নারী সমাজ তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নয়

সুলতানা রিজিয়া

সুলতানা রিজিয়া
 
নারীকে নিয়ে ভাবতে গেলে, কথা বলতে গেলে কিম্বা লিখতে গেলে এখন আর আগের মতো বুকের মাঝে আবেগের নদী দুলে উঠে না। চোখের দেখা প্রাণের সখার  কাব্যকলাও ফুটে উঠে না। নারী যেনো এই সমাজ, সংসার, সভ্যতা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির জন্য একরকম বিষফোঁড়া। ফলে সর্বত্রই নারী আজ উপেক্ষিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত তথা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার। নারী হাসলে এখন সুখের মুক্তো ফোটে না। আড়ালে আবডালে বলা হয় – কি বেহায়া রে মেয়েটি! নারী সাজলে এখন আর সে অপরূপা হয়ে উঠে না। পেছনে টিপ্পনী কাটা হয়- যে চেহারা ও বয়স তাতে আবার সাজুগুজু!

নারী কাঁদলে কারো মনে দুঃখের পাষান জমেও না। পাশ থেকে বলা হয়- আর কতকাল অভিনয়টা চালিয়ে যাবে! নারী স্বাধীন ভাবে বাঁচার পথ খুঁজতে পথে নামলে, কিম্বা পরিবার কর্তৃক লাঞ্ছনা গঞ্জনা থেকে মুক্তি পেতে গৃহত্যাগ করলে অপেক্ষায় বাতায়ন খোলা থাকে না। তার আপাদমস্তক কলঙ্কের কালিমা মাখিয়ে সংসার নতুন করে সেজে উঠার প্রশ্রয় পায়। নারী আত্মহত্যা করলে কিম্বা অপঘাতে তার মৃত্যু হলে চারপাশ যেনো নিঃশব্দ মুক্তির অক্সিজেনে ভরে উঠে। শুধু তাকে ঘিরে গুজবের ডালপালার আঁধার নামে।

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের পঙক্তিমালা ইদানিং মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। নারীরা যে ঘর সাজায়, বংশের লতিকায় গিট দেয়, সন্তানদের কোলে পিঠে করে মানুষ করে, স্বামীর বিশ্বস্ত প্রেমিকা, প্রেমময় প্রহরীর গুরুদায়িত্ব পালনে উদয়াস্ত পরিশ্রমে সংসার তরণীর গুণটেনে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এর কোনই স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ) হয়না।

সংসারে কন্যাশিশু জন্মের পর বোধবুদ্ধির উন্মেষের সাথে সাথে তার মগজে চাপিয়ে দেয়া হয় এভাবে চলোনা, ওখানে যেও না, এটা ধরো না, ওটা খেয়ো না- এমন হাজারো না – না। বাড়ির নারীরাই কন্যাশিশুদের অন্যতম শিক্ষাগুরু। বাবাদের শাসনে, ভাইদের একচক্ষু উদাসীনতায়, চাচাতো, ফুফাতো, পাড়াতো ভাইদের যৌন হয়রানির নাগপাশ কাটিয়ে অধিকাংশ কন্যাশিশুরা হাতে পায়ে বেড়ে উঠে। তখন তাদের উপর সংসারের ফুট ফরমায়েশের বোঝা দিনে দিনে চাপিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমতঃ সংসারে মাকে সাহায্যের নামে, অতঃপর পরের ঘরে ( শ্বশুরবাড়ি ) গিয়ে যেনো কাজকর্ম করে সংসারে টিকে থাকতে পারে সেটার প্রশিক্ষণ নেওয়া কিশোরির জন্য আবশ্যিক হয়ে উঠে। এটাই নারীর ললাট লিখন।
‘আয় ছলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যায়
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।’
কবির এ আহ্বান কতভাগ শিশুকন্যার কপালে জোটে? নব্বই ভাগ কিশোরী বা নারীর আয়ে এখন সংসার চলে। এর বেশির ভাগ পোশাক শিল্পে, কুটির শিল্পে অথবা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে, মাঠে, ঘাটে,  মানুষের বাড়িতে শ্রমে। নতুবা পরদেশে পাচার হওয়া নারীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ হয়। বিনে পরিশ্রমে তারা ঘরে বসে স্ফূর্তি করতে পারেনা। নারীকে জীবনভর চরম মূল্য দিয়ে সমাজ সংসারে টিকে থাকতে হয়।

নারীর জন্য নির্ভার, নিশ্চিন্ত, সম্মানজনক কর্মস্থল আজও গড়ে উঠেনি। বিবাহিত, সন্তানদের জননী নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে পরিবেশের মতো অবিবাহিত, কুমারী বা তালাকপ্রাপ্ত নারীর পরিবেশ নিরাপদ নয়। পুরুষকর্মীদের কর্তৃত্ববল, অর্থবলের কাছে নারীরা অসহায়, লাঞ্ছিত এবং বঞ্চিত, নিগৃহীত। নারীর কর্মের পরিবেশের পাশাপাশি তাদের কর্মঘন্টা এবং মজুরীর ( প্রাপ্য অর্থ )  বৈষম্যও অমানবিক। পুরুষের তুলনায় নারীর বেতন ভাতা কম। পরিশ্রমের দিকদিয়েও শুভঙ্করের ফাঁকি। পুরুষ শ্রমিকের ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে চা পান, ধূমপানের অবসর- অবকাশ আছে, নারীর বেলায় সুদূরপরাহত। শিশুকে কর্মক্ষেত্রে রাখা, স্তন্যপান করানোর কোন পরিবেশ আজও অনেক প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেনি। অথচ সেই ১৮৫৭ সাল থেকে বেতনভাতার বৈষম্য দূরীকরণ, কর্মের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী, নির্দিষ্ট  কর্মঘন্টার জন্য আজ অবধি নারীদের আন্দোলন বা লড়াই চলে আসছে। প্রতি বছর ৮ মার্চে পালন করা হচ্ছে বিশ্বনারী দিবস।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় -আন্তর্জাাতিক নারীদিবসের সূত্রপাত আমেরিকায় ঘটে যাওয়া এক আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চে নিউইয়র্কের সূতার কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকরা তাদের বেতন বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা আর কাজের বৈরি পরিবেশের বিরুদ্ধ একজোট হন। তাদের এই জোটবদ্ধতাকে নিষ্ক্রয় করার জন্য কারখানার মালিক এবং প্রশাসন তাদেরকে ছত্রভঙ্গের উদ্দেশ্যে দমন – পীড়ন চালায়। নারীর সেই আন্দোলনের  অর্ধশত বছর পরে ১৯০৮ সালে জার্মানিতে ৮ মার্চের দিনটির স্মরণে প্রথম নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর দুই বছর পরে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এই সম্মেলনে ১৭ টি দেশ থেকে প্রায় ১০০ শতজন নারী প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো প্রতি বছরের ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসাবে পালনের প্রস্তাব দেয়া হয়। এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল থেকেই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান করলে বিশ্বব্যাপী দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

নারী আন্দোলনের মূল লক্ষই ছিলো নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, কাজের স্বাস্থসম্মত পরিবেশ তৈরি করা, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা এবং নারী পুরুষের বেতন বৈষম্যের অবসান ঘটানো। আমরা এই দাবিগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে সরে এসেছি। নারীরা কর্মক্ষেত্রে কতটা বিব্রত, নিগৃহীত, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করছে সেটা আমরা অনুসন্ধান করিনা। নারীর প্রতি প্রতিষ্ঠানের বস ( মালিক ), সহকর্মী, পুরুষ শ্রমিক কতটা অমানবিক, বেতন বৈষম্যের পাল্লাটা কতটা ভারসাম্যহীন, নারী কর্মীরা কতভাবে পুরুষদের স্বেচ্ছাচারী যৌন উৎপীড়নের শিকার এবং তাদের হাতের পুতুল সেই দিকগুলোর কোন হিসাব আমাদের হাতে নেই। যাওবা আছে তা কেবলই অনুমানমাত্র। আমরা কোন ভাবেই নারীদের কর্মক্ষেত্রের এমন অনিশ্চয়তা, অসম্ভ্রম, নিপীড়ন এবং নির্যাতনের অলি-গলি চোরাপথের সন্ধান করতে পারিনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগড়ে নিষ্পেষিত নারীরা যতোদিন না সচেতন হবে, সোচ্চার হবে এবং এই আন্দোলনের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে ততোদিন তারা কোন ভাবে সফল হতে পারবে না ।

এখনকার নারী নির্যাতন, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, বঞ্চনার করুণ ইতিহাস কি সেই শত শত বছর পূর্বের আইআয়ে জাহেলিয়াত এর চেয়ে ভালো? আমাদের এই আধুনিক শিক্ষিত সমাজে নারীরা মর্যাদায়, স্বাধীনতায়, চিন্তা ভাবনায়, নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার কি নারী সমাজের আছে? ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিনোদনে সর্বত্রই নারীর স্বকীয়তা ভূলুণ্ঠিত। কর্মক্ষেত্রে কয়জন নারী তার বস-সহ সহকর্মীদের মন জুগিয়ে চলা থেকে নিস্কৃতি পেয়েছেন বা পাচ্ছেন? নারী তাদের কাছে জ্ঞান গরিমায়, শারীরিক শক্তিতে সর্বপরি বেতনের দিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তু। ঘরে যেমন তারা উপেক্ষিত, উৎপীড়িত থাকে তেমনি তারা বাইরেও একই পেরেশানিতে সময় অতিবাহিত করে।

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে সমাজ সংসারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শিল্প বানিজ্যে, সাহিত্য সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া সুস্পষ্ট হলেও, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নগর বন্দরে আধুনিকায়নের চাকচিক্য দৃশ্যমান হলেও নারীর উন্নয়নে, স্বাধীনতায়, নিরাপত্তায়, যথার্থ সম্মানে অংশিদারিত্বে কোন স্বীকৃতি নেই। শিক্ষা দীক্ষায় নারী কতটা এগিয়ে, কর্মক্ষেত্রে নারীর কর্তৃত্ব কতভাগ এবং নারীর সম্মান, সম্ভ্রমের নিরাপত্তা কতটা  সুনিশ্চিত তার কোন রূপরেখা বা নীতিমালা আজও অলিখিত। পথে ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, সংসারে নারীর শ্লীলতা হানীতে প্রশাসনিক আইন প্রণয়ন তথা বিচারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কতটুকু নিশ্চত হয়েছে তার যেমন কোন দলিল নেই তেমনি আইন অমান্যের ফাইনের প্রমাণও নাই। আর সেকারণে নারী আজ একশ্রেণী মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে বিনোদনের ও তামাশার বস্তু। তাইতো নারীর হাসি, নারীর সাজ, নারীর ভালোথাকা, নারীর সৃজনশীলতা এবং স্বাধীন কর্মপরিধিকে নিয়ে কটাক্ষ করা হয়, তুচ্ছাতিতুচ্ছ হিসাবে গন্য করা হয়।

৮ মার্চ কেনো, কি,  সেটাই আগে নারীদের অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। ১৮৫৭ সালের মতো তাদেরও রুখে দাঁড়াতে হবে, দাবী আদায়ে একজোট হতে হবে। সর্বপরি নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে শিক্ষা দীক্ষায় জ্ঞান গরিমায়। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র দিন এখন আর নেই। সামনের লোকে কতটা সম্মান করে, করতে বাধ্য হয় সেটাই মাথায় রাখতে হবে। তাহলেই বিশ্ব নারী দিবসের আন্দোলন, উদ্দেশ্য সফল হবে।
এককে আলোকিত হয়ে কোনই লাভ নেই। বরং সকলের আলোকে সমুন্নত রাখার প্রয়াসেই নারীরা উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ পাবে এবং তাতেই আন্তর্জাতিক বিশ্বনারী দিবসের মর্যাদা সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠবে।

সুলতানা রিজিয়া: কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘নন্দিনী’নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করছেন। এছাড়া তার রয়েছে প্রকাশনা হাউস সম্রাজ্ঞী। তার প্রকাশিত একক গ্রন্থের সংখ্যা ২৩ টি। সাহিত্য ও সাংগঠনিক অবদানের জন্য পেয়েছেন ত্রিশটির বেশি সম্মাননা পদক।

ওমেন্স নিউজ/