শুভ জন্মদিন ছন্দের জাদুকর পি বি শেলি

আজ ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি পার্শি বিশি শেলির জন্মদিন। রোমান্টিক ধারার এই কবি ইংরেজি কবিতার ছন্দের জাদুকর হিসেবে স্বীকৃত। কবিতার পাশাপাশি তিনি উপন্যাস, নাটক  প্রচুর প্রবন্ধ রচনা করেছেন। যদিও খুব বেশিদিন সাহিত্য চর্চা করার সুযোগ মেলেনি তার। ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন কয়েক আগে ইতালির লিরিসিতে এক নৌ দুর্ঘটনায় মারা যান বিশ্ব সাহিত্যের এই প্রতিভাবান কবি। সাহিত্য জগতে তিনি পি বি শেলি নামেই সমধিক পরিচিত।

প্রথম জীবন

পার্সি বিশি শেলি ১৭৯২ সালের ৪ আগস্ট সাসেক্সের হরসেমে ব্রিটেনের এক সভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা টিমোলি শেলি ছিলেন একজন সংসদ সদস্য। বাড়িতেই শিক্ষা জীবন শুরু হয় শেলির। পরে তাকে সায়ন হাউস একাডেমিতে পাঠানো হয়। ১৮০৪ সালে তাকে বোর্ডিং স্কুল ইটন কলেজে পাঠানো হয়। যেখানে বন্ধুদের সান্নিধ্যে লাজুক শেলি হয়ে উঠেন ‘খ্যাপা শেলি’। সেখানেই তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘জাস্ট্রোজি’লেখেন যা ১৮১০ সালে লন্ডন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বইয়ে লেখকের নাম লেখা হয়েছিল কেবল তার নামের  আদ্যক্ষর পি.বি.এস। শেলির দুটি গোথিক উপন্যাসের মধ্যে এটি প্রথম। ওই বছরই তিনি লন্ডনের অক্সফোর্ড কলেজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি।

আর সেই বছরেই শেলি The Necessity of Atheism (নাস্তিক্যবাদের প্রয়োজনীয়তা) নামে একটি বই লেখন। ছদ্মনামেই তিনি সেটা লিখেছিলেন। এটি তিনি ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন কলেজের প্রধান ও বিশপদের কাছে পাঠান। রচনাটির মূল বিষয় ছিল যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়টি বাস্তব সাক্ষ্যপ্রমাণ বা যুক্তি দিয়ে প্রমাণিত না সুতরাং ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়ে একটি মুক্ত তদন্ত হওয়া উচিত। এই অভিযোগে এখন আর কেউ অক্সফোর্ড থেকে বহিষ্কার হবে না, এমনই ধারণা করা যায়।

কিন্তু এ ঘটনায় উল্টো শেলি ও তার বন্ধু টমাস জেফারসন হগকে অক্সফোর্ড থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এ ঘটনায় শেলির বাবা  খুব কষ্ট পান। শেলি তখন তার বন্ধু হগের সঙ্গে লন্ডন চলে যান। সেখানে লজিং থেকে প্রচুর পড়াশুনা শুরু করেন। এ সম্পর্কে বন্ধু হগ পরে বলেন, তখন শেলি প্রতিদিন ষোলো ঘণ্টা পড়তেন। জনাকীর্ণ রাস্তায় চলাকালেও এক হাতে একটি বই চোখের সামনে ধরা থাকত এবং অন্য হাতে আরেকটি পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকত। যেন একটি বই শেষ করে তাকে অন্য একটি বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়।

ব্যক্তিগত জীবন

কাব্য চর্চার মতো শেলির ব্যক্তিগত জীবনও যথেষ্ট বৈচিত্র্যময় ছিল। অক্সফোর্ড থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার মাত্র চার মাস পরে, ১৮১১ সালের ২৮ আগস্ট ১৯ বছরের তরুণ শেলি ১৬ বছর বয়সী হারিয়্যাট ওয়েস্টব্রুককে নিয়ে  স্কটল্যান্ডে পালিয়ে যান এবং সেখানে তারা বিয়ে করেন। হ্যারিয়েট ছিলেন একজন অবসর প্রাপ্ত হোটেল কিপারের মেয়ে এবং শেলির বোনদের সাথে একই বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন। তো বোনদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হ্যারিয়েটের সঙ্গে পরিচয়।

তার জীবনী লেখকদের কেউ কেউ মনে করেন, সুদর্শন ও অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান হিসাবে শেলির প্রতি হ্যারিয়েটই প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। পরে সুন্দরী এই তরুণীর আবেদনে সাড়া দিতে সময় নেননি তরুণ শেলি। তিনি ভালো করেই জানতেন তার প্রভাবশালী বাবা এই বিয়েতে রাজি হবেন না। তাই তিনি হ্যারিয়েটকে নিয়ে পালিয়ে যান।

একজন হোটেল কিপারের মেয়েকে বিয়ে করায় ক্ষেপে যান শেলির বাবা স্যার টিমোথি শেলি এবং নব দম্পতিকে কখনও বাড়িতে উঠতে দেননি। উপরন্তু তিনি শেলির মাসোহারা বন্ধ করে দেন। ফলে নব বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে প্রচণ্ড আর্থিক সঙ্কটে দিন কাটাতে বাধ্য হন শেলি।

এ অবস্থায় বিয়ের দু বছর পর লন্ডনে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। তারপরেই শেলির দীর্ঘ ও আলোচিত কবিতা কুইন মাব প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই বিয়ে সুখের ছিল না। বিয়ের কিছু দিন যেতে না যেতেই দুজনের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। শেলি হ্যারিয়েটকে বিয়ে করার মাত্র তিন বছর পর ১৮১৪ সালে উইলিয়াম ও বিখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও লেখক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মেয়ে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট গডউইনের প্রেমে পড়েন। ওই বছরের ১৮ জুলাই গর্ভবতী স্ত্রী হ্যারিয়েটকে ছেড়ে কিশোরী প্রেমিকা মেরিকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যান শেলি। তবে তারা সুইজারল্যান্ডে বেশিদিন থাকতে পারেননি। মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর শেলি ও মেরি ফের লন্ডনে চলে আসেন।

এদিকে শেলির অবর্তমানে হ্যারিয়ট একাই ছেলে চার্লসের জন্ম দেন। শেলির জীবন লেখকরা বলছেন, এ সময় হ্যারিয়েটও অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং সন্তানদের তার বোন এলিজাবেথের কাছে রেখে তিনি অন্যত্র চলে যান। কিন্তু পরে প্রেমিকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।

 ১৮১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর হাইড পার্কের হ্রদের জল থেকে গর্ভবতী হ্যারিয়েটের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর আগে হ্যারিয়েটের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্রিস্টোফার ম্যাক্সওয়েল (৩৬) নামের একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। যার কারণে তিনি গর্ভবতী হন এবং শেষমেষ পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেন। যদিও এই অভিযোগ মেনে নিতে রাজি ছিলেন না কবি শেলি। বিষয়টি পরে আদালত অবধি গড়ায়। তবে বাদি পক্ষের কাছে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় মামলায় শেলি জিতে যান। আর এভাবেই তিনি নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে সামাজিক অসম্মান থেকে রক্ষা করেন। যদিও এ ঘটনায় তার সামাজিক সম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

এদিকে হ্যারিয়েটের মরদেহ উদ্ধার করার মাত্র তিন সপ্তাহ ১৮১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রেমিকা মেরিকে  বিয়ে করেন শেলি। বিয়ের পর স্বামী শেলির উৎসাহে মেরি শেলি নামে লেখালেখি শুরু করেন মেরি গডউইন। তার লেখা বিখ্যাত উপন্যাসের নাম ফ্রাংকেনস্টাইন যা এখনও পাঠকদের মনোরঞ্জন করে থাকে। এটি বরাবরই ইংরেজি সাহিত্যের একটি অন্যতম উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত।

শেলির কাব্যচর্চা

আগেই বলেছি শেলি খুব বেশিদিন কাব্যচর্চার সুযোগ পাননি। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অসংখ্য বিখ্যাত সব কবিতা লিখে গেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম কবি পার্শি বিশি শেলি  ইংরেজি সাহিত্যের অন্য দুই প্রধান কবি জন কিটস এবং লর্ড বায়রনের সঙ্গে মিলে ইংরেজি সাহিত্যে যে রোমান্টিক ধারার সূচনা করেছিলেন তার আবেদন আজও অক্ষয়। তিনি আজীবন তার কাব্য সঙ্কলন ওজিম্যানডিয়াসের জন্য বিখ্যাত হয়ে থাকবেন। তার আরও কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে-ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড, টু দ্য স্কাইলার্ক, মিউজিক, হোয়েন সফট ভয়েসেস ডাই, দ্য ক্লাউড,  মন্ট ব্লাঙ্ক, দ্য ডেথ এবং দ্য মাস্ক অব এনার্কি তার বিখ্যাত কবিতা। তার রচিত গোথিক উপন্যাস জাসট্রজি এবং সেন্ট আরভিন।

সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন, শেলির কাব্য প্রতিভার সেরা স্বাক্ষর হচ্ছে তার গীতিকবিতাগুলো। গীতিকবিতার মাধ্যমেই তিনি যেন নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন। শেলি অসংখ্য গীতিকবিতা রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘স্টাঞ্জার্স, রিটেন ইন ডেজেকসন, নিয়ার নেপলস, টু নাইট, রেয়ারলি রেয়ারলি, কামেন্ট দ্যাউ, লাইটস রিটেনস রিটেন অ্যামং ইউগোনিয়ান হিল, টু এ স্কাইলার্ক, অড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড, ও ওয়ার্ল্ড ও লাইফ, ও টাইম, দ্য ক্লাউড ও দ্য সেনসেটিভ প্লানেট।

কবিতা ও উপন্যাস ছাড়াও তিনি সমকালীন সাহিত্য, সমাজ ও ধর্ম নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। এছাড়া কিছু নাটক রচনা করেছেন।

বিশ্বসাহিত্যে শেলির প্রভাব

শেলির প্রথাবিরোধী জীবনযাপন এবং আপসহীন আদর্শ তাকে সব সময় কোণঠাসা করে রেখেছিল। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত জীবনের অধিকারী এই মহান কবি নিজের সাফল্য ও স্বীকৃতি দেখে যেতে না পারলেও তিন-চার প্রজন্মের কবি ও সাহিত্যিকদের ওপর তার প্রচুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে বিশ্ব সাহিত্যের অনেক কবি-ই শেলির দ্বরা প্রভাবিত হয়েছেন। শেলির প্রভাব আমাদের বাংলা সহিত্যেও পড়েছে। এদের অন্যতম কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। তিনি শেলির কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই বাংলায় গীতিকবিতা লিখতে শুরু করেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতাতেও শেলির প্রভাব লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাসের বিখ্যাত ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করা যায়।

মৃত্যু

১৮২২ সালের  8 জুলাই ইতালির বন্দর নগরী লেঘর্ন (লিভর্নো) থেকে লেরিসিতে ফিরে যাওয়ার সময় লা স্পিজিয়ার উপসাগরে আকিস্মিক ঝড়ের মুখে পড়ে ডুবে যায় তার নৌকাটি। ফলে নিজের ত্রিশতম জন্মদিনের এক মাসেরও কম সময় আগে এভাবেই করুণভাবে সলিলসমাধি হয় এই আলোচিত কবির। তবে কেউ কেউ মনে করেন শেলি ইচ্ছে করেই নৌকাটি ডুবিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

সে যাই হউক, আজ ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম এই কবির ২২৮ তম জন্মদিন। এই বিশেষ দিনে ওমেন্স নিউজ ২৪ তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।  শুভ জন্মদিন কবি পি বি শেলি।  

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/