আদর্শিক দার্শনিক ও সুসাহিত্যিক বেগম রোকেয়া

হোমায়রা হুমা

নারী জাগরণের একমাত্র অগ্রণীশোভন অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। কুসংস্কার,পশ্চাৎপদ,অন্ধকারাচ্ছন্ন,কুসংস্কারপূর্ণ,নারী বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতিকে পায়ে মাড়িয়ে যুক্তিযুক্ত পথ পরিক্রমার মাধ্যমে নারীকে সম্মুখসমরে আলোভরা পথ দেখানোর সাহস করেছিলেন সমাজ সংস্কারক আলোর দিশারী বেগম রোকেয়া। নারীর অরক্ষিত জীবনের কষ্টকর,যাতনা বিদ্ধ,বঞ্চিত, দুঃখের তরঙ্গিণী,পরাধীন রক্ষণশীল জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন, মুক্তবুদ্ধির সরব সম্মুখ সামাজিক আন্দোলনের সাহসীযোদ্ধা, মননশীল শক্তিধর লেখিকা সুসাহিত্যিক বেগম রোকেয়া।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরে জন্ম,১৮৯৮ সালে তার বিবাহ। তিনি ছিলেন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী। তার গর্ভে দুটো সন্তান জন্মে, তাদের অকাল মৃত্যু হয়। ১৯০৯ সালে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ১৯০৯ সালেই বেগম রোকেয়া বিহারের ভোগলপুরে 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার স্বামীর প্রথমা স্ত্রীর কন্যার স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ১৯১১ সালে কলকাতায় স্কুলটি স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হন।

রোকেয়া ছিলেন জমিদার পরিবারের কন্যা। তখনকার সময়ে অন্তঃপুরের এই অবরোধ বাসিনীদের শিক্ষা লাভের কোনো সুযোগ ছিল না,ইসলামধর্ম ছাড়া। সেই কট্টর রুদ্ধদ্বার সময়ে বেগম রোকেয়াকে তার ভাই সাবের হোসেন বইপড়ার সুযোগ করে না দিলে আজো নারী সমাজ অন্ধকারেই পড়ে থাকতো।

নারীর শিক্ষা বিস্তার ও অধস্তন নারীর উন্নয়ন সাধন নয়,তিনি তার তীক্ষ্ণ,যুক্তিপূর্ণ  জ্বালাময়ী লিখনির মাধ্যমে তার অব্যক্ত বাণীগুলো  লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বেগম রোকেয়া একজন বিদগ্ধ সমাজ সচেতন বিপ্লবী নেতাই শুধু নন, তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন। গল্প,কবিতা,উপন্যাস,রম্য রচনা, রসবোধ সম্পন্ন ছোট কাহিনী লিখেছেন যার মূল উপজিব্য বিষয় ছিল নারীর বঞ্চনা, যাতনা ও বিপদসংকুল জীবন কাহিনী। পদে পদে নারীরা যে নীচস্তরবাসিনী ছিলেন তার স্পষ্ট রূপরেখা তিনি লেখায় ফঁটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

একজন সুসাহিত্যিক হিসেবে তখনকার বুদ্ধিজীবীদের কাছে সমাদৃত ছিলেন। বিংশশতাব্দীর সূচনালগ্নে লেখক নবেগম রোকেয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সে সময়ের তিনটি পত্রিকা 'নবপ্রভা', 'মহিলা', 'নবনূর' পত্রিকায় বাংলা এবং ইংরেজি 'দি মুসলমান' ইংরেজি পত্রিকায় তিনি ইংরেজিতে লিখতেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত 'সওগাত'পত্রিকায় মিসেস আর এস হোসেনের কবিতা 'সাওগাত' প্রকাশিত হয়েছিল।'মাসিক মোহাম্মদী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে 'অবরোধ বাসিনীর' খণ্ডচিত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯০১ থেকে ১৯৩২ দীর্ঘ বত্রিশ বছর বেগম রোকেয়া সাহিত্য সাধনা করেছেন। প্রতিটি লেখায় নারী জাগরণ,নারীশিক্ষা,বাঙ্গালি ও বাঙালি মুসলমানের জীবন ও জীবনবোধকে নিরন্তর তার কলমে তেজোদৃপ্ত চৈতন্যে প্রবিষ্ট রেখেছেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন বুদ্ধিজীবী,শক্তিমান সাহিত্যিক,ও সমাজ সংস্কারে এক নিবেদিত প্রাণ কর্মী। তিনি ভেবেছিলেন নারী জীবনে অগ্রগতির মূল সোপান শিক্ষা অর্জন, তারই বিস্তারে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পাশাপাশি সাহিত্যিক মূল্যায়ণে তার চিন্তাচেতনায় বুদ্ধিবৃত্তিক গদ্যরচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।  স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, 'স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে'।

একই প্রবন্ধে লিখেছেন, 'জগতের যে সকল সমাজের পুরুষরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হইতেছেন,তাহারা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন। 'আরো উল্লেখ্য যে, 'উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই,পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?'

একই প্রবন্ধে লিখেছেন, 'আমরা অকর্মণ্য পুতুল- জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই,একথা নিশ্চিত।' ভ্রাতা-ভগ্নী প্রবন্ধে লিখেছেন,-'বল তো ভাইয়া! মায়ের অতগুলো অলংকারের শ্রাদ্ধ কাহারা  করিয়াছে?–তোমরা। পুরুষ প্রভুরা!! স্বর্ণভার বহন করে ভগিনী অবলারা,আর স্বর্ণ ভোগ করে ভাগ্যবান সবলেরা। টাকা হইলে কিনা পাওয়া যায়? তাই অন্তঃপুরে বন্দিনীদের হাতে টাকা থাকিতে দেয়া হয় না।

সুবেহ্ সাদেক প্রবন্ধে লিখেছেন–'যাহা হউক, মাতা ভগিনী,কন্যে! আর ঘুমাইও না,–উঠ, কর্তব্য পথে অগ্রসর হও।  'নবনূর' প্রবন্ধে,' কেহ বলিতে পারেন যে, তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন? তদুত্তরে বলিতে হইবে যে, 'ধর্ম' শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমনীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই ধর্ম লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম। এজন্য ধর্মিকগণ আমায় ক্ষমা করিতে পারেন।'

মতিচূর' প্রবন্ধে–'বিবেক গ্রন্হ,অবনতি দেখাইয়া দিতেছে, এখন উন্নতির চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।  ' সুগৃহিনী' প্রবন্ধে বলেছেন-
'সুশিক্ষার স্পর্শমণি যাহাকে স্পর্শ করে সেই সুবর্ণ হয়।'

'মনের উক্তি' কবিতায় লিখেছেন,'সোনার পিঞ্জিরা ধরে রেখো না আমায়, আমারে উড়িতে দাও দূর নীলিমায়!'  'আমি ও মন'–কবিতায় লিখেছেন,–মন! তুমি কোথায় কোথায়?দিবানিশি খুঁজে মরি,পাই না তোমায়!' বেগম রোকেয়ার সাহসী ক্ষুরধার কলম কোথাও থেমে যায় নি। তিনি লেখেছেন,'সর্ব্ব অঙ্গে ব্যাথা, ঔষধ দিব কোথা?'

তিনি তার লেখার প্রতি পলকে পলকে নারীর অর্ধস্তন অবস্হান ও অন্তনিহিত বেদনার কথা উপমায়,প্রমাণে,ব্যাখ্যায় ব্যাপকভাবে  উৎপ্রেক্ষায় বর্ণনা করেছেন। তার চিন্তনে প্রবাহমান ছিল নারী,নারী মুক্তি,নারীর উজ্জীবনী শক্তি,নারী ও পুরুষের সমতা সমানাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন,নারীর রাজনৈতিক অধিকার।একজন সমাজ সংস্কারক তার লেখনী ধারায় একের পর এক কল্পবাস্তবতায় সৃষ্টি করেছেন জীবন্তিকা। যুগ যুগ ধরে বেগম রোকেয়া নারী ও সমাজের শক্তিধর ব্যক্তিত্বের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তার নিজস্ব দুঃখ বেদনা জানাবার চেষ্টা কেউ কি করেছি! তার মৃত্যুর আগের বছর তিনি বোন মোহসেনাকে লিখেছেন, ‘শৈশবে বাপের আদর পাইনি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। দুবার মা হয়েছিলাম–তাদেরও প্রাণভরে কোলে নিতে পারিনি। একজন পাঁচমাস বয়েসে, অপরজন চার মাস বয়েসে চলে গেছে। আর এই বাইশ বছর যাবত বৈধবের আগুনে পুড়েছি। সুতরাং নুরী আর আমাকে বেশি কে কাঁদাবে? সে তো বোঝার ওপর শাখের আঁটির মাত্র ছিল। আমি আমার ব্যর্থ জীবন নিয়ে হেসেখেলে দিন গুনছি।’

হয়ত সে কারণে বেগম রোকেয়ার ১৯০১-৬ পর্যন্ত লেখার বিরতি ছিল। তবে ১৯১৫-৩২ পর্যন্ত তিনি পূণরায় সাহিত্য চর্চায় নিবিষ্ট হয়েছিলেন।বেগম রোকেয়া জীবিতাবস্থায় পাঁচটি গ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর ঐ পাঁচটি বইয়ের সঙ্গে অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, কবিতা নিয়ে কবি-গবেষক আব্দুল কাদিরের সম্পাদনায় 'রোকেয়া রচনাবলী' ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়।পরবর্তিতে বাংলা একাডেমি সম্পাদকমণ্ডলী কর্তৃক পরিবর্ধিত ও পরিমার্জনায় প্রকাশিত হয়। বেগম রোকেয়া ছিলেন বিংশশতাব্দীর স্বাধীনচেতা, পর্দানশীন,ভদ্র ও মধুরভাষী ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তার রচনা ছিল শিল্পমূল্যে মূল্যবান। তার কাব্যিকতা,গভীর মনস্তত্ত্বের সংলাপ, যুক্তিশীলতা,রঙ্গ ও ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণতা,বাক্যরীতি ১৪০ বছর পরও সকলের মন ও মননে আলোড়ন তোলে।

তিনি স্বাধীনচেতা সমাজসেবার কারণে সেই সময়ের ইসলামি হুজুরা তাকে বাক্যবাণে জর্জরিত কম করেনি। তারই উল্লেখ পাই অবরোধ-বাসিনীতে, তিনি লেখেন, 'আর জীবনের ২৫ বছর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইতেছি।' তবু নারী সমাজের উন্নয়নে তার গতি কমেনি মোটেও। বেগম রোকেয়া মৃত্যুর আগের রাত্রি পর্যন্ত  রচনা লেখায় নিরবিচ্ছিন মগ্ন ছিলেন। 'নারীর অধিকার' ('মাহে-নও', মাঘ১৩৬৪)–অসম্পূর্ণ শেষ রচনাটি, তার মৃত্যুর পরে লেখার টেবিলে পাওয়া গিয়েছিল।

বাঙ্গালি সমাজে এমন এক সমাজবোদ্ধা সংস্ককারক ক্ষণজন্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করি। বেগম রোকেয়ার দার্শনিক চিন্তা চেতনা সমৃদ্ধলেখাসমূহ ১৪০ বছর পরও সৃজনশীল শক্তি যোগায়, দাবি আদায়ের  আন্দোলনকে বেগবান, দার্শনিক আবেগে শক্তি যোগায় একবিংশের নারীদের। বেগম রোকেয়া তার আন্দোলনে তেজস্বীশক্তিকে লেখনীর ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন বিধায় তার মুক্তচিন্তার দিকনির্শনায় যুক্তিশীল ভাষায় সমৃদ্ধ হয়েছে যুগযুগান্তের আপামর নারী সমাজ; আগামী শত বছরও নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়াই প্রতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রগতিশীলদের আলোকবর্ষ হয়।

বেগম রোকেয়ার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বেগম রোকেয়া আজো একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকবোধ সম্পন্ন তরুণী নারীদের আহ্বান করছেন–বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; আমরা ভগিনী! আমরা আসবাব নই,বল কন্যে! জড়োয়া অলঙ্কার রূপে সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নহি, সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ।"

হোমায়রা হুমা: কবি, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/