নারীর প্রতি সহিংসতা

কাজী দিলরুবা রহমান

কাজী দিলরুবা রহমান

দক্ষিন এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত  যেমন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, মায়ানমার,  ভুটান, মালদ্বীপ,  আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর অধিকার বঞ্চনার মাত্রা সর্বাধিক। এই দেশগুলিতে যেমন রয়েছে  অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তেমন শিক্ষার অভাব, নারীর অধিকার বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধতার মধ্যে আছে সামাজিক আচার-ব্যবস্থা, রয়েছে ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা। নামে কোন কোন দেশ কেবল গনতন্ত্র বিরাজমান। সব চেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হচ্ছে পুরুষ নেতৃত্ব।তবে এসব দেশে নানা সময়ে ততোধিক বার রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নেতৃত্বে নারীকে দায়িত্ব পালনে দক্ষতার পরিচয়ে দেখা গেছে।কিন্তু বিভিন্ন গূরুত্বপূর্ণ পর্যায় এখনও পুরুষ নেত্রীত্বের আধিক্য বেশি। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং সংসদের স্পিকার পর্যন্ত নারী। নারীর ক্ষমতায়নে সরকার যে সব সুযোগের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে তাতে বিশ্বে বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অবস্থা ৭তম। সম্প্রতিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নারী নেতাদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর প্রায় ৭০ শতাংশ নারী, তৈরি পোষাক কর্মীদের ৮০ শতাংশ নারী এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নারীরা সংখ্যা গরিষ্ঠ।(ডেইলি ষ্টার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২)।কিন্তু বিভিন্ন গূরুত্বপূর্ণ পর্যায় এখনও পুরুষ নেত্রীত্বের আধিক্য বেশী। সে কারনেই সংসার পর্যায় থেকে শুরু করে  অধিকাংশ জায়গায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বে পুরুষ ব্যক্তির ভুমিকাই মূখ্য থাকে। পুরুষ সদ্যস্যরা পর্দা প্রথা কিম্বা নারীর কোমল মতির দোহাই দিয়ে তাকে অর্থ  উপার্জনের পথ থেকে নিবৃত্ত রেখে কেবল সন্তান পালন এবং পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে নিজেকে ভাবতে বাধ্য করে। একজন মানুষ যখন অর্থনৈতিক ভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল  হয়ে পরে তখন সেই মানুষ বাধ্য থাকে তার সব ধরনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে। আজকের নারীরা শিক্ষায়, মননে, কর্মে পুরুষের পাশাপাশি সম দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। তারা শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে তাদের অধিকার এবং আত্মমর্যাদা বোধ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে।তাই তারা সমাজ সংসারের সব কিছুকে বিনা যুক্তিতে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বিধায় অনেকে উদাহরণ হিসেবে তুলে আনছেন মা-চাচীদের কথা। তাদের সময়ে সংসার সুখের ছিল কেবল মুখ বুঝে সব কিছু সহ্য করতে পারতেন বলে। এই প্রশ্নে সমাধানে বলতে হয় একই কথা তখন মা-চাচীরা অর্থনৈতিক ভাবে এবং শিক্ষা গত যোগ্যতায় তাদের পুরুষ সঙ্গীর চেয়ে পিছিয়ে থাকতেন বিধায় পুরুষ সঙ্গীর সব ধরনের কাজের প্রতি সম্মান ছিল তাদের।আবারো প্রশ্ন তবে কি সংসারের সুখের জন্য নারী শিক্ষা বন্ধ রাখা সঠিক? পুরুষ সমাজ সেটাই ভাবে। কারণ তাতে যেমন সংসারে সুখ বিরাজ করে তেমনী পুরুষ নেতৃত্ব বহাল তবিয়তে থাকে। তবে বলতে হয় সময় ঘড়ির কাঁটাগুলিও  বন্ধ করে রাখা দরকার।তবে সংসার,  সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই সবাই সুখে দিবা-নিশি নিদ্রা যেতে পারবে।কিছুকাল পর দৃষ্টি মেলে দেখবে পুরু পৃথিবী একটি অরণ্যে এ পরিনত হয়েছে।মানুষ তার আদিম আবাসে চলে যাবে।তাই দেশ, জাতি, তথা সম্পূর্ণ পৃথিবীকে সচল রাখার জন্য চাই অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর সার্বিক উন্নয়ন।উন্নয়নের পাশাপাশি মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি পূরুণ।

এখানেই শেষ নয়,  চাই নারীর লিঙ্গ বৈশম্যের সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি পূরুণ।পুরুষের পৌরষের কাছে হেরে যায় নারীর শিক্ষা আর আত্মসম্মান বোধ টুকু। আমরা যদি বাংলা দেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনায় আসি তবে সাম্পতিক কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনার উদাহরণ দিয়ে শুরু করতে পারি। ইলমা রহমান ঢাকা ইউনিভার্সিটির নৃত্যকলা বিভাগের ছাত্রী। প্রবাসী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার শিক্ষা ছিল কিন্তু ছিল না কাজ করার অধিকার। নিজস্ব সত্তা তৈরির অধিকার। সার্বক্ষণ স্বামীর নজরদারীতে থাকতে হতো তাকে।সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের একজন  টিভি, সিনেমার অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুর স্বামীর হাতে হওয়া লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কথা জানি। ভালোবেসে দুজন দুজনকে বিয়ে করেছিলেন। বিবাহিত জীবনের সময়টাও নেহায়াত কম ছিল না। সন্তান ছিল, সংসারের তেমন কোন অর্থনৈতিক টানাপোরেনও ছিল না। পরকীয়ায় লিপ্ত আছে সন্দেহে একজন মানুসের জীবন নিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কারো নেই। সে কারনেই তিক্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার মনবল তৈরি করা নিজের মধ্যে যেমন প্রয়োজন তেমনী পরিবার, সমাজেরও রয়েছে দায়। নারীর আত্ম হত্যা অথবা স্বামীর হাতে খুন হওয়ার কারণ হিসেবে ঐ নারীর পরিবার অনেকাংশে দায়ী আমি বলবো। কারণ তার মেয়ের কাছে পারিবারিক অশান্তির কথা জেনে বার বার মানিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিতে থাকে। তারপর আসি  স্কলাসটিকা স্কুলের একজন কর্মকর্তা ইভানা লায়লা চৌধুরী নারীর প্রসংগে, সংসার বিচ্যুতির ভয়ে  আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। কাকে ভয় ছিল? তিনি তো  স্বাবলম্বী ছিলেন। কিন্তু ভয় ছিল সমাজকে। এখনও আমাদের সমাজে একটি মেয়ে পরিচিত হয় তার স্বামীর পরিচয়ে সে ক্ষেত্রে তার যত বড় পরিচয়ই থাক না কেন। অনেক শিক্ষিত নারীও অন্য একজন নারীকে মূল্যায়ন করে তার স্বামী কি করেন সেই পরিচয়কে অবলম্বন করে। অথচ এক জন স্বামীকে তার স্ত্রীর যোগ্যতাহীনতার জন্য যেমন ছোট হতে হয় না তেমনী তার যোগ্যতার জন্য সম্মানিত করা হয় না।নারীর যোগ্যতা কেবল সংসারে সমাজের সব ধরনের অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করার মধ্য সীমাবদ্ধ। আমরা নারীর অধিকারের প্রশ্নে স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্কগুলির মধ্য সীমাবদ্ধ করে রাখি।

স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক গুলি আইন করে মেটানো সম্ভব নয়। তবে দু-জনকে নিজের ইচ্ছেমাফিক  চলার আইন পালনে যে সামাজিক বাঁধা বা বিপত্তি আসে সেগুলি দূর করা করা যায়। যেমন ডিভোর্সি নারীর স্বাচ্ছন্দে সামাজিক জীবন-যাপনের স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। ডিভোর্সের পর দেশের আইন অনুযায়ী নারীর ও সন্তানদের দেখ-ভালের দায়িত্ব পালনের অধিকার রক্ষা করা। এছাড়া নারীর পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার থাকলে ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজো সেই সম্পত্তি নারীর পক্ষে ভোগ করা এক জটিল পর্যায়ে চলে যায়। অনেক সময় পরিবারের পুরুষ সদস্যারা নারীকে দুর্বল ভেবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। নারী যখন সোচ্চার হয় তখন পরিবারের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পরে। আর সে কারণে নারীরা সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও বাবার সম্পত্তি নেয়া থেকে বিরত থাকে। মুসলিম আইনে এক জন নারী তার স্বামীর সম্পত্তির দু আনা অংশ পান। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর দেখা যায় কোন ভাবেই ঐ নারী তার সম্পত্তি একক ভাবে ভোগ করে যেতে পারেন না। অথবা নারী যদি ডিভোর্স নেন সেক্ষেত্রেও তিনি সব সময় খোরপোশের টাকা পান না।অধিকাংস সময় খোরপোশের টাকার জন্য মামলা করতে হয়।কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা সব সময় হয় না। অনেকে অনিশ্চয়তার ভয়ে হয়তো মামলা করেন না।এভাবেই নারী পুরুষতন্ত্রের কাছে অহরহ বলীর পাঠা হচ্ছে। কন্যাশিশু থেকে শুরু করে রেহাই পান মধ্য বয়সী নারী পর্যন্ত ধর্ষনের লজ্জা জনক থাবা থেকে।পথে-ঘাটে চলতে গিয়ে একটু নির্জন পরিবেশে ওৎ পেতে থাকা বিকৃত পুরুষের লালসার কাছে প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে কত জন! পেপার-পত্রিকা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে সেসব আমরা প্রতি দিনই  দেখতে পাই।স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ বাবার সামনে মেয়েকে এসব  যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়েছে দাঁড়িয়েছে।নারীরা কর্ম ক্ষেত্রেও অহরহ যৌন হেনস্তার  শিকার।

কেবল ধর্ষণ নয় ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হচ্ছে  পর্যন্ত।বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় নারী সংগঠন মহিলা পরিষদ ১৩টি বাংলা ও ইংরেজী জাতীয় দৈনিক পত্রিকাতে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সারাদেশে নারী ও কণ্যা শিশুর নির্যতনের তথ্য সংরক্ষণ করে।২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণ, গণ ধর্ষণ, হত্যাসহ নারী ও ক্ণ্যাশিশুর মতো বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৪৫১টি। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী সামাজিক নারী সংগঠনগুলো কাজ করে যাচ্ছে  নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কিন্তু সব পদক্ষেপ যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।

সমাজে যে নারীরা কেবল পুরুষতন্ত্র দ্বারা শোষিত হচ্ছে তা নয়। তারা নারী দ্বারাও নির্যাতিত হয়।যেমন শশুর বাড়িতে নারীর শাশুড়ি-ননদ, আবার শাশুড়ি হচ্ছেন পুত্র বধু দ্বারা নির্যাতিত।এমন কি ক্ণ্যা শিশুকে অবাঞ্চিত মনে করে মা নিজেই শিশু জন্মের পর পর ফেলে দেন ডাষ্ট বিনে কিম্বা নিজ হাতে মেরে ফেলেন, বিক্রি করে দেন পর্যন্ত। সাম্প্রতিক সময়ে খুলনায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা তার প্রমান। মা তার যমজ দুই কন্যা শিশুদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে গলা টিপে হত্যা করেন এবং পরে পুকুরে ফেলে দেন। এর কারন মূলত অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, শিক্ষার অভাব এবং নারীর প্রতি পুরুষের সম্মান বোধের অভাব।  

লেখক পরিচিতি: কাজী দিলরুবা রহমান একাধারে একজন কবি, কথা সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক। তার জন্ম জেলা বরিশাল এবং বেড়ে উঠা ঢাকায়। পড়াশুনা করেছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানে। বেশ কিছু বছর যাবত লেখালেখির সাথে যুক্ত তিনি। বিভিন্ন সাহিত্য এবং পোর্টাল পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত প্রকাশ পেয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি। এ বছর বইমেলায় দুটি নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

ওমেন্স নিউজ/