শুভ জন্মদিন বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শ

আজ ২৬ জুলাই বিশ্ব সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। কেননা আজ বিখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ‘র (George Bernard Shaw) জন্মদিন। বলা হয়ে থাকে, শেক্সপিয়ারের পর তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে সফল নাট্যকার। মূলত নাট্যকার হিসাবে খ্যাতি পেলেও সাহিত্যের সব শাখাতেই (প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোট গল্প) তার সাবলীল পদচারণা লক্ষণীয়, বিশেষ করে সাহিত্য সমালোচনায়। অনেকের মতে তার মতো সাহিত্য সমালোচক বিশ্বে দুর্লভ। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি একসঙ্গে নোবেল ও অস্কার পেয়েছিলেন।

প্রথম জীবন

জর্জ বার্নার্ড শ ১৮৫৬ সালের এই দিনে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জর্জ কার শ এবং মায়ের নাম লুসিন্ডা এলিজাবেথ শ’। জর্জ বার্নার্ড শ' ছাড়াও তাদের আরো দু’কন্যা সন্তান ছিল। মেথোডিস্ট চার্চ পরিচালিত ডাবলিনের একটি গ্রামার স্কুলে তার পড়াশোনা। ডাবলিন ইংলিশ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল ডে স্কুলে তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ার সমাপ্তি ঘটে। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭১’র মধ্যে তিনি  মোট চারটি স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং এর প্রত্যেকটিই তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি বিরূপ করে তোলে। পরবর্তীতে তিনি তার লেখায় স্কুলকে কারাগার এবং স্কুল শিক্ষককে কারাপরিদর্শক হিসেবে উপস্থাপনা করেছেন।

বার্নার্ড শয়ের বাবা ছিলেন মদ্যপ ও আর্থিকভাবে অসফল একজন মানুষ। ফলে অভাব অনটনের মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন এই নাট্যকার। স্বামীকে পছন্দ করতেন না তার মা লুসিন্ডা এলিজাবেথ শ। লুসিন্ডা এক সময় ডাবলিনের সঙ্গীত শিক্ষক জর্জ জন লি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে স্বামীকে ছেড়ে তার সঙ্গে চলে যান। যে কারণে বার্নার্ড শ আজীবন মনে করে এসেছেন, জন লি তার প্রকৃত বাবা।  নাট্যকার  বার্নার্ড শ’র জীবনে এই ব্যক্তির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তার সাহচর্যে এসেই তিনি সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন যা পরবর্তীতে তার সঙ্গীত বিষয়ক লেখালেখিতে কাজে এসেছিল।

সংসারের আর্থিক অনটন দূর করতে ১৮৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে ডাবলিনের জমিজমা সংক্রান্ত এক অফিসে জুনিয়র কেরানি হিসাবে কাজ নেন তিনি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দ্রুত উন্নতি করেন এবং কোম্পানির ক্যাশিয়ার হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন।  এসময় তিনি জর্জ শ নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ১৮৭৬ সালে তিনি নিজের নাম থেকে পুরেনো ধাচের ‘জর্জ’ শব্দটি বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত স্টাইলিশ ‘বার্নার্ড শ’ নামটি গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি এ নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত হন।

আগেই বলেছি তার বাবার আয় রোজগার ভালো ছিল না। ফলে তার মা পুরোপুরি প্রেমিকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ১৮৭৩ সালে জন লি ডাবলিন ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমালে তিনিও দুই মেয়েকে নিয়ে তার সঙ্গী হন। কিন্তু বাবার সঙ্গে ডাবলিনেই রয়ে যান বার্নড শ। পরে ছোট বোন এলিনোর অ্যাগনেসের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তিনি লন্ডনে ছুটে যান এবং সেখানেই থিতু হন। পাল্টে ফেলেন জীবনের গতি, কেননা লন্ডনে তিনি আর কেরানির চাকরি করতে রাজি ছিলেন না। এসময় লি তার জন্য ব্যঙ্গাত্মক সাপ্তাহিক ‘দ্য হর্নেট’ পত্রিকায় একটি ছোট কাজ জোগাড় করে দেন। তিনি সেখানে সংগীতের ওপর কলাম লিখতেন। আর বাকি সময় পড়ে থাকতেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। তিনি ওই লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য পাস সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন এবং সাপ্তাহিক ছুটির পুরো দিনটা তিনি সেখানেই কাটাতেন। তার প্রকৃত জ্ঞান চর্চা আর লেখালেখির শুরু ওই লাইব্রেরি থেকেই।

এ সময় তিনি সমাজতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে পরিচিত হন এবং কার্ল মার্ক্সের ‘দাজ ক্যাপিটেল’ পড়ে ফেলেন। ফলে তার চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। রাজনৈতিকভাবে তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন। এছাড়া তার জীবনে হেনরি জর্জের ‘প্রগ্রেস এন্ড প্রোভার্টি’ বইটিরও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এসব বই তার মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল যা পরবর্তীতে নাট্য রচনায় প্রভাব ফেলেছে।

১৮৮০’র দশকটি বার্নার্ড শয়ের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তিনি সামলোচক ও লেখক হিসাবে সুনাম অর্জন করতে শুরু করেন এবং লিখে ফেলেন দুটি আস্ত উপন্যাস। একই সঙ্গে বয়সে বড় বিধবা নারী জেনি প্যাটারসনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এই সম্পর্ক নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। যদিও তারা কখনও বিয়ে করেননি।

জর্জ বার্নার্ড শ ১৮৯৮ সালে বিয়ে করেন শার্লট পেইন-টাউনশ্যান্ডকে। তার স্ত্রী ছিলেন খুবই গুণী নারী। তিনি নিজেও একজন উচ্চমানের লেখক, অনুবাদক ও নারী অধিকার কর্মী ছিলেন।

বার্নার্ড শ১৮৯৭ সালে পার্লামেন্ট মেম্বার হিসেবে মনোনীত হলেও পরে স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে তৎপর ছিলেন। তিনি ১৯০০ সাল পর্যন্ত কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জর্জ বার্নার্ড শ’র লেখা প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৮৯০ সালে। অচিরেই তিনি তার সমাজে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। পরবর্তীকালে ১৮৯৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স। এ ছাড়া তিনি বিখ্যাত সংবাদপত্র নিউ স্টেটম্যানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

লেখালেখি

জর্জ বার্নার্ড শ বিশ্বজুড়ে নাট্যকার হিসাবে খ্যাতিমান। তবে তার সাহিত্য, সঙ্গীত ও রাজনীতির সমালোচনামূলক লেখাগুলো কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। জর্জ বার্নার্ড শ’ রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক হলো- আর্মস এন্ড ম্যানস, দ্য ম্যান অব ডেসটিনি, ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান, ব্যাক টু ম্যাথুসেলাহ, সেইন্ট জোয়ান,  সিজার এবং ক্লিওপেট্রা, অ্যান্ড্রোকলস  অ্যান্ড  লায়ন, মেজর বারবারা, দ্য ডক্টরস ডিলেমা, ক্যান্ডিডা, পিগম্যালিয়ন, হার্টব্রেক হাউস, দ্য অ্যাপল কার্ট, অন দ্য রকস, জেনেভা, ইউ নেভার ক্যান টেল মি,  দ্য ডেভিলস ডিসাইপল ইত্যাদি।

আগেই বলেছি ক্রিটিকস হিসাবে তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তিনি সঙ্গীত, নাটক, রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা লিখেছেন। সঙ্গীত নিয়ে তিনি যেসব সমালোচনা করেছেন তার ওপর তিন ভলিউম বই প্রকাশিত হয়েছে, যার আয়তন ২৭শ পৃষ্ঠার বেশি। এছাড়া তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা পাঁচ।

একসঙ্গে নোবেল ও অস্কার

জর্জ বার্নার্ড শ’ এমন ব্যক্তিত্ব যিনি একসাথে শিল্প সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার  নোবেল এবং অস্কার পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি একাই ছিলেন একসঙ্গে এই দুটি পুরস্কার লাভকারী বিরল সম্মানের অধিকারী। পরে মার্কিন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ বব ডিলান এতে ভাগ বসান। জর্জ বার্নাড শ’য়ের পর বব ডিলান হলেন ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি একাধারে জিতেছেন নোবেল (২০১৬) ও অস্কার (২০০১) পুরস্কার।

১৯২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয় করেছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ। আর ১৯৩৯ সালে ‘সেরা চিত্রনাট্য’ বিভাগে অস্কার জয় করে তার লেখা পিগম্যালিয়ন ছবির চিত্রনাট্য।

নোবেল পুরস্কার গ্রহণের ইচ্ছা ছিল না  বার্নার্ড  শ‘র। স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তা তিনি গ্রহণ করেন। তবে তিনি পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করেননি। তিনি পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, আমি ডিনামাইট তৈরির জন্য আলফ্রেড নোবেলকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তনকারীকে ক্ষমা করতে পারি না, কারণ একমাত্র মানুষরূপী শয়তানই এমন পুরস্কার প্রবর্তন করতে পারে। জর্জ বার্নার্ড শ’ নোবেল পুরস্কার পেলেও বিভিন্ন সময়ে এই পুরস্কার এবং এর প্রবর্তকের সমালোচনা করেছেন। ব্যক্তি জীবনে এতটাই সৎ, নীতিবান আর স্পষ্টভাষী ছিলেন এই সাহিত্যিক।

তিনি ১৯৫০ সালের ২ নভেম্বর ৯৪ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারে মৃত্যুবরণ করেন।

আজ এই মহান সাহিত্যিকের ১৬৪তম জন্মদিনে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো অসীম শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন জর্জ বার্নার্ড শ।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/