সুলতানা রিজিয়ার প্রবন্ধ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’

সুলতানা রিজিয়া

একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি

শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা ছুঁই ছুঁই সময়েই আমরা মফস্বল শহরে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে জেনেছিলাম। সেই তখনই আমাদের মুখে মুখে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে  বীর ভাষা শহীদদের নাম মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। রফিক, শফিক, জব্বার বরকত সহ নাম না জানা শহীদদের নিয়ে আমরা সুশৃঙ্খল লাইন করে একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্লোগান দিতে দিতে স্কুলের গেট পেরিয়ে রাস্তায় হেঁটেছি।
আমার ভাষা তোমার ভাষা
বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষা বাংলা চাই
উর্দ্দু ভাষা নিপাত যাক।
বাংলা ভাষার জন্য জীবন কেনো দিয়েছিলো,
বাংলা ভাষার বদলে উর্দ্দু ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হলে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির জন্য কি কি ক্ষতি হতে পারে সেসব বড় ভাইয়ের ( স্কুল, কলেজের ছাত্র নেতারা )  মুখে শুনেছি। আগুনে ফুলকি ঝরতো তাদের প্রতিবাদী কথায়, শ্লোগানে। আমরা শুনতাম, সমস্বরে প্রতিবাদে অংশও নিতাম।
পাক ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকায় করে দুটি দেশ। একটি ভারত অন্যটি পাকিস্তান।  এর আবার দুটো অংশ নিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।  একটি পশ্চিম পাকিস্তান,  অন্যটি পূর্বপাকিস্তান। একাই রাষ্ট্রের দুটি অংশের দূরত্ব যোজন যোজন মাইল। কোন পরিকল্পনায়, কাদের চক্রে এহেন  বিভাজন! একটি বৃহৎ, অন্যটি ক্ষুদ্র।।স্বাধীন রাষ্ট্রে চতুর্দিকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাদেশ থাকে। এখানে তেমন টি হয়নি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশের সংখ্যা ছিলো বেশি।
আমরা এর আগামাথা বুঝে উঠতে পারতাম না। আমরা বইয়ের মলাটে, খাতার উপরে লিখতাম পূর্ববাংলা। পূর্ব পাকিস্তান কদাচিৎ লেখার রেওয়াজ ছিলো। পূর্ব পাকিস্তান মূলতঃ বাঙালি অধ্যুষিত অংশ। নব্বই ভাগ বাঙালি। তার আশি ভাগ কৃষক, মজুর জেলে, কামার, কুমোর, জোলা, নাপিত, গরীব দুখী। কুড়িভাগ শিক্ষত, চাকরিজীবী, অফিস আদালতের কর্মচারী, শিক্ষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পাটকলে, চিনিকলে, কাপড়ের কলে,  সরকারী অফিসের পদ পদবীতে বড়রা ছিলো হাতে গোনা। তাদেরও অনেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী। রেলওয়ে বিভাগেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের আধিপত্য ছিলো নজরকাড়া।ফলে তাদের বড় বড় বাংলো, পাকা দালান, সরকারী কোয়ার্টারে হিস্যা ছিলো ৬০/৭০ ভাগ। এই বিভাজনে পূর্ববাংলায় বিহারি, পাঞ্জাবি, উর্দ্দুভাষীদের আধিপত্য, দখলী মনোভার, সুপার পাওয়ারের অংশ হিসাবে ৮০ ভাগ আদি বাঙালির পর ছড়ি ঘুরাতো। পরে বুঝেছিলাম এরা আমাদের ৮০ ভাগ মানুষের শ্রমে বখরা বসাতো। রাওয়ালপিন্ডি, করাচী, লাহোর, পেশোয়ারে পূর্বপাকিস্তানীদের শ্রমে, ঘামে রৌশনাই হয়ে উঠতো। এদেশের সোনালী ধান, রূপালী আঁশ ( পাট, তূলো) লাঠির মাঝের সরবত ( আখ/ কুসুর ), তৈজসপত্রের সিংহভাগ চলে যেতো পশ্চিমে।  পশ্চিম থেকে আসতো গম, ভূট্টা। মিল কারখানার বস্ত্র, প্রসাধনী সামগ্রী, ঔষধ পত্র। মাছে ভাতে বাঙালি ভাতের বদলে গমের রুটিতে, ভূট্টার ছাতুতে ক্ষুধা নিবারন করা শিখতো। স্কুলে বাংলার সাথে উর্দ্দুও ছিলো। আমরাও উর্দ্দু পড়েছি। আরবির সাথে হরফের মিল, তার উপরে আকার ইকার ( জের, জজম, পেশ ) ছিলোনা। কেউ কেউ এটাকে সহজ পাঠ্য হিসাবে আখ্যায়িত করতেন। পূর্ববাংলার ভাষা বাংলা। তাই কোন ভাবেই তাদের মার্তৃভাষা উর্দ্দু হতে পারেনা।
রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়
উলুখাগড়ার বন পুড়ে।
সাধারণ মানুষ এক অর্থে উলুখাগড়ার অধিক। রাজনীতিবিদগন কোন কালেই আমজনতার শতভাগ ভালোর কথা ভেবে কোনই সিদ্ধান্ত নেন না। যেহেতু পশ্চিমপাকিস্তান আকারে প্রকারে, শক্তি সামর্থে পূর্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সুতরাং তাদেরকেই আজ্ঞে হুজুর করে কথা বলতে হবে। মানতে হবে তাদের সকল আবদার, হুকুম দাসত্বপ্রথা অনুসারে।
কিন্তু ওরা জানতো না-
বাংলার মাটি
দুর্জয় ঘাঁটি।
শান্তি প্রিয় আমুদে ভবঘুরে ভাবালুতায় আবিষ্ট বাঙালির দৃঢ়চেতা মনন, চেতনা, বিপ্লবী, প্রতিবাদী জীবনপণ  আত্মবলিদানকারীর বলিষ্ঠতা।
প্রশসনের সকল চেষ্টা, ভাষন, শাসন, তোষন ভেসে গিলো মরমী সুর-
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।
জাগো জাগো
বাঙালি জাগো-
আমার ভাষা তোমার ভাষা
বাংলাভাষা বাংলাভাষা
পদ্মা মেঘনা যমুনা
তোমার আমার ঠিকানা।

অনেকে কলা কৌশলগত গোলটেবিল মিটিং,  সমবেত ছাত্রদের সামনে উর্দ্দু ভাষার প্রস্তাব, সিদ্ধান্তের পর এলো ১৪৪ ধারার নাটক।
কে মানে কার কথা!ছাত্রজনতার রায়ে, রোষে গুড়িয়ে গিয়েছিলো ১৪৪ ধারার জুজুর ভয়। প্রতিবাদীদের মিছিল, মিটিং থমকে যায় রাজপথে বুকের তপ্ত রক্তের আলপনায়। স্তম্ভিত সরকার, প্রশাসন, দেশের গণ্ডি  ছাড়িয়ে বিশ্ববিবেক। ১৯৫২ এর ২১ শে ফেরুয়ারী ( আট ফাল্গুনে——) তারুণ্যের তাজা রক্ত ঝরলো। প্রাণ দিলো রফিক, শফিক বরকত, জব্বার সহ নাম না জানা আরো অনেকে। আহত হলো দ্বগুন। পুলিশের লাঠিচার্জে কতজনের বুকে পিঠে হাতে উরুতে দগদগে লাল দাগ পরেছিলো তার সঠিক  কোন পরিসংখ্যান নেই। ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো তৎকালীন ছাত্রীদের একাংশ।
মাতৃভাষার দাবির লড়াইয়ে একাট্টা হয়েছিলো  পুরো পূর্ববাংলার আপমর জনসাধারণ।
আওয়াজ উঠলো-
বাংলা ভাষা শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেনো না দেনো না-
জীবন দিবো তবু মুখের ভাষা দেবো না-
আমার ভাষা তোমার ভাষা, বাংলাভাষা বাংলাভাষা।

বাংলাভাষার দাবিতে রাজধানী ঢাকা ছাপিয়ে দেশের বিভাগে বিভাগে, মফস্বলে সংঘবদ্ধ ছোট বড় সংগঠন গড়ে উঠলো। যে যেভাবে পারলো রুখে দাঁড়ালো। পার্ব বাংলার বুকে জেগে উঠলো শহীদ স্মরণে শহীদ মিনার। একুশের প্রভাত ফেরীর নগ্নপায়ের মৌণ মিছিলে অমর বাণীতে হৃদয়হরণ সুর উঠলো –
‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি।’

আহা! বুকের মাঝে উত্থিত হয় ভাষার দাবিতে ভাই হারানোর হাহাকার। ভিজে ওঠে দু'চোখের পল্লব!

একুশ মানে মাথা নত না করা, একুশ মানে এগিয়ে যাওয়া। আর এই শক্তি আমাদের দিয়েছে অমর একুশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভাষাশহীদ বীর ভাষা সৈনিকদের আত্মদানের বীরত্ব।
একুশের এই শক্তির বলে বলীয়ান হয়েই আমরা এগিয়ে যাই। শুধু ভাষার এ মাসে নয়, একুশ আমাদের শক্তি জোগায় সারা বছর। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়।

সেদিন এমনই ফাল্গুনে ঝরেছিল তাজা প্রাণ। যাদের দাবি ছিল মায়ের ভাষার অধিকার; যারা পথে নেমেছিল রাষ্ট্রভাষার অধিকারের কথা জানাতে। অধিকার আদায়ের সেই লড়াইয়ে ঘাতকের গুলিতে ঝরে পড়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরসহ নাম না-জানা আরও অনেক শহীদ। তাদের স্মরণে আজো অমর একুশে প্রভাতফেরিতে মানুষের ঢল, ফুলের নৈবেদ্যে একুশের চেতনা নবতর সাজে জেগে ওঠে বাঙালির হৃদয়ে।

৫২’র শুরু থেকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে স্লোগানে রাজপথ তপ্ত করে ছাত্রসমাজ যে লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা কেন বাংলা হবে না—সে প্রশ্ন করতে শিখেছিল, এই মাস সেই জবাবদিহিতার মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে যে নামগুলো রচনা করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম  বাংলাদেশের ভিত্তি, তাদের আত্মদানের স্মৃতিকে মনে রাখার দায়িত্ব আজকের প্রজন্মের। একুশের এই দিন কেবল আমাদের রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দিন এখন আর নেই। দিনটি এখন বিশ্বব্যাপী উদযাপনের দিন। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেসকো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্যসাধারণ অর্জন।

সেই প্রত্যাশায় শুরু হোক ভাষার অধিকার আদায়ে জীবন বিলিয়ে দেওয়া সেই দিনের প্রথম প্রহর। আলতাফ মাহমুদের সুরে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা সেই অমর গান গেয়ে উঠুক বাংলাদেশ–আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’।

একুশের রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলের শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করেন প্রভাত ফেরির আনুষ্ঠানিক আয়োজন। পুরো রাতজুড়ে এমনকি একুশের দুপুর গড়িয়ে গেলেও এ ফুলের নৈবেদ্যে শ্রদ্ধা জানানো শেষ হয় না। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশু এসে মিলিত হবে শহীদদের স্মরণে, শাসকদের হাত থেকে মাতৃভাষাকে ছিনিয়ে আনার অর্জনের গৌরবে।

 সুলতানা রিজিয়া: কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘নন্দিনী’নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করছেন। এছাড়া তার রয়েছে প্রকাশনা হাউস সম্রাজ্ঞী। তার প্রকাশিত একক গ্রন্থের সংখ্যা ২৩ টি। সাহিত্য ও সাংগঠনিক অবদানের জন্য পেয়েছেন ত্রিশটির বেশি সম্মাননা পদক।

ওমেন্স নিউজ/