দেনমোহর কি শুধুই আর্থিক সংখ্যা?

পাপিয়া সুলতানা পান্না

পাপিয়া সুলতানা পান্না

মুসলিম বিধান মতে বিবাহের ভিত্তিতে একজন পুরুষ ও একজন নারীর বৈধ সঙ্গম, সামাজিক স্বীকৃতি তথা সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবনের জন্য দেনমোহর একটি অন্যতম বিষয়। ইসলামি শরিয়া আইন এবং প্রচলিত দেশীয় বিধানে এটির স্পষ্টতা থাকলেও বাস্তবিক প্রয়োগক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। অনেক মুসলিম নর- নারী স্পষ্টত জানেও না দেনমোহর আসলে কি, এটি কীভাবে, কখন পরিশোধ করতে হয়। এখানে দেনমোহর নিয়ে আলোচনার আগে মুসলিম আইনের কয়েকটি দিক তুলে ধরা যাক।

যুগে যুগে বিভিন্ন মনীষী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইন নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন। Aristotol, Plato, Austin, kelsen, T.H.Green,Hobbes,Gettle, Oxford English Dictionary সবার মতবাদ আলাদা। তবে আইনের মূল কথাই হলো নিয়ম-নীতি বা কিছু বিধি-বিধান। প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক জাতিতে এ বিধান বিদ্যমান ছিল এবং আছে। ইসলামি আইন বলতে যা বুঝায় তা প্রকৃতপক্ষে শরিয়াহ ভিত্তিক। আর শরিয়াহ মানে হল বিশ্বাস ও আমলের একটি সুসম্পূর্ণ বিধান বা সংহিতা। শরিয়াহ হল সমতা এবং অনুকম্পার আইন। ফৌজদারী বিচারে ইসলামি শরিয়াহ এই নীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে ( আল কোরআন- ২:১৭৮)। মানুষের জীবনকে সুষ্ঠু গতিশীলতা দানের জন্য বিভিন্ন আইন ' রয়েছে। এই আইন একদিনে তৈরি হয়নি। প্রত্যেক আইনের কিছু উৎস রয়েছে, আইন সৃষ্টির প্রেক্ষাপট রয়েছে। তেমনি মুসলিম আইনেরও বিভিন্ন উৎস রয়েছে। এই উৎসগুলো আবার দু'ভাগে বিভক্ত। ক) প্রাথমিক উৎসসমূহ, খ) দ্বিতীয় স্থানীয় উৎসসমূহ।

প্রাথমিক উৎসে আছে – কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস। দ্বিতীয় স্থানীয় উৎসসমূহ হল – ইসতিহসান( সমর্থন বা অনুমোদন), ইসতিসলাহ্( জনস্বার্থে আইন), ইসতিদ্ লাল (স্বাভাবিক অনুমোদনের আইন), ইজতিহাদ ( সর্বাত্নক প্রচেষ্টা) ও তক্ লিদ ( অন্ধ অনুকরণ) । প্রাক ইসলামী যুগে আরবের প্রথা ও রীতিনীতি এবং এগুলোর ইসলামে অনুপ্রবেশ ও প্রভাব এখনও বিদ্যমান। যেমন- বিচারের কার্যবিধি, হলফ বা শপথ, প্রতিশোধমূ্লক শাস্তি, বিবাহ প্রথা, মোহরানা, বহুবিবাহ, বিবাহ – বিচ্ছেদ, ইদ্দত, উইল, মিরাস ইত্যাদি।

মুসলিম আইন প্রতিষ্ঠায় প্রথার যথেষ্ট অবদান লক্ষ্যণীয়। আরব দেশের প্রচলিত প্রথাগুলোর অনেকই কোরআন বা হাদিস রদ করেনি। অনেকগুলো সম্পর্কে নবী করিম ( স.) নীরব ছিলেন। এগুলোও আইনের উৎসরূপে গণ্য করা হয়। সূ(ত্র- স্যার আব্দুর রহীম – মোহামেডান জুরিস প্রুডেন্স)

বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে দু' ধরনের সম্প্রদায় বিদ্যমান। একটি হল শিয়া অন্যটি হল সুন্নি। হযরত মুহাম্মদ ( স.) – এর ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত অনুসারী এবং যারা শিয়াদের মৌলিক ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করে তারা সুন্নি বলে পরিচিত। আর হযরত আলী(রা.) – এর অনুসারীগণ শিয়া নামে অভিহিত। হযরত আবু বকর (রা.) কে খলিফা নির্বাচনের ফলে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাট অনৈক্যের সৃষ্টি হয় এবং এই অনৈক্য এখন পর্যন্ত বিদ্যমান।

সে যাই হোক, যদি আমরা মুসলিম আইনের প্রায়োগিক দিক দেখি তবে বৃটিশ, ভারত এবং বাংলাদেশে ইসলামী আইনের প্রয়োগের দিকে নজর দিতে হবে। সাধারণত মুগল শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী আইন, সংহিতার প্রয়োগ ছিল। বৃটিশ সরকারো প্রথমে সাবেক প্রথাকে অনুসরণ করা যুক্তিযুক্ত মনে করেছিল। কিন্তু অবিভক্ত ভারতে প্রকাশ্যভাবে এবং কতিপয় নির্দিষ্ট বিষয়ে মুসলিম আইন মোটেই প্রযোজ্য ছিল না। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও এই আইনের কোন পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও মুসলিম শরিয়াহ ভিত্তিক আইনের তেমন কোন রদ-বদল দেখা যায়নি। যদিও এখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবে কতিপয় ক্ষেত্রে ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ মুসলিম আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশোধন এনেছে এবং সেটিই এখনও অনুসরণীয়। তবে প্রায়োগিকতা এখনও বিকশিত নয়।

লেখার দ্বিতীয় অংশ প্রকাশিত হবে আগামীকাল

পাপিয়া সুলতানা পান্না: কবি ও লেখক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/