সুলাইমান মাহমুদ রাসেলের প্রবন্ধ ‘বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন’

ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন

সভ্যতার শুরু থেকে পুঁজিবাদীদের হাতে ছিল অন্যায় ও শোষণের হাতিয়ার, বিপরীতে মুক্তিকামী মানুষের হাতে মুক্তির মশাল। স্বাধীনতা স্বাধীকার আর সার্বভৌমত্বের নতুন ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে অসীম সাহস আর অমিত তেজে লিখেছেন শোষকের পরাজয়। পরিবার পরিজনকে ফেলে কারাগারের নির্জন কুঠুরিতে বন্দিত্ব বরণ করেছে শুধুমাত্র মা মাটি মানুষের টানে। এক যুগের বেশি সময় কারানির্যাতন ভোগের যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন তিনিই বাঙালির আত্মপরিচয়, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চৌদ্দ শিকের নির্মমতার গল্প আজও জাতীয়তাবাদী ঐক্যের  প্রেরণার উৎস।

টুঙ্গিপাড়ার শেখের বেটা
টুঙ্গিপাড়ার বিখ্যাত শেখ পরিবারে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুনের কোল আলো করে ১৯২০ সালের ২০ মার্চ যে নবজাতকের আবির্ভাব তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশবের দুরন্তপনা, পারিবারিক ঐতিহ্য, সবুজ শ্যামল প্রকৃতি আর মধুমতি নদীপাড়ে বেড়ে ওঠা মুজিব সবকিছুকে ছাপিয়ে একদিন হয়ে ওঠেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম রূপকার, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়ক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ পাস করা তাগড়া জোয়ান অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, নিপীড়িত জনতার পরম বন্ধু হতে গিয়ে জীবনের সিংহভাগ কারাবন্দি থেকেছেন। তিনিই বঙ্গবন্ধু। খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হওয়ার সংগ্রামমুখোর দিনগুলি আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্ববহ।

বঙ্গবন্ধুর কারাভোগ: স্মৃতি-বিস্মৃতি
পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু প্রায় ৪,৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। নির্জন কারাগারে একাকী জীবন যেমন ছিল যন্ত্রণার তেমনি ছিল অতিষ্ঠের। তবু মহান নেতার অত্যুজ্জ্বল দেশপ্রেম ও অতুলনীয় ধৈর্য তাঁকে বলিষ্ঠতা দান করেছে। জেলখানায় শেখ মুজিবের সম্বল ছিল প্রিয় পাইপ, বেশকিছু বইপত্র, খবরের কাগজ, লেখার খাতা ইত্যাদি। কতটা নির্মম বন্দিদশা— মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র, পার্টির লোক কারো সাথেই কথা নেই, দেখা নেই এ যেন এক নরকপুরী! ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত হাজতে বহুবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। ফাঁসি দেয়ারও অপচেষ্টা চলেছে দু-তিনবার। তবু দমে যাননি শেখ মুজিবুর।

প্রতিবাদী মুজিবের প্রথম জেল
বন্ধু আবদুল মালেককে মারধর করার কথা শুনে দুঃসাহসিক মুজিব রমাদত্তের গ্রুপের সাথে হাতাহাতি করে দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে আনে। শহরের হিন্দু নেতারা ক্ষেপে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ লিখিয়ে মুজিবকে আসামি বানিয়ে জেল হাজতে পাঠায়। জেল খাটলেন সাত দিন। মুজিব থানায় হাজির না হয়ে পালাতেও পারতেন। কিন্তু না, তিনি বাঙালি বাঘ। তাঁর ফুফাতো ভাই তাকে বলল, ‘মিয়াভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না।’সে বললেন, ‘আমি পালাব না লোকে বলবে,আমি ভয় পেয়েছি’। জামিন পেলেও পনেরশো টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছিল। তখন থেকেই মুজিবের উদার মানসিকতা, অদম্য প্রতিভা আর দুর্বার সাহস ছিল।

ভাষা আন্দোলনে কয়েদি বঙ্গবন্ধু
মাতৃভাষার স্বপক্ষে সোচ্চার বঙ্গবন্ধু আটচল্লিশের আন্দোলন থেকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, কারাবরণ করেছেন। অন্যায়ভাবে জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। ভাষার দাবিতে প্রথম গ্রেফতার হন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। সেপ্টেম্বরে কার্ডন প্রথার বিরোধিতা করায় ফের গ্রেফতার। এরপর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় ১,০১০ দিন রাজবন্দি হিসেবে কারারুদ্ধ ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে টানা ১৩ দিন অনশন করলে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। মুক্তির দাবিতে দৃঢ়প্রত্যয়ে তিনি বলেন, Either I will go out of the Jail or my deadbody will go out.

গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর চৌদ্দশিকের চিত্রপট
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধু একটি শ্লোগান, একটি অধ্যায়। তাইতো চুয়ান্নতে ২০৬ দিন, আইয়ুব খানের শাসনামলে ১,১৫৩ দিন, ছয়দফাকালে প্রায় ৯০ দিন কারাভোগ করেন। চরম অনিশ্চিয়তা ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালেও ২৮৮ দিন জেলের অন্ধ কুঠুরিতে নির্মম জীবনযাপন করেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। রাজনীতিতে তাঁর আত্মত্যাগ সীমাহীন। বঙ্গবন্ধু উপাধিদাতা বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা করেছেন।

কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন
অন্যায়ের বিপক্ষে মানে ন্যায়যোদ্ধা,
নিপীড়নের প্রতিবাদ মানে শান্তির বার্তা।

বঙ্গবন্ধু বহুমাত্রিক বর্ণাঢ্য জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যে বরেণ্য এক কিংবদন্তি। নিঃসঙ্গ কারাভোগ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু দেশ ও জাতির কল্যাণে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। শোষকদের বিরুদ্ধে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থানই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল কোটি বাঙালি। SADI এর তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু ১৩ বছর সভাসমাবেশ আর ১৩ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। তবু তাঁর জীবনদর্শনে অমায়িক ব্যক্তিত্বের নিদর্শন দৃশ্যমান। তিনি কারাবন্দি হয়েও বই পড়েছেন, ‘কারাগারের রোজনামচা'র মতো বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন, মাঝেমধ্যে রসিকতাও করছেন। জেল বদলে এয়ারপোর্ট থেকে যখন ক্যান্টনমেন্টে গেলেন তখন মনে মনে বললেন, ‘তোমাকে আমি ভালোবাসি, মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয় মা।’ অসাধারণ এ মানুষটির জনবান্ধব মানসের দৃষ্টান্ত দুর্লভ।

জেলখানায় শেখ সাহেবের রোগ-দশা
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে জেল হাজতে মানবেতর জীবনযাপনের হাজারো গল্প উঠে এসেছে। রোগাক্রান্ত হলেও ভালো চিকিৎসা পেতো না। ১৯৫০ সালে গোপালগঞ্জ জেলে দুর্বল হার্ট, চোখের যন্ত্রণা, পায়ে  ব্যথা জ্বরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জোর করে জেল চিকিৎসকরা টিউব ঢুকিয়ে তরল খাবার খাওয়ালে তাঁর নাকে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। হার্টের অসুবিধা, পাইলস, গ্যাস্ট্রিকসহ নানা রোগ-বালাইয়ে তিনি শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন। তবু তিনি পাকিস্তানের কাছে মাথা নত করেননি।

কয়েদিদের অদ্ভুত ঈদ
১৯৬৭ সালের ঈদ, ব্যতিক্রমি ঈদ। জেলের বাইরে শতকরা ৯০ ভাগ লোক ১৩ তারিখ ঈদ পালন করবে। পাক-সরকারের জুলুমবাজির চরম পর্যায়ে কয়েদিদেরকে ১২ তারিখেই ঈদের  নামাজ পড়তে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। ৫ টাকায় ৪/৫ জনের খাবারের বন্দোবস্ত। পরের দিন বঙ্গমাতা খাবার নিয়ে এলে বঙ্গবন্ধু ৬০/৭০ জনের সাথে ভাগাভাগি করে খেলেন। কতটা নিষ্ঠুর লোহার শিক, কতটা পাশবিক শোষক!

রাসেলের আব্বার বাড়ি সফর
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল জেলখানাকে আব্বার বাড়ি বলেই জানতো। কারাগার এমন এক অবস্থা করেছিল যে কামাল রাসেলরাও নিজের বাবাকে বাবা ডাকতে পারতো না। কারণ বাবা তো বাড়িছাড়া! রাসেল জেলেখানায় বাবাকে দেখতে এলেই কোলে উঠতো আর নামতে চাইতো না।
বঙ্গবন্ধু তাঁর মা-বাবার আদর থেকেও তখন বঞ্চিত হন। এক জেল থেকে অন্য জেল করতে করতে মায়ের অসুখ দেখতেও বাড়ি যেতে পারেননি৷ Solitary Confinement দশায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জবানিতে—‘জেল কতৃপক্ষ যে মাছ আমাকে দিয়েছিল তা খাওয়ার অযোগ্য। ফেরত দিয়ে দিলাম।…মশক শ্রেণী সাঁড়াশির মতো আক্রমণ করে।’
নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। ১৫৭৬ সালের দাউদ কারানীর কথা টেনে মীর জাফর, কাদুল লোহানীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা তুলে ধরেন। এসব বিবরণ থেকে জেলজীবনের দুরবস্থা ও তাঁর ব্যক্তিত্ববোধ, ইতিহাসচেতনা, দূরদর্শিতার পরিচয় মিলে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনসংগ্রাম
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পঞ্চান্ন বছরের (১৯২০—১৯৭৫) জীবনে উপমহাদেশে মূর্তিমান জ্যোতিষ্কের মতো আলো ছড়িয়েছেন। ১৯৪৪ সাল থেকে রাজনৈতিক সক্রিয়তা। এরপর থেকে আর পিছু তাকাতে হয়নি। ছাত্রনেতা থেকে যুক্তফ্রন্ট্রের মন্ত্রী, ছয়দফার প্রবক্তা, সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দলের প্রধান নেতা, সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক,বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা— কোথায় নেই শেখ মুজিব? তাঁর হাত ধরেই নির্মিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ, বাহাত্তরের সংবিধান, লাল সবুজের পতাকা। তাঁর উদারতা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আদর্শিক দিকগুলো জাতিকে আলোকিত করবে। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি যোগাবে সেই প্রত্যাশা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে মর্মান্তিকভাবে হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে যে কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল তা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে ডুবাতে পারেনি বরং ঘাতকেরাই চিরতরে ধিক্কৃত লাঞ্চিত। পক্ষান্তরে আজও দীপ্তিময় মুজিবুর। ষোল কোটি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন।

উপসংহার
কবি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তিটিই বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রযোজ্য। তাঁর ছিল গভীর চিন্তা, মহান অনুভব, অকৃত্রিম দেশপ্রেম। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনে তিনি যে আদর্শ রেখে গেছেন কাল থেকে কালান্তরে অত্যাচিরত অবহেলিত মানুষের স্বাধীনতা ও স্বাধীকারের লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করবে।

মহাকাব্যের পাতায় পাতায় সোনালি হরফে লেখা
নামটি তোমার বঙ্গবন্ধু, ওরে বাংলার খোকা।

সুলাইমান মাহমুদ রাসেল

সুলাইমান মাহমুদ রাসেল: কবি, প্রাবন্ধিক ও তরুণ গবেষক।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/