ভ্রমণকাহিনী: গ্যাংটকে তারার মাঝে কয়েকদিন

গ্যাটকের বিখ্যাত ছাঙ্গু লেক

নূরুন্নাহার বেগম

দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি ও অবসাদ জীবনকে একঘেয়ে, বিপর্যস্ত করে তোলে ৷ সুখানুভুতি আর সাময়িক পরিতৃপ্তির অন্বেষায় দূর অথবা কাছের কোনো অচেনা দেশে ঘুরে আসার বাসনা মনে সুরসুরি দিচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই ৷ কোনো অদেখা প্রান্ত অথবা শহর থেকে দূরে পাহাড়, সবুজ বনানী বিস্তৃত  নির্জন পল্লী বা সমুদ্র সৈকতে শ্রান্তি নিরসনে যাবার প্রচন্ড ইচ্ছে মনে ৷  অদেখাকে দেখব,  অজানাকে জানব—এযে অন্যরকম তৃপ্তিদায়ক সুখকর অনুভূতি ৷ মনে সংশয়,  সঙ্কট কোনোকিছুকেই ঠাঁই দেইনি ৷ ভ্রমন কষ্টকর, বিপজ্জনক, ব্যয়বহুল তারপরেও সব ধরনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে ভ্রমন করার সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে ফেলা হলো ৷

২৩ নভেম্বর ,২০১৯ আমরা গ্যাংটকের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিচ্ছি ইনশাল্লাহ ৷ ভ্রমন যাত্রার আগের রাত প্রায় নির্ঘুম৷ কারণ উৎকন্ঠা, যাওয়ার ব্যকুলতা , কি নিলাম আর কি বাদ পড়লো তারপরেও সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে পেরেছি কিনা আরেকবার চেক করে নিলাম ৷ প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র, শীতের কাপড়, কেডস, সব নিয়েছি ৷ ছেলে বললো আম্মু, গ্যাংটকে কিন্তু অনেক ঠাণ্ডা ৷ সেভাবেই রেডি থেক ৷ মনে ভাবলাম ভয় করলে কি আর জয় হয় ৷ ঠিক সকাল ৬ টায় আমরা রংপুরের বাসা থেকে বের হলাম ৷ আগের দিন সকালে ছেলে তার বৌসহ ঢাকা থেকে বিমানে রংপুরের বাসায় আসে ৷ একটা রাত শুধু বিশ্রাম নিয়ে আবার ওরা দু'জন যাত্রা শুরুর উদ্দেশ্যে রেডি ৷ ভাড়ায় নেয়া কারে আমরা বুড়িমারী বর্ডারে যাচ্ছি ৷ আমার ছেলে, ছেলের স্ত্রী, মেয়ে আমার ভ্রমন-সাথী ৷ হালকা কুয়াশা ভেদ করে গাড়ি ছুটছে আমাদের গন্তব্যে বুড়িমারী বর্ডারের উদ্দেশ্যে ৷ পাগলাপীর, ডালিয়া ব্রিজ ক্রস করে হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট জেলায় প্রবেশ ৷ অনেক চেনা পথ আমার ৷ তারপর ৪ বছর ঐ পথে চলা হয়নি ৷ চেনা পথ অনেকটাই অচেনা হয়ে গিয়েছে ৷ ইতোমধ্যে অনেক স্থাপনা উঠেছে, রাস্তাঘাট সবকিছুর মধ্যেই একটা পরিবর্তনের ছাপ লক্ষ্য করছি ৷ ঠিক আটটায় বুড়িমারী চেকপোস্টে আমরা পৌঁছালাম ৷ সকালে তাড়াহুড়া আর উৎকন্ঠায় কিছু খাওয়া হয়নি ৷ হালকা কিছু খাবার সাথেই নেয়া ছিল ৷ বুড়িমারীতে পৌঁছে সঙ্গে নেয়া কেক, ডিম সিদ্ধ আর পানি খেয়ে পেট, শরীর কিছুটা স্বস্তি বোধ করল ৷ ইমিগ্রেশন রুম পরিষ্কার করছিল সে সময় ৷ সেজন্য মূল ফটকের বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো ৷ একে একে ভ্রমনেচ্ছুক যাত্রীরা এসে ইমিগ্রেশন চত্বর ভরে গেল ৷ আমরাও যে যার লাগেজ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম ৷ চেয়ারে বসে পড়লাম ৷ চেক পোস্টে দালালের বিষয়টা মাথায় ছিল আগে থেকেই ৷ কিন্তু এতটা প্রকট এটা জানা ছিল না ৷ ট্রাভেল ট্যাক্স জনপ্রতি ৫০০ টাকা আগেই জমা করেছিলাম ৷ ওরা যাত্রীদের সাথে প্রতি পাসপোর্ট অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর কাজ করে ৷ আমার ছেলের সাথে এপারে ১৫০ টাকা, ওপারে ১০০ টাকায় কাজ সমাধা করবে বলে জানিয়ে দিল ৷ দালালদের হাতে পাসপোর্ট চলে গেল ৷ জায়গায় জায়গায় কি করতে হবে হবে সব করা হলো ৷ আমাদের আর কিছু ভাবতে হবে না ৷ লাগেজের দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে ৷

অপেক্ষা জিনিসটা বড়ই অপ্রীতিকর ৷ ঢাকা থেকে শ্যামলী, এসআর বা অন্যান্য  গাড়িতে যারা এসেছেন তাদের ইমিগ্রেশন আগেই করা হলো ৷ প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় পর আমাদের ডাক এলো ৷ আমার ছেলে কাছেই দাঁড়িয়ে দেখছে সব ৷ আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো আমি কি করি ৷ করতাম তো অনেক কিছু ৷ সরকারি দায়িত্ব পালন করতাম ৷ এখন পূর্ণ অবসর জীবন যাপন করছি ৷ তাই উত্তরে স্রেফ বলে দিলাম কিছু করি না ৷ লেখালেখি করি— বলিনি ৷ ভাবলাম—ওটাতো আমার সখের বিষয় ৷ কথা বাড়িয়ে লাভ কি ৷  ছবি তুলে নেয়া হলো ৷ আরো যা যা করার সব শেষ ৷ এখন চেক পোস্ট অতিক্রম করতে হবে ৷ বাংলাদেশি, ভারতীয় ৷ কত টাকা নিয়েছি,  ভারতীয় রুপি নিয়েছি কিনা ৷ সত্য কথাই বলে দিয়েছি ৷ কারণ মিথ্যে বলার অভ্যাস নেই ৷ ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম সারতে ৪ ঘন্টা ব্যয় হল ৷ কত ধরনের ফর্মালিটিজ ৷

ট্যাক্সি গাড়ি ভাড়া করা হলো ৷  আমরা এখন শিলিগুড়ি আসব ৷ চ্যাংড়াবান্ধার রাস্তা ধরে আমরা এগুচ্ছি ৷ প্রশস্ত রাস্তা ৷ ড্রাইভার আতাউর আমার ছেলের সাথে কথা বলছে ৷ বাংলাভাষী,  মুসলিম সে ৷ পাশ দিয়ে চলন্ত ট্রেন পাড় হয়ে গেল ৷ কত শত গাড়ি সারি লাইন ধরে এগুচ্ছে ৷ আমার দেশের কয়েকটি নামের সাথে মিল পেলাম রাজার হাট, আমবাড়ি, খোকশাবাড়ি,  ফুলবাড়ি,  পুটিমারী ৷ রাস্তার দুপাশে ফসলি জমি ৷ ধান কাটা হয়ে গেছে ৷ বিরান ভুমি পড়ে আছে ৷ কাটা ধানগাছ শুকানোর জন্য জমিতেই ফেলে রাখা হয়েছে ৷ জমিতে নারী—পুরুষ মিলেই কাজ করছে ৷ রাস্তায় কয়েকটি স্কুল চোখে পড়লো ৷ ছুটি শেষে ছেলে মেয়েরা বাড়ি ফিরছে ৷ কোনো রিকসা নেই স্কুলের গেটে ৷ বাড়তি লোকের ভিড় নেই ৷ মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছে ৷ মেয়েরা সাইকেলে একসাথে কয়েকজন বাড়ির দিকে চলছে ৷ অটো ,মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক ,তেলের গাড়ি, ভারী যানবাহন এসবই চোখে পড়ল ৷ রাস্তার পাশে বাড়িগুলো পরিষ্কার, গোছানো মনে হলো বাহির থেকে  ৷ প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে ঠাকুর ঘর ৷ রাস্তার মোড়ে ঠাকুর ঘরে ঠাকুর দাঁড় করানো ৷ মসজিদ চোখে পড়েনি ৷ হিমালয় থেকে উদ্ভূত তিস্তা নদীর উপর ব্রিজ ক্রস করছি আমরা ৷ আমার দেশের মত একদিক দিয়ে রেললাইন ব্রিজ অন্য পথে সড়ক ব্রিজ ৷ নদীতে পানি নেই বিশাল চর পড়ে আছে ৷ জয়পুর চা বাগান সবুজে সবুজ ৷ যতদুর চোখ যায শুধুই চা-বাগান ৷ বাগান কর্মীরা কাজ করছে চা বাগানে ৷ মাঝে মধ্যে বৃহদাকার গাছ দাঁড়ানো ৷ শিলিগুড়ির দিকে ক্রমশ এগুচ্ছি ৷ আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছে যাব ৷ এ অসময়ে রবি ঠাকুরের  'আকাশ ভরা সূর্য তারা  ' গানটির কয়েকটি লাইন মনের দোরে উঁকি দিচ্ছে ৷
 ‘কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ ৷’

বিস্ময়ভরা মন নিয়ে ক্রমেই এগুচ্ছি আমরা ৷  ঠিক দুপুর আড়াইটায় শিলিগুড়িতে পৌঁছালাম আমরা ৷ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় ৷  হাত-মুখ ধুয়ে ক্যান্টিনে  খাবার অর্ডার দিয়ে আমরা টেবিলে বসে পড়লাম ৷ সিকিম রাজ্যে প্রবেশের জন্য সিকিম ন্যাশনালাইজড ট্রান্সপোর্ট থেকে অনুমতি নিতে হবে ৷ ক্ষানিকটা সময়ের জন্য ছেলে একাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ৷ ১০/২০ মিনিটের মধ্যে ছেলে কাজ শেষ করে একবারে এসএনটি বাসের টিকেট কেটে এসে খেতে বসল ৷ আমাদের বলল তোমরা রেডি হও, বাস রেডি ৷  অনুমতি নেয়ার কাজ শেষ করে আমাদের নিয়ে বাস ছেড়ে দিলো ৷ বছর দু 'তিনেক আগে বাংলাদেশি বাদে অন্যান্য দেশ থেকে বিদেশিদের গ্যাংটক প্রবেশের অনুমতি ছিল ৷ বাংলাদেশিদের প্রবেশের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট,ভিসা দেখিয়ে এসএনটি’র (সিকিম ন্যাশনালাইজড ট্রান্সপোর্ট) থেকে অনুমতি নেয়ার  পর ইচ্ছা করলে ৮ /১০ জনের জন্য ভারতীয় ক্যাব ভাড়ায় নিয়ে সরাসরি সিকিম পৌঁছানো যায় অথবা সময়মত এসএনটির বাস দাঁড়ানো থাকে ৷ নির্ধারিত সিট নাম্বারে টিকেট কেটে বসা যায় ৷ আমরাও তাই করেছি।
আকাশছোঁয়া পাহাড় ৷ বাতাস কেটে শোঁ শোঁ করে ছুটছে মিনি বাস ৷ আমরা চারজন দুই সিটে বসেছি ৷ যে কয়জন যাত্রী সবাই যার যার সিটে বসা ৷ অতিরিক্ত যাত্রী নেই ৷ জানালা দিয়ে গা সওয়া ঠান্ডা বাতাস ৷ শিলিগুড়ি থেকে লাঞ্চ সেরে ভারতীয় সময় ৩টা ৩০ মিনিটে এসএনটি চেক পোস্ট থেকে আমরা গাড়িতে উঠলাম ৷ ভাত ঘুম দেয়ার অভ্যেস হয়েছে অবসর জীবনে ৷ গাড়িতে বসে ঝিমুনি এসেছিল ৷ বাইরে রোদ ৷ শিলিগুড়ি শহর ছেড়ে রাস্তার দু 'ধারে  সারি সারি অসংখ্য গাছ ৷ দারুন নান্দনিকতা ৷ চ্যাপ্টা গোলগাল মেয়েরা টুপিস পড়ে স্কুটি চালিয়ে যে যার গন্তব্যে যাচ্ছে ৷ সিকিমের নির্দিষ্ট এক ধরনের গাড়িতে যাত্রীরা চলছে ৷ ৮ /১০ জন করে ওঠা যায় ৷ ভারী লাগেজ ছাদে নেয়ার বন্দোবস্ত ৷ আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমাদের গাড়ি এগুচ্ছে ৷ রাস্তা থেকে অন্তত  ১০০ ফুট নিচ দিয়ে ঝর্নাধারা  প্রবাহিত ৷ যতই অগ্রসর হচ্ছি ততই অবাক হচ্ছি ক্রমশ ৷ নীচে পাহারের ঢালু বেয়ে বাড়িঘর ৷ রাস্তার দু 'ধারে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৷ মেয়েরাই পসরা নিয়ে আছে ৷ খাবার তৈরি করছে ৷ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে ৷ কতদিনে এই পাহাড় কেটে কেটে আঁকাবাঁকা রাস্তা বানিয়ে বসতি গড়েছে, কে জানে ৷ অন্তত ৫০০০-৬০০০ ফিট উপরে ঘরবাড়ি বানিয়ে মানুষ বসবাস করছে ৷ প্রত্যেক বাড়ির সামনেই রাস্তা আছে ৷ এসবের নির্মাণ কৌশল অভিনব ৷ দুর্যোগের সাথে খাপ খাইয়ে এরা গড়ে তুলেছে সভ্যতা ৷ ঘন্টা তিনেক যাত্রাপথ পাড়ি দেবার পর ১৫ মিনিটের যাত্রা বিরতি পেলাম ৷ আমার ছেলে হিন্দিতে মোটামুটি ভালই বাতচিৎ করতে জানে ৷ ও মোটামুটি বোঝাতে সক্ষম হলো আমরা আসলে কি খেতে চাচ্ছি ৷ এর ফাঁকে আমরা ওয়াসরুমে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে গেলাম ৷ বড় বড় কাটা জ্যারিকেনে পানি ভরা ৷ সেটা থেকে পানি নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারার কায়দা নেই ৷ আমরা বদনা / হ্যান্ড শাওয়ারে পানি ব্যবহারে অভ্যস্ত ৷ এরা কিভাবে পানি ব্যবহার করে জানিনা ৷ যাহোক অনেক কষ্টে পরিষ্কার হতে হলো ৷ অল্প সময়ের মধ্যে একটা ফুটফুটে মেয়ে গরম রুটি, ছোট বাটিতে ডাল, দুই প্রকারের সবজি ভাজিসহ খাবার নিয়ে এলো ৷ অন্যান্য টেবিলে আরো সব যাত্রীরা তাদের যার যার পছন্দের খাবার খেতে বসেছে ৷  খাবার খেয়ে সময়ন্তে গাড়িতে উঠে গানের ধুমধারাক্কা বাজনা শুনছি ৷ কিছুদূর যাবার পর আমার সামনে বসা এক ভদ্রলোক সম্ভবত তার স্ত্রীকে নিয়ে বসেছিলেন ৷ কথায় মনে হলো ওনারা গ্যাংটকের স্থানীয় বাসিন্দা হবেন ৷ কিছুদূর যাবার পর উনি কানে কানে ড্রাইভারকে কি যেন বললেন ৷ ডাইভার গাড়ি থামালেন ৷ আমার সামনে বসা মহিলা আর পাশের একজন মহিলা রাস্তার উপরে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন ৷ গাড়ির ভিতরের লাইট অফ করা হলো ৷ ওনারা ওনাদের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে গাড়িতে উঠলেন ৷  বাস পুনরায় স্টার্ট করলো ৷ মনে অনেক ভাবনা নিয়ে পথ অতিক্রম করছি ৷ মোবাইল ফোন, ট্যাব সব অচল হয়ে আছে ৷ আসার সময় কর্তা বললেন ঘন্টায় ঘন্টায় ভ্রমণবৃত্তান্ত জানাতে ৷ এরমধ্যে ১২ ঘন্টা অতিক্রান্ত হল ৷ বাড়িতে কোনো খবর জানানো যাচ্ছেনা ৷ সিম প্রবলেম ৷ ওনাকে বোঝাব কীভাবে ৷ রাত ১০ টায় সিতান, রানিপুল পার হয়ে পৌঁছে গেলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৫০০ ফুট উচ্চতায়  গ্যাংটক শহরে  ৷ যতই শহরে প্রবেশ করছি রবি ঠাকুরের কবিতা ‘একটি শিশির বিন্দু’ মনকে আন্দোলিত করছিল ক্রমশ ৷ ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে / দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা /দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু / দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া /ঘর হ 'তে শুধু দুই পা ফেলিয়া /একটি ধানের শিষের উপরে / একটি শিশির বিন্দু ।’

নিজের মনকে নিজেই ধিক্কার দিলাম অবলীলায় ৷ অনর্থক কত টাকা অপচয় করেছি ৷ অজানাকে জানার,  অদেখাকে দেখার জন্য ঘর থেকে বের না হলে কি চলে! সৃষ্টিকর্তার  অপরুপ সৃষ্টি,  অপার করুনা দেখবার সুযোগ হল বলেই তো আজ আসতে পারলাম গ্যাংটক শহরে ৷ মূহুর্তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম কল্পনার সাগরে ৷ মিলিয়ে নিচ্ছিলাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি দক্ষিন এশিয়ার দেশ নেপালের সাথে ৷ চারদিকে এমনই পাহাড় নেপালেও ৷ সরকারি সফরে মন্দিরের শহর কাঠমন্ডুতে অবস্থান করেছিলাম ২০০৭ সালে ৷ গ্রুপ ট্রিপ ৷ সিনিয়র অফিসার আমি-সহ আরেকজন, আর জুনিয়র অফিসার ৮ জন ৷ অন্নপূর্ণার কোল ঘেষা দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় শহর পোখারাতেও গিয়েছিলাম ৷ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭৫০০ ফুট ওপরে অবস্থিত নাগরকোট যেন স্বর্গেরই আরেক নাম ৷ পোখারায় দেখেছিলাম ‘ডেভিস ফলস’৷ ১০০ ফুট গভীর আর ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ঐতিহাসিক জলপ্রপাত ৷ কথিত আছে ১৯৬১ সালে ডেভিস নামে একজন সুইস পর্যটক জলপ্রপাতটিকে দেখতে এলে তিনি সেখানে পড়ে যান, বেশ কয়েকদিন পর উদ্ধার হন তিনি ৷ তারই নামানুসারে এর নাম ‘ডেভিস ফল ৷’ ভাবের ঘোর কাটে ছেলের আহ্বানে ৷ আম্মু নামবে না,  আমাদের এখানেই নামতে হবে এখন ৷ ছেলে শিলিগুড়িতে কয়েকটা কমলালেবু কিনে দিয়েছিল ৷ কয়েকটা খেলাম ৷ মেয়ে আর পারুকে দিলাম ৷ তারপরেও কয়েকটা থেকে গেল ৷ কোল থেকে অসাবধানতা বশত নীচে পড়ে যায় ৷ ছেলেকে তুলে নিতে বললাম ৷ তাড়াহুড়ো করে নেমে গেলাম ৷ কমলাগুলো বাসের ফ্লোরে এধার ওধার করবে অবশেষে ৷ কেউ চাইলে খেয়ে নেবে নয়তো ফেলে দেবে ৷

হোটেলের কাছেই বাস দাঁড়াল ৷ এই সময়ে দীর্ঘ জার্নির পর হোটেল খোঁজার ধৈর্য নেই ৷ সামনে যেটা পাওয়া গেল সেটাতেই প্রবেশ করা হল ৷ ছেলে বললো তোমরা অপেক্ষা কর, আমি ভেতরের অবস্থা দেখে আসি ৷ সমস্যা হলে আগামীকাল বদলানোর চিন্তা করা যাবে ৷ ছেলে দেখে এসে আস্বস্ত করল ৷ অবশেষ ময়ুর হোটেলে রাত্রিযাপন করা হল ৷ হোটেলের জানালায় বিশাল কাঁচ আর কাঠ ৷ আছি দোতালায় ৷ ঘরে একটা বড় ওয়াল ফিটিং খাট, আলমিরা, সিঙ্গেল সোফা,  বেড সাইড টেবিল দুপাশে দুটো,  লম্বা টেবিলের উপর এলইডি টিভি,  ট্রেতে পানির জগ, গ্লাস রাখা আছে ৷ আলমিরার ভিতর আরো অতিরিক্ত দু 'টো কম্বল রাখা আছে ৷ টিভি দেখে মনটা ভালো হয়ে উঠল ৷ ভাবলাম জি বাংলায় পছন্দের সিরিয়াল দেখা যাবে ৷ হোটেল বয়ের সাহায্য নিলাম  জি বাংলা দেখার জন্য ৷ প্রশ্নোত্তরে জানা গেল জি বাংলা চালুর ব্যবস্থা নেই তাদের ৷ বাংলাদেশ তো তারা দেখেই না ৷ হতাশ হয়ে গেলাম ৷ ভাবলাম এরা তো বাংলাভাষী নয়,  বাংলায় সিরিয়াল দেখবে কেন? যাহোক বাথরুমে গিজার, গরমপানি, হ্যান্ড শাওয়ার সব ব্যবস্থা দেখে মোটামুটি আশ্বস্ত হলাম, যে ক 'দিন থাকব, টিভি ছাড়া ভালোভাবেই থাকা যাবে ৷ আসার পথে ওয়াশরুমে পানি ব্যবহারের যে কষ্ট তা লাঘব হলো ৷ আমরা যে হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এর থেকে অন্তত ৫০০০ ফিট নিচেও বসতি আছে ৷ দূর পাহাড়ে দৃশ্যমান আলোয় মনে হচ্ছে এখানকার মানুষ সন্ধ্যার আকাশে তারার সাথে সখ্যতা করে ৷ মেঘের ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় ৷ আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে পাহাড় ৷ বিদ্যুতিক আলোয় ঝলমলে বাড়িগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে ৷ ঠাণ্ডা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির মত কুয়াশা ঝরছিল ৷  যখন গাড়িটা এই রাস্তায় উঠছিল কানের ভিতরটা পটপট করছিল ৷ বারবার আঙ্গুল দিয়ে পরখ করছিলাম কানটা ৷ রাতের খাবার, নামাজ শেষে সেদিনের মত ঘুমিয়ে গেলাম ৷

রৌদ্র ঝিলমিল আকাশ ৷ ভোরের মনকাড়া দৃশ্যটা অপরুপ ৷ পাহাড় আর মেঘের লুকোচুরি অনন্য! কখনো এমন   দৃশ্য  দেখতে পাব ভাবিনি ৷ যাক ছেলে, বৌমার অছিলায় আমি, আমার মেয়ে বিদেশ দেখছি, উপভোগ করছি—এ কম কি ? প্রকৃতিপ্রেমিদের জন্য গ্যাংটক উত্তম শহর ৷ গ্যাংটক ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিমের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর ৷ পূর্ব হিমালয় পর্বত শ্রেনীর শিবালিক পর্বতে ১৪৩৭ মিটার উচ্চতায় গ্যাংটকের অবস্থান ৷ ১৮৪০ সালে এনচে মঠ নির্মানের পর থেকেই বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসাবে গ্যাংটকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে ৷ ১৮৯৪ সালে তৎকালীন সিকিম রাজা খুতোব নামগিয়াল গ্যাংটককে রাজধানীতে রূপান্তর করেন ৷ বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে তিব্বতের নাসা ও কলকাতার মধ্যে বানিজ্যপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্রামস্থলে পরিনত হয় গ্যাংটক ৷ ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর সিকিম ভারতে যোগ না দিয়ে স্বাধীন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসত্বা বেছে নেয় ৷ গ্যাংটক ছিল এই স্বাধীনভূমির রাজধানী ৷ পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে যোগ দিলে ভারতের ২২তম রাজধানী শহরে পরিনত হয় গ্যাংটক ৷ এখানে যে কোনো সময় তাপমাত্রা ১৫ থেকে ০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা মাইনাসে নেমে আসে ৷ প্রতিবছর গড়ে ১৫০ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় ৷  শহরটির অধিকাংশ লোকই নেপালি, লোপচা ও ভুটিয়া ৷ ওদের চেহারাতেও অনেক সাদৃশ্য ৷ ছেলে— মেয়েরা প্যান্ট, শার্টেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে ৷ একটু বয়সী নারীরা ঢোলা প্লাজুর উপরে ছোট চাদর পরিধান করে ৷

পরদিন হোটেল ময়ুরের নিচতলায় ক্যাফেতে সকালের নাস্তা সেরে নেয়ার জন্য সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে হলো ৷ দোতলা থেকে নিচে নামা খুব একটা কষ্টকর নয় ৷ সকাল ৮ টার আগে ডাইনিং খোলা হয় না ৷ গ্যাংটকে যখন  সকাল ৮ টা তখন আমাদের দেশে সকাল সাড়ে আটটা ৷ আধা ঘন্টা সময়ের হেরফের ৷ ছেলে মেনু চার্ট দেখে আমরা কে কি খেতে চাই জেনে খাবারের অর্ডার দিল ৷ সকলেই একমতে উপনীত হলাম গতকাল যা খেয়েছি আজো তাই খাব ৷  ডাইনিং—এ আমরাই শুধু খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি ৷ নাস্তা সেরে এপথেই আমরা বাইরে যাব ৷ বাইরে বের হবে এ প্রস্তুতি নিয়ে ছেলের বৌ পারু আমার রুমে প্রবেশ করল ৷ আমি তখন কাঁচের জানালা দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছি ৷ আমার জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ, আবাস সুন্দর দেখা যায় এই আক্ষেপ নিয়ে ও ছবি তোলার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত ৷ আমরা এত উপরে আছি চিন্তাই করা যায় না ৷ আমাদের উপরেও কত্ত আবাস ! মা,  ঐ দেখ  গাড়ি—বাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে নিচে নামছে ৷ ঐ দেখ ষ্টেডিয়াম, সবাই খেলায় মত্ত !  পিক তুলে আমরা নিচে নেমে গেলাম   ৷  ইতোমধ্যে ছেলের দেয়া অর্ডার অনুয়ায়ী টেবিলে খাবার এসে গেল ৷  আমরা সবাই খাবারে মনোনিবেশ করলাম ৷ তেলে ভাজা ফোলা লুচি ৷ বিশেষ এক ধরনের ষ্টীলের বাটিতে পরিবেশন করা হলো ৷ সাথে আলুর ডাল, আলু পরোটা ৷  উপাদেয় খাবার ৷ সাথে গ্লাসে কুসুম গরম পানি  ৷ আদার সুঘ্রাণ মেশানো চা ৷ দারুন উপভোগ্য ছিল ৷

হোটেলের সন্নিকটে এম,জি (মহাত্না গান্ধী) মার্কেট ৷ ছেলে তার প্রোগ্রাম জানিয়ে দিল আমাদের ৷ যেহেতু গতকাল রাত ১০টার পর আমরা গ্যাংটকে পৌঁছাতে পেরেছি ৷ সিম না পাল্টালে রংপুর বাসায় যোগাযোগ না করে তাদের নিশ্চিন্ত করা জরুরি ৷ সেজন্য আগে এমজি মার্কেটে সিম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাজ শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ৷ আমরা মার্কেটে ঘুরে এটা—ওটার মূল্য যাচাই করছি ৷ মার্কেটটা লম্বাটে অনেকদূর এলাকাজুড়ে ৷ মাঝে ফুলের বাগান ৷ বাগানের চারপাশে বসার হেলনা বেঞ্চ ৷ গান্ধীজীর ম্যুরাল, বাচ্চাদের জন্য হাতচালিত রাইড রয়েছে ৷ মার্কেটে এসে কিছুক্ষনের জন্য রাইডে বাচ্চাদের দিয়ে নিশ্চিন্তে কেনাকাটা করতে পারেন ৷ সব বয়সের নারীরা স্কিন টাইট প্যান্ট, শার্ট, গরম সোয়েটার পরিহিত ৷ লম্বা নারী চোখে পড়েনি ৷ ওখান থেকে ট্যাক্সিতে করে বৌদ্ধ মরচুয়ারিতে গেলাম ৷ পাহাড়, উঁচু— নীচু এ শহরে ট্যাক্সি ব্যতীত চলাচলে কোনো গত্যন্তর নেই ৷ অনেক উঁচুতে মরচুয়ারি ৷ অনেক কষ্টে আমাকে উঠতে হলো ৷ ছেলে একবার বৌমা আরেকবার আমাকে ধরে ধরে নিচে নামায় ৷ ট্যাক্সির ড্রাইভার আমাদের সাইটগুলো দেখাবে ৷ মূল্য পরিশোধে ছেলের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হলো ৷ ট্যাক্সি ঐ পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অপেক্ষায় থাকল। আমরা ঘুরলাম ৷ ছবি তুললাম ৷ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রার্থনা দেখলাম ৷ বৌদ্ধ অনুসারীরা আসছেন একে একে ৷ ভিতরে একটা গমগম আওয়াজ ৷

সেখান থেকে সিকিম রোপ ওয়েতে আরোহন করব আমরা ৷ লাইন দিয়ে টিকেট কাটতে হলো ৷ অপেক্ষার পালা ৷ অনেক কারুকার্য ৷ বিজ্ঞানের বদৌলতে শূন্যে তারে জড়ানো ক্যাবে করে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে যেতে হবে ৷ দু 'টি ক্যাব ৷ ২৪ জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ একসাথে আরোহন করতে পারে ৷ ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে একাধিক ব্যক্তি নিয়োজিত ৷ শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে সবাইকে আরোহনে সাহায্য করছে তারা ৷ সব বয়সী নারী-পুরুষ আরোহন করছে রোপ ওয়েতে ৷ শুধু ক্লিক ক্লিক, ছবি তোলার শব্দ ৷

এরপর Banjhakri Falls দর্শন ৷ বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে অবিশ্রান্ত ধারায় বেয়ে চলেছে ঝর্ণা ৷ ক্লান্তি নেই, কমতি নেই, বিরতি নেই ৷ কী এক অপূর্ব মোহিনী এর চলার গতিতে ৷ ঝম ঝম, ঝম ঝম ৷ মেইন গেইট পেড়িয়ে আমরা যতই এগোই, দেখার আগ্রহ ততই তীব্র হয় ৷ ঝর্ণাধারার সামনে রোপ ঝুলানো ৷ রোপের সাথে কোথাও গোল বেড়ি, কোথাও মই বাঁধা ৷ মাথায় হ্যাট, কোমরে দড়ি বেঁধে পূর্ণ নিরাপত্তা নিয়ে দড়ি অতিক্রম করল কমবয়সী এক ছেলে৷ বয়স কম বলে ওরাই পারে হাসতে হাসতে জীবনের ঝুঁকি নিতে ৷ ইচ্ছে করলে কোনো দর্শনার্থী ভাড়ায় বর—বধুর পোশাক নিয়ে মজা করে ঝর্ণার কোল ঘেসে ছবি তুলতে পারে ৷ সবুজ পানির চৌবাচ্চায় পা চালিত নৌকায় ঘুরে ঘুরে খানিকক্ষন মজা নেয়া যায় অনায়াসে৷ ভুলে থাকা যায় ব্যর্থতার শোক ৷ বৃহদাকার পাথরে আছড়ে পড়ছে পানি ৷ গড়িয়ে পড়ছে উপর থেকে নিচে আরো গভীরে , মিশে যাচ্ছে নদীতে ৷ ড্রাইভার আমার ছেলের সাথে একটা কথাবার্তা বলতে বলতে একটা সময় বলল তারা গ্যাংটকে খুব ভালো আছে ৷ এদেশে হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, মুসলিম বলে কোনো কথা নেই ৷ যে কোনো ধর্মাবলম্বীর মানুষ এখানে শান্তিতে সহাবস্থান করতে পারে ৷

পরদিন Butterfly Falls,  Naga Falls,  Bhewma Falls দর্শন শেষে ১২৬ কিমি অতিক্রম করে ৯৬০০ ফুট উচ্চতার লাচুং শহরে প্রবেশ করব এই উদ্দেশ্যে আমাদের পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়া শেষ ৷ লাচুং উত্তর সিকিমের অন্তর্ভূক্ত ৷ সিকিমের চার জেলার মধ্যে উত্তর সিকিম আয়তনের দিক থেকে বড় কিন্তু জনসংখ্যায় ছোট ৷ হিমালয় পর্বতমালার অবর্ণনীয় ও নাটকীয় দৃশ্য দেখার জন্য উত্তর সিকিম তুলনাহীন ৷ অনেক উচ্চতায়,  অসংখ্য লেক,  হাজারো ঝর্ণার একত্রে বাস এখানে ৷ Blue Sky ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে হোটেল, ভেহিকেল ভাড়া করা হয়েছিল ৷ পথে কয়েকবার পুলিশ দরবারে ট্রাভেল এজেন্সির পারমিশন আছে কিনা তা পরীক্ষা করাতে হয়েছে ৷ সমস্ত পাহাড় জুড়ে ছোট ছোট অসংখ্য ওয়াটার ফলস  সজীব করে রাখে পাহাড়ের গাছপালাগুলোকে ৷ এত বড় পাহাড়ে কাক দেখিনি ৷ খুব বেশি পাখি চোখে পড়েনি ৷ চার 'শ— পাঁচ 'শ ফুট উপর থেকে খাড়া নিচের দিকে নেমে আসা ঝর্না দেখতে দেখতে আমরা গন্তব্যে চলছি ৷ ক্রমশ  অবাক হই যখন ঝর্নার পানি আছড়ে পড়ে পাথরে, তৈরি হয় ফেনায়িত মেঘ ৷ মেঘের পরে রোদের ঝিলিক, অসাধারণ রংধনুর মিলনমেলা ৷ এ এক নৈসর্গিক দৃশ্য ! পথে যেতে যেতে দেখেছি Use me লেখা ময়লা ফেরার বাস্কেট ৷ কোথাও টিনের,  কোথাও প্লাস্টিকের, কোথাও বাঁশ নির্মিত ৷ আছে অসংখ্য মাইলস্টোন ৷ তাতে লেখা নানা ধরনের তথ্য বা নির্দেশিকা ৷ ‘If married divorce speed’ তার মধ্যে অন্যতম ৷ পথে মাঝে মধ্যে বড় বড় লোমওয়ালা ' ইয়াক ' নামের গরুগুলো চোখে পড়েছে ৷ ওরা জাতিতে মনে হয় হিংস্র নয়, কতগুলো ছেড়ে দেয়া ৷ রাস্তায় শুয়ে, বসে আছে ৷ কখনো মুখ ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছে ৷ কতকগুলোর পিছনে মালিক থাকে ৷ গাড়ি গাড়ি দর্শনার্থী আসছে ৷ একসাথে গাড়িগুলো যেভাবে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল বরযাত্রীর গাড়ি সারিবেঁধে চলছে ৷ উঁচু—নিচু পথ বেয়ে ছুটে চলছে গাড়ি ৷ গাড়িগুলো যখন উপরে উঠছে নিচ থেকে বা উপর থেকে নিচে অনেক ছোট মনে হয় ৷ ১২০০০ ফিট উঁচু পাথরের পাহাড় বেয়ে চলা গাড়ি থেকে নিচে তাকালে জানে দম আছে কিনা সন্দেহ হয় ৷ উত্তর সিকিমের দুটো উপত্যকা ও দুটো নদীর সংযোগস্থল চুংথাং ৷ লেচাংচু নদী ও লাচেনচু নদী মিলে এর নাম হয়েছে তিস্তা ৷

হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল ৷ আরো অনেক গাড়ি দাঁড়ানো ৷ Site seeing পর্ব বুঝতে দেড়ি হলো না ৷  চা কফি পান করার ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে ৷ প্রয়োজনে ওয়াশরুম ব্যবহার করা যেতে পারে ৷ ছেলের প্রস্তাবে রেলিং—এ হেলান দিয়ে রিলাক্সমুডে কফি পান করলাম ৷ বেশ মজা লাগছিল ৷ নীচে বিশাল গভীরতা ৷ স্থির জলধারা ৷ প্রশ্ন করতেই ছেলের জবাব তিস্তা নদীর প্রবহমান জলধারায় বাধ সৃষ্টি করে জলবিদ্যুত প্রকল্পের মধ্যে একটির কাছে আমরা দাঁড়িয়ে এখন ৷ নিমেষে  আমার মাথায় বিদ্যুত খেলে  গেল ৷ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে প্রশ্নের উদ্ভব হয় তিস্তার উৎস কোথায় তাহলে? ভূগোল বিষয় পড়েছি আবার ভুলেও গেছি ৷ চাকরিকালীন জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় নদীর বিষয়গুলো অনেক শুনেছি ৷ পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তার বক্তব্যে অনেকবার খরা আর বর্ষার মৌসুমে তিস্তার পানি নিয়ে অনেক কথা উচ্চারণ করতেন ৷ অনেক সমস্যা তুলে ধরতেন ৷  তিস্তার উৎসমুখ ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে ৷ আমাদের দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাস নদীটিতে জলের প্রবাহ থাকে না ৷ বিষয়টি স্পর্শকাতর বটে! তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে পৌছাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ৷ তবে এই দু’পক্ষের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ৷ তাদের জবাব তিস্তায় পানি নেই কাজেই বন্টন কিসের? তাহলে পানি যায় কোথায়? পানি তো আর বাষ্প হয়ে উড়ে যায় না ৷ নিশ্চয়ই কোনো একটা পদ্ধতিতে পানি প্রবাহে বাধা দেয়া হয় ৷ তিস্তার প্রবহমান জলধারার গতিকে বাধাপ্রদান করে জলবিদ্যুত প্রকল্প পরিচালনা করা হচ্ছে ৷ ছোট বড় মিলে ২৯টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে ৷ এসব প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমান ৪,৪০০ মেগাওয়াট ৷ ফলে তিস্তা তার স্বাভাবিক জলপ্রবাহ হারিয়ে ফেলেছে ৷ কারণ উজানে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ড্যাম দিয়ে জল আটকে রাখা হয়েছে ৷ সেখানে জলবিদ্যুত প্রকল্প চালু রয়েছে ৷ তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গের ৩ টি জেলার মাত্র ৯ টি থানার ১২ হাজার বর্গ কিলোমিটার অববাহিকা এলাকার ১০ লাখ লোক উপকৃত হয়ে থাকে ৷ অথচ বাংলাদেশে  ৮ জেলার ২৫ টি উপজেলার ২০—২২ হাজার বর্গ কিলোমিটার অববাহিকা এলাকার প্রায় দেড়কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়ে থাকে ৷ এছাড়া বাংলাদেশে তিস্তা প্রকল্পের মতো বৃহদাকার সেচ প্রকল্পও রয়েছে সম্পূর্ন তিস্তার উপর নির্ভর করে ৷ পানি না পেলে এই প্রকল্প ১০০ ভাগ মুখ থুবড়ে পড়বে ৷ পথ চলতে চলতে যে পরিস্থিতিতেই থাকিনা কেন আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে চলা যায় না বলেই ভাবিয়ে তোলে আমাদের ৷ ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভাবনা আসে৷ পরিবেশ, প্রতিবেশ রক্ষার্থে আমরা কি করছি ৷ বোধগম্য হলো ছেলে আমার গ্যাংটক আসার পূর্বে ভালোভাবেই সব স্টাডি করেছে।

রাত আটটা নাগাদ চীন বর্ডারের কাছে আমরা লাচুং পৌঁছালাম ৷ লাচুং শব্দের অর্থ ছোট পর্বত ৷  আর্মি ক্যাম্পের পাশেই আমাদের হোটেল The Dogra Inn৷  গাড়ির মধ্যে ঠাণ্ডা ততটা অনুভব হচ্ছিল না ৷ স্বাভাবিক গরম কাপড়ে ঠিক ছিল ৷ কিন্তু নামার পর বোঝা গেল ঠাণ্ডা কাকে বলে ৷ হোটেল ঘরে লেপ, কম্বল, পানির জগ, গ্লাস, বাথরুমে গিজারের , হাই কমোডের ব্যবস্থা আছে ৷ হ্যান্ড শাওয়ার নেই ৷ পানি ব্যবহারে বিড়ম্বনা পোহাতে হল ৷ হোটেলে কয়েকবার চা পান করতে দেয়া হল ৷ ঠান্ডায় হাত বের করে চা নেব— দু: সাধ্য ৷ রাত যতই বাড়ছে ঠান্ডা আরো জেঁকে বসছে ৷ রীতিমত কাবু হয়ে গেলাম ৷ ছেলেকে বললাম আব্বু আর বাঁচিনা ৷ এ জায়গায় তুমি কেন এলে! লেপ, কম্বল কিছুই কাজে আসছে না ৷ দেখতো রুম হিটার পাওয়া যায় কিনা ৷ হোটেল থেকে সাপ্লাই পাওয়া গেল ৷ অন পেমেন্টে ৷ যাক তবুও—তো বাঁচা গেল ৷ রাতের খাবার খেতে হবে ৷ পাশেই ডাইনিং রুম ৷ আমরা যে রুমে আছি তার সাথে নয় ৷ রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে কয়েক কদম হেঁটে আবার সিড়ি দিয়ে নীচে নামতে হবে ৷ ঠাণ্ডায় মনে হচ্ছিল না খেয়ে রাত পার করে দি ৷ কিন্তু ক্ষুধা বলে কথা ৷ কাঁপতে কাঁপতে গেলাম খেতে ৷ হোটেলের অন্য বোর্ডাররা খাচ্ছে ৷ আমরাও খেলাম ৷ সেল্ফ সার্ভিস ৷ বয়লার মুরগীর মাংস, সবজী, ডাল ৷ খেয়ে এঁটো থালা একটা বড় বাস্কেটে রেখে রুমে গেলাম ৷ ঠান্ডায় কাঁপছি রীতিমত ৷ আমার ছেলেই সাহায্য করলো রুমে আসার পথে ৷ প্রতিদিনকার মত রাতে প্রেসারের ঔষধ খেয়েছি কিনা ছেলে খোঁজ নিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে পাশেই ওর রুমে চলে গেল ৷

আমরা যে গাড়িতে লাচুং গিয়েছি সে গাড়ি হোটেলের সামনেই পার্ক করানো ছিল ৷ ড্রাইভার সিরিং ওখানেই অবস্থান করেছিল ৷ সকালবেলা ঠিক সময়মত ও গাড়ি ধুয়ে—মুছে আমাদের নেবার জন্য প্রস্তুত ৷

রাতের বেলা আশেপাশের সৌন্দর্য বোঝা যাচ্ছিল না ৷ শুধু কানে আসছিল সমুদ্রের গর্জনের মত ঝর্ণাধারার শব্দ ৷ ভোর বেলা বারান্দায় বের হয়ে প্রকৃতির যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য মনে হচ্ছিল আমি যদি চিত্রশিল্পী হতাম ছবি পটে এঁকে মনের দুয়ারে চির অম্লান করে রাখতাম ৷ কিন্তু বিধি বাম আমি যে চিত্রশিল্পী নই ৷ পরে জেনে নিয়েছি লাচুং একসময় তিব্বতের অংশ ছিল ৷ ১৯৫০ সালে অধিকৃত হওয়ার আগে ছিল তিব্বত ও সিকিমের বাণিজ্য পরিচালনার কেন্দ্র ৷ পরে বন্ধ হয়ে যায় ৷ সম্প্রতি ভারত সরকার লাচুং টুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ায় এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো ৷ এখানে প্রতিটি পর্বতচূড়া বরফে ঢাকা থাকে সবসময় ৷ এখানে প্রবাহিত নদীগুলো কখনো শান্ত, কখনো হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর ৷

ড্রাইভারকে বলা আছে আমরা ঠিক ৬টা ৩০ মিনিটে জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হব ৷ লাচুং থেকে জিরো পয়েন্ট ৫৯ কিলোমিটার ৷ মাঝে মাঝে রাস্তার ছালবাকল উঠে গেছে ৷ যেভাবে গাড়ি বাঁক নেয় তাতে করে সোজা হয়ে বসে থাকাও কষ্টকর ৷ এপাশে দুলছি, ওপাশে যাচ্ছি ৷ আমার পাশে মেয়ে, ছেলের বৌ ৷ ওরাও দোলে ৷ যাবার সময় নাস্তা করে গেলে দেড়ি হবে জন্য আমরা পথে ইয়ামথাম ভ্যালির ( ১২,০০০ ফুট) উপত্যকায় নাস্তা সেরে নিলাম ৷ নারী চালিত দোকান ৷ গ্যাসের চুলায় খাবার রান্না হচ্ছে ৷ পাইপ দিয়ে ঝর্ণার পানি এসে জমছে বড় বালতি, গামলায় ৷ তাই দিয়ে থালা— বাসন ধোয়ার কাজ হচ্ছে ৷ ঘরে খড়ির চুল্লিও জ্বলছে ৷ পাইপ দিয়ে ধোঁয়া ঘরের চালের বাইরে ৷ শীতে হাত গরম করে নিলাম একটু ৷ সময় নেই, তাড়াহুড়ো করতে হলো ৷ দোকানি খাবার দিচ্ছে একহাতে ৷ পেটে ক্ষুধা ৷ ভালোমন্দ চিন্তা করলেই মুস্কিল ৷ পরিষ্কার হাতে, পরিচ্ছন্ন জায়গায় খেতে পাচ্ছি এই-বা মন্দ কি  ৷ রান্না করা  ম্যাগি নড্যুলস বাটি ভর্তি করে পরিবেশন করলেন দোকানি ৷ গরম পাউরুটি জেলি মেখে খেয়ে নিলাম সবাই ৷ সাথে গরম চা ৷ অন্যপাশে  পশমী বস্ত্রাদি বিক্রির জন্য মেলে ধরা আছে ৷  কেউ কিনতে চাইলে নারী বিক্রেতা বিক্রিও করছে ৷ আমাদের ড্রাইভার সিরিং ওদের সাথে এমনভাবে মিশে যেয়ে ওদের ভাষায় আলাপচারিতা করছে মনে হচ্ছে হয় ওরা ওর পরম আত্নীয় নয়তো অনেক দিনের পরিচিত ৷

আমরা জিরো পয়েন্টে ০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় শরীর রক্ষার জন্য যাবতীয় সতর্ক ব্যবস্থায় ইয়ামথাম ভ্যালি থেকে পুনরায় যাত্রা করলাম ৷ যাত্রার প্রাক্কালেই ছেলে হোটেল ডগরা ইন থেকে হাত মোজা,  টুপি, সোয়েটার ভাড়ায় নিয়েছিল ৷ অধিক সতর্কতার জন্য দোকান থেকে ভাড়ায় নেয়া বুট জুতা, হাত মোজা,  মাথার দেয়ার জন্য উলেন টুপি অর্থাৎ যার যা দরকার নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করা হলো ৷ দু 'চোখ ভরে উপভোগ করছি প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মনে মনে স্মরণ করছি স্রষ্টাকে ৷ এখানে অকৃপণভাবে এত সম্পদ  দিয়েছ খোদা ৷ বৃহদাকার লাল পাথরের বিছানা ৷ সফেদ জমানো বরফের কোল ঘেঁসে ঝর্ণাধারা ৷ পাহাড়ে মেঘ জমে আছে ৷ সূর্যের আলোকচ্ছটা পাহাড়ের চূড়ায় ৷ কত ধরনের গাছ গাছালি— পাইনসহ অন্যান্য গাছের বিচিত্রতা মনে দাগ কাটে ৷ উপত্যকা জুড়ে বন্য হলুদ এবং প্রিমুলাস,  বিভিন্ন রডোডেনড্রন ৷ বরফে ঢাকা পর্বতগুলো চারিদিক থেকে মনে হচ্ছে রাঙানো সুউচ্চ উপত্যকা ৷ তিস্তা নদীর একটা প্রবাহ এই উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলেছে ৷  পথে যেতে দেখছি রাস্তা মেরামতের কাজ মেয়েরা করছে ৷ রোড লাইনারে বর্ডার দিচ্ছে মেয়েরা ৷ নারী—পুরুষের  পোশাক একই রকম ৷ শীত ওদের কাবু করতে পারেনি ৷ পথিমধ্যে দু 'একটি গাড়ি থেকে পর্যটকরা নেমে ছবি তুলছেন ৷ আমরা সবাই চলছি একই গন্তব্যে কেউ কাউকে চিনিনা ৷

আমরা সুরক্ষিতভাবেই জিরো পয়েন্টে পৌঁছালাম ৷ পাহাড় ঘুরে ঘুরে১১ টার দিকে ওখানে পৌঁছে গেলাম ৷ ভুপৃষ্ঠ থেকে ১৫৫৬০ ফিট উপরে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি ৷ নেমেই মাথা ঘুরছে ৷ ঠাণ্ডা লাগছে প্রচণ্ড ৷ নিঃশ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছিল ৷ হেলনা বেঞ্চে খানিকক্ষন বসে থেকে ভালো লাগছে না বলে গাড়িতে যেয়ে বসলাম ৷ মাথাটা হেলান দিয়ে রিলাক্স করে বসলাম ৷ একটুপর কিছুটা সুস্থতা বোধ হলো ৷ ছেলেকে বললাম চলো এবার ৷ ও জমানো বরফ পরখ করে দেখছে ৷ বয়ে যাওয়া উপরের পানি জমে গেছে ৷ নিচের পানি জমেনি কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডা ৷ ওর ও খারাপ লাগছিল কিন্তু টগবগে রক্ত ওয়ালা শরীর ৷ এসব ছোটখাট সমস্যা থোরাই কেয়ার করে না সে ৷ আম্মু খারাপ লাগছে? চা /কফি খাবে?  সিদ্ধ ডিম বা অন্য কিছু? খাও ভালো লাগবে ৷ ইত্যাকার কথায় আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সিদ্ধ ডিম আর কফি নিয়ে এলো ৷ সবাই খেলাম ৷ একটু ভালো লাগছিল তারপর ৷ আবার আমরা একই পথ ধরে ফেরত আসছি ৷ আসার সময় পাহাড়ের শীর্ষে সূর্যের আলো পৌঁছায় নাই ৷ সাদা বরফ কুচিগুলো সারা পাহাড় বিছানো ৷ আসার পথে সূর্যের আলোয় চকচক করছে তুলোর মত বরফকুচি ৷ ঘন্টাখানিক পর পৌঁছালাম ইয়ামথাম ভ্যালিতে ৷

ইয়ামথাম ভ্যালিতে শাড়ি পরিহিত নারী দেখে ভাবলাম হয় বাংলাদেশি নয়তো ভারতীয় হবেন ৷ ওনাদের প্রশ্নে বুঝতে পারলাম ওনারা ওয়াশরুম খুঁজছেন ৷ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি ৷ আমি বললাম রংপুর থেকে ৷ আমিও জানতে চাইলাম, ‘আপনি?’ উনি উত্তরে বললেন, ‘ঢাকা থেকে ৷’ এই মূহুর্তে আর এর বেশি কিছু জানার তাগিদ মনে করিনি ৷ কারণ উনি স্বাস্থ্যগত কারণে খুব চাপে আছেন ৷ যেখান থেকে আমি নিজেও ক্ষনিক আগে বিড়ম্বনা নিয়ে ফেরত এলাম ৷ ওয়াশরুম ব্যবহার করার জন্য সার্ভিস চার্জ নেয়া হচ্ছে অথচ সেটার অবস্থা বড়ই নাজুক ৷ ময়লা পানি মেঝের উপরে উঠে এসেছে ৷ পানি মাড়িয়ে কমোড ব্যবহার করতে হবে ৷ কমোড ব্যবহারের পর আর পানি সরবরাহ নেই ৷ মানে হ্যান্ড শাওয়ার বিকল ৷

গ্যাংটক থেকে ২৭— ১১— ১৯ তারিখ দেশে ফিরব সে উদ্দেশ্যে রওনা হব বলে মনস্থির করেছি ৷ সকালের নাস্তা সেরে আমরা ছাঙ্গুলেক ১২,২১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট, গ্যাংটক থেকে ৪০ কিমি দূরে ৷ সাঙ্গুলেক পূর্ব সিকিমের অন্তর্ভূক্ত ৷  তা দেখার উদ্দেশ্যে বের হলাম ৷ না দেখে তো কোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়না ৷ ছেলে আগের রাতেই পাসপোর্ট সহকারে পারমিশন সংক্রান্ত যাবতীয় ফর্মালিটিজ করে রেখেছিল ৷ ওর কথামত জানলাম ড্রাইভার ঠিক ৯ টায় গাড়ি নিয়ে হোটেলের কাছে রেডি থাকবে ৷ আমাদের সাথে একজন গাইড দেয়া হবে ৷ গাইড ব্যতীত সাঙ্গুলেকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়না ৷ সময় সম্পর্কে আমরা ঠিক থাকব এই কথাতেই আমরা সবাই ঠিক ছিলাম ৷ সকালের নাস্তা হোটেল ময়ুর সংলগ্ন রেস্তোরায় খাওয়া হল ৷ গাড়ি, ড্রাইভার রেডি ৷ সময় সম্পর্কে বেশ সচেতন ওরা ৷ ট্রাফিক সমস্যার কারণে ৩০০ গজ হাঁটতে হলো আমাকে ৷ মেয়ে আর আমি হাঁটছি ৷ বাম পা—টা উঁচু—নিচু রাস্তায় পড়তেই আর যায় কোথায়—আমি শেষ ৷ প্রচণ্ড চোট পেলাম ৷ সেরেছে—এবার বেড়ানোর সব মতলব মাটি ৷ কষ্টে একটু উহ্ আহ্ এমনিতেই বের হলো ৷ আমার পৌঁছাতে দেড়ি হচ্ছে জন্য ছেলে এগিয়ে এসে দেখে আমার এই অবস্থা ৷ পরে ও ধরে ধরে হেঁটে নিয়ে গেল ৷

মাঝে মধ্যে গাড়ি থামছে ৷ পরে জানলাম একই ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে চারটা গাড়ির জন্য একজন গাইড দেয়া হয়েছে ৷ দুই জায়গায় চেকিং হলো ৷ আমাদের গাড়ি অন্যান্য আরো গাড়ি সব একসাথে উপরে উঠছে তো উঠছেই ৷ জায়গায় ফ্রেস হওয়ার সুবিধা রয়েছে ৷ ইচ্ছেমত সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার রওনা দেয়া যায় ৷ ৩৫ কিমি দূরত্বের মাঝামাঝি অবস্থানে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল ৷ অনেকেই নামছে ৷ আমরাও নামলাম ৷ বিশেষত্ব হলো সাদা মেঘ পাহাড় ছুঁয়ে গেছে ৷ আমরা মেঘে ভাসছি ৷ ক্লিক ক্লিক—অনেক ছবি তোলা হলো ৷ এবারে আর থামাথামি নেই একবারে ছাঙ্গু লেক ৷ ঠাণ্ডা বাতাস ৷ রৌদ্রজ্জ্বল সকাল কিন্তু ঠাণ্ডা বাতাস প্রবহমান ৷ নাক—মুখ বন্ধ হয়ে আসছে ৷ চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত মাঝখানে নীল স্থির পানি—এরই নাম ছাঙ্গু লেক ৷ রাস্তার পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে  ' ইয়াক '—গুলোকে ৷ বিরাট বড় শিং—লাল রংয়ের উল দিয়ে বানানো নেট দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে শিং দু 'টোকে  ৷ শরীরের লম্বা লম্বা লোম গুলো সাবান/ শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে ঝরঝরে থাকে সেজন্য ওদের মালিক বাব় বাব় ওদের শরীর চিরুনী গিয়ে আচড়িয়ে ঠিকঠাক রাখছে ৷ অনেকেই দামদর ঠিক করে ওর পিঠে আরোহন করে রাস্তার এপ্রান্ত ওপ্রান্ত ঘুরছে ৷ ইয়াকের মালিকরা হিন্দি, স্থানীয় ভাষা বুঝতে ও বলতে পারে বলে কোন অসুবিধা হয়না ৷ রোপ ওয়ে আছে ৷ ইচ্ছেমত অনেকেই উঠছে ৷ পাহাড়ের উপরে উঠে সৌন্দর্য উপভোগ করছে ৷

আমরা ছাঙ্গু লেক থেকে ফিরে এসে আমরা যে হোটেলে এই ৫ দিন অতিবাহিত করলাম ‘হোটেল ময়ুর’ সেখানেই প্রতিদিনকার মত দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিয়ে লাগেজ-সহ ট্যাক্সি করে সোজা ডিওরেলী ষ্ট্যান্ড ৷ গ্যাংটকে ট্যাক্সি, ক্যাব ছাড়া মুভমেন্ট করার কোন উপায় নেই ৷  ট্যাক্সি ড্রাইভার অত্যন্ত সহযোগী ছিল ৷ সে যেতেই যেতেই অনেক জায়গা সম্পর্কে আমাদের বয়ান দিচ্ছিল ৷ আমার ছেলের সাথেই ড্রাইভারের কথা হচ্ছিল ৷ আমি পিছন থেকে শুনছিলাম ৷ ক্যাব গাড়িতে আট জন সুন্দরভাবে বসতেপারে ৷ আমরা যখন গাড়িতে উঠি তখন দামদর ঠিক করেই ওঠা হয়েছে ৷ আমরা ছিলাম চারজন ৷ সে কারণে আরো যাত্রী থাকলে আমাদের চারজনের ওপর চাপ কম পড়ত ৷ কি আর করা ৷ বাড়তি অর্থের চাপ নিয়েই চলছি আমরা ৷ আমি আসছি আর ভাবছি পথে শিলিগুড়িতে আমার হঠাৎ পাওয়া কবি বন্ধু শ্যামলী, কনিকা দাস, মীনা মুখার্জী, শিখা চৌধুরী, দেবযানী সেন ওদের যদি সাক্ষাৎ পেতাম ৷ কি মজাই না হত ৷' হঠাৎ পাওয়া ' এজন্যই বললাম,  এ বছর /২০১৯— র ফেব্রুয়ারিতে নন্দিনী পাঠচক্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ঢাকায়  অনুষ্ঠিত হল ৷ পূর্ব পরিকল্পনামাফিক ভারতীয় কবিদের সাথে বাংলাদেশি কবিরা সিলেট, চট্টগ্রাম ভ্রমনের সুযোগ পাবে ৷ ঢাকা কেন্দ্রিয় নন্দিনী পাঠচক্রের ব্যবস্থাপনায় আমরা দুই বাংলার ১৮ /২০ জন প্রথমত সিলেট, পরে চট্টগ্রাম,  কক্সবাজার গেলাম। একসাথে থাকা, ঘুরে বেড়ানো, কেনাকাটায় সবার মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ৷ এপার—বাংলার কবিদের সাথে গল্পগুজবে হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি যেন ৷ ওপাড়ে যেয়ে তাদেরকেই মনের অজান্তেই বারকয়েক মুখে ওদের নাম উচ্চারণ করলাম ৷ দুর্ভাগ্য ঠিকানা সাথে নেয়া হয়নি ৷ আশা অপূর্ণ থেকে গেল ৷

শিলিগুড়ি থেকে কারযোগে আমরা চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ৷  দেশের মাটি সে—যে সোনার চেয়েও খাঁটি ৷ চারজনের চারটি বড় বড় ব্যাগ দেখে কাস্টমসে জিজ্ঞাসাবাদ ৷ সত্য বচন না যায় খণ্ডন ৷ ব্যাগে গরম কাপড় সব বলেছি ৷ বি ডি আর চেক পোস্টে কুকুর নিয়ে দাঁড়িয়ে অবৈধ মালামাল ধরবার জন্য ৷ মনে মনে ভাবলাম বর্ডারে এত কড়াকড়ি তারপরেও অবৈধ মালামাল আসে কি করে ? পথে আসতে আসতে  আমাদের ড্রাইভারের উত্তরে জানলাম কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে ওপারে—এপারে বাঁশ দিয়ে আপত্তিকর মালামাল পাস করানো হয় ৷ অদ্ভূত বুদ্ধি তো! ওদের দেশে চারদিকে প্রকৃতিগতভাবে সম্পদে ভরপুর ৷ আর আমাদের দেশে মানুষে মানুষ ৷ এই মানুষগুলো যদি শৌর্য—বীর্যে,জ্ঞান— গরিমায় , দক্ষতায় সম্পদ হতে পারত তাহলে আমাদের সোনার বাংলা হতে কতদিন ? আমাদের মাথাপিছু আয়, জিডিপি বেড়েছে ৷ মাদক, সবক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ করতে পারলেই আমরা—ই সেরা ৷ দেশে প্রবেশ করে যখন গাড়িতে ঘরে ফিরছিলাম ছেলে বলল-অনেকদিন বাংলাগান শোনা হয়নি ৷ গাড়ির স্পিকারের সাথে মোবাইল এ্যাডজাস্ট করে গান চালিয়ে দিল ৷ বৌমা পারু বলছে ‘এই ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চলো পলায়ে যাই’ গানটা দিতে ৷ বেড়িয়ে এসে আবার কোথায় পালাতে চায় রে বাবা ৷ ততক্ষনে চারদিকে গা ঢাকা অন্ধকার ৷ আর আমার চোখে ফেলে আসা রাতের আকাশে হাজার তারা ৷ আকাশে হেলান দিয়ে সব বাড়ির বৈদ্যুতিক বাতিগুলো একেকটি তারা ৷ সুউচ্চ আকাশসম পাহাড়ে রাতভর জ্বলে ৷ নিজভূমে রোজ ছাদে উঠে আকাশের বিশালতা দেখি ৷ বিশালত্বের প্রাচুর্যতা নেই, নিরহংকার, তর্জন, গর্জন শূন্যের কোঠায় ৷ আর পাহাড়ের দেশে আকাশ সমান পাহাড ৷  পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকে মেঘ ৷ পাহাড় ভাবে মেঘ—তো আমার ৷ ইচ্ছে হলে মেঘকে বরফ বানিয়ে হিম করবো পাহারের বুক ৷ সূর্য ছড়িয়ে দেবে আলো নিশ্চল, নিশ্চুপ মেঘের বুকে মেঘাকাশে রঙের লুকোচুরি খেলায় হাসবে পাহাড় ৷ কখনো মেঘের ভেলায় বৃষ্টি নেমে পাহাড়কে নাইয়ে দেবে ৷  পাহাড় নেবে স্বস্তি ৷ পাহাড়ের কোল ঘেঁসে সবুজ গাছ ভিজিয়ে পাথরের বুকে আছড়ে পড়বে ঝর্ণাধারা অবিরাম গতিতে ৷ আমি দেখব আকাশসম ভালোবাসার স্বপ্ন ৷ রাতের আকাশে তারার বসতি, দিনের আকাশে মেঘেদের লুকোচুরি ৷

লেখক পরিচিতি: গাইবান্ধা জেলাধীন সুন্দরগঞ্জ থানা লেখিকা নূরুন্নাহার বেগমের জন্মস্থান ৷ বর্তমানে  রংপুর শহরে বসবাস ৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যায় বি,এস- সি( সম্মান ), এম,এ-সি ডিগ্রি অর্জন করেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অধীন জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন ৷ ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি করতেন ৷ অবসর জীবনে ছড়া,কবিতা, প্রবন্ধ ,ছোট গল্প লিখে সময় অতিবাহিত করছেন ৷ তাঁর ‘শব্দেরা কথা বলে’ এবং  ‘নারী অধিকার ও বেগম রোকেয়া’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ৷ যৌথভাবে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা তেত্রিশটির বেশি ৷ স্থানীয়, জাতীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত তার লেখা প্রকাশিত হয় ৷

ওমেন্স নিউজ/