শ্রদ্ধাঞ্জলি: ভাষা আন্দোলনের বিস্মৃত সাহসী নারীরা

সুফিয়া কামাল, শরিফা খাতুন, লায়লা নূর, চেমন আরা, নাদেরা বেগম ও রিজিয়া খাতুন (বাম থেকে ডানে)

‘কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।’

 কবি তার কবিতায় নারী স্বাধীনতার জয়গান গাইলে কি হবে, ইতিহাস তো সব সময় কথা কয় না। যদি কথা কইতে পারতো তাহলে বাংলা ভাষার আন্দোলনে এদেশের নারীদের ভূমিকার কথা লেখা থাকতো স্বর্ণাক্ষরে। পাক শাসকদের বিরুদ্ধে ভাষার আন্দোলনের সূচনা লগ্ন থেকেই নারীরা ছিলেন সম্মুখ সারিতে, পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছে বিক্ষোভ-আন্দোলনে। এজন্য জেলও খেটেছেন অনেক নারী। শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গোটা দেশের নারীরা। তবে ঠিক কতজন নারী সে সময় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব মনে রাখেনি ইতিহাস। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে- সক্রিয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের সংখ্যা শতাধিক। এদের মধ্যে ১৫ জনের কথা বিস্তারিত জানা যায়। এই নিবন্ধে আমরা ওই ১৫ জনের ওপর আলোকপাত করবো। তবে এদের মধ্যে আমরা মাত্র ১২ জন ভাষা সৈনিক নারীর আলোকচিত্র সংগ্রহ করতে পেরেছি।

হালিমা খাতুন (১৯৩৩-২০১৮)
বাংলাদেশের যে কয়েকজন নারী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন তাদেরই একজন অধ্যাপক হালিমা খাতুন। শিক্ষকতার পাশাপাশি শিশু সাহিত্যিক হিসাবেও তার সুনাম রয়েছে। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে ২০১৯ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন ভাষা সৈনিক অধ্যাপক হালিমা খাতুন। এছাড়াও তিনি ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক ভাষা সৈনিক সম্মাননা এবং সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও লেখিকা সংঘ পুরস্কার।  হলেন একজন বাংলাদেশী অধ্যাপক ও সাহিত্যিক। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা ও শিশু সাহিত্য রচনা করার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।[৩] ভাষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।

আনোয়ারা খাতুন (১৯১৯-১৯৮৮)
আনোয়ারা খাতুনএকজন বাঙালি নারী রাজনীতিবিদ যিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৪৬ সালে তৎকালীন থেকে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।[১] ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনেও জয় লাভ করেন তিনি। আনোয়ারা খাতুন আলী আমজাদ খানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্বামী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি ছিলেন। ৪লায়লা নূর ((১৯৩৪ -২০১৯)

লায়লা নূর (১৯৩৪-২০১৯)
লায়লা নূর ছিলেন শিক্ষাবিদ, অনুবাদক ও ভাষা সৈনিক। ১৯৫৭ সালে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম মহিলা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি একটানা ৩০ বছর শিক্ষকতা করার পর পরে ১৯৯২ সালে অবসর নেন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন এই সাহসী নারী। ১৯৫৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে মিছিল করতে গিয়ে যে ২১ জন নারী পাকিস্তান পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের দলে লায়লা নূরও ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি ২১ দিন কারাভোগ করেন।

রওশন আরা বাচ্চু (১৯৩২ – ২০১৯)
বায়ান্নোর  ভাষা আন্দোলনের সামনের দিকের একজন সংগ্রামী ছিলেন এই নারী। ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে সকল ছাত্র নেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত তৈরির জন্যও ব্যাপক চেষ্টা করেন। তিনি ইডেন মহিলা কলেজ এবং বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়েরর ছাত্রীদের সংগঠিত করে আমতলার সমাবেশ স্থলে নিয়ে আসেন। এখান থেকেই ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তারা ব্যারিকেড টপকিয়ে মিছিল নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে ব্যরিকেড টপকানো বেশ কঠিন ছিলো। রওশন আরা বাচ্চু তার দলের সবাইকে নিয়ে পুলিশের তৈরি ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলেন। এরপর পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে দেয়। এতে নিহত ও আহত হন অনেকে। পুলিশের প্রহারে রওশন আরা বাচ্চু নিজেও আহত হয়েছিলেন।
 
রিজিয়া খাতুন (১৯৩১-)
 রিজিয়া খাতুন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সৈনিক। নড়াইল জেলা থেকে যে তিনজন নারী ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন রিজিয়া খাতুন তাদেরই একজন। এছাড়া ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে নড়াইল জেলা শহরে প্রথম যে ১০-১৫ জন মিলে শহীদ মিনার স্থাপন করে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন সেই দলে ছিলেন তিনিও। ভাষা আন্দোলনের পাশপাশি ব্রিটিশবিরোধী তেভাগা আন্দোলনেও তার সক্রিয়া ভূমিকা রয়েছে।

১৯৫২ সালে ঢাকায় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু হলে এর ঢেউ লাগে জেলা শহরগুলোতে। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে নড়াইলেও শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। সেদিন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’এই স্লোগানে মুখরিত করে তোলে। সেদিন ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য ছাত্রীদের আহ্বান জানালে নড়াইলে মাত্র তিনজন নারী সরাসরি যোগ দেন মিছিলে। এদের একজন রিজিয়া খাতুন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে নড়াইল শহরের মহিষখোলা বর্তমানে নড়াইল সদর এলাকার বাসিন্দা ও তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন মোক্তারের বাড়িতে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। এসব বৈঠকে অংশ নেন রিজিয়া খাতুন, আফসার উদ্দিনের কন্যা সুফিয়া খাতুন ও রুবি। এ বৈঠকে ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার জন্য কাজের পরিকল্পনা নেয়া হতো। তিনিসহ ১০-১৫ জন মিলে শহরের তৎকালীন কালিদাস ট্যাংক (বর্তমান টাউনক্লাব) এরপাশে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করে পুস্পমাল্য অর্পণ করেন। [

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষিকা। ৯০ বছরের এই ভাষা সৈনিক বর্তমানে অবসরে আছেন।

কাজী খালেদা খাতুন (১৯৩৯-২০১৩)
কাজী খালেদা খাতুন ভাষা আন্দোলনের সেই মহান সৈনিকদের অন্যতম যারা অত্যন্ত কম বয়সে, স্কুলের ছাত্র থাকা কালীন সময়েই ভাষা আন্দোলনে সংযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে খালেদা খাতুন কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ভাষা কন্যা রওশন আরা বাচ্চু সহ অন্যান্য ভাষা সৈনিকেরা সেই সময়ে সমাজের সর্বস্তরের সকল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন যার মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন কাজী খালেদা খাতুন।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারার মধ্যেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলার সভায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে মিছিল নিয়ে বের হলে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন খালেদা খাতুন। পুলিশের ছোঁড়া কাঁদানে গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কাজী খালেদা খাতুন এবং অন্যান্য ভাষা কন্যারা মিলে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরি করেন। এটি ছিলো কোনো স্কুলে তৈরী প্রথম শহীদ মিনার।

মমতাজ বেগম (১৯২৩-১৯৬৭)
মহান বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগ্রামী নারী মমতাজ বেগম। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি চরম ভাবে লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হন, এমনকি দীর্ঘ কারাভোগ পর্যন্ত তাকে করতে হয়। এমনকি এতে অংশ নেয়ায় তার সংসার পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল।

তার আগের নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেন মুসলিম যুবক আব্দুল মান্নাফকে। তার স্বামী মান্নাফ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সিভিল সাপ্লাই অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসা। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তিনি মমতাজ বেগম নাম গ্রহণ করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তার সংসার ভেঙে যায়। তিনিই একমাত্র মহিলা যাকে ভাষা আন্দোলন করার দায়ে তার স্বামী তালাক দেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলোনের সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। '৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মর্গান হাইস্কুলের নিকটস্থ রহমতুল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে মর্গ্যান স্কুলের ছাত্রীসহ মহিলাদের প্রথম মিছিল নিয়ে উপস্থিত হন মমতাজ বেগম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। বিক্ষুব্ধ জনতা সারা দেশে সভা সমাবেশের উপর চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিশাল মিছিল বের করে। এতে নারীদের নিয়ে অন্যতম নেতৃত্ব দেন মমতাজ বেগম।

চরম বাঁধা এবং রক্ষনশীল পরিবেশের মধ্যেও নারীদের একত্রিত করে মিছিলে অংশগ্রহণ করা এবং ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে গোপণ কার্যক্রম চালানোর দায়ে পুলিশ তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। তিনি ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য তৎকালীন রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক ও মতবিনিময় করতেন। আদমজী জুট মিল শ্রমিকদের সঙ্গে বেশ কয়েকদফা বৈঠক করে তাদেরকে আন্দোলনে উৎসাহিত করেন।

২৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তাকে গ্রেপ্তার করে হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কোর্ট তার জামিন নামঞ্জুর করে। সংবাদ পাওয়া মাত্র ক্ষেপে ওঠে নারায়ণগঞ্জ বাসী। উত্তেজিত জনতা থানা ঘেরাও করে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মমতাজ বেগমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু চাষাড়া পর্যন্ত যেতেই জনতার বিশাল বাঁধার মুখে পড়ে পুলিশ। শুরু করে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু উত্তেজিত জনতার বিশাল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ। ঢাকা থেকে আসে পুলিশ এবং ইপিআর এর আরো ফোর্স। এদিকে উত্তাল নারায়ণগঞ্জ বাসী চাষাড়া থেকে পাগলা পর্যন্ত রাস্তার প্রায় ১৬০ টি গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পুলিশ-জনতার তীব্র সংঘর্ষে আহত হন শত শত ব্যক্তি। শতাধিক গ্রেপ্তার হন। গণগ্রেপ্তার এবং লাঠিচার্জের মুখে রাতের বেলা একটি ট্রাকে করে মমতাজ বেগম এবং তার সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতদের ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়। এই সংবাদ দৈনিক আজাদ, ভারতের দ্য স্টেটসম্যান সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এরপর সরকার মমতাজ বেগমকে শর্তাধীন বন্ড সইয়ের মাধ্যমে মুক্তি দিতে চাইলেও তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে তাকে দীর্ঘ কারাভোগ করতে হয়। সরকারি চাকরিও হারাতে হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের কারণে প্রথম এবং একমাত্র চাকরিচ্যুত নারী হলেন তিনি।১৯৫৩ সালের মে মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পান।

ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ষাট বছর পর ২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসাবে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে  বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া তার সম্মানে নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের সামনের সড়কটির নাম রাখা হয়েছে 'ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’।

বেগম মমতাজ হচ্ছেন একুশের হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম নারী যিনি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কারাভোগ করেন। আটক হওয়ার প্রায় দেড়বছর পর মুক্তি পান তিনি। এরপর শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। এই ভাষা সৈনিক মারা যান ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ ।

জোবেদা খানম চৌধুরী (১৯০১-১৯৮৬)
জোবেদা খানম চৌধুরী বা জোবেদা রহিম চৌধুরী মহান ভাষা আন্দোলনের অগ্রসেনানীদের একজন। তিনি বাংলাদেশের নারী রাজনীতির অন্যতম পথিকৃত।

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা: বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকেই সিলেট জেলার মহিলাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত এবং পরে পূর্ববঙ্গের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। এখানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ স্মারকলিপি পাঠানোর পর থেকে বিভিন্ন ভাবে তাদের উপর চাপ আসতে থাকে। এ সময় সিলেটে উর্দু সমর্থক পত্রিকা ইস্টার্ণ হেরাল্ড তাদের সম্পাদকীয়তে নেত্রী জোবেদা খানম চৌধুরী ও স্মারকলিপি সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য প্রকাশ করে। এই অশোভন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন আরেক মহান ভাষা সংগ্রামী সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন। সাপ্তাহিক নওবেলালের ১২ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদ লিপিতে তিনি বলেন, ‘যাহারা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী হইয়া মাতৃভাষার বিরুদ্ধাচরণ করে তাহারা মাতৃভাষার বিশ্বাসঘাতক কু-পুত্রতুল্য।…উর্দু ভাষাভিজ্ঞ অপেক্ষা সিলেটের উর্দু অনভিজ্ঞ মুসলমানেরা ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পালনে কোন অংশে হীন ? বরং এ বিষয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সিলেটের মুসলমানদের তাহজীব ও তমদ্দুন এক বিশিষ্ট স্থান লাভের অধিকারী বলিয়া অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মত প্রকাশ করিয়াছেন।’

তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম জোবেদা খানম চৌধুরীসহ নারী নেত্রীদের এই অনন্য সাহসী ভূমিকার জন্য চিঠি লিখে অভিনন্দন জানান। তিনি লেখেন, ‘আজ সত্যিই আমরা অভূতপূর্ব আনন্দ এবং অশেষ গৌরব অনুভব করছি।সিলেটের পুরুষরা যা পারেনি তা আপনারা করেছেন। উর্দুর সমর্থনে সিলেটের কোন কোন পত্রিকা যে জঘন্য প্রচার করছে আর সিলেটের কোন কোন পুরুষরা স্মারকলিপি দিয়ে যে কলঙ্কজনক অভিনয় করেছেন তা সত্যিই বেদনাদায়ক। কিন্তু আপনাদের প্রচেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই।…তমদ্দুন মজলিশ আজ আপনাদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছে।’

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালিরা। এসময় জোবেদা খানমের নেতৃত্বে জিন্নাহ'র কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তারবার্তা পাঠানো হয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ছাত্র ও জনতার উপর পুলিশের নির্মম আক্রোশের প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারিতে সিলেটে বহু নারী একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। জোবেদা খানম সিলেট আঞ্চলিক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

তার পুত্র আহমদ কবির চৌধুরী একজন ভাষা সংগ্রামী ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষন শুরু করলে আহমদ কবির চৌধুরী মারাত্মক আহত হন।

কেবল ভাষা অন্দোলন নয়, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের সময় তিনি অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। তার নেতৃত্বে ঢাকাতে মহিলাদের মিছিল বের হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতেন।

নাদেরা বেগম (১৯২৯-২০১৩)
নাদেরা বেগম মহান বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠক এবং কর্মী ছিলেন। বাংলাদেশে মুসলিম নারীদের বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন

বড় ভাই কবীর চৌধুরী এবং মেজো ভাই মুনীর চৌধুরী দুজনেই বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠেও বড় ভাইদের সহায়তায় পড়াশুনা শেষ করতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ করার সময়েই তিনি জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। মুনীর চৌধুরী'র অনুপ্রেরণায় কমিউনিস্ট ছাত্রী সংস্থা গঠনের কাজ শুরু করেন।

১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন সরকারের নির্দেশে ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বহিস্কার ঘোষণা করে। যাদের মধ্যে একমাত্র মেয়ে হিসেবে নাদেরা বেগমের নাম ছিলো। পুলিশ তার নামে হুলিয়া জারি করলে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। এ অবস্থায় তিনি পালিয়ে পিকেটিং-মিটিং-মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হলে ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা আর রংপুর জেলে দুই বছর কারাভোগ করেন তিনি।

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা:তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের অন্যতম সংগঠক। ১৯৪৮ সালের ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত সভাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সভায় পুলিশি অ্যাকশনে তিনি আহত হন। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে আরবি, রোমান ইত্যাদি বিভিন্ন হরফে লেখার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান তিনি। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে তার প্রচেষ্টায় কামরুন্নেসা স্কুল, বাংলাবাজার স্কুল, ইডেন মহিলা কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়ে তিনি নারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। পরবর্তীতে এসব নারীরা ভাষা আন্দলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতি-চারণায় সেগুলো উঠে আসে। ভাষাসৈনিক ড. হালিমা খাতুন বলেন, ‘নাদেরা বেগম তখন আন্দোলনের কিংবদন্তি নায়িকা। অনেকবার জেল খেটেছেন। ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে আমি নাদেরা বেগমের কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে আনি। মেয়েরা পরদিন সকালে আমতলার সভায় অংশগ্রহণ করেন। তার চিঠির ভাষা ছিল এমন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটাকে প্রতিহত করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাও।’

 সৈয়দা শাহার বানু (১৯১৪-১৯৮৩)
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং সিলেটে নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন ভাষা সৈনিক । তার বর্ণাঢ্যময় রাজনৈতিক জীবন ভাষা আন্দোলন এবং সিলেটের ঐতিহাসিক গণভোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার ছেলে।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকেই সিলেট জেলার মহিলাদের পক্ষ থেকে পূর্ববঙ্গের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। আর ঐতিহাসিক এই স্মারকলিপির অন্যতম উদ্যোক্তা ও স্বাক্ষরদাতা ছিলেন শাহার বানু চৌধুরী। সিলেটে ভাষার জন্য সমস্ত আন্দোলনে তিনি অন্যতম নেতৃত্ব প্রদান করেন। আরেক মহান ভাষা সৈনিক জোবেদা খানম চৌধুরী এবং অন্যান্যদের সাথে ভাষার অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামের কারণে বিভিন্ন পাকিস্থানপন্থী মহলের কাছে তাদেরকে নিগৃহীত হতে হয়। পত্রিকায় কুৎসা রটানো থেকে শুরু করে সামাজিক ভাবে বিভিন্ন লাঞ্চনার শিকার হন এই মহান ভাষা সংগ্রামীরা।

 অধ্যাপক চেমন আরা (১৯৩৫-)
এই ভাষা সৈনিক যখন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন তখন মাত্র অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তিনি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনে যোগ দেন ১৯৪৮ সালে। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে গোটা বাংলাদেশ যখন প্রকম্পিত তখন তিনি ইডেন কলেজের ছাত্রী। তিনি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন মিছিল, মিটিংয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা শহীদ বরকতের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের করে তাতে অংশ নিয়েছলেন চেমন আরা। পরবর্তীতে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন, পাশপাশি চলে সাহিত্যচর্চা। ৮৫ বছর বয়সী এই ভাষা সৈনিক বর্তমানে অবসরে আছেন।

হামিদা রহমান(১৯২৭-২০০৫)

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হামিদা রহমান (১৯২৭ সালের ২৯ জুলাই) যশোরের পুরাতন কসবায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যশোর একমাত্র নারী ভাষা সৈনিক ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের একাধিক পত্রিকায় ভাষা আন্দোলন ও নারী অধিকা নিয়ে তার লেখা প্রকাশ হয়।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নতুন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু এমন যুক্তিতে কোলকাতার আজাদ পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর প্রতিবাদ জানিয়ে এম এম কলেজের ছাত্রী হামিদা রহমান ‘স্বাধীনতা’পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি ১০ জুলাই ১৯৪৭-এর সংখ্যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে বাংলা। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের শিক্ষার্থীরাও গঠন করে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। সেই পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আলমগীর সিদ্দিকী। আর একমাত্র নারী যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন যশোরের অগ্নিকন্যা হামিদা রহমান। আন্দোলন চলাকালীন সময় তার ভূমিকায় শাসক গোষ্ঠী এতটাই খ্যাপা ছিলেন যে, তার পুরাতন কসবার বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালায় পুলিশ। পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোর জেলার যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব নিয়ে পুরো দেশে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালিত হয় এবং এ সময় যশোরে ওই কর্মসূচি সফল করার জন্য অন্যদের সঙ্গে হামিদা রহমান অগ্রগামী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। সেদিনের হরতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের কর্মসূচির প্রতি যশোরের মোমিন গালর্স স্কুলের শিক্ষকেরা একমত না হওয়ায় স্কুলের গেট বন্ধ করে ক্লাস চালু রাখা হয়েছিল। এ খবর পাওয়ার পর হামিদা রহমানের নেতৃত্বে মেয়েদের একটি মিছিল মোমিন গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে সমবেত হয়। তিনি ও তার সাথিরা লাথি মেরে স্কুলের গেট খুলে ফেলেন। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রী মোমিন গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনি দিতে শুরু করেন। ছাত্রী-মিছিলটি মোমিন গার্লস স্কুল থেকে যশোর কালেক্টরেটের সামনে এসে হাজির হলে কোর্টের সামনে দাড়িয়ে হামিদা রহমান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এক পর্যায়ে পুলিশ ওই ছাত্রীসমাবেশে বা লাঠিপেটা করে এবং গুলি চালায়। এতে অনেক আহত হলেও কেউ মারা যাননি। হামিদা রহমান আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন। কিন্তু পুলিশ সুফিয়া নামে একজনকে হামিদা রহমান ভেবে ধরে নিয়ে যায়।

ওইদিন রাতে যশোর কলেজের ছাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের গোপন বৈঠক বসে। হামিদা রহমান ছেলেদের পোশাক পরে সে বৈঠকে যোগ দেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য যশোরে ধর্মঘট চালানো হবে। ধর্মঘট একটানা সতদিন চলে এবং সাধারণ মানুষ তাতে ব্যাপক সাড়া দেয়। ধর্মঘটের পাশাপাশি ১৩ মার্চ যশোরে হরতাল পালিত হয়। হরতাল কর্মসূচি চলাকালীন সেদিন হামিদা রহমানের নেতৃত্বে যশোরে মেয়েদের একটি মিছিল বের হয়। তবে নানা কারণে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মিছিলে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি হামিদা রহমান।

সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯)

সুফিয়া কামাল ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’নামকরণের দাবি জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতঃপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্থানী বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল, আর ওই সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।

ভাষা সৈনিক শাফিয়া খাতুন
১৯৫২ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলে ছাত্র-জনতার মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া হয় শাফিয়া খাতুন তাতে আন্দোলিত হন। তিনি উইমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভিপি হিসেবে এ সময় ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীনিবাস ‘চামেলি হাউসে’র ছাত্রীদের নিয়ে বৈঠক করেন এবং তাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে শরিক হতে আহ্বান জানান। ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু তার স্মৃতিচারণে শাফিয়া খাতুন সরাসরি ভাষা আন্দোলনের যোগ দেয়ার বিষয়ে বলেন-একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক আগের রাত। যাখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আঁচ করতে পারলো পরের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। রাতে এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে ছাত্রীদের নিয়ে আসার ভার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর। ছাত্রীরা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এ দায়িত্ব নেয়। প্রথম দলেই মেয়েরা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বেরিয়ে যায় এ দলে ছিলেন শাফিয়া খাতুন। শাফিয়া খাতুন লাঠির ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে চলে যান। পরে তার দেখাদেখি অন্য নারী শিক্ষার্থীরাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহিলা কলেজে ও গার্লস স্কুলে ছাত্রীদের সুসংগঠিত করে আন্দোলনমুখী করার কাজে নানা কৌশল অবলম্বন করেন। এক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন বা একাধিক সহপাঠী ছাত্রীকে দায়িত্ব বণ্টন করে তিনি আন্দোলনে জনমত গঠনের কাজে প্রবৃত্ত হন। চামেলি হাউসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বেশ কয়েকটি বৈঠক, সমাবেশ ও মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন।

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালীন ছাত্রীদের একটি মিছিলে শাফিয়া খাতুন নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের মিছিলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে গমন করে। ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত ভাষা আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি সভা ও সমাবেশে শাফিয়া খাতুনকে আপসহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রজনতার সমাবেশকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য ছাত্রীদের পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন শাফিয়া খাতুন। তিনি বিভিন্ন ছাত্রী নেত্রীদের ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহিলা কলেজ ও বালিকা বিদ্যালয়ে গমন করে সেখান থেকে মিছিল সহকারে অকুস্থলে ছাত্রীদের নিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার সাংগঠনিক দূরদর্শিতার জন্যই সে দিন বিপুলসংখ্যক ছাত্রীকে আমতলার সমাবেশস্থলে যোগ দেয়। আমতলার সমাবেশে প্রথম চারজন করে বের হওয়ার কথা যখন আলোচিত হয়, তিনি তাতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। শাফিয়া খাতুন মনে করেন, চারজন করে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ছাত্রছাত্রীদের বের হওয়ার ফলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে না। তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সব ছাত্রছাত্রীর এক সঙ্গে বের হওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রক্রিয়া শুরুর নেতৃত্ব দেন শাফিয়া খাতুন। এসব আন্দোলনে তার সাথে ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার, হালিমা খাতুন।

ছাত্রজীবনে ড. শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহ সভাপতি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন হল ইউনিয়নের (১৯৫০-৫১) জি.এস [৫] ও এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একমাত্র আবাসস্থল চামেলি হাউস ছাত্র সংসদের ভিপি (১৯৫১-১৯৫২) ছিলেন। ১৯৫২ সালে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ১৪৪ ধারা ভাঙার মূখ্য ভূমিকা ছিল তার। ওই বছরই তিনি শুভেচ্ছা সফরে তুরস্কে যান। [৬]

স্বীকৃতি ও সম্মাননা: ২০১৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আদিতমারী উপজেলা প্রশাসন তাকে মরণোত্তর সংবর্ধনা দেন। তার জন্মস্থানে লালমনিরহাট আদিতমারী উপজেলায় একটি বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে তার ড. শাফিয়া খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়। ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকার কথা স্মরণ করে ঢাকা করপোরেশন ধানমন্ডিতে একটি রাস্তার নামকরণ করেছে ‘ভাষাসৈনিক শাফিয়া খাতুন সড়ক’।

বা থেকে ভাষা সৈনিক হালিমা খাতুন, হামিদা রহমান, সাফিয়া খাতুন, রওশন আরা, মমতাজ বেগম ও জোবেদা খানম

শরিফা খাতুন (১৯৩৬-)
অধ্যাপক শরিফা খাতুন ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।

ভাষা আন্দোলনে অবদান: স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দু’একটি মিছিলেও তিনি অংশ নেন। তখনো ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে আসে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তখন আন্দোলনটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। স্কুলের ছাত্রীরা সে মিছিলে অংশ নিয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সকালবেলার কথা স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন শরিফা। সেদিন ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গেছে ততক্ষণে। তবে ইডেন কলেজের এ ছাত্রীদের লক্ষ আমতলার সভা। ছাত্রীরা সকালবেলা উঠে প্রস্তুত হন। ততক্ষণে কলেজের গেট কিন্তু তালাবদ্ধ। তখন শরীফাসহ আরো কয়েক ছাত্রী গাছ ও ডাল বেয়ে দেয়াল টপকে কলেজ আঙিনা থেকে বের হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় চলে যান। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে। অনেক ছাত্রী গ্রেপ্তার হয়। অনেককেই সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার দায়ে পুলিশ ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেদিন গ্রেফতার হওয়া ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ২০-২১ জন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপক লায়লা নূরও ছিলেন তাদের সঙ্গে। লায়লা শরীফার পরিচিতদের একজন। লায়লা নূরের সঙ্গে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন শরীফা খাতুন। ২১ পরবর্তী সময়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করে তাতে যখন শ্রদ্ধা অর্পণ করা হয়, সেটিতেও অংশ নিয়েছিলেন শরিফা খাতুন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করেছেন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে।

ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। অধ্যাপক শরিফা খাতুন পেশাজীবনে ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী।  ৮৪ বছর বয়সী এই ভাষা সৈনিক অবসর জীবন যাপন করছেন।

উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা অবলম্বনে মাহমুদা আকতার

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/