বায়েজিদ হোসেনের গল্প ‘মেঝবাবুর দ্যাশ’

বায়েজিদ হোসেন

মেঝবাবুর দ্যাশ

হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম দেবীনগর৷ কয়েক ঘর মুসলিমও আছে৷ বিপদে-আপদে,সুখে-দুঃখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করে তারা৷ শবে বরাতের হালুয়া রুটি যেমন পৌঁছে যায় প্রতিবেশী হিন্দু বাড়ির খাবার থালায় তেমনি লক্ষ্মী পুজার মুড়ি মুড়কি পৌঁছে যায় মুসলিমদের ঘরে৷ অনাবিল শান্তির এক গ্রাম৷
১৯৭১ সাল৷ চারিদিকে কেমন যেন গুমোটে ভাব ৷ শহরের বাতাসে বারুদের গন্ধ, প্রতিবাদ-মিছিলের গুঞ্জন৷ যদিও শহর ছাপিয়ে সে বারুদের গন্ধ, প্রতিবাদ মিছিলের গুঞ্জন গ্রামে এখনও সেভাবে এসে পৌঁছেনি তবে অজ পাড়াগাঁয়ের দু একজনের কানে খবর এসে পৌঁছেছে বটে৷ দেবীনগরে খবর পৌঁছানোর মাধ্যম হলো মেজ কর্তা বাবুর ফোর ব্যান্ডের জাপানী রেডিওটি৷ বিসিসি থেকে দেশের নানা খবর আসে৷ রোজ সকাল-সন্ধ্যায় গ্রামের কয়েকজন খবর শুনতে এসে হাজির হয় দেবীনগরের এই পুরোনো জমিদার দত্তদের বাড়িতে৷ যারা আসে তারা বেশির ভাগই বয়স্ক৷ বয়স্কদের সাথে কয়েকজন যুবকও থাকতো৷ সেই যুবকদের একজন রশীদ ৷
রশীদ আসলে আসে খবর শুনতে নয় গান শুনতে৷ রশিদ কিছুদিন মুজাম্মেল ফকিরের কাছে গান শিখেছিলো৷  গানের প্রতি তার ভীষণ টান৷ দরাজ তার গলা৷ দত্ত বাড়িতে টুকটাক ফায়-ফরমাইশ খাটে আর গরু দেখাশোনা করে সে৷ সহজ সরল আত্মভোলা গান পাগলা এই যুবকটিকে মেজ বাবু অত্যন্ত স্নেহ করেন৷ গ্রামের মাঠে কিংবা পথে রশিদের উপস্থিতি জানতে তাকে দেখা লাগে না কারন তার গলার গানই বলে দিবে তার অবস্থান৷
২৫ শে মার্চের কালো রাতে হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পর সারাদেশে চরম আতঙ্ক শুরু হলো৷ লাখ লাখ মানুষ এক কাপড়ে পিতৃভিটা ছেড়ে নাড়ীর টান কে উপেক্ষা করে সীমান্তের অপারে শুধুমাত্র জীবন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকেরা৷ দেবীনগরের হিন্দুরা গ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও কয়েকদিন পর যখন হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী পাশের গ্রাম জ্বালিয়ে দিলো তখন আর গ্রামে থাকার সাহস পেলো না কেউ৷ রাতের আঁধারে গ্রামের হিন্দুরা যখন নিরব চোখের জল ফেলে গ্রাম ছাড়ছে তখন মুসলিমদের চোখেও ছলছলে জল৷ চলে যাবার সময় মেজ বাবু রশীদকে ডেকে তার প্রিয় ফোর ব্যান্ডের রেডিওটি রশীদের হাতে দিয়ে বলেন
— এই ট্রানজিস্টারটা তুই রাহেক রশীদ ৷ গানটান শুনবি আর যহন আমাগের কতা মনে হবি, আমাগের দেখতি ইচ্ছা হবি এই ট্রানজিস্টারটা দেহিস ৷
মেজবাবু কান্না চেপে রাখতে পারলেন না৷ রশীদও কেঁদে ফেলে৷ সত্য কথা বলতে আত্মভোলা রশীদ কখনও আঁচ করতে পারেনি মেজবাবু তাকে এতো ভালোবাসে ৷ এই ঘোর বিপদে মেজবাবুর দেশত্যাগ করা না লাগলে হয়ত রশীদ জানতেই পারতো না তার প্রতি মেজবাবুর স্নেহ বাৎসল্যতা ৷ একে একে সবাই বিদায় হয় ৷
দেবীনগরের আনন্দবাজারে নেমে আসে অনামিশার আঁধারে৷ খা খা করছে গ্রাম৷ মানুষ নেই , শূন্য দাওয়ায় বিছানো খেঁজুর পাতার পাটি অপেক্ষা করছে গৃহস্তের৷ শূন্য বিছানার অপেক্ষা কাটে না৷ যার বুকে রোজ রাতে প্রেম, অভিমান, খুনসুটির আসর বসতো আজ সে একা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে থাকে ৷ চারিদিকে শুধুই শূন্যতা৷ চকলেট কালারের ফিতে ওয়ালা ব্যাগে রেডিও কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় রশীদ৷ আধ বয়সি মা আর যুবতী বোনের ভরণ পোষণের দায়িত্ব তার কাধে অথচ কাজ নেই৷ বাবা তো সেই কবেই নতুন সংসার পেতেছে অন্য জায়গায় গিয়ে ৷ আর তখন থেকেই রশীদের অপরিপক্ব কাধে পড়েছি সংসারের জোয়াল৷
কয়েকদিন পর দেবীনগরে একটি দুঃসংবাদ ভেসে আসে৷ পালিয়ে যাওয়ার সময় হানাদার বাহিনীর হামলায় মেজবাবুসহ দেবীনগরের অনেকেই মারা গেছেন৷ লাশগুলো সৎকারও হয়নি ৷ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ একরাশ কালো আঁধার ঘিরে যায় রশীদের পৃথিবী৷ পিতৃহীন রশীদকে যে লোক এতো স্নেহ করতো তার লাশ না পেল চিতার আগুন না পেল শ্মশানের মাটি! এর দায় কার? নিজের অজান্তেই সে মেজবাবুর ছেলে হয়ে উঠেছিলো আজ সে পিতৃহারা হয়েছে৷

রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেশোত্ববোধক গান হয়৷ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর শোনা যায়৷ রশীদের মনে জ্বলে ওঠে নিজের অজানান্তেই সন্তান হয়ে ওঠা সেই পিতার হত্যার প্রতিশোধের আগুন৷ একটা দেশ তৈরীতে নিজেকে সঁপে দিতে চায় সে যে দেশ থেকে আর কোন পিতাকে পালাতে হবে না অন্য দেশে৷ পৃথিবীর সব পিতাদের একটা নিজের দেশ থাকা উচিত৷ বাঙালি পিতাদেরও একটা দেশ থাকা উচিত৷
মেজবাবুর রেডিওটা কাধে ঝুলিয়ে পাশের গ্রামের কয়েকজন যুবকের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে রওনা হয় রশীদ৷ যাওয়ার সময় মাকে বলে যায়
–মেজবাবুর লাইগা দ্যাশ আনতি যাচ্ছি মা৷ দ্যাশ স্বাধীন হলিই চলে আসপোনে ৷
চোখের পানিতে পুত্রকে বিদায় দেয় মা৷ রশীদের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পরে এলাকায়৷ এলাকায় পাক বাহিনীর দোসরদের আনাগোনা বেড়ে যায়৷ গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ নির্বিচারে খুন হতে থাকে মানুষ৷ মানুষের জীবনের মুল্য এর চেয়ে সস্তা আগে কখনও হয়েছিলো বলে জানা যায় না৷ তারপর বর্ষার একরাতে অভিশাপ নেমে আসে দেবীনগরে৷ এক জীপ পাক বাহিনী আর রাজাকার এসে হাজির হয় দেবীনগরে৷ তছনছ হয়ে যায় রশীদদের বাড়ি৷ হানাদারের বুটের আঘাতে মূর্ছা যায় রশীদের মা ছোটু৷ পরদিন জ্ঞান ফিরলে ধ্বংসস্তুপের ভীড়ে খুঁজে পায়না তার ষোড়শী কন্যা আদুরীকে৷ গ্রামের লোক মারফত জানতে পারে হানাদারেরা নিয়ে গেছে তার মেয়েকে৷ পুত্র কন্যার শোকে ভেঙে পড়ে ছোটু৷
থানা সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্যাম্পের আলো আঁধারী ঘরে আরো কয়েকটা অচেনা মেয়েদের সাথে আদুরীর নতুন জীবন শুরু হয়৷ শরীরে কাপড় বলতে পেডিকোট আর ব্লাউজ৷ শাড়ী থাকলে যদি গলায় ফাঁস নিয়ে মরে যায় তাহলে তাদের জৈবিক তাড়না মেটাবে কে? তাই শাড়ি খুলে রাখা হয়েছে সবার৷ প্রতিরাতে ঠিক কতজন পশু প্রতিটি মেয়ের উপরে সওয়ার হয় বলতে পারে না কেউ কারণ রোজ যখন তাদের চেতনা ফেরে তখন দিনের সুর্য অনেকটাই উপরে উঠে গেছে বলে অনুভব করে তারা৷ নিদারুণ যন্ত্রণা আর ঘৃণা নিয়ে প্রতিটি দিন কাটে তাদের৷ রাতে আবার শুরু হয় পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন৷ মহান স্রষ্টার কাছে মুক্তি চেয়ে চেয়ে হতাশ হওয়ার পর তারা মৃত্যু চাইতে থাকে কিন্তু হায় !এই অসহায় নারীদের ফরিয়াদ পৌঁছে না কোন স্রষ্টার কাছে৷ না আসে মুক্তি, না মৃত্যু৷ তারা ভুলে যায় তারা কোন কালে মানুষ ছিলো৷ একদিন প্রচন্ড গুলির শব্দে চেতনা ফেরে আদুরীর৷ যেন ঝাঁঝরের মধ্যে মুড়ি ভাজা হচ্ছে৷ মুহুর্মুহুঃ গুলির শব্দ আর জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে৷ আদুরী ভাবে তার ভাই এসেছে ঈশ্বর হয়ে তাদেরকে উদ্ধার করতে৷ তারপর গুলির শব্দ থেমে যায়৷ কিছু অচেনা লোক এসে ঘরের দরজা খুলে লুঙ্গী ,গেঞ্জি পড়া সাধারণ মানুষ৷ ঠিক কতদিন কতরাত পরে মুক্ত বাতাসে আসলো আদুরী বলতে পারে না৷ বাইরে কুকুর শেয়ালের মত পরে আছে হায়েনাদের লাশ৷ জীবত স্বশস্ত্র মানুষের ভীড়ে নিজের ভাই রশীদকে খুঁজে আদুরী৷ গলায় ট্রানজিস্টার ঝোলানো রক্তের ভাই৷ কিন্তু কোথাও নেই ভাই৷ গতরাতে প্রথম যে হায়েনাটা তার উপর সওয়ার হয়েছিলো তাকে বাঁধা দেখতে পায় আদুরী ৷ ছুটে গিয়ে লাথি মারতে মারতে জ্ঞান হারায় সে ৷
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে খুঁজে পায় হাসপাতালের বিছানায় পরনে সাদা থান৷ আরো দুদিন পর বাড়িতে ফিরে আসে সে৷ মা বাড়ির আঙ্গিনায় বসে আছে নির্বাক হয়৷ এলোমেলো চুল,ছেঁড়া বসন৷
–দ্যাশ স্বাধীন হয়ছে? রশীদ কই ? প্রশ্ন করে মা ৷
উত্তর দিতে পারিনি আদুরী চিৎকার করে কান্না করা ছাড়া যে কিছুই করার নেই তার৷ কয়েকদিন পর পাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ছেলেগুলো আসে রশীদদের বাড়িতে৷ রেডিওটি তুলে দেয় আদুরীর হাতে৷ রক্তের দাগ লেগে আছে চামড়ার ব্যাগটাতে৷ এ রক্ত তার ভাইয়ের রক্ত৷ রক্তে ভাইয়ের গন্ধ পায় আদুরী৷ চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও গলা আটকে যায় তার৷ মেজবাবুর দেশ আনতে গিয়ে তার ভাই জীবন দিয়েছে৷  ভাইয়ের রক্তে পবিত্র হয়েছে সবুজ দেশের কালো মাটি৷ নিজে দিয়েছে সম্ভ্রম৷
এদিকে নিজের ভেতরে একটি পাপ বড় হচ্ছে টের পায় আদুরী৷ ইচ্ছে হয় নিজেকে শেষ করে দিতে৷ তাতে নিজের সাথে পাপটাও মুছে যাবে৷ কিন্তু পাগলী মাকে কে দেখবে? যে এখনও ছেলে ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে৷ আদুরী পারে না নিজেকে শেষ করতে৷ তার ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকে যুদ্ধ শিশু যে কুমারী মায়ের রক্ত চুষে বড় হচ্ছে৷ গ্রামেও আদুরী ধিক্কারের পাত্রী,সে যে পাপের ফসলের মালিক !
ভাইয়ের প্রিয় রেডিওতে গান বেজে ওঠে," জয় বাংলা বাংলার জয় ৷"
উঠোনের কোন থেকে চিৎকার করে ওঠে পাগলী মা
–মিছে কথা৷ দ্যাশ স্বাধীন হয় নাই৷ দ্যাশ স্বাধীন হইলে রশীদ ফিইরা আইবো আমারে কইয়া গেছে আমার বাপে৷ কই রশীদ তো ফিরলো না ৷

নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে গরুর গোড়ায় খড় দেয় আদুরী৷

লেখক পরিচিতি: বায়েজিদ হোসেন একজন তরুণ লেখক। জন্ম ঝিনাইদহ জেলায় হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন গাজীপুরে। খুব অল্প বয়স থেকেই তার গল্প ও কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। বিভিন্ন জাতীয় ও অনলাইন পোর্টালে নিয়মিত লিখছেন। কেবল কবিতা বা গল্প নয়, লিখছেন প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, উপন্যাসও। তার একাধিক কবিতাগ্রন্থ, উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে ৷

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/