স্বাধীনতা দিবসের মূল প্রবন্ধ ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী’

কাজী সুফিয়া আখ্তার

পৃথিবীর সকল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ও এক সার্বজনীন সত্য যে, নারীর অংশগ্রহণ ব্যতীত কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভাতের মুখ দেখেনি। নিত্যদিনের স্বাভাবিক সময়ে যারা কোনো মা- বোন-স্ত্রী- প্রেমিকা এবং কন্যার ভূমিকায় নিজেদের সকল কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রেখেছেন সমাজ ও পরিবারও তাদেরকে সেভাবে সম্মানিত করেছে, যুদ্ধের সময়ে তারাই সর্বকালের এই সকল সম্পর্কের উর্ধ্বে ওঠে একজন যোদ্ধার ভূমিকায় নিজেকে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ঝুঁিক আছে জেনেও বিস্তৃত করেছেন, ব্যাপৃত করেছেন নিজেকে অজানা কর্মের পরিধিতে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমাদের ’মুক্তিযুদ্ধ’ আমাদের স্বতন্ত্র ভূ-খন্ড,  স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র- বাংলাদেশ’ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে দীপ্র উপস্থিতি।

ঐতিহ্যগত ভাবেই এদেশের প্রতিটি সংগ্রামে, প্রতিটি আন্দোলনে ছিল নারীর সবল অংশগ্রহণ, দৃপ্ত পদচারণা। প্রতিটি মিছিলে, প্রতিটি আন্দোলনে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, পদক্ষেপ হয়েছে দৃঢ়, ভূমিকা হয়েছে বিস্তৃত। একাত্তরের দিনগুলোতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিক মানুষই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিকামী, স্বাধীনতা প্রত্যাশী প্রতিটি মানুষের কাছে সেদিন গোটা দেশই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। নারী পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ, ধর্মের স্পর্শকাতরতার চেয়ে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী, পাকিস্তানী শাসকদের হাত থেকে এদেশকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় সেদিন সবাই ছিলেন উজ্জ্বীবিত।

শহুরে গ্রামীণ, শিক্ষিত নিরক্ষর সকল মহিলা সেদিন যার যার সাধ্য ও ইচ্ছামাফিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কাজের ভার। কেউ কেউ জীবন বাজী রেখে অস্ত্র ধরেছেন, কেউ ফিরে আসবে না জেনেও সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, কেউ ধরা পরলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অস্ত্র পাচার করেছেন, অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সাংগঠনিক চিঠি-পত্র আদান প্রদান করেছেন, ভ্রাম্যমান চিকিৎসা দলে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে সেবিকার কাজ করেছেন। অনেক মেয়েই সেদিন গেরিলা ট্রেনিং না নিতে পেরে মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন। আবার খুঁজে খুঁজে কাজ বের করে -কখনো সেবাধর্মী কাজে যুক্ত হয়ে, কখনো রান্না, কখনো শৃঙ্খলা রক্ষা, কখনো স্কুল চালানোর পরিকল্পনা, কখনো বাংলাদেশের স্বপক্ষে বিশ্বজনমত গঠন, কখনো যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ, কখনো গানের স্কোয়াডে অংশ নিয়ে নিজের মনের গ্লানি দূর করতে, শরনার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে উজ্জীবিত করতে তৎপর হয়েছেন।

কিন্তু স্বাধীন স্বদেশে বিগত পঞ্চাশ বছরে আমরা পুরষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমরা পঞ্চাশজন ছাড়া কোন মহিলা মুক্তিযোদ্ধার নাম পাইনা, তাদের পরিচয়ও জানিনা। মুক্তিযুদ্ধের উপর যা কিছু রচিত হয়েছে, সেগুলো পড়ে, শুনে মনে হয় এতো বড় ইতিহাস একমাত্র বুঝি শুধুমাত্র পুরুষদের রক্ত শ্রম ও কষ্টে নির্মিত হয়েছে। পুরুষদের প্রতি আমাদের কোন বিদ্বেষ নেই। কিন্তু নারীর কর্ম, তাঁর অস্তিত্বেরই স্বীকৃতি। নারীর কর্ম স্বীকৃত না হলে সমাজে, পরিবারে, রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে আমরা নারীর যে মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার কথা বলি-তা প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহন যথাযথ ভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে একথাও সত্যি যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সত্যিকার ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন প্রবন্ধে, গল্পে নাটকে, উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে এসেছে সেখানে কি মেয়েদের ভূমিকা যথাযথভাবে চিত্রিত হয়েছে? হয়নি। এমন কি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিল পত্র’ ১৫টি বিশাল খণ্ডে সমাপ্ত দলিলেও মেয়েদের ভূমিকা অবদান যৎসামান্য উল্লেখিত হয়েছে।

তবে নারীদের কথা কি উল্লেখই হয়নি? হয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নোক্তভাবেঃ- “প্রথমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার পরে তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে সারারাত ঝুলিয়ে রাখা হতো। এই ঝুলন্ত অবস্থায়ও মেয়েদের শরীর নিয়ে দস্যুরা উল্লাসনৃত্যে মেতে উঠতো। মেয়েদের শরীররে বিশেষ অংশ গুলোতে আঘাত করতো। বেয়োনেট চালিয়ে সোজা এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলা হতো। ঝুলন্ত অবস্থায় স্তন কেটে বিছিন্ন করে ফেলা হতো। কেউ আবার যোনিপথে রড ঢুকিয়ে দিত, ধারালো চাকু দিয়ে পাছার মাংস চিরে ফেলা হতো। এসময় যেসব মেয়েরা চিৎকার করতো কিংবা বাধা দিতো তখন লোহার রড আগুনে পড়িয়ে পুড়িয়ে তাদের গোপন অঙ্গে ঢুকিয়ে হত্যা করা হতো। প্রতিদিন এভাবে অসংখ্য মেয়েকে তারা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করতো” (২১ পৃষ্ঠা একাত্তরের গণহত্যা ও নারী নির্যাতন।) স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এভাবে নারীর নির্যাতীত রূপকে বিবৃত করা হয়েছে কিন্তু নির্যাতিত রূপের পাশাপাশি সাহসী সক্রীয় যোদ্ধা নারীর ইতিহাস তৈরি হচ্ছে না এ্টাই দুঃখজনক ঘটনা।

স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের মেয়েরা কি অন্যভাবে অংশগ্রহন করেনি? অবশ্যই করেছে। আর সেই অংশগ্রহন ছিল সর্বক্ষেত্রে এবং সর্বতোভাবে। যুদ্ধ মানেই শুধু বন্দুক নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করা নয়। তার সাথে অন্যান্যভাবে যারা অংশগ্রহন করেছের তাদের অবদানকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। যারা প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের অবশ্যই আমাদের শ্রদ্ধা জানাবো। এখানে কোন সংশয় বা দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পাশে কেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রওশন আরার নাম এককাতারে থাকবে থাকবে না? “বীর রওশন আরা বেগম বুকে মাইন বেঁধে জল্লাদের ট্যাংকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের কিশোরী দেহের সঙ্গে একটা আস্ত প্যাটন ট্যাংককেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। “(বাংলাদেশের স্বাধঘীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র) রওশন আরা বেগম কি মুক্তিযোদ্ধা নন? তিনি কি মেয়ে বলেই পৃথকভাবে অভিষিক্ত হবেন? মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে মেয়েরা এদেশের সকল সংগ্রামে অংশগ্রহনকারী মেয়েরা শুধু যুদ্ধের সময়কালেই নয়-যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই সচেতন নাগরিকের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন। বলা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাপর্বে তখনকার তরুণীরা ছাত্রীরা যে যুদ্ধে সশরীরে ভূমিকা নিতে এগিয়ে এসেছিলেন তার কিছু কিছু স্বাক্ষ্য ও তথ্য প্রমান পাওয়া যায়।

মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল তাতে ছেলেদের পাশাপাশি সেদিনের অনেক তরুণী সচেতন ছাত্রীদের অংশগ্রহনও ছিল উল্লেখ করার মতো। কাঠের বন্দুক হাতে সেই তরুণী ছাত্রীদের মিছিলের খন্ড ছবি সে সময়কালে এবং পরবর্তীতেও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগের ঢাকার অবস্থানকারী নেতা কর্মী ও সমর্থক। যতটুকু মনে করা যায় তাতে সেসময় যারা অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলেন তাতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সংগঠক ও কর্মীদের মধ্যে কেন্দ্রিয় সহসভানেত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের তৎকালীন সহসভানেত্রী আয়শা খানম, সাধারণ সম্পাদিকা রীনা খান, মুনিরা আক্তার, কাজী রোকেয়া সুলতানা, রোকেয়া বেগম, নাসিমুন আরা মিনু, নাজমুন আরা মিলু, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী নেলী চৌধুরী, রোকেয়া খাতুন রেখা, ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের সাহিত্য সম্পাদিকা রাখী দাশ পুরকায়স্ত, ইডেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক নাসিমুন নাহার নিনি, সালেহা বেগম, মমতাজ বেগম, সালমা বেগম, সুরাইয়া আক্তারসহ অনেকে। ছাত্রলীগের নেতা সংগঠক কর্মীদের মধ্যে ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেত্রী রাফেয়া আক্তার ডলি, সংগঠক মমতাজ বেগম, রাশেদা আমিন, মমতাজ শেফালীসহ অনেকে। যে সব ছাত্রীরা সে সময় হল এবং হোস্টেলে ছিলেন তারা ঢাকা শহরে বন্ধুবান্ধব অথবা আত্মীয় স্বজনের বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন। সেখান থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে আসতেন।

এছাড়াও তাদের কার্যক্রম ছিল স্টুডেন্টস একশন কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র ভাইদের সমন্বয়ে এলাকায় এলাকায় ছাত্র ব্রিগেড তৈরি করে ছাত্র তরুণ সমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করা। বলা প্রয়োজন মধ্য মার্চ থেকে এই কার্যক্রম সংগঠনের জেলা পর্যায়ে বিস্তৃত হয়। পরবর্তীতে ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সমাবেশ ও মিছিল ইত্যাদিতে অংশগ্রহন করে মেয়েরা। যার কিছু কিছু সে সময়ের পত্র পত্রিকায় ও প্রকাশ হয়েছিল। অনেক তরুণী গৃহিনী মেয়েরা সেসময় এগিয়ে এসেছিলেন ঢাকা শহর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সূচনা পর্বেই। কাজেই বলা প্রয়োজন যে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্ব থেকে শেষ পর্যন্তই মেয়েদের অংশগ্রহন ছিল উল্লেখ করার মত ব্যাপার।

স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রে বাংলাদেশের মেয়েরা

‘৩০শে মার্চ রাত সাড়ে সাতটায় কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আধ ঘন্টার মত একটা অনুষ্ঠান প্রচারের শুরুতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে যে টেলিগ্রাম দিয়েছিলেন তার বাংলা ও ইংরেজি তর্জমা করা হয়েছিল। ইংরেজিতে তর্জমা করেছিলেন ডঃ মঞ্জুলা আনোয়ার সেদিনের ঘোষণায় কন্ঠ দিয়েছেন কাজী হোসনে আরা।’ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বঙ্গুবন্ধু টেলিগ্রামটি ডাঃ নরুন নাহার জহুরের নামে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তৎপর হয়ে যথা সময়ে বিভিন্ন জনের হাত দিয়ে টেলিগ্রামটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন।
পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আগরতলায় স্থানান্তর করা হলে সংবাদ পাঠক হিসেবে হাসান ইমাম, আলী যাকেরের  সাথে সেই সময়ে পারভীন হোসেন ও নাসরীন আহমদ প্রায় নিয়মিত সংবাদ পড়তেন।

চলচিত্র শিল্পী কবরী, নাট্যশিল্পী অমিতা বসু, ফেরদৌসী মজুমদার বিভিন্নভাবে জনমত সৃষ্টিসহ মুক্তি-যুদ্ধের কাজে অংশ নিয়েছিলেন। অমিতা বসু নিয়মিত নাটকে অংশ নিতেন। এছাড়া লায়লা হাসান সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। আর গানে প্রায় নিয়মিত অংশ নিতেন-কল্যাণী ঘোষ, স্বপ্না রায়, রুমা ভৌমিক, শাহীন আক্তার, মনিরা জামান, নায়লা জামান, ডালিয়া নওশীন, শারমিন মোর্শেদ, মুক্তি মহলানবীগ, উমা চৌধুরী, রূপা খান, মালা খান, ফ্লোরা আহমেদসহ আরো অনেকে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা

যুদ্ধের শুরুতেই সানজিদা খাতুনের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ গঠিত হয়েছিল। এই সংস্থা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও অর্থ সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ডঃ সানজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক ও মাহমুদুল হাসান বেনু এর নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি গানের স্কোয়াডও গঠন করা হয়েছিল। সেই সময়ে রূপান্তরের গান শোনার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরের সকল বাঙ্গালী পাগল ছিল। যোদ্ধাদের মনে উদ্দীপনা ছড়াতে, শত কষ্ট, যন্ত্রণার মধ্যেও শরনার্থী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে গানের স্কোয়াডের কর্মীদের দেশাত্ববোধক গানের অসামান্য অবদান। গানের স্কোয়াডের কর্মীরা বিভিন্ন সীমান্তবর্তী শরনার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে গান শোনাতেন। প্রাণের সঞ্চার করতেন সকলের মনে। কখনো তারা হেঁটে হেঁটে; কখনো নৌকায় চড়ে এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তে যেতেন। দলের সকল সদস্যের নাম আজ আর কারো মনে নেই। তবে চট্রগামের শর্মিলা দাস, শীলা দাস, ঢাকার শাহীন মাহমুদ, মিলিয়া গনি, ডালিয়া, লুবনা, নায়লা ও শারমীনসহ অনেকেই ছিলেন।

অর্থ সংগ্রহ ও অন্যান্য

যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের জন্যে অর্খ সংগ্রহে দেশের এবং প্রবাসী বাঙ্গালীদের বিরাট ভূমিকা ছিল। প্রবাসী বাঙ্গালীরা চেরিটি ডিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। আমেরিকায় বসে এই দায়িত্বের সিংহভাগ পালন করেছেন ডাঃ শামীমা ইসলাম, মিসেস সেলিমা ফারুকী ও আরো অনেকে। দেশের ভিতরে বিভিন্ন জেলাতে, বিভিন্ন পাড়াতে বিভিন্ন জন এই দায়িত্ব পালন করেছেন। নার্গিস জাফর, জাহানারা ইমাম, বাসন্তীগুহ ঠাকুরতা, সুফিয়া কামাল, খোদেজা কিবরিয়াসহ আরও অনেকে শত দুর্বিপাকে পড়েও অর্থ সংগ্রহের কাজ বন্ধ করেননি। দেশ ছাড়েননি। শুধু কি অর্থ সংগ্রহ? চাল-ডাল আটা, পুরানো কাপড়-চোপড় যখন যা পেরেছেন সংগ্রৃহ করে ছোট ছোট প্যাকেট করে বিভিন্ন জনের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠিয়েছেন। কার্ফু বন্ধ হলেই হলো। ইডেনের বেশকিছু মেয়েও এই কাজে যুক্ত ছিল।

‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে জাহানারা ইমাম লিখেছেন, “এখন বিভিন্ন বর্ডারে যুদ্ধ খুব জোরে সোরে হচ্ছে। ওষুধের খুব দরকার। ওষুধ কিনে ছোট ছোট প্যাকেট করে রাখি। সুযোগ মত বিভিন্ন জনের হাতে পাঠাই। শুধু ওষূধই নয় টাকা, সিগারেট এসবও।”
“অপরিসীম ঝুঁকি নিয়ে তারা এইসব দ্রব্যাদি সংগ্রহের কাজ করতেন। অনত্র গত সপ্তাহে একসঙ্গে ছ‘টা সোয়েটার কিনতে গিয়ে প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। জিন্না এভিনিউতে লম্বা ফুটপাত জুড়ে ছোট ছোট দোকানীরা চাদর বিছিয়ে তাদের দোকান সাজিয়ে বসেছে। ওদের কাছ থেকে মোটামোটি সস্তায় হাতাকাটা সোয়েটার, মোজা, এগুলো কিনতে শুরু করেছি সপ্তাহখানেক থেকে। আগে শুধু ওষুধ, সিগারেট আর টাকা পাঠাতাম এখন শীত এসে গেছে, গরম কাপড় দরকার” (একাত্তরের দিনগুলি)

তথ্য আদান প্রদান

“সালমা ধরা পড়েছে, আমাদের সহকর্মী। কিছু জরুরী কাগজ পৌছে দিতে যাচ্ছিল। বাবা মারা গেছেন মধ্য এপ্রিলে, ছোট ভাইটি যুদ্ধে, মাকে ঘিরে আমরা কজন।
মা আমাদের মধ্যে সালমার গর্ব, মা আমাদের মধ্যে সালমার কান্না, মা কেঁদো না।“ (জার্নাল ৭১ ডাঃ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর)
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমা হানাদারদের প্ল্যান প্রোগ্রাম জানানোর মত ঝুঁকিবহুল কাজে ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত জেনেও সেদিন শহরের শিক্ষিত মেয়েদের পাশাপাশি গ্রামের নিরক্ষর মেয়েরাও এগিয়ে এসেছিল। পিরোজপুরের ভাগীরথীর নাম আমরা জেনেছি। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য যাকে অকথ্য নির্যাতন ও মারাত্বক বর্বরোচিতভাবে মারা হয়েছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি স্বরূপ। ঢাকার কলাবাগানের একটি বাড়িতে ডুপ্লিকেটিং মেসিনে ছাপা হতো “মুক্তিযুদ্ধ“ নামক পত্রিকা। সেই পত্রিকা বাসে চেপে আরেকজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার সাথে রওশনআরা জলি পৌছে দিতেন নারায়নগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে।
এছাড়া লিফলেট বিতরণ ও বিভিন্ন জরুরি কাগজ সরবরাহে আরো যে নামগুলো পাওয়া যায় তারা হলেন পিউ, মিরো, মীরা, আর্জু, উর্মি। ঢাকার বাইরের জেলাতেও এমন অনেক মেয়ে এক্ষেত্রে কাজ করেছেন। তাদের নাম খুজে বের আজ করা প্রয়োজন।

অস্ত্র রাখা, আশ্রয় দান, খাদ্য সরবরাহ

যেসকল স্থানে মুক্তিযোদ্ধরা অপারেশন চালিয়েছেন, তার আশেপাশের গ্রামেই তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেদিন দেশের অভ্যন্তরে থাকা মানুষগুলোই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। অনেকের ঘরে দু‘মুঠো খাবারের সংস্থানও ছিল না। অনেক গরীব মহিলা নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দিয়েছেন। অস্ত্র লুকিয়ে রেখে পাহারা দিয়েছেন। সেদিন সীমান্তবর্তী অনেক মহিলাই গ্রেনেড চার্জ করতে পারদর্শী ছিলেন। আজ আমরা তাদের নাম ও সংখ্যা বলতে পারি না। এ লজ্জা কোথায় রাখি?
“চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর ওসমানের সাথে তার স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। এই তেজস্বীনী মহিলা অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সাহসী এবং একজন বীরের স্ত্রী বেগম ওসমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। একদিকে তিনি স্বামীকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতেন, অপরদিকে বিডি আর জোয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অনুপ্রাণিত করতেন। নিজের হাতে রান্না করে যুদ্ধ শিবিরে পাঠিয়ে দিতেন। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর রাতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে বেগম ওসমান নিহত হন।” চট্রগ্রামের আতিয়া মওলাও রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পাঠাতেন। তার ‘কাকলী’ বাড়ীটা তো মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল।
রাজৈই থানার গোপালগঞ্জ গ্রামের আনোয়ারা বেগম এপ্রিলের পরে প্রতিরাতেই, মুক্তিযোদ্ধারা এসে যদি খেতে চায় এই ভেবে ভাত তরকারি রেধে রাখতেন। তখন প্রায় সকল স্থানের মায়েরাই এঁটা করতেন। তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সবসময়ই ভাত ও অন্যান্য খাবার মজুত থাকতো। কে আজ তাদের এই আত্মত্যাগের ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন করছে? একাত্তরের এই বাংলায় সকল মায়েরা মেয়েরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কোন মেয়ে রাজাকার, আলবদর, আলসামস এর খাতায় নাম লেখাননি। এজন্যই নয়মাসে বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল। একথা আজ ভুলতে বসেছে সবাই।

বন্দুক হাতে মেয়েরা

কুমিল্লার মেয়ে শিরিন বানু মিতিল তো কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন পুরুষের বেশে প্যান্ট স্যুট পরে চুল ছেটে থ্রি নট থ্রি চালিয়ে। তখন তিনি পাবনাতে থাকেন। অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছাত্র রাজনীতির নেত্রী। টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি দখলের অপারেশনে ছিলেন। পরে কন্ট্রোল রুমের ডিউটিও করেছেন। সেদিন এই বাংলার মানুষ তাকে কিন্তু পুরুষের বেশেই আন্তরিকভাবেই গ্রহন করেছিলেন। পরে তিনি এপ্রিলের দিকে বাধ্য হয়েই ভারতে চলে যান। শরনার্থী শিবিরে এবং সীমান্ত এলাকায় জনমত সৃষ্টির কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের সংগঠিত করেছেন। ৯নং সেক্টরে মেজর জলিলের আন্ডারের বাকুন্দিয়া ক্যাম্পে রুনু দাশ, রমা, বিথিকা বিশ^াস, মিনতি ওঝা, মালতি হাওলাদার, তপতি মন্ডলসহ বেশ কয়েকজন গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে বিথিকা বাংলদেশে এসেছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলে আরো এগারোজন মেয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা নড়াইল মহাকুমার লোহা অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর সাথে যশোর এসেছিলেন মৃত্যুকে তুচ্ছ করে। এরা স্কুল ও কলেজের ছাত্রী ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের জন্য রান্না এবং যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা শুশ্রষা করা তাদের মুল দায়িত্ব ছিল্ চট্রগ্রামের জাহানারা আঙ্গুর মিরসরাই গ্রামের বাড়ীতে বসেই মেয়েদের নার্সিং ট্রেনিং ও সংগঠিত করার কাজ করেছেন।

বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরের কাজে মেয়েরা

মুক্তিযুদ্ধের মহিলা বিষয়ক কনভেনর বেগম বদরুনন্নেছা আহমেদ, ডাঃ নরুন নাহার জহুর, বেগম নুরজাহান মুরশিদ, সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, সেলিনা বানু। বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরের দেখাশোনার দায়িত্বে তো ছিলেনই, এছাড়া স্বাধীনতার পক্ষে বিশ^ নেতৃবৃন্দের জনমত গঠন, অর্থ সংগ্রহ, রিলিফ দ্রব্যাদি সংগ্রহ ওব ন্টনসহ মেয়েদের জন্য নার্সিং ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করার কাজে ও নিজেদের সদাব্যস্ত রেখেছেন। মুজিব নগর, আগরতলা ও কোলকাতা ছিল তাদের মূল কর্মক্ষেত্র।

তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ কোটি লোক ওপার বাংলায় গিয়েছিলেন। ভারত সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্যে এই শরনার্থী শিবিরগুলো পরিচালিত হতো, ছাত্রী নেতৃবৃন্দ, সাধারণ গৃহবধু এবং মহিলা নেত্রীরা সেদিন বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব, নতুন শরনার্থীদের নাম তালিকা ভুক্তিকরণ, ওষুধ-পত্র প্রদান, রিলিফ দ্রব্যাদি বিতরণ এবং রান্না করার কাজ ছেলেদের পাশাপাশি নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কোন কোন ছোট বাচ্চাদের স্কুল পরিচালনাও মেয়েরা করেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে। এর মধ্যে হেনা দাস, যোগমায়া সাহা রায় উল্লেখযোগ্য। তারা যদি সেদিন এই শরনার্থী শিবিরের কাজগুলো না করতেন তাহলে সুষ্ঠভাবে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব হলেও সাধারণ অন্ন-বস্ত্র কর্পদকহীন মানুষের দূর্গতির সীমা থাকতো না। সেদিন চিকিৎসক হিসাবে, সেবিকা হিসেবে বেইজ ক্যাম্পের কার্যক্রম পরিচালনার সহকারী হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দলের কর্মী হিসেবে রাধুনী ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মী হিসেবে মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ, আগরতলা, করিমগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে মালেকা বেগম, শান্তি দত্ত, রাহেলা, সুরাইয়া, বিথিকা, নাজমা, সাজেদা বেগম, মুশতারী শফী, ডাঃ মাগদুমা নার্গিস রত্না, রোকেয়া বেগম, আয়েশা খানম, ডাঃ ফওজিয়া মোসলেম, উষা দাশ পুরকায়স্ত, নিবেদিতা দাস পুরকায়স্ত, মুনিরা আক্তার, রোকেয়া বেগম, রাখী দাস পুরকায়স্তসহ আরো অনেকে।

যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতালে মেয়েরা

আগরতলার কাছাকাছি সোনামুড়ার জঙ্গলের মধ্যে তাবু খাটিয়ে, মাটিতে পলিথিন পেতে তৈরি হয়েছিল হাসপাতাল। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শেলিং-এ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা হতো। ডাঃ আখ্তার, ডাঃ শামসুদ্দীন ও ডাঃ মবিনের সাথে কোন প্রকার নার্সিং ট্রেনিং ছাড়াই এই হাসপাতালে কাজ করেছেন কবি সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে সাঈদা কামাল টুলু ও লুলু। উল্লেখ কবি সুফিয়া কামালকে পাক দস্যুরা প্রায় নজর বন্দীর মতো রেখেছিল। পরে ডাঃ ডালিয়া, রেশমা, আসমা, জাকিয়া, পদ্মা, নীলিমাসহ অরো কিছু নার্সিং ট্রেনিং প্রাপ্ত মেয়ে যোগ দেন। সময়ের দাবী ও প্রয়োজন তাদেরকে সেদিন অপরিচিত পরিবেশ ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কাজ করতে সাহসী এবং যোগ্য হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। পরে বাঁশের তৈরী একটি হাসপাতাল বিশ্রামাগঞ্জের প্রতিষ্ঠা করা হলে আগস্টের দিকে তারা সেখানে চলে গিয়েছিলেন। তখন সেখানে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডাঃ সেতারা বেগম, ডাঃ নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ মোবিনসহ কাজ করছিলেন। গীতা কর, গীতা মজুমদার, শেফালী, ইরা, অনিলা, লক্ষী, শোভা, রঞ্জিতা, অঞ্জলী, যুথিকা, আন্না এবং আরো অনেকে কাজ সেখানে করেছেন। ইতিপূর্বে সামান্য ওষূধ, গজ, ব্যান্ডেজ, স্পিরিট ও গ্লাভসই ছিল চিকিৎসার প্রধান উপকরণ। এখানে আরো দরকারী ওষুধ ও সরঞ্জাম ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

জি বি কল্যানী অন্যান্য হাসপাতালে মেয়েরা

সিদ্ধান্ত ছিল যুদ্ধ বেশিদিন স্থায়ী হলে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা টিমের সাথে ৩ জন করে নার্সিং ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়ে পাঠানো হবে ফার্স্ট এইড প্রদানের জন্য এছাড়াও আহত মুক্তিযোদ্ধা ও আহত এপার বাংলার বাঙালীর জন্য প্রতিটি সরকারী হাসপাতালে একটি করে নির্ধারিত ওয়ার্ডের কাজও নার্সিং ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়েদের দায়িত্ব হবে।

বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ বিভিন্ন ক্যাম্পের আগ্রহী মেয়েদের নার্সিং ট্রেনিং ব্যবস্থা করেন জি বি গৌরাঙ্গ বল্লভ হাসপাতালে। এরকম একটি ৩৫ জনের ট্রেনিং ব্যাচে ছিলেন-লক্ষীচক্রবর্তী (নারায়নগঞ্জ), প্রীতিকণা দাস, প্রতিভা ভট্রাচার্য, রমা মজুমদার, সীমা চৌধুরী ও মীরা রায়। সম্ভবতঃ এরা সবাই কুমিল্লার মেয়ে ছিলেন। দীপাঞ্জলী আইচ চট্রগ্রামের মেয়ে। এছাড়া শিখা চক্রবর্তী, আভা মন্ডল, সুফিয়া আক্তারসহ আরো অনেকেই ছিলেন। বিশ্রামগঞ্জের হাসপাতালে যোগদানকারী মেয়েদের অনেকেই আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী, নীলরতন হাসপাতাল ফার্ষ্ট এইড ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই ব্যাচে ৪০ জন মেয়ে ছিল। সকলেই ছাত্রী ছিল স্কুল কলেজের। ভ্রাম্যমান চিকিৎসা দলে ছিলেন মতিয়া চৌধুরী, আয়শা খানম, মুনিরা আক্তার প্রমুখ।

দেশের ভিতরে ক্লিনিকে, গ্রামে

দেশের দূর্যোগে চিকিৎসক, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রী কেই-ই বসে ছিলেন না। তবে দেশের ভিতরে যারা ছিলেন, তাদের কে অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। চট্রগ্রামের ডাঃ রেনুকণা বড়–য়া রাতের অন্ধকারে মাইলের পর মাইল হেঁটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাদের চিকিৎসা করেছেন। স্বামী হারিয়ে বাবার বাড়ীর গ্রামে বসে থাকেননি তিনি।

এখন প্রশ্ন হলো-কেন আমরা ‘মুক্তিযুদ্ধে মেয়েরা’ বলার প্রয়ান অনুভব করছি বা মুক্তিযুদ্ধে নারী বলার প্রয়াশ অনুভব করছি? ‘মুক্তিযুদ্ধ‘ একটি জাতির মুক্তির লড়াইয়ের রক্তাক্ত ও অহংকারের ইতিহাস। গর্বের ইতিহাস। এখানে আবার নারী-পুরুষের পৃথকীকরণ কেন? এই ভেদচিহ্ন অঙ্কন কি শোভন? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। নয় অস্বাভাবিকও।

কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক যা কিছু রচিত হয়েছে, সেখানে মেয়েদের ভূমিকা ও অবদান যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়েছে কি? তাদের প্রাণবাজী রাখা কর্মকান্ডের মূল্যায়ন হয়েছে কি? উত্তর সবারই জানা-হয়নি।

কোথাও কি পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রোশনারা বেগমকে মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়েছে? কোথাও কি ভাগীরথী এবং বেগম ওসমান, কবি মেহেরুন্নেসা সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে শহীদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে? মুক্তিযুদ্ধে পুরুষ যোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন, নারীরা নিহত হয়েছে এটাই কি শোভন এবং সত্যি? মেয়েদের আত্মত্যাগের এই অবমূল্যায়ন কি গ্রহনযোগ্য?

মুক্তিযুদ্ধে নারী পুরুষের অংশ গ্রহণের ভেদরেখা আঁকতে আমরা ইচ্ছুক নই। নই পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান খাটো করে দেখতে। তবু কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের অংশ গ্রহণের খতিয়ান আলাদা ভাবে করতে প্রয়াসী? কারণ-
‘নর দিল কত বুকের রক্ত
লেখা আছে ইতিহাসে
নারী দিল কত সিথির সিদুঁর
লেখা নাই তার পাশে।’
এক্ষেত্রে আমাদের সুস্পষ্ট উচ্চারণ, নারীর ভূমিকা ও অবদান তুলে ধরা -প্রথমতঃ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনার প্রয়োজনে। দ্বিতীয়তঃ নারীর অস্তিত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে।  কারণ একজন নারীর স্বীকৃতি তার স্বীয় কর্মকান্ডের মূল্যায়ন, তার ভূমিকা ও অবদান চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়েই আসবে। নারীর র্ভূমিকা, কর্ম স্বীকৃত না হলে, মানুষ হিসেবে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এই সমাজে হবে সুদূর পরাহত।
তৃতীয়তঃ মুক্তিযোদ্ধা মানেই “একজন রাইফেলধারী পুরুষ”- এই বোধে আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা যেমন নগন্য নয়, তেমনি নারীর সংখ্যাও অনেক। আমরা তার এই বোধের শিকড়ে নাড়া দিতে চাই। নারী নিজেকে চিনতে শিখুক। নিজের কর্মের মূল্যায়ণের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করুক। চিন্তা চেতনার জগতে তাঁর লাগুক হাওয়া। আমাদের এখনো অনেক কাজ করবার আছে। পঞ্চাশ বছর একটি জাতির ইতিহাস রচনার প্রয়োজনেই মেয়েদের ভূমিকা ও অবদান স্বতন্ত্রভাবে চিত্রিত হওয়া উচিত। প্রয়োজনে মেয়েদেরই এই গুরু দায়িত্বভার তুলে নিতে হবে। ফ্রান্সের মহিলাদের দু‘শো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের যুদ্ধকালীন অবদানের স্বীকৃতির জন্য। আমাদের কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? অপেক্ষা করার মতো সময় আমাদের হাতে আছে কি? এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। অনেক মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা একটি সুন্দর স্বপ্নের জন্যে যুদ্ধ করেছিলাম। সাহসী হয়েছিলাম।

সকল মুক্তিযোদ্ধা নারী ও পুরষকে অভিবাদন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূতির্তে দেশের সকল নাগরিককে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

কাজী সুফিয়া আখ্তার: কবি, লেখক ওমানবাধিকার নেত্রী।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/