কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফের গল্প ‘খুন করা যায় না’

খুন করা যায় না

বাড়িটা সুনসান নীরব। অনেক বেশি জায়গা নিয়ে করা দোতলা বাড়ি। চারপাশে খালি জায়গা-লন, গাছপালার ঘের। বড় রাস্তা থেকে খোয়া বিছানো সরু পথ মিশেছে নির্জন এই বাড়ির বারান্দায়। উপরে বোগেনভেলিয়ার ঝাড় গাড়িবারান্দার বারান্দা হয়ে ঝুলে আছে। চারপাশে অনেক বাড়ি ডেভেলপারের কবলে পড়ে আকাশ ঢেকে দিয়েছে। এই বাড়ি ব্যতিক্রম-গাছপালার অফুরন্ত সবুজের মাঝখানে দুধ-সাদা রঙের রুচিস্নিগ্ধ ছোট বাড়ি, লন-বাগান, যেমনটা বিদেশি ছবিতে এবং ছবি দেখতে দেখতে স্বপ্নেই দেখা যায়। সেই চল্লিশ বছর আগের গুলশানের ঘরবাড়ির নমুনা খুঁজতে গেলে এখন এই রকম আঙুলেগোনা দুয়েকটা বাড়ির উপরই নজর বুলাতে হয়।
ছিমছাম এই বাড়িরই কিচেনে একটা ধারালো ছুরি টেবিল থেকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে ঝন্ন্ন শব্দ হলে বুক কেঁপে ওঠে। ছোটখাটো ফুটফুটে কিশোরী আলেয়ারও কাঁপল। তুলতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করায় তর্জনীতে লাগল। আঙুলের ডগা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। আজকাল রক্ত তাকে ভীত করে না, আকস্মিক অসম্ভব রক্তপাতের পরও সে স্বাভাবিক। কোনকিছুতেই তার প্রতিক্রিয়ার সুযোগ নেই। ছোট্ট শরীর আর তার ভেতর ছোট্ট মনটায় সবকিছু হজম করাটাকেই কপাল বলে মেনে নিয়েছে এই ছোট্ট মেয়েটি।
আলেয়ার বাবার অনেক টাকার সুদি-ঋণ। শরিকানা মামলায় পড়ে চাষের জমি অল্প যা ছিল, প্রায় সবটুকু চলে গেছে সেই কিসমত সরকারের কব্জায়, যে জুমাঘরে প্রথম সারিতে নামাজ পড়ে, সালিশ-বিচারে জোরগলায় কথা বলে-তার ছোটবউ সুদে টাকা লাগায়, কেউ মুখে উচ্চারণ না করলেও সবাই জানে, সবাই এ-ও জানে-টাকা শোধ করতে না পারলে কিসমত সরকারই দয়া করে এগিয়ে আসে, জমি কিনে নেয় মর্জিমত দামে। ছোট দু’টা ভাই স্কুলে পড়ছে-বাবা-মা অনেক ভেবেচিন্তে ওদের পড়াশোনাটাই বেছে নিয়েছে। আলেয়া আর ছোট বোনটাকে প্রাইমারি শেষ করে পড়াশোনার পাট চুকাতে হয়েছে। বড় বোনের এখনও বিয়ে হয়নি-বিত্তহীন বাপের মেয়ের বিয়ে সহজে হবে কেন। এরকম এক কিশোরী আলেয়ার ভীত হওয়ার কী কোন সুযোগ আছে?
বিবিসাব সকালে যান অফিসে-সন্ধ্যায় ক্লাবে। আবার মাঝেমধ্যেই এনজিও’র কাজে ঢাকার বাইরে দু’তিন দিন-কখনও সপ্তাহ কাটিয়ে আসেন। আলেয়া আসার পর দু’বার বিদেশেও ঘুরে এসেছেন। সাহেব অফিসের গাড়িতে উঠেন সাড়ে আটটায়, ফিরেন পাঁচটার পর। আবার বের হন সাতটায় নিজেদের গাড়িতে-যান ক্লাবে। সঙ্গে কোনদিন বিবিসাব, কোনদিন একা। গভীররাতে দু’জনই গাড়ি থেকে নেমে টলমল পায়ে বেডরুমে ঢুকে যান। কোনদিন খাবার টেবিলে আসেন, কোনদিন গড়িয়ে পড়েন বিছানায়। টেবিল গোছগাছ করে খেয়ে নিয়ে আলেয়া কিচেনের পাশে সার্ভেন্টস রুমে চলে আসে। ছিটকিনিহীন দরজা বন্ধ করা যায় না-কিচেন পেরিয়ে এই কোণায় কেউ আসেও না। তারপরও দরজায় ভাঙা টুল দিয়ে তাতে পা ঠেকিয়ে শোয়। মা বলে দিয়েছে, সবসময় সাবধান থাকবা। গরিবের বিপদ পায়ে পায়ে।
সময় বেঁধে রান্নার কাজ করে নজিফা বুয়া-সকাল সাতটা থেকে সাড়ে আটটা-এগারটা থেকে দেড়টা-সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে আটটা। কেয়ারটেকার চলে যায় রাত আটটায়। ড্রাইভার গাড়ি গ্যারেজে রেখে বেরিয়ে যাওয়ার পরই দারওয়ান গেটে তালা লাগায়। তারপর পূবদিকের কোণে ঝাঁকড়া আমগাছের তলায় গ্যারেজের পেছনের কুঠরিতে কান খাড়া রেখে ঘুমায়-সাহেবের গাড়ির ভেঁপু শুনে দৌঁড়ে গিয়ে গেট খুলে দেয়। সাড়ে আটটার পর বাড়িটা নীরবতার কুয়াশায় ঢাকা পড়তে থাকে।     
এ বাড়ির ছেলেমেয়ে দু’টি পড়াশোনা করছে ভারতের নৈনিতালে। বছরে একবার আসে শীতকালে। কথা বলে ইংরেজিতে। কিছুই না বোঝে আলেয়া তাদের ফরমাশ খাটে অনুমানে আর মাঝেমধ্যেই ওদের বিরক্তি জাগায়। ওরা বাইরে ঘোরাঘুরির সময়টুকু ছাড়া কম্পিউটার নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
ওর বড় বোন ধানমন্ডি এক বাড়িতে দু’বছর কাজ করে গেছে। তার কাছে যেমন শুনেছে, তেমন কোন ধমাকাধমকির মুখোমুখি এখনও হতে হয়নি আলেয়ার। ঘরদোর পরিস্কার রাখা, সবকিছু গোছগাছ করা, দুপুরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলে সাহেবের খাবার রেডি করে দেয়া আর নজিফা বুয়া আগে চলে গেলে রাতে টেবিলে খাবার দেয়া-কাজ খুব বেশি তা মনে না হলেও আলেয়ার অবসরের কোন সুযোগ নেই। তার ভালই লাগে-নিজের বা পরিবারের বিষয়-আশয় নিয়ে দিনেরবেলা চিন্তিত হওয়ার উপায় প্রায় নেই।  
আলেয়া নিজের কাজগুলো একের পর এক করে যায়। শৈথিল্য-আলস্য কোনকিছুই প্রশ্রয় পায় না। বাড়িটা এমনিতেই ছিমছাম-গুছিয়ে রাখতে তার খুব অসুবিধা হয় না। দিলখোলা মেজাজের বিবিসাব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে যখন-তখন খিটমিট করেন না। প্রথম সাতদিন নিজে সাথে থেকে ওকে সবকিছু শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকে তেমন বেতাল কিছু ঘটেনি। বিবিসাব শব্দটার প্রতি বিবিসাবের খুব বিরক্তি। প্রথমদিকেই বলে দিয়েছেন, বিবিসাব-টিবিসাব নয়, ম্যাম, বুঝলে মেয়ে, ম্যাম বলবে। ম্যাম কি, কেন-না বুঝেই ভাল লেগেছে তার। ম্যামের নজর ঘরের চেয়ে বাইরে বেশি। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা খুব একটা বলতে শুনেনি। সারাক্ষণই কানে সেলফোন লাগিয়ে থাকেন। ইংরেজিতে রাজ্যের কথা-আলেয়া বুঝে না কিছুই। কথা বলতে বলতে যখন হাসেন, ভারী সুন্দর লাগে তার। যখন রাগ করেন, তখনও খারাপ লাগে না। সুন্দর মানুষের হাসি আর রাগের মধ্যে কী কোন ফারাক নেই-আলেয়া সময় পেলেই অবাক হয়ে ভাবে। তার দাদি বলত পুঁথির বাদশাজাদিদের গায়ের রঙ দুধে-আলতায়, মুখ পানপাতা আর হাত-পা বেলানের মত গোল, মাথায় গোছা গোছা চুল হাঁটু ছাড়িয়ে পড়ে। এরকম মানুষ হতে পারে না, তার এই ভাবনা যে কতটা ভুল, ম্যামকে দেখে বুঝেছে। ছবির মত এই বাড়ি আর পুঁথির শাহজাদিদের মত ম্যাম যেমন মানানসই, সাহেবও তেমনি-ফর্সা লম্বা-ওর দাদির ভাষায় একেবারে সাহেবের বাচ্চার মত-বেমানান শুধু মোটা নাকের উপর ক্ষুদে মার্বেল সাইজের জ্বলজ্বলে দুটা চোখ। ওর দাদি বলত, চান্দেও কলঙ্ক থাকে-হয়ত তা-ই। আবার ভাবে মানুষের মধ্যে যারা চাঁদ, তাদের সবার কলঙ্ক থাকবে-এটা কেমন কথা, না-ও তো থাকতে পারে।

// দুই //
দিনের অধিকাংশ সময় ছবির মত এই বাড়ি থাকে একদম ফাঁকা। দরজা-জানালা খুলে দিলে ঘরের ভেতরে বাতাসের কানাকানি শুরু হয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্রের চরে ঝাউবনে এরকম বাতাসের শব্দ শুনেছে আলেয়া। একবার ওই ঝাউবনে একটা আজদাহা সাপ ঢুকে পড়েছিল। পুটুলির মা’র একটা মাত্র ছাগল, সেটাও গিলে খাওয়ার পর ঝাউবনে ওই হিসহিস শব্দ লক্ষ্য করে এগোয় লোকজন-তাদের নজরে আসে ওই আজদাহা। বিশাল সাপ দেখতে আশপাশের লোকজন ভিড় করে ঝাউবনে। ঝাউবন তছনছ হয়ে পড়ে। স্ফীত উদর নিয়ে সাপটা ঝিম মেরে থাকে। কেউ কেউ বলে ছাগলটা হজম করা পর্যন্ত এভাবে থাকবে। কলিমুদ্দি মাস্টার বলেন, এটা এদিককার সাপ না, উজানে আসামের পাহাড়ি বনজঙ্গল থেকে ব্রহ্মপুত্রে ভেসে এসেছে।  
চরের ঝাউবন-কাশবন, নলগড়ের ডোবা, ভাংতিরবাজার, সুতিয়াখালি, ফুলপুর-আলেয়ার ছোট্ট চোখে দেখা এ সবের কত অন্তরঙ্গ দৃশ্য ও শব্দ উন্মোচিত হয়। এই শব্দ-দৃশ্য তাকে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে তার ছোটবেলাকে ফিরিয়ে দেয়। টিভির নাটকের মত সেই দৃশ্যাবলী দেখে-তার ভেতর উচ্ছ্বল কিশোরীকে দেখে। বুবুর বিয়ে হতে দেখে-তারপর নিজেরও বিয়ে হয়-গরিব পরিবারের টানাটানির বিয়ে বলে একেবারেই আনন্দ-উচ্ছ্বলতাহীন, তা নয়। বাবা-মা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ছোট ভাই দু’টা কলেজের পড়া শেষ করতে পারলেও ওদের একজনের চাকরি হয় ইলেকট্রনিক্সের দোকানে। আরেকজন কম্পিউটার শিখছে-শেষ হলে কোথাও লেগে যেতে পারবে। বাবা-মার সামনে স্বস্তির দিগন্ত।
নিজেকে-নিজের ভবিষ্যতকে দেখার এই প্রক্রিয়াটি আবিস্কারের পর তার নিঃসঙ্গতা অনেকটাই কেটে যায়। রাতে এই সময়টাতে এবং দিনের বেলায়ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওইসব দৃশ্যের মধ্যে নিজেকে চলাফেরা করতে দেখে। অতীত ও বর্তমান দিয়ে সেলাইকরা ভিন্ন এই ভবিষ্যত-জগত তাকে বেশ স্বস্তি দিয়েছে, অনেকটা সুস্থির রেখেছে।  
গত সপ্তাহে ম্যাম ঢাকার বাইরে গেছেন বিদেশি সাহেবদের নিয়ে। যাবার সময় ম্যাম চোখ-মুখে খুশির ঢেউ ছড়িয়ে বলেছেন, ডিলটা যদি হয়ে যায়, তোকে একজোড়া সোনার কানপাশা দেবো-তুই খুশি হবি-বিয়ের সময় কাজে লাগবে।
কানপাশার কথা বলত তার মা-ম্যাম কেন বললেন? তাজ্জব হলেও আলেয়া এই নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবেনি। ধনী মানুষেরা সব সময় খেয়ালি হয়-ধন-সম্পদের সঙ্গে খেয়ালিপনার বোধহয় একটা অনিবার্য সম্পর্ক রয়েছে। আলেয়া তার নিজের মত করে এরকম একটা কিছু ভেবেই হয়ত কানপাশা নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেনি। এই একজোড়া কানপাশার জন্য তার ফুপুর বিয়ে ভেঙে যাওয়া ও পরের দুঃসহ হতাশার নানা দৃশ্যও তখন সে দেখেছে যদিও এই দৃশ্যগুলো তার জন্মের আগের-সে শুনেছে নানাজনের কাছে।
ম্যাম প্রথমবার যখন বিদেশে যান, তখন তাদের ছেলেমেয়ে দু’জনই ছুটিতে দেশে ছিল-পরেরবারে সাহেবের বোন আর তার দুই বাচ্চা ছিল। ম্যামের ট্যুর ছিল তখন দু’সপ্তাহের। দেশের ভেতরে দুয়েকদিনের ট্যুরের সময় নজিফা বুয়া থাকে। এবারও তারই থাকার কথা। ম্যাম যেদিন সকালে গেলেন, সেদিনই সন্ধ্যায় বড় মেয়ের বাচ্চা হওয়ায় নজিফা বুয়াকে রাতে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে।   
সোমবার রাতে খাওয়ার সময় সাহেব বারবার তাকাচ্ছিলেন আলেয়ার সদ্যফোটা শরীরের দিকে। তার খেয়াল করার কথা নয়। সে অভ্যাসমতই খাবার সার্ভ করছিল। খাওয়া শেষে সাহেব গিয়ে বসলেন ড্রয়িং রুমে। তার আগে পশ্চিম কোণের বেতের পার্টিশনের আড়ালে নিচু চ্যাপ্টামত কেবিনেট থেকে বোতল আর গ্লাস এনে রেখেছেন।
আলেয়া এরমধ্যে টেবিল পরিস্কার করে কিচেনে এল, নিজের খাওয়া সারল। তারপর বেরিয়ে পেছনের সার্ভেন্টস রুমে যাবে তখনই সাহেব ডাকলেন। সাহেবের কণ্ঠ স্বাভাবিক নয়, ঈষৎ কম্পমান। কম্পমান কণ্ঠ বাতাসে ভাঙা ভাঙা ঢেউ ছড়িয়ে দিল। আলেয়া এই সময়টাতে নিজের মধ্যে ফিরে যায়-সুতিয়াখালি-ফুলপুর গ্রাম-সামনে ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ চর-চরে উত্তরে-দক্ষিণে ছড়িয়ে থাকা দীঘল ঝাউবন আর কাশবন-দক্ষিণে, যেখানে ক্রমাগত সংকীর্ণ ব্রহ্মপুত্র আবার পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে, সেখানে নতুন বসতি-নয়ারচর-ওই সবকিছু ছুঁয়েছেনে বাতাসের শো-শো শব্দ ভেসে আসে। রাতে এই সময়টাতে আলেয়া-ঘোরের মধ্যে অনেক কিছু দেখে ও শুনে এবং দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে নিরাপদ ঘুমে তলিয়ে যায়।    
সাহেব আবার ডাকলেন, এদিকে আয়–
আলেয়া সংকুচিত পা ফেলে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। তখনও তার কানে ব্রহ্মপুত্রের চরে ঝাউবনে বাতাসের ঘোরলাগা শব্দ বইছে-যার ভেতর থেকে হৃদয় প্রফুল্ল করেতোলা সুবাস দুনিয়ার অনাকাক্ষিত সব গলিজ পদার্থ বিলীন করে দেয়।
সাহেব কাঁপা কণ্ঠে বললেন, অত দূরে কেন, ভয় নেই-এগিয়ে আয়-তোর ম্যাম বলেছে তোকে দেখে রাখতে-আয় ভালকরে দেখি-তোকে তো ভাল করে কখনও দেখিনি-তোর ম্যাম অবশ্য বলে ভারি কিউট গার্ল-
ঝাউবনে বাতাসের সুরেলা কানাকানির ভেতর ঢুকে পড়ে সাহেবের এলোমেলো দুর্বোধ্য কণ্ঠস্বর-ওই আজদাহার চাপা হিসহিস শব্দে মিশে চারদিক থেকে আলেয়াকে ঝাপটে ধরল। তার মনে পড়ে পুটুলির মা’র একমাত্র সম্বল ওই ছাগলটির কথা। ভীত-চকিত আলেয়া পিছিয়ে যেতে চেয়ে পায়ে পা আটকে গেল। তার সারা শরীর কাঁপছে-ভেতর-বাইরে সব উলোটপালট হয়ে গেছে। চেনা এই বিশাল ড্রয়িংরুমটাকে আর চেনা যাচ্ছে না-চেনা যাচ্ছে না ছিমছাম-পরিচ্ছন্ন সাহেবকেও, যিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন সংকোচে অজানা শংকায় কম্পমান কিশোরী আলেয়াকে। বোধশোধহীন দুঃসহ অপেক্ষা। কত সময় কেটে গেল বুঝতে পারেনি।
এক সময় আছাড়ি-পাছাড়ি করতে করতে আলেয়া দেখল, ঝাউবনের ভেতরে ঢুকেপড়া আজদাহা সাপটা তার নিথর ছোট শরীর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে ফেলছে-তার বিশাল হা-এর ভেতর টেনে নিচ্ছে, যেভাবে পুটুলির মা’র ছাগলটাকে টেনে নিয়েছিল-এরপর মনে হল সে মরে যাবে-মরেই যাবে-
পরদিন নজিফা বুয়া কাজের ফাঁকে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে, কিরে আলো, রাইতে কুনু অসুবিধা হয় নাই তো?
আলেয়া শরীরের বাধন আলগা করে দেয়া তিরতিরে ব্যাথা নিয়ে কেঁপে ওঠে-মাথা ঘুলিয়ে যায়-বেশিক্ষণ চুপ মেরে থাকলে বুয়ার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে-ম্যাম নেই, কি বিপদ নেমে আসবে, কে জানে।
বুয়া তাগিদ দেয়, কিরে আলো, হুনছস কি জিগাইলাম?
আলেয়া থতমত খায়, খালা কী জানি কইলা?
বুয়া তেঁতে ওঠে, কানের মাথা খাইছস ছ্যামড়ি-ঠিক কতাখান ঠিক সময়ে না কইলে বিপদ ঠেকাইবার কুনু উপায় থাকে না-
আলেয়া তার কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করে, খালাগো তুমার নাতির কথা কও-দেখতে কেমুন হইছে-নাক-মুখ-চোখ বাপের লাহান, না মায়ের লাহান?
মঙ্গলবার এবং বুধবারও সাহেব আর সন্ধ্যায় বের হন না। খেয়েদেয়ে গ্লাস আর বোতল নিয়ে টিভি দেখতে বসেন।  ঘন্টাখানেক পর আলেয়া বাতাসে আবার ওই হিস হিস শব্দ শোনে। গত ক’দিন এই হিসহিস ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায়নি সে, দেখতেও পায়নি কিছু। বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেছে, শুধু আতংক ছড়ানো ধ্বনিটাই আছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও কোন বাতাস নেই। তার একান্ত দৃশ্যাবলী ধূসর অস্পষ্টতায় ঢাকা যেন অন্য কোন জগতের। ব্যথায় কুঁকড়ানো কচি শরীর নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর রাত কাটে তার।

//  তিন  //
দিনভর রক্ত, কাটা আঙুল এবং ছুরি এই তিনটি বিন্দু একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার প্রণান্ত প্রচেষ্টা চালাল। কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যেতে না পেরে একে অন্যের উপর চেপে বসল। কোনটা ছুরি, কোনটা আঙুল এবং কোনটা রক্ত-আলাদা করতে পারছে না আলেয়া। দৃষ্টিবিভ্রম ঘটছে। শরীরে চিমটি কেটে, দু’আঙুলে চোখ টেনে ধরে চেষ্টা করল। না পারল না। এক সময় ছুরিটা তুলে নিল। অবলীলায় নাড়াচাড়া করল-হাত থেকে পড়ল না-হাত কাটল না। এই করতে করতে ছুরিটা তার আঙুল হয়ে ওঠে। সে আঙুল নাড়াল, ছুরি চকমকিয়ে ওঠল। সে ছুরি নাড়াল, আঙুল বাতাস কুচি কুচি কেটে ফেলল । ছুরিটা তার ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে ওঠল এবং অবলীলায় ইচ্ছার রূপায়ন ঘটাতে থাকল।
এরকম একটা ছুরি দিয়ে ছবুরন মানুষ খুন করেছিল। এই ছুরি-ছুরিই ছবুরনের আদ্যোপান্ত দৃশ্যটি ঝলমলিয়ে তুলল। ছবুরন ক্রমাগত স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর।
জেল থেকে বেরিয়ে ছবুরন এসেছিল ওদের বাড়িতে। সারা গায়ে কেউ জায়গা দেয়নি-ভাইয়েরাও না। খুনি ছবুরনকে আশ্রয় দিতে ভরসা পায়নি। মাঝবয়সেও শক্ত-সামর্থ, চটপটে, হাসিখুশি ছবুরন ওদের বাড়িতে থেকে গেল । বাড়ির সবার কাজ একা করে। শত পরিশ্রমেও হাঁপায় না, ঘামে না, মুখ ব্যাজার করে না। রাতে রান্নাঘরের বারান্দায় ছেঁড়া মোছলায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। পাশে থাকে একটা কুকুরও।
তাড়াতে গেলে বলত, থাউক, মানুষের চে’ কুত্তা ভালা-অনেক ভালারে-
ছবুরনের মনটা বড় নরম। কারো দুঃখ-ব্যথা দেখলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে। শব্দ করে কান্না নয়, লোক দেখানো কান্না নয়। গভীর মর্ম থেকে ব্যথা উগলে দেয়া কান্না। পাশের বাড়ির নতুন বউটাকে তার শাশুড়ি খুন্তি পুড়িয়ে দাগ দেয়। তাতেই তিনদিন ছবুরন শুধু কেঁদেছে এবং ভাত-পানি মুখে তুলেনি।  
বলেছে, ভুলবার পারতাছি না আমি-ভুলবার পারতাছি নারে-
সেদিন ছিল মুষল বৃষ্টি। আলেয়া ছবুরনের সাথে রান্নাঘরে। ছবুরন ধান ভানছিল ঢেঁকিতে-মোড়লবাড়ির ধান ভানার কাজ করত তার মা-ছবুরন জোর করে একাই ওই কাজটা করে। বৃষ্টির তোড় এমন যে ছাতার তলায়ও ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। ভারিবর্ষণের শব্দ নিচ্ছিদ্র-গলা ফাঁটিয়েও একঘর থেকে আরেকঘরে কারও সঙ্গে কথা বলা যায় না। ছবুরন কাজ-কাম শেষ করে আলেয়ার মাথার উকুন বাছছিল।
আলেয়া আচমকা জিজ্ঞেস করল, ছবুরন খালা তুমি বুলে ছুরি দিয়া মানুষ খুন করছ?
ছবুরনের সাফ জবাব, হ করছিই তো-ছুরিটা ধার আছিল না-তয় কাম অইছে-
আলেয়া অবাক, তুমি মানুষ খুন করছ! মিছা কতা, আমার মনে কয় না, তুমার মতন মানুষে মানুষ খুন করবার পারে না-
ছবুরনের জিজ্ঞাসা, তয় জেল খাটলাম ক্যান?
আলেয়া আরও অবাক, ক্যান খুন করছ!
ছবুরনের উদাসীন জবাব, যে কারণে করছি, হেই কারণ যেন তুম’গর জীবনে কুনুদিন না ঘটে-আমিও ছোটবেলায় তুমার লাহান সোন্দর আছিলাম-লোকে কইতো, নইমুদ্দীর ঘরে গোলাব ফুল ফুটছে-হারামজাদারা হেই গোলাব দলামোচড়া কইরা পিষ্যা ফালাইছে-খুন করবাম না তো কী করবাম-খুন করছি-খুব করছি-খুন করন ছাড়া আমার কুনু উপায় আছিল, ক’তুই-
ছবুরনের কোন উপায় ছিল না। আলেয়ার কী কোন উপায় আছে? তার নিঃশব্দ এই একটি উচ্চারণ দিনভর হাজার উচ্চারণ হয়ে জালের মত তাকে ঘিরে ফেলল। থকথকে ঘন কুয়াশার সেই জালে চারদিক ঢাকা পড়ল। তার চেনাজীবন আর অচেনাজীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওই জমাটপ্রায় কুয়াশায় ওই ছুরি আর আঙুলকাটা রক্ত ছাড়া আর কিছু তার চোখে পড়ে না। হেমন্তের ছাইগলা কুয়াশার ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলেয়ার দৃষ্টি ছাপিয়ে দিন গেল, সন্ধ্যা গেল, রাত্রি নামল। কুয়াশা আরো ঘন হয়ে ঘিরে ধরল এই সুনসান সাদা বাড়িটা। হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করল। আর কোন খালি জায়গা নেই।
ভেতরে বাইরে কুয়াশার ঠাসাঠাসির মধ্যে সশব্দে ফেটে পড়ল, খুন করবাম না তো কী করবাম-খুন করবাম না তো কী করবাম-
ছবুরনের এই জ্বলন্ত উচ্চারণ যত ব্যাপ্ত, এ ছুরি আর রক্ত তত বিস্তৃত হতে লাগল। আলেয়ার চেতনায় এই উচ্চারণের শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই এবং ছুরি ছাড়া সব দৃশ্য উধাও। আলেয়ার ভেতর ঘন ছায়ার ঢেউয়ের মত ছবুরন ঢুকে পড়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠল। একটি ইচ্ছার সলতে লকলকিয়ে বাড়তে থাকল।
আজদাহার মত তার ছোট শরীরটা পেঁচিয়ে ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করল আলেয়া। তারপর হাতড়ে হাতড়ে ছুরিটা তুলে নিয়ে আচমকা লোমশ পিঠে বসিয়ে দিল। ন্যাংটো লোকটা ছিটকে পড়ে উঠে দৌঁড়াতে চাইল। আলেয়ার শক্ত হাতে উদ্যত ছুরির অর্ধেক রক্ত, অর্ধেক ইস্পাত ঘন কুয়াশা ফেঁড়ে ঝকমকিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিল তার। দ্বিতীয় আঘাতটা সামলে সে তাকায় আলেয়ার চোখে এবং তাকিয়েই প্রাণপণে দৌঁড়ে দরজা ঠেলে লাফিয়ে পড়ে বাইরে। সবুজ লন পেরিয়ে উঁচু দেয়ালের পাশে মেহগিনি গাছটায় উঠার চেষ্টা করছে।
আলেয়া তুফান বেগে ছায়ার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। পিঠে-বুকে-কোমরে-পায়ে অবিরাম ছুরিকাঘাতে ঝরা আমের মত এক সময় টুপ করে ঝরে পড়ল লোকটা।
উদোম আলেয়া কুয়াশার চাদরে নিজেকে ঘিরে রেখে বসে থাকল ক্ষত-বিক্ষত নগ্ন লাশের পাশে।

// চার //
প্রথম সূর্যের আলোতে কুয়াশা যখন কুচি কুচি হয়ে উড়তে লাগল শিমূল তুলার মত, তখন উঠে দাঁড়ায় আলেয়া। লন, বোগেনভেলিয়া, সাদা বাড়িÑসব আগের মতই ছিমছাম। সে দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল।
এখন পুলিশ আসবে-তাকে ধরে নিয়ে যাবে-জেল থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যাবে-কেউ তো খুনি আলেয়াকে জায়গা দেবে না-তারপরও একটি বউকে খুন্তি পুড়িয়ে দাগ দিলে আলেয়ার ভেতর থেকে গভীর কান্না উথলে ওঠবে-নিঃশব্দে গড়িয়ে গড়িয়ে নামবে কান্না-কার জন্য এবং কেন এ কান্না, কেউ জানবে না-
জলজ্যান্ত সাহেব মোটা নাকের শেষপ্রান্তে মার্বেল গুলির মত দুই চোখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন, আরে সারা রাত কোথায় ছিলি তুই-হাতে ছুরি কেন? ছুরি দিয়ে কি হবে-
ড্রয়িং রুমের মাঝখানে বিস্ময়ে এতটাই স্তব্ধ আলেয়া যে মনে হল, তার গোটা পৃথিবীটা কেউ উপুড় করে দিয়েছে-পৃথিবীর তাবৎ গাছপালা-মানুষজন এবং আলো-বাতাস সব চারদিকে ভেঙেচুরে গড়িয়ে যাচ্ছে। সারাটা রাত সে কি ছায়াকে ক্রমাগত আঘাত করেছে-খুন করেছে-রাতের সবটাই কি ছিল তার স্বপ্নের ঘোর!
তার দাদির কথায় সাহেবের বাচ্চার মত-এই সাহেব খিক-খিক করে হেসে ওঠল, দেখ তোর শরীর কত পেলব-কোমল, কত সুন্দর-এই সুন্দর শরীর নিয়ে যাবি কোথায় তুই-
আলেয়া তার পাথরখোদাই ছোট শরীর-তার ভেতর গনগনে ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে উদোম মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল-কংক্রিটে গেঁথে গেছে তার কচি-নরম-পেলব পা-

লেখক পরিচিত: ইউসুফ শরীফ বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক । তার লেখালেখির শুরু ষাটের দশকে কবিতা দিয়ে। সত্তর দশকের গোড়া থেকে ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখছেন এবং এখনও লিখেই চলেছেন। তার ছোটগল্পের সংখ্যা ৭০ এবং প্রকাশিত উপন্যাস ২১টি।  পেশাগত জীবনে তিনি একজন সাংবাদিক এবং দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের উপ-সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কথাসাহিত্যিকদের সংগঠন ‘কথাসাহিত্যিক কেন্দ্র’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/