বইমেলায় মাটির ভাড়ে চা এবং নতুন বইয়ের স্বাদ

আতাতুর্ক কামাল পাশা

পর পর কয়েকদিন একুশে বইমেলায় গেলাম। বিশেষ করে বিকেলে, সন্ধ্যেয় বইমেলা বেশ গম্ গম্ করতে থাকে জন সমাবেশে। বেশ কয়েকদিনই সব বয়সের মেলাপ্রেমী মানুষের ভিড় দেখলাম।

বইমেলাকে ঘিরে এই জনারণ্যের মাঝে টিন এজদের উপস্থিতিই বেশি। প্রসঙ্গত, ১৩ বছর থেকে ১৯ বছরের ছেলে মেয়েদের টিন বলা হয়ে থাকে। বন্ধু বান্ধবী মিলে লেকের পাড়ে, কখনো বা চারজন তরুণ দু’জন তরুণী (মূলত এরা শিক্ষানবীশ) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকের বইদোকানগুলোর সামনের মাঠে বসে গল্প করছে। দু’জন হয়তো বাদাম চিবাচ্ছে। অনেক বাবা-মা দুই বা তিন ছেলে মেয়েদের বই কিনিয়ে দিয়ে তাদের হাত ধরে নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভেতরও এক যুগল এসে নির্দিষ্ট দোকান থেকে একটি নির্দিষ্ট বই নিয়ে চলে যাচ্ছে, এমন দৃশ্যও সহজেই চোখে পড়ে। মূলত বইমেলা আমাদের এমন একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই ডিজিটালনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার যুগেও কিছু মানুষকে এ আয়োজনটি এখনো মুদ্রণনির্ভর মাধ্যমে ধরে রাখতে পেরেছে। তবে এখনো বলা চলে, রবাহুত যারা আসছেন, তাদের মাঝে অবধূতের সংখ্যা খুব কম নয়।

দেশের সুদূর উত্তরাঞ্চল থেকে আমার এক বন্ধু রহিম আব্দুর রহিম ঢাকা এসেছেন বইমেলাকে উদ্দেশ করে। একসময় তার লেখা কলাম ‘বাংলাদেশ সময়’ দৈনিকের উপসম্পাদকীয়তে অনেক ছাপিয়েছি। তখন এ পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ড. হান্নান ফিরোজ। কলাম বা উপসম্পাদকীয়তে লেখা দেয়ার জন্য আমি কোন টাকা দিতে পারতাম না। তারা বারবার বলতেন, কিন্তু আমি দিতে পারিনি, তবু তাদের কাছে লেখা চাইতাম, তারা রাগ ভুলে গিয়ে আবারো কলাম পাঠাতেন। এমন একজন পুরনো বন্ধু দেশের সর্বোত্তর বিন্দু পঞ্চগড় থেকে ঢাকা এসেছেন আর আমি তার সাথে দেখা করবো না, এমন অসহিষ্ণুতা মেনে নিতে পারিনি বলে মেলায় তার সাথে দেখা করতে এলাম। এবারে মেলায় এসেছে তার নতুন বই ‘গুণ-আদর্শের বরপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ বইটি। মেলার ৩৫৪ নম্বর দোকান অভিযান প্রকাশনীতে পাওয়া যাচ্ছে। বললাম-‘আপনি এলেন, চলেন চা খাওয়াই।’ তিনিই বরং খাওয়াতে চাইলেন। গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তর দিকে। সেখানে মাটির ভাড়ে চা বিক্রি করা হচ্ছে। তবে মাটির ভাড়গুলো সাধারণ মনে হল না। বলা চলে বেশ পুরু আর কিছুটা রুচিপূর্ণ অলংকরণ রয়েছে। আমাদের জন্য উনুনে দু’টো ভাড় (মাটির পেয়ালা) নিয়ে আগুনে (অনেকটা) পুড়িয়ে নিয়ে তা আবার গরম চায়ে পরিস্কার করে সেখানেই চা দেয়া হল। মনে হলো যেন হাইজিনিক বা নির্মল করে নেয়া হলো। চা যে খুব সুস্বাদু এমনটি বলার নেই, তবে নিঃসন্দেহে চায়ের স্বাদ পাওয়া গেল। প্রতি কাপ রাখল চল্লিশ টাকা করে। এবারের মেলায় এটি নতুন সংযোজন মনে হল। আরো একটি নতুন সংযোজন দেখা গেল। এবার লিটিল-ম্যাগ কর্নার সোহরাওয়ার্দী মাঠেই বিশাল এলাকা আলাদা করে এবং ঘিরিয়ে সুন্দরভাবে পৃথক করা হয়েছে। আর আগের বর্ধমান হাউজের পেছনের অংশে এবার স্টল খোলা হয়েছে। নতুন যে লিটিল-ম্যাগ কর্নার সাজানো হয়েছে, সেটিও কিন্তু বেশ সুন্দর, ছিমছাম ও গোছানো হয়েছে।
একাডেমির মূল চত্বরে গেলাম। সন্ধ্যেটি ছিল বৃহস্পতিবার। জিজ্ঞেস করলাম, ক’টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে? তথ্য কেন্দ্রের সেই আগের মোছাঃ সাবিনা ইয়াসমিন জানালেন, আজ ১৩টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এ দিন মেলায় এসেছে ১৩টি নতুন বই। প্রায় তিন সপ্তাহে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ২,৪৬৭টি নতুন বই মেলায় এসেছে। এটি ঠিক, বইমেলার মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নতুন বই আসার সংখ্যা কমে আসে। তবে মেলা চলার চতুর্থ সপ্তাহে এই সংখ্যা সচরাচর বেড়ে যায়। অন্যান্য বছরগুলোতেও এমনটি দেখা গিয়েছে। তবে চতুর্থ সপ্তাহে হঠাৎ বই আসার ঝাঁক বেড়ে যায়। এ সপ্তাহেও কিছু নতুন বই এসেছে। এসবের কিছু বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরা হলো।

Card of the fool
অভিযান প্রকাশনীতে এসেছে নির্জলা প্রকৃতির লেখা ইংরেজি উপন্যাস Card of the fool। বেশ সুন্দর উপন্যাসটি। লিখিয়ে নির্জলা প্রকৃতি মাত্র অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। এটি তার তৃতীয় ইংরেজি উপন্যাস। এর আগেও আরো দু’টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এবারের উপন্যাসটি মূলত কিশোর বয়েসী অস্কার, রাইয়া, বিল আর আইরিনকে আবর্তন করে গড়ে উঠেছে। মোটামুটি সহজ ইংরেজিতে লেখা হলেও আজকের দিনে ছেলে মেয়েদের কথাবার্তায় বর্তমান যে পশ্চিমা ধাঁচের ইংরেজি কথপোকথন ব্যবহার হচ্ছে সেগুলোর উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। আইরিন তার ভাই বিলকে নিয়ে একটি কৌতুকে মেতে ওঠে। তারা ক্যাফেটেরিয়ার পেছনের অন্ধকারে এই কৌতুক খেলায় মেতে ওঠে। ঠিক এ সময়েই একটি পুতুলের আবির্ভাব হয় যে হাঁটতে পারে, চলাফেরা করতে পারে। আর এ নিয়েই তাদের মাঝে শুরু হয় কৌতুহল আর সৃষ্টি হয় এক ধরনের ভয়। অভিযান প্রকাশনীর এই বইটির প্রচ্ছদ করেছেন তাহমিদ রিতু। পাওয়া যাচ্ছে ৩৫৪ নম্বর স্টলে।

হৃদয়ের কম্পাঙ্ক
হৃদয়ের কম্পাঙ্ক উপন্যাসটি এসেছে পারিজাত প্রকাশনীতে। লিখেছেন সারোয়ার জাহান। লেখক উদ্ভিদবিদ্যায় সম্মান ও স্নাকোত্তর করলেও ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্য চর্চা করে আসছেন। সাহিত্য পত্রিকাও বের করতেন। বর্তমানে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বইটিতে একটি সুন্দর প্রেমকাহিনী গড়ে উঠেছে মলি আর নায়কের মাঝে যা পাঠককে সহজেই আকর্ষণ করবে। পাওয়া যাচ্ছে ৫২০-৫২১ নম্বর স্টলে।

মেঘে ঢেকেছিল তারা
এ সপ্তাহে একটি সুন্দর নতুন কবিতার বই এসেছে। লিখেছেন শিমুল পারভীন। শিমুল পারভীনের কবিতার বিশেষত্বই হচ্ছে সহজ ভাষায় কবিতা লেখা আর কবিতার ভেতর একধরনের আবেগ আর চিত্রকল্প অঙ্কন করা। এ কারণেই তার কবিতা বেশ পাঠকপ্রিয়তা পায়। তিনি বাচিক শিল্পী হিসেবে সুপরিচিত। সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠানকে তিনি নিপুন উপস্থাপনায় জীবন্ত করে তুলতে পারেন। মেঘে ঢেকেছিল তারা বইটি সহজেই পাঠপ্রিয়তা পাবে। বইটি এনেছেন শওকত হোসেন লিটু তার পারিজাত প্রকাশনীতে। পাওয়া যাচ্ছে ৫২০-৫২১ নম্বর স্টলে।

তবুও অপেক্ষা
তবুও অপেক্ষা নামে ছোটগল্পের একটি বই এনেছে ছায়াবিথী প্রকাশনী। বইটি লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, সমাজকর্মী, সাহিত্যিক জামাল উদ্দিন জামাল। জামাল উদ্দিন জামাল দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। এ গল্পগুচ্ছে তিনি তার অতীত জীবনের কিছু সত্যিকার ভাললাগা আর ক্ষণেকের ভালবাসার চিত্র তুলে ধরেছেন। এগুলো পড়তে বেশ ভাল লাগে কারণ, গল্পগুলোতে ভাষার কোন কৃত্রিমতা বা বক্তব্যের কোন জটিলতা নেই। দেশের সব তরুণ তরুণীর জীবনে একসময় এসব ঘটে যায়, তাই সব পাঠকই এসব গল্পকে নিজদের জীবন চিত্র হিসেবে কখনো অনুভব করতেও পারবেন। বইটি পাওয়া যাচ্ছে ৫৬৫-৫৬৬-৫৬৭ নম্বর স্টলে।

স্ন্যাপশট : টুকরো কথার চিত্র
নব্বই দশকের লেখক মিলু শামস কবিতা, গল্প, প্রবন্ধে একজন সুনিপুন লেখক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। কবিতায় যেমন সুন্দর চিত্রকল্প আঁকতে পারেন, প্রবন্ধেও তেমনি অনেক তথ্যপূর্ণ বিষয়াবলীর উপস্থাপন করতে পারেন। এবারের বইমেলায় তার স্ন্যাপশট : টুকরো কথার চিত্র বইটি এনেছে কাকলী প্রকাশনী। সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন দৃশ্যের সুনিপুন বুনটে প্রকাশিত এসব মুক্তগদ্য। মিলু শামস খুবই সহজ ভাষায় এবং সঠিক বর্ণনায় এসব চিত্র তুলে ধরেছেন। সহজে বলা যায়, বাংলা ভাষার সাথে হৃদয়ের আকুতি অনুভব করে মিলু শামস্ যেভাবে গদ্য সৃষ্টি করতে পারেন, অন্য লেখকদের বেলায় এটি কদাচিৎ দেখা যায়। সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের অনেক দায়িত্ব থাকে। কিন্তু সহজে কেউ এসব করতে চায় না। অথচ আমাদের এসব করবার দায়িত্ব রয়েছে। তাতে সমাজে বিভেদগুলো উঠে আসে এবং সচেতন মানুষ এসব দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এসব দায়িত্ব পালনে মানুষের চেতনাকে উস্কে দেয়ার কথা নিয়েই এই মহৎ বইটি। প্রকাশ করেছে কাকলী প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন নুরুল ইসলাম পেয়ার। পাওয়া যাবে প্যাভিলিয়ন নম্বর ৩-য়ে।

আতাতুর্ক কামাল পাশা: সাংবাদিক, কবি, লেখক, অনুবাদক ও সাহিত্য সমালোচক। দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় নিয়মিত তার লেখা প্রকাশিত হয়।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/