‘ফ্রান্সের লকডাউন দেখে ৭১-এর কথা মনে পড়ছে’

আইফেল টাওয়ার এখন জনশূন্য

করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা ইউরোপের। প্রতিদিনই সেখানে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড করা হচ্ছে। আর এ কারণেই ইউরোপকে করোনাভাইরাসের নতুন কেন্দ্রস্থল হিসাবে ঘোষণা কেরছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ইউরোপে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ইতালি, স্পেন আর ফ্রান্সের। এই তিন দেশে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি। মঙ্গলবার পর্ন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতালিতে ২১৫৮, স্পেনে ৫০৯ ও ফ্রান্সে ১৪৮ জন মারা গেছেন। করোনা ঠেকাতে ইউরোপের অনেক দেশেই চলেছে লক ডাউন। অর্থাৎ আইন করে দেশের মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে; যার ফলে সেখানকার অনেক দেশেই বিরাজ করছে কবরের নিস্তব্ধতা।

এ নিয়ে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বিবিসির কাছে তুলে ধরেছেন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বাসিন্দা নিলুফার জাহান। তিনি জানান, একটা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে পুরো ফ্রান্সের জীবন ও সমাজ অচল হয়ে পড়েছে – এমনটা আগে কখনো দেখেননি তিনি। এই অবস্থাকে তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেমের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

প্যারিস থেকে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘যখন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো শনিবার টিভিতে ভাষণ দিয়ে বললেন যে আমাদের সবাইকে ঘরে থাকতে হবে, তখন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যেমন একটা বন্দী অবস্থায় ছিলাম – ঠিক ওই কথাটাই আমার মনে পড়ে গেল।’

নিলুফার জাহান একজন শিল্পী, যিনি ৩২ বছর ধরে প্যারিসে বসবাস করছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত ফ্রান্সে এ পর্যন্ত ৬ হাজারেরও বেশি লোক সংক্রমিত হয়েছে আর মৃত্যু হয়েছে প্রায় দেড়শ জনের।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো রোববার টিভিতে এক ভাষণ দিয়ে অন্তত ১৫ দিনের জন্য সবাইকে ঘরে বসে থাকতে বলেছেন। ফ্রান্সে সব স্কুল ক্যাফে-রেস্তোরাঁ, এবং ছোট দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

নিলুফার জাহান বলেন, ‘লোকের মনে একটা আতঙ্ক দেখছি। মানুষ ভয় পাচ্ছে যে কি হবে। ফ্রান্সে এই ভাইরাসে যারা মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক লোক। প্রেসিডেন্টের ওই ভাষণের পর রোববার থেকেই ক্যাফে-রেস্তোরাঁ, ছোটখাটো দোকান সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল শুধু সুপার স্টোর, ফার্মেসি, টোব্যাকো শপ, ব্যাংক আর পোস্ট অফিস খোলা থাকবে।’

`শনিবারেই দেখেছিলাম, রাস্তাঘাটে লোকজন একেবারেই কম। মানুষজন একে অপরের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলছে, কথা বলছে না। সোমবার ( ১৬ মার্চ) সকালে দুধ কিনতে সুপারস্টোরে গিয়ে দেখলাম, বাইরে বিরাট লম্বা লাইন। বলা হয়েছে, সবাইকে এক মিটার দূরে দূরে দাঁড়াতে হবে। লোকজন অনেকেই মাস্ক পরে আছে। এটাও আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলো।’

প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ফ্রান্সে লোকজনকে ঘরের বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। সরকারি আদেশে বলা হয়, কেউ ঘরের বাইরে বেরোলে তার কারণ উল্লেখ করে একটা ফর্ম সাথে রাখতে হবে, যা অমান্য করলে ১৩৫ ইউরো জরিমানা করা হবে। এ আদেশ মানা হচ্ছে কিনা – তা নিশ্চিত করতে ১ লক্ষ সরকারি কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে সারা দেশে।

ফ্রান্স প্রবাসী নিলুফার জাহান

নিলুফার জাহান বলছিলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে যাদের ছেলেমেয়েরা ছোট – তাদের ছুটি নিতে বলা হয়েছে। অনেকে বাড়ি থেকে কাজ করছেন। অনেকে অফিসে যাচ্ছেন না। যাদের বয়স ৬০-এর ওপরে তারা যদি ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে সিক লিভ নেন, তাহলে তাদের ৮০ শতাংশ বেতন দেয়া হবে।’

‘এই শনি-রবিবারই লোকে সব বাজার-টাজার করে ঘরে স্টক করে ফেলেছে, সুপার মার্কেট খালি। দোকানপাটে জিনিসপত্র নাই। বিশেষ করে দুধ, ডিম, বোতলের পানি – এগুলোর খুব অভাব আছে।’

‘আমি পেশায় আর্টিস্ট এবং টেক্সটাইল ডিজাইনার। আমাদের বাড়ির কাছেই একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে – সেখানে আমরা কয়েকজন আর্টিস্ট মাঝে মাঝে যাই, বুড়োবুড়িদের ছবি আঁকা শেখাই, তাদের সাথে কথা বলি। এবার আমার ডাক্তার বললো তুমি সেখানে যাবে না।’

বাইরে বেরুনোর কারণ লেখা ফর্ম পরীক্ষা করছে পুলিশ

‘বাংলাদেশ থেকে সারাক্ষণ টেলিফোন আসছে, স্বজনরা জিজ্ঞেস করছে যে আমি ঠিক আছি কিনা। তাদের আমি আশ্বস্ত করছি যে ভয়ের কোন কারণ নেই, আমার চারপাশে সবাই ভালো আছে। সাবধানতা যেটুকু পালন করতে হয়, সেটা করছি। সেটা হলো – বাইরে না যাওয়া।’

ওমেনস নিউজ ডেস্ক/