ভালো অনুবাদ যদি তাদের হাতে তুলে দিতে না পারি তাহলে আজকে যে আমরা বলছি পাঠক নেই পাঠক নেই। তবে পাঠক তৈরি হবে কেমন করে। দেখা যাবে যে সমস্ত দেশে সাহিত্যের পাঠকদের নিয়ে গর্ব করে। মানে অনেক পাঠক বই পড়ে। সেসব দেশে শিশুসাহিত্যও তত উন্নত। ইভেন কলকাতার কথাই যদি ধরি। কত রকমের শিশুদের পত্রিকা ও প্রকাশনা। এজন্য ওখানে পাঠকও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও একজন লেখক নিজেই পাঠক তৈরি করবেন। তার নিজের পাঠক নিজেই তৈরি করবেন। সে ক্ষেত্রে শিশুসাহিত্যের বিকল্প নেই। পত্রপত্রিকা প্রকাশনা তো বটেই ওরা তো পাঠক তৈরির চেষ্টা করবেই। একজন লেখককে তার নিজের পাঠক নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। এই আমাদের দেশে চাই বা না চাই মাঝে মাঝে যে মৌলবাদের হুঙ্কার হয়। সমাজে নানা ধরনের শিশুকিশোর অপরাধ হয়। এর প্রধান কারণ উপেক্ষিত শিশুসাহিত্য। অন্যতম প্রধান কারণ। মাদ্রাসাগুলোতেও বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। ওখানে কোনো সাহিত্যই তো নেই। যা তাদের মনন গড়ে দেবে। মনে রাখতে হবে এটা আমাদের বিশাল এক জনগোষ্ঠী কিন্তু। এরা পাসটাস করে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাদের অশিক্ষিত বলে উপেক্ষা করলে তো হবে না। তাদের মধ্যেও অনেক ট্যালেন্ট আছে। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করছে তারা। সো শিশুসাহিত্য পড়ানোর মাধ্যমে তাদের মনন গঠনের উদ্যোগ নেয়া অবশ্যই জরুরি। কাজেই এটা সত্য কথা যে এ ক্ষেত্রে মানে শিশুসাহিত্যে আমাদের দুর্বলতা আছে। প্রকাশনার ব্যাপারেও বলব কী ছাপা কী বাঁধাই অনেক উন্নত এখন। কিন্তু ম্যাটেরিয়ালের দিকে তাকালে মনে হয় কিছু দুর্বলতা আমাদের আছে। আমি যে কারণে বিজ্ঞানীদের নিয়ে লিখেছিআমি যে কারণে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে লিখেছি শিশুতোষ লেখা এটা একটা দায়িত্ববোধ থেকে লেখা। শিশুসাহিত্য নিয়ে আরো কিছু লেখার প্ল্যান আছে আমার।

 দেশে বিদেশে অনেক কবিতা সম্মেলনে আপনি গিয়েছেন। মিশেছেন অনেকের সঙ্গে। কবিদের জন্য কোন পেশাকে অধিকতর ভালো বলে মনে করেন?

আসাদ চৌধুরী : এটা আসলে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব না। আমার মনে হয় নিজের পেশাকে নিয়ন্ত্রণ করেই কবিকে লিখতে হবে। টমাস মান ব্যাংকার ছিলেন। টিএস এলিয়ট ব্যাংকার ছিলেন। হেমিংওয়ে সাংবাদিকতা করতেন। বাংলাদেশে যারা কবিতা লেখেন বা সাহিত্য করেন তাদের অধিকাংশেরই পেশা মনে হয় অধ্যাপনা আর সাংবাদিকতা। ত্রিশের দশকের প্রায় সবাই অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু ইউরোপে একটা বই যদি কোনো প্রকারে হিট হয়ে যায় তাহলে তাকে আর কিছু করতে হয় না।  যেমন হ্যারল্ড রবিন এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখক না। কিন্তু তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে অভিজাত হোটেলে রুম বুকিং করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গিনী প্রয়োজন হলে তাও দিয়ে প্রকাশক বলে যে এবার লেখো। এটা মহৎ সাহিত্য কিছু না। আবার জে কে রাওলিংয়ের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না। তিনি মূলত বাচ্চাদের জন্য লেখেন। আমি দেখেছি তার দ্বিতীয় বইটা যখন বের হয় তখন আমি আমেরিকায় ছিলাম। ভার্জিনিয়া থেকে আমার নাতনিকে নিয়ে আমার ভাগনে যাবে ওয়াশিংটনে। কেনবইটা কিনতে। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক মানুষের পেছনে পেছনে দাঁড়িয়ে সে বইটা কিনল। এবং হ্যারিপটারের বইগুলো বয়স্ক লোকেরাও আমেরিকাতে কাভারটা কাগজে মুড়ে নিয়ে তারপর পড়ে। কিন্তু এটা তো কোনো বাস্তবতা না। এটা একধরনের ম্যাজিক। স্বপ্ন দেখানো। এর মধ্যে হয়তো একটা নীতিকথা থাকে যে সত্য কখনো পরাজিত হয় না। অনেকটা বাজারি সিনেমাগুলোর মতো মারপিট যা-ই ঘটুক শেষে সত্যের জয় হবে। আমাদের এখানে আব্দুল করিম নামে একটা লোককে চিনতাম। ইন্দিরা গান্ধী মারা গেল তাকে নিয়ে একটা বই লিখে ফেলল। ভুট্টো মারা গেল তাকে নিয়ে একটা বই বেরিয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু মারা গেল তিনদিনের মধ্যে তার বই বেরিয়ে গেল। আবার তিনজনকে নিয়ে লেখাগুলোকে একত্র করে আলাদা একটা বই বেরিয়ে গেল। এগুলোকে পথুয়া সাহিত্য বলে। কাজেই লেখকের কাজ কী হবে তা বলা মুশকিল।

 কবিতা ও সংসার একসঙ্গে কীভাবে সম্ভব? বিশেষ করে যখন কবি বা লেখক সে বইপত্র কিনছে সেগুলো সবসময় পড়ছে সে বিভিন্ন মানুষের মাঝে চলে যাচ্ছে। মোটকথা এটাও একটা সংসারের মতো। ছফা ভাইকেও আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একবার। তিনিও আমাকে তাই বলেছিলেন। আমি আসলে বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে, ‘বিয়ে করেননি কেন?’ তিনি আমাকে ধৈর্য ধরে জবাব দিয়েছিলেন যে একজন লেখক যা করে তা সংসারের চেয়ে কম না। বইপত্রের সঙ্গে থাকা, ইতিহাস ও সাম্প্রতিকতার সঙ্গে থাকা সেগুলো নিয়ে লেখা পয়দা করা। পয়দা হওয়া বইগুলোই তো লেখকের সন্তান।

আসাদ চৌধুরী : আমার ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি যে আমি ভাগ্যবান। আমার স্ত্রী আগাগোড়া কো-অপারেট করেছে। আমার মা কো-অপারেট করেছে। আমাকে কোনো কাজ করতে হয়নি। এমনকি এখনো টাকা রোজগার করতে হয় না। আমার কাছ থেকে মাঝে মাঝে চাঁদাবাজি করে সেটা হচ্ছে আরাম পায় বলে। দরকার নেই তবু একটুখানি বিরক্ত করল বা হয়তো আমি নিজেই কো-অপারেশন করি না ভাবব বলে হয়তো জড়ালো এমন আরকি। যেমন বাজারে গেল। আমার কাছে টাকা চাইল। ভাবলাম কী জানি কত টাকা চায়। দুই হাজার টাকা চাইল কিন্তু দশ হাজার টাকার বাজার করে আনল। এই দুই হাজার টাকা না নিলে তার কিছুই হতো না।

 বাংলাদেশে কাদের কবিতা মনোযোগ আকর্ষণ করে আপনার?

আসাদ চৌধুরী : আমি তরুণদের কবিতা পছন্দ করি সব সময়। আমাদের কালের যারা তাদের মোটামুটি সবার লেখাই ভাল লাগে। শুনতে খুব খারাপ লাগবে সমুদ্রগুপ্ত মারা যাওয়ার পর। কবিতার মধ্যে যে একধরনের মজা সেটা পাই না। নির্মলেন্দু গুণ এখনো লিখে যাচ্ছেন। আল মাহমুদ এখনো চোখে দেখে না। কানে শোনে না। তারপরও বিস্ময়কর কিছু কবিতা লিখছেন। তরুণদের মধ্যে অনেকেই ভালো লিখছে তবে আমার একটা নালিশ যেটা তরুণদের মধ্যে হয়। পরপর চিত্রগুলো যে দেয় সেগুলোর পরম্পরা অনেক সময় তৈরি হয় না। গ্রন্থনার মধ্যে কোথাও একটা খাদ থাকে। কবিতাটা ঠিক পূর্ণতা পায় না। আমি ঠিক ধরতে পারি না। পিছলে পিছলে পড়ে যায়। টোকন ঠাকুরমুজিব ইরমের কবিতা ভালো লাগে।  আবার সরকার আমিনের কিছু কিছু চিত্রকল্প আমার ভীষণ পছন্দের। আরেকজন কবির লেখা আমার খুবই ভালো লাগে ময়ূখ চৌধুরী চট্টগ্রামে থাকে। আমি যে লেখা পড়ি তারা হাততালির জন্য লেখে না। আমাদের এখানে আবৃত্তির জন্য একধরনের কবিতা বেছে নেয়া হয়। তারা হাততালির জন্য পড়ে। মহৎ কবিতা তারা কখনোই নির্বাচিত করে না।

 বোদলেয়ার একবার বলেছিল যে কবিতা যা তা আবৃত্তিযোগ্য না। বা যা আবৃত্তি করা যায় না তা-ই কবিতা।

আসাদ চৌধুরী : না। আমি তা মনে করি না। হয়তো আবৃত্তিওয়ালারা অন্যের কবিতা বেশি পড়ছে। আর তাই রেগেমেগে বলেছিলেন। হতে পারে। যারা আবৃত্তি করে তারা তো আসলে পরের ধনে পোদ্দারি করে। দেখা গেল যে কবি না খেয়ে মরছে আর আবৃত্তিওয়ালা তারকা হয়ে গেছে। এ রকমই তো হয়।