খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – আসুন তারুণ্যের পাশে থাকি

ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু স্থির চিত্র

সুলতানা রিজিয়া

গত ০৫/০৯/২০২১ তারিখে আমরা কানাডার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। এটি একটা ছিমছাম ছোট শহর। শহরকে ঘিরেই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথবা উল্টো করে বললে বলা যায় ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই এই শহরের গোড়াপত্তন।বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশ জুড়ে ছড়ানো ছিটানো ঘর-বাড়ি । একাডেমিক বিল্ডিং, বিভিন্ন বিভাগ পাশাপাশি গোছানো। দীর্ঘদিন পরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণ শিক্ষার্থীদের পদচারনায় আজ মুখরিত। সামার শেষে ক্লাস শুরু হলো ০৭ সেপ্টেম্বর। কেউ কেউ বাবা-মা বা নিজ নিজ অভিভাবকদের সাথে আজ এখানে এসেছে। উচ্ছ্বল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর প্রায় সকলেই। কুণ্ঠা বা বিমর্ষতা কারো চোখে মুখে ছিলো না। শীত আসি আসি করলেও আকাশ জুড়ে উজ্বল তেজদীপ্ত সূর্যের অঢেল আলোক রশ্মিতে চারপাশে ধাঁধাঁনো আলোকচ্ছটা যেনো ঠিকরে পড়ছে।  উপরে ঘননীল আকাশে শরতের উড়ন্ত সফেদ ধবধবে সাদা দুরন্ত মেঘের ঘোরলাগা খুনশুটি থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। আদিগন্ত সবুজের সমাহার, বাতাসের দোলায় দোদুল বৃক্ষশাখার সবুজ ঝালরে ক্লান্তিহীন। দেখে মনে হলো আমরা যেনো আজ কোন এক মহা উৎসবমুখর প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেছি। তারই আবেশে আমার বয়সটাও অবলীলায় অষ্টাদশী কলেজ পড়ুয়া তরুণীর কোঠায় পৌঁছুলো। অদ্ভুত এক ভালোলাগার প্রশান্তি আমাকে আজ আচ্ছন্ন করে রাখলো। দীর্ঘদিন ঘরবন্দী জীবনের পরিসমাপ্তিতে মনের জমাট অস্বস্তির জংগুলো যেনো খসে পড়লো। মনে হলো তারুণ্যের ধ্বংস থেকে পৃথিবী ঘুরে দাঁড়ালো। প্রাণসংহারী কোভিড- ১৯ এর আক্রমণে অকালে প্রাণ হারানো চেনা অচেনা মুখগুলো স্মৃতির জমাট শোকের মাঝে জেগে উঠলো। মনে মনে আশা এবং সন্তুষ্টির প্রার্থনায় নুইয়ে পড়লাম মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সমীপে-।

আমার একমাত্র পুত্র সন্তান অয়নের সংসার জীবনের প্রায় দীর্ঘ চার বছরের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা এই বিশ্ববিদ্যালয়। পুত্র অয়ন, তার স্ত্রী উষ্মিতা এবং তাদের একমাত্র সন্তান ইয়াফি হক। কানাডায় টরেন্টোতে তাদের ছোট্ট সংসারে আমি এসেছিলাম ২০১৮ সালে। মাঝে দুবছর আর আসা হয়নি। উষ্মিতার উচ্চতর ডিগ্রি লাভের ইচ্ছা ও সুযোগেই তাদের ঢাকার সংসার কানাডামুখী হয়েছিলো। উষ্মিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা পেশাকে সমুজ্জ্বল করার চেষ্টায় উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগে তারা ঢাকার পাট গুটিয়ে ফেলে। বিরতিহীন পাঠ্যক্রম, সংসার, প্রবাস জীবনে তারা এখন অভ্যস্থ। সম্প্রতি অয়নরা কানাডার ব্রাম্পটন শহরে নতুন করে সংসার সাজিয়েছে। আমেরিকাস্থ বড় মেয়ে রওনকের কাছ থেকে আমার কানাডায় প্রবেশ গত ১০ আগস্ট তারিখে। ছুটির দিনে এখানকার জীবন যাপন নিজেদের ইচ্ছে বা মর্জি মতোই চলে। অফিস, স্কুল কলেজের ব্যস্ততায় ছেদ পড়লে পরিশ্রমী জীবনে সৌখিনতা ভর করে। আয়েশ করার অভ্যাস বাঙালির মজ্জাগত। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায়, কখনো পরিবারের মাঝেই তারা খুঁজে নেয় আনন্দ বিনোদন। আমরাও সাপ্তাহিক ছুটির সুযোগে সারাদিনের জন্য পথে নামলাম। আগ্রহটা আমারই বেশি ছিলো। ছেলে মেয়েদের সংসারের সুখ শান্তি, জ্ঞান গরিমার পসরা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা গুরুজনরা মুগ্ধ চোখেই নিরিখ করে। মনে মনে তারা তাদের শৈশব কৈশোরকালের স্মৃতির পাখা মেলে ধরেন। স্মৃতির আলো ছায়ায় তারা নিজেদের হারানো সময়গুলোকেই পরখ করেন, সুখ শান্তির ওম পেতে মগ্ন হন। এটাই জীবনের বাস্তবতা। আমিও আমার সন্তানদের মাঝেই আমার ফেলে আসা জীবনের সুখ দুঃখ, বিরহ বেদনা, সংগ্রামের কড়িকাঠ গুনতে থাকি। হিসাবের ঝুড়িতে প্রাপ্তির আধিক্যে অভিভূত হই, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সেজদাবনত হই। সন্তাদের কল্যাণ, মঙ্গল কামনায় নিষ্ঠ থাকি।

আমাকে পাশে নিয়ে অয়ন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, তারা কোথায় ( স্টুডেন্টস কোয়ার্টার ) থাকতো, কোথায় বসে সময় কাটাতো, তাদের সন্তান ইয়াফি কোন স্কুলে পড়তো, কোথায় খেলতো, তারা কোন হালাল মার্কেটে বাজার করতো সবই একে একে নিজে ড্রাইভ করে ঘুরে ফিরে দেখালো। সে কি ভাবে তার কর্মস্থলে যেতো, উষ্মিতার ডিপার্টমেন্ট থেকে তাদের বাসা কতটা কাছে সবটাই দেখেলো। আমি যেমনটা তাদের ছোটবেলার স্মৃতিময় ঘটনা বলতে বলতে আনন্দে ভাসতাম, ফুল্ল হয়ে উঠতাম, অয়নের মাঝে ঠিক তেমনটাই খুঁজে পেলাম। সেই শৈশবে পড়া কবি জসিম উদদীনএর কবিতার মতো, কাব্যের সুখ সুখ মুগ্ধতার মতো।

‘যাবে তুমি ভাই যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয়?’
অসাধারণ এক চিত্রকাব্য!

সন্তানরা পিতা মাতার ভাবনায় আজীবন ছোট্টটিই থেকে যায়। হয়তো তাই তাদের পরিশ্রম, সাংসারিক দায়দায়িত্বের ছোট বড় জটাজালের কষ্টকে তারা মেনে নিতে পারেন না। তাই তারা সদা সর্বত্র দু'হাত বাড়িয়েই রাখেন সাহায্যার্থে, যদি তাতে সন্তানদের কষ্টের ভার কিছুটা হালকা হয়!

আজ ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ইয়াফির স্কুল শুরু। তারও সামারের ছুটি শেষ। দীর্ঘ দিন ঘরে বসে থেকে বিশ্বের সকল শিশুর মতো তারাও ক্লান্ত এবং বিরক্ত। কাহাতক আর ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের সাথে সময় কাটানো যায়! কত আর গেম খেলা, টিভি দেখা, অনলাইলে পড়ার ফ্যাকড়া সহ্য হয়। তাকে আজ বেশ স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রফুল্ল মনে হলো। এখানে দুই মাইলের কম রাস্তার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল বাস নেই। তাদের হেঁটেই স্কুলে যেতে ও আসতে হবে। অথবা বাবা মা তাদের পৌঁছে দেবেন  কিম্বা অন্যকোনও বিকল্প ব্যবস্থা তাদের নিতে হবে। অয়ন আমার ফোনে গুগল খুলে বাড়ি থেকে স্কুলের ম্যাপ সেভ করে দিলো। অফিসে যাওয়ার সময় বাবা ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দেবে, ছুটির সময় আমি সামনের পথে তার অপেক্ষায় থাকবো।
আমাদের সময় বাবা মায়েদের সময়ই হতো না তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দেয়ার বা নিয়ে আসায়। আমরাই হৈ হৈ করে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি এক, দুই ক্রোশ পথে পেরিয়ে। কলেজেও তাই। রিক্সা বা বাসে যাওয়ার চেয়ে তখন হাঁটার একটা মোহময় নেশা বুকের মাঝে জেগেই থাকতো। পথের দুপাশের দৃশ্য, বৃক্ষ তরুলতা, ডোবা খালের বৈচিত্র্যময় রূপ, বন্ধুদের সাথে প্রাণ উজাড় করা কথার ডালির রৌশনাই ছিলো রূপকথামালা থেকেও রোমাঞ্চকর।

এখানের কমিউনিটিগুলোতে ছোট ছোট প্রায় একই ডিজাইনের বাড়িঘর নিঃশব্দেই দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়ির সামনে হৈ চৈ এর আড্ডাটা চোখে পড়েনা।  প্রত্যেক কমিউনিটিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা কেন্দ্রসমূহ, বনায়ন ( পরিবেশবান্ধব ), জলাশয় বা লেক, খেলার মাঠ বা পার্ক থাকাটা আবশ্যিক। শিশু ও প্রবীণদের প্রতি এদেশে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। ১২ বছর থেকে এর ঊর্দ্ধে প্রায় সকলেই বিশ্ব মহামারী করোনার টিকা নিয়েছে। ফলে সকল শিক্ষার্থী করোনা সংক্রমণের আওতা থেকে অনেকটাই নিরাপদ। এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুনিশ্চিত নিরাপত্তার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধাও আছে। তারপরও এখানের বিভিন্ন শপিং মলে, বিনোদন কেন্দ্রে, পার্কে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকলের জন্য মাক্স পড়াটা বাধ্যতামূলক। এদেশের নিয়মানুবর্তিতা এবং আইন প্রয়োগে কোন ছলচাতুরী দেখা যায় না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং নিয়মের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ থাকার চেষ্টায় করোনার কঠিন আগ্রাসন হয়তো একদিন থেমে যাবে। যেমন বিগত শতাব্দীর নানাবিধ মহামারির অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আসুন এই মহা দুর্যোগময় সংকটকালে আমরাও সংঘবদ্ধ হয়ে স্বাস্থ্যগতভাবে সুরক্ষিত থাকি এবং নিয়ম নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। ঘুরে দাঁড়াই স্থতিশীল স্বাভাবিক জীবনের স্বার্থে।

খুলুক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠে গজিয়ে ওঠা দুর্বাঘাসে শিক্ষার্থীরা সবুজের পরাগ মাখুক, বুভুক্ষিত অন্তরকথারা স্কুল বাউন্ডারি চৌদিকে সশব্দে ছড়িয়ে পড়ুক, বন্ধুত্বের বন্ধন চিরজাগরুক থাকুক। এইসব শিক্ষার্থীদের তারুণ্যই আমাদের উত্তরাধিকারীদের অদম্য শক্তির উৎস, আগামী পৃথিবীর কর্ণধারদের নেতৃত্বের হাতিয়ার।

আসুন তারুণ্যের পাশে আমরা দুভের্দ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলি, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখি। যমের ঘরে কাঁটা বিছাই।

সুলতানা রিজিয়া

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/