ছন্দা পালের গল্প ‘ইচ্ছাশক্তি’

ছন্দা পাল

‘ইচ্ছাশক্তি

বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। তবু কিছুতেই আজ ঈশানির উঠতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আজ ঈশানি বাড়িতে ফিরেছে। ফিরে স্নান সেরে একটু কিছু মুখে দিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আজ স্কুলে বেশ চাপ ছিল তার উপর ভিজে এসে শরীর টা ক্লান্ত লাগছিল। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশানি। মা এসে কখন যে আলো জ্বেলে দিয়ে গেছে কিছুই টের পায়নি সে। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পৌনে ছটা বাজে। মায়ের সন্ধ্যা দীপ জ্বালানো হয়ে গেছে,সারা ঘরে ধূনোর গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে।ঠাকুরঘর থেকে মায়ের গলার শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মা এসে বলছেন
– কিরে ইশু, শরীর খারাপ লাগছে,মাথা ধরেছে? এই মাকে নিয়ে হয়েছে জ্বালা সবসময় তার মেয়ের জন্য আশংকা! এই বুঝি মেয়েটার কিছু হয়েছে! ইচ্ছে করেই কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে এসে বেতের‌ চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়ল।
ততক্ষণে মা হাতে দুকাপ ধূমায়িত চায়ের কাপ আর ঘরে বানানো মায়ের হাতের স্পেশাল নিমকি র‌ ট্রে নিয়ে এসে পাশের চেয়ারে বসল। ঈশানি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,- ‘মনে আছে তো মা আগামী কাল কিন্তু তোমার রক্ত পরীক্ষার তারিখ। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা নিয়ে বসে যেওনা। তোমার তো ঘুম থেকে জাগলেই চা চাই! ব্লাড সুগার আর হিমোগ্লোবিনের পরিমাপ করতে হবে। না খেয়ে থাকতে হবে , ভুলে যেওনা যেন।’
 মায়ের গলায় কৃত্রিম অভিমান -‘আর পারিনা বাপু তোকে নিয়ে,এইতো সেদিন রক্ত পরীক্ষা করালাম, আবার এর‌ই মধ্যে? আমার তো কোনো অসুখ করেনি কেন মিছিমিছি—’
মায়ের কথা শেষ না হতেই ঈশানি বলতে শুরু করল, ‘বলেছিনা তোমার ওসব ভাবতে হবে না। তুমি শুধু আমার সাথে যাবে । এরকম ছ'মাস পরপর  করাতে হবে,ডাক্তার কাকু বলেছেন , তোমার মনে নেই?’

আর সুরভী সেসময় নিজে থেকেই বললো, ‘তোর বাবা ও তো বলতেন–‘স্বাস্ব্যই সম্পদ’! সুরভী স্বামী সুকুমারের কথা বলতে বলতে ভাবনার কোনো এক অন্য জগতে হারিয়ে গেল-তখন ঈশানি বছর তিনেকের হবে। বাবা কাজ থেকে ফিরলে বাবার কোলে বসে কত কত ছড়া যে শিখে ফেলেছিল ওইটুকুন বয়সে!সুকুমার বলতেন, ‘দ‌্যাখো সুরভী, আমাদের মেয়ে বড় হয়ে শিক্ষিকা হবে,ওর যা স্মরণশক্তি!’ স্বামীর কথায় মৃদু হেসে সুরভী বলতেন-‘মেয়ে যা বাপ-সোহাগী, দেখা যাবে কত পড়াশোনা করে!’

ঈশানি তখন বাবার কোলে বসে দুলে দুলে নিজের মনে ছড়া আউড়ে যাচ্ছে। মায়ের কাছে ঈশানির অক্ষর-পরিচয়। আর মা-বাবার সুশিক্ষায় ধীরে ধীরে ছোট্ট ঈশানি একটু বড় হয়ে পাড়ার এক স্কুলে ( "সহজ পাঠ") ভর্তি হল। শুরু হলো তার শিক্ষাজীবন! এভাবে নদীর স্রোতের মতো সময় বয়ে চলল। বছরের পর বছর গড়িয়ে গেল। দেখতে দেখতে ঈশানি হাইস্কুলের দশম শ্রেণী তে উঠে গেল। সুকুমার বাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন,- আর কিছু দিন পর তাদের মেয়ে হয়ত এই স্কুলে‌ই পড়াবে আজ যেখানে ও পড়ছে।

বড় আশা সুকুমার বাবুর। নিজের অপূর্ণতা মেয়ে র মধ্যে দিয়ে পূরণের ইচ্ছা। এই হয়ত বেশির ভাগ মাবাবার ই মনোবাসনা হয়ে থাকে। এবার টেস্ট পরীক্ষার ফল ঈশানির মনমতো হয়নি। এবার সে ক্লাসে প্রথম হতে পারেনি, তৃতীয় হয়েছে। বাড়ি এসে বাবার কাছে বলল,
-বাবা, তুমি রাগ কোরোনা , আমি এবার প্রথম হতে পারিনি।
বাবা ঈশানির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,-‘দূর বোকা মেয়ে ,বকব কেন? ক্লাসে প্রথম হতে পারাটাই বড় কথা নয়,বড় কথা হল জীবনে প্রকৃত মানুষ হ‌ওয়া,বড় মনের মানুষ হ‌ওয়া, একথা সবসময় মনে রাখবি।আর তোর ইচ্ছাশক্তি টাই বড়। ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে।’

সুরভী তাদের বাপ-বেটির কথার মধ্যে কখনো থাকে না। তবে স্বামীর প্রত্যেকটি কথায় সে আত্মতৃপ্তি বোধ করে। সেদিন সুকুমার একটা ছোট্ট কাজ সেরে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পেছন থেকে এক লরির অতর্কিত ধাক্কায় পথে উল্টে পড়ে গিয়ে মূহুর্তে দুটি করুণ অসহায় মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সব অন্ধকার হয়ে গেল। চিরতরে নিথর হয়ে গেল একটা তরতাজা জীবন। খবরটা পেয়ে মা-মেয়ে দুজনেই রূদ্ধবাক হয়ে গিয়েছিল। কদিন কোনো কথা বলতে পারে নি তারা। আত্মীয় স্বজনদের স্বরূপ বোঝা গেল কয়েক দিনের মধ্যেই। তখন ঐ কিশোরী ঈশানি মাকে
বুঝিয়ে চোখ মুছতে লাগল আড়ালে।

সুকুমার বাবুর ফার্ম থেকে সুরভীকে কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল,আর বাড়িভাড়ার টাকা এই নিয়ে মা মেয়ের সংসার চলতে লাগল হতাশার মধ্যে দিয়ে। ঈশ্বর হাসেন অন্তরালে! ঈশানি প্রথম বিভাগে কয়েকটি বিষয়ে লেটার নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করল। বাবার প্রত্যেকটি কথা ঈশানির ইচ্ছাশক্তিকে দশগুণ বাড়িয়ে দিল। বুকের ভেতর কষ্টগুলো লুকিয়ে রেখে মাকে নিয়ে আর পড়াশোনা নিয়ে হাজারো বাধাবিপত্তিকে জয় করে এম,এ পাশ করে পরীক্ষা দিয়ে ঈশানি হাইস্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পেল।

প্রথম দিন স্কুলে যাবার আগে বাবার ছবিতে মালা দিয়ে আশির্বাদ চেয়ে , মাকে প্রণাম করে কর্মজগতে প্রবেশ করল , সুকুমার বাবুর সেই ছোট্ট ঈশানি।

চা জুড়িয়ে জল, ভাবনার ভেলায় চড়ে সুরভী ভেসে গিয়েছিল কোন সুদূরে। ঈশানি কখন উঠে গিয়ে স্কুলে র খাতাপত্র নিয়ে বসেছে। সুরভী উঠে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ভাত বসাতে। জীবনের কথা জীবনের মানে শুধু-ই বুঝি অন্তর্যামীই জানেন। মানুষ তার সংসারে উপলক্ষ মাত্র।

লেখক পরিচিতি: ছন্দা পাল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাসিন্দা। অনেক দিন ধরে লিখছেন-কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ-সাহিত্যের সব শাখায় তার সাবলীল পদচারণা। লেখার পাশপাশি পড়তেও পছন্দ করেন এই কবি ও লেখক। স্থানীয় লিটলম্যাগগুলোতে প্রায়ই তার লেখা ছাপা হয়। তিনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণাধর্মী পত্রিকা ‘সংশপ্তক’য়ের নিয়মিত লেখক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/