অভিনয় গুণে এখনো অনন্যা ববিতা

চিরচেনা ভঙ্গিতে ববিতা

আনজুমান আরা শিল্পী

বাংলা চলচ্চিত্রের নন্দিত অভিনেত্রী ববিতা। ৭০ ও ৮০ দশকে লাবণ্যময়ী নায়িকা হয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের সাদাকালো পর্দায় আলো ছড়ানো এই অভিনেত্রী এখনো সমান জনপ্রিয়। কালের বিবর্তনে তিনি নায়িকা থেকে সিনিয়র চরিত্রে এসেছেন কিন্তু অভিনয়ের গুণে এখনো তিনি অনন্যা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান এনে দেশের সম্পদ হয়ে উঠেছে তার কাজ দিয়ে। বাংলাদেশী ছবির ইতিহাস ববিতা ছাড়া অসম্পূর্ণ। তিনি এখনও চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

যশোরের মেয়ে ববিতা। তার আসল নাম ফরিদা আক্তার পপি। বড়বোন সুচন্দা ও ছোটবোন চম্পাও দেশের চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দুই অভিনেত্রী। প্রথমদিকে অভিনয় করতে এসে ‘সুবর্ণা’ নাম ছিল পরে ‘ববিতা’ নাম দেয়া হয়।

১৯৬৮ সালে ‘সংসার’ ছবিতে শিশুশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় শুরু ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে প্রথম নায়িকা। এ ছবি দুটি তার প্রাথমিক পাঠ ছিল। ‘টাকা আনা পাই’ ছবিটি ভালো পরিচিতি দেয়। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পেয়ে যান ১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে। সত্যজিৎ তার ছবির জন্য বাঙালি বধূর চিরন্তন রূপের আভা আছে এমন একটা পরিচ্ছন্ন মুখ খুঁজছিলেন। সুচন্দার সাথে ববিতা ছিল সেখানে সত্যজিৎ সুচন্দাকে আলাপের ছলে ববিতাকে দেখিয়ে বলে, নায়িকা তো পেয়ে গেছি। অতঃপর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নামকরা এ উপন্যাসের ‘অনঙ্গ বউ’ হয়ে গেলেন ববিতা। বাংলা চলচ্চিত্র সমিতি থেকে পুরস্কৃত করা হলো তাকে। ঐ পরিচিতির পরে ববিতাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

সত্তর দশকটা পুরো শাসন করতে থাকেন অথচ তখনও বহাল তবিয়তে শাবানার মতো মহানায়িকা ছিলেন ঢাকাই ছবিতে। পুরস্কারকন্যা ববিতা অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন দেশি-বিদেশি। পরপর তিনবার টানা জাতীয় পুরস্কার পেয়ে চমক দেখিয়েছিল সবাইকে। বাদী থেকে বেগম (১৯৭৫), নয়নমনি (১৯৭৬), বসুন্ধরা (১৯৭৭) এই তিন ছবিতে টানা পেয়েছিলেন। পরে আরো দুবার রামের সুমতি (১৯৮৫), পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৯৬)। বাচসাস পুরস্কার পেয়েছিলেন পাঁচবার।

জননন্দিত ববিতার সাক্ষাতের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো-

অনঙ্গ বউয়ের তুলনা হয় না। জহির রায়হানের নায়িকা হিসেবে তার যাত্রা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-এ অভিনয় করে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি লাভ করেন।

অভিনেত্রী না হয়ে নাকি ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন?

মা (বেগম জাহানারা) ডাক্তার ছিলেন। আমিও ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। লেখাপড়ায়ও ভালো ছিলাম। খুব ছোটবেলায় সুচন্দা আপার সঙ্গে মাঝে মাঝে শুটিংয়ে গিয়ে দেখতাম, একই শট তিনি বারবার দিচ্ছেন।

বালু, পাহাড়-পর্বতে দৌড়াচ্ছেন। খুব বিরক্ত লাগত, বোন এত কষ্ট করছে? সিনেমা করতে এত কষ্ট করতে হয়? সিদ্ধান্ত নিলাম, অভিনয় করব না। এর মধ্যে জহির (রায়হান) ভাইয়ের সঙ্গে আপার বিয়ে হলো। তিনি বিখ্যাত পরিচালক, দুলাভাই হলেন। তিনি বললেন, পপি (ডাকনাম), আমার সিনেমায় তোকে টিনএজ মেয়ের অভিনয় করতে হবে। বয়সও তখন ১২-১৩। আমি বেঁকে বসলাম ভালো লাগে না, করব না। মা-বোন খুব বোঝালেন, দুলাভাই বলছে, কর। ছবিটির নাম ‘সংসার’। রাজ্জাক ভাই আমার বাবা, সুচন্দা আপা মা। কিশোরী মেয়ে আমি, নাম ‘সুবর্ণা’। খেলার ছলে অভিনয় করেছি।

নায়িকা হলেন কীভাবে?

বছর দুয়েক পর জহির ভাই ঠিক করলেন, একটি উর্দু ছবি বানাবেন ‘জ্বলতে সুরজ কি নিচে’। বাংলাদেশেরই ছেলে পাকিস্তানে বিখ্যাত নাদিম হবেন নায়ক, শবনম ম্যাডাম নায়িকা। তবে তিনি নায়িকার শিডিউল পাচ্ছেন না। ছবির প্রযোজক বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান আফজাল চৌধুরী বললেন, এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? তোমার ঘরেই তো নায়িকা আছে। কে? ‘পপি। টেলিভিশনের একটি নাটকে দেখেছি, মেয়েটি তো ভারি ফটোজেনিক, অভিনয়ও ভালো করে।  

আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘একটি কলম’ নাটকে আমাকে সবাই পছন্দ করেছিলেন কিন্তু জহির ভাই যখন বললেন, রিফিউজ করে দিলাম। আগের মতোই মা-বোন বোঝাতে লাগলেন, এই ছবিতে নায়িকা হবে, নাদিমের সঙ্গে অভিনয় করবে। করো।

বললাম, এক শর্তে করতে পারি এটাই হবে প্রথম এবং শেষ। আর অনুরোধ করতে পারবেন না। আফজাল ভাই, তার স্ত্রী মিলে আমার নাম দিলেন ববিতা। তবে বড় আর্টিস্টদের শিডিউল পাওয়া গেল না পশ্চিম পাকিস্তানে শুটিং করতে হবে ইত্যাদি কারণে ছবিটি আটকে গেল। ফলে জহির ভাইয়েরও খুব মন খারাপ।

তিনি বললেন, তোকে নায়িকা করলাম আর ছবি হবে না? ঠিক আছে, বাংলা সিনেমা করব। শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে আমার বিপরীতে ছিলেন রাজ্জাক ভাই। ছবিটি করতে গিয়ে খুব অস্বস্তি হলো কয়েক দিন আগেও যাকে বাবা ডেকেছি, এখন তিনি আমার প্রেমিক, তাকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে! লজ্জায় অভিনয় করতে পারছিলাম না। তাই দেখে জহির ভাই খুব বকলেন, আরে, এ তো অভিনয়, লজ্জা পাচ্ছিস কেন? ধমক খেয়ে স্বাভাবিক হলাম। এই মিষ্টি, রোমান্টিক ছবিটি ১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট রিলিজ হলো।

সেদিনই তো মা মারা গেলেন?

ছবির পারিশ্রমিক ১২ হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছিলাম। মা তখন অসুস্থ, হার্টের অসুখে ধানম-ির নিরাময় ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন। ঠিক হলো, ছবি রিলিজের দিন ক্লিনিকে রাজ্জাক ভাই, তিনি আমাদের পরিবারেরই একজন, তাকে তো জহির ভাই চলচ্চিত্রে এনেছেন, জহির ভাই, সুচন্দা আপা, আমি সবাই মায়ের সঙ্গে দেখা করব। মাকে দেখানোর পর গাড়িতে চড়ে হলগুলোতে ঘুরব। গে-ারিয়া থেকে এসে কেবিনে ঢুকেই দেখি, মাকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে, তিনি এইমাত্র ইন্তেকাল করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।

চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের সঙ্গে ববিতা

‘শেষ পর্যন্ত’ কেমন ব্যবসা করেছে?

সুপারডুপার হিট হয়েছে। ছবিটি রিলিজ হওয়ার পর ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে ‘ববিতা ক্রেজ’ তৈরি হলো। বাড়িতে জাদরেল সব পরিচালকের লাইন পড়ে গেল। নজরুল ইসলাম, এহতেশামের মতো পরিচালকরা এসে বললেন, জহির, তোমার শ্যালিকাকে আমার ছবিতে লাগবে। চারদিকে ববিতা ক্রেজ, বড় বড় পরিচালক আসছেন দেখে জহির ভাই বললেন,  দেখ, তোর ভাগ্য এখানেই লেখা আছে। যতই বল, সিনেমা করবি না; এ জগৎ তোকে ছাড়বে না। এসব পরিচালককে তো আর বাদ দিতে পারবি না। আসলেই তাদের রিফিউজ করতে পারলাম না।

স্বাধীনতার পর প্রথম রিলিজ হলো ‘মানুষের মন’। সাংঘাতিক ব্যবসা করল। তারপর নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’। এই ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ এখনো মানুষ গায়। দিন দিন যত ছবি বেরোতে লাগল, ততই ববিতা ক্রেজ বাড়ছে।

‘পিচঢালা পথ’ আরো সুপারহিট হলো। এই করতে করতে পৌনে ৩০০ ছবি করলাম। চলচ্চিত্র জগৎ আমাকে কী দেয়নি? খ্যাতি, সম্মান সবই দিয়েছে। তবে কষ্ট হয় জহির ভাইকে হারালাম। তিনি তো আমাদের চলচ্চিত্রের অভিভাবক ছিলেন। তার ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ও শেষ করতে পারলাম না। এটি অদ্ভুত একটি ছবি ছিল। জহির ভাই নিজেই ছবির সব কাজ করেছেন। নিজে ক্যামেরাম্যন ছিলেন স্ক্রিপ্টও তার। তিনি বলতেন, এটিই হবে আমার জীবনের শেষ ছবি। তার প্রতিটি মৃত্যুবার্ষিকীতে ছবিটির বিভিন্ন অংশ দেখানো হয়।

আলাদাভাবে কোন কোন ছবির কথা বলবেন?
অসংখ্য ভালো ছবি আছে। আমার আরেকজন প্রিয় পরিচালক সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র জন্য ‘জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার’ পেয়েছি। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে তার ‘বসুন্ধরা’ও খুব সুন্দর ছিল। এটি আমরা মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ড. আরশাফ সিদ্দিকীর ‘গলির ধারের ছেলেটি’ অবলম্বনে ‘ডুমুরের ফুল’ মস্কো ফেস্টিভালে পুরস্কার পেয়েছে। নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ এখনো টিভিতে দেখানো হয়। আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ তো মাইলস্টোন ছবি। তার ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, গ্রামের পটভূমিতে ‘নয়নমণি’ বিখ্যাত ছবি। সুপারডুপার হিট ছবি ‘নয়নমণি’ পরে রিমেক করা হলেও আমাদের ধারেকাছেও যেতে পারেনি।

‘বাঁদী থেকে বেগম’ জীবনের অন্যতম সেরা ছবি এ কারণেই যে এতে বাঁদী, বেগম, নর্তকী তিন ধরনের চরিত্র ছিল। তিন ধরনের অভিনয় ফুটিয়ে তোলা খুব কঠিন ছিল। এই ছবিতে নর্তকী ছিলাম কিন্তু নাচের ‘ন’ও জানি না। তারপরও দর্শককে বিশ্বাস করাতে হবে যে আমি সত্যিকারের নর্তকী।

দুই বেলা শুটিংয়ের ফাঁকে, লাঞ্চ ব্রেকে খাবার না খেয়ে রওশন জামিলের বাড়িতে চলে যেতাম। তার হাজব্যান্ড (গওহর জামিল) তো ডান্সের মাস্টার ছিলেন। তাদের কাছে ক্লাসিক্যাল ডান্স শিখতে শিখতে পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। ছবিটি যখন রিলিজ হলো, ক্লাসিক্যাল ডান্সাররা পর্যন্ত বলেছেন, ববিতা নিশ্চয়ই ক্লাসিক্যাল ডান্স পারে! রাজ্জাক ভাইও অদ্ভুত অভিনয় করেছেন। এ ছবির মাধ্যমেই প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলাম। আমি তো পর পর তিনবার এই পুরস্কার পেয়েছি। ধারেকাছেও কেউ আসতে পারেনি (হাসি)। সাত-আটটি জাতীয় পুরস্কার, দেশ-বিদেশের ৬৫-৭০টি পুরস্কার পেয়েছি।

কোনগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
দেশেরগুলো তো অবশ্যই। তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ রিলিজ হওয়ার পর শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে যাওয়া শুরু হলো। সবাই তখন জানতে চাইতেন, এই বাচ্চা মেয়েটি কে? তারা বলতেন, ও সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-এর নায়িকা। অস্কারে যেতে পারিনি সত্য কিন্তু অস্কারের মঞ্চেও ববিতাকে দেখানো হয়েছে। যখন সত্যজিৎ রায়কে অস্কার দেওয়া হলো, তিনি তখন অসুস্থ, কলকাতায়। অস্কার অ্যাওয়ার্ডের দিন ‘অশনি সংকেত’-এর ববিতার সেই পানিতে গোসল (হাসি) দেখানো হয়েছে।

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বার্লিন ফেস্টিভালে যেতে পেরেছি, তিনি ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পেয়েছেন। মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে গেছি ৮-১০ বার, তাসখন্দ ফিল্ম ফেস্টিভালে গেছি ১০-১২ বার। চেকস্লোভাকিয়া, বেলগ্রেড, ইন্দোনেশিয়া, কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভালে একাধিকবার গেছি।

‘অশনি সংকেত’-এর জন্য বিএফজেএর (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন) সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ নায়িকা হয়েছি। ছবিটি পুরো ভারতে চলেছে। নয়াদিল্লির ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট পার্লামেন্ট অভিনয় বিবেচনা করে আমাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট ইন অ্যাক্টিং’ ডিগ্রি দিয়েছে। দিল্লির বিজ্ঞান ভবন থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। তবে এসবের জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। তখন প্রযোজকরা টেবিলের ওপর টাকা ফেলে সাইন করাতে চাইতেন। কিন্তু আমি বলতাম, না ভাই, আগে গল্প শুনি, স্ক্রিপ্ট পড়ে দেখি; তারপর ঠিক করব ছবি করব কি করব না। এভাবে ছবি নির্বাচন করতাম। ভালো ছবি করার জন্য হয় বিনা পয়সার অভিনয় করেছি, নয়তো নামকাওয়াস্তে টাকা নিয়েছি।

শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’-এ এক পয়সাও নিইনি। ‘দহন’ নিয়ে চেকস্লোভাকিয়া গিয়েছিলাম। একটা সময় প্রতিবছর তাসখন্দ, মস্কোতে আমার ছবি যেত। ওদের সিনেমা হলে ওদের ভাষায় ডাবিং করে রিলিজ হতো। তাতে ববিতা রাশিয়ান ল্যাংগুয়েজে ডায়ালগ বলত। ফলে তাসখন্দের আশপাশের মানুষ আমার খুব ভক্ত হয়ে গেল। সিনেমা শুরু হলে ওরা বলত, কিনু আখক্রিস ববিতা ফ্রম বাংলাদেশ।  মানে বাংলাদেশের ফিল্ম অ্যাকট্রেস ববিতা। রাশিয়ায় দেখেছি, ট্যাক্সি ড্রাইভারও ববিতাকে চেনে।

পাশাপাশি তো কমার্শিয়াল ছবিও করেছেন-
সব ধরনের ছবিই করেছি। অলরাউন্ডার হতে চেয়েছি আমি। শুধু বক্তব্যপূর্ণ ছবিই করলাম। গ্রামগঞ্জের লোকজন আমাকে চিনল না, জানল না, আমার ছবি দেখতে ভিড় করল না; তাহলে তো হয় না (হাসি)। ‘নাগ-নাগিনীর প্রেম’ ছিল সাপের ছবি। ববিতা-রাজ্জাক সাপ ছিল। ছবিটি দেখার জন্য মানুষ ভিড় করেছে সুপারহিট হয়েছে। ইবনে মিজানের সেই আমলের বিখ্যাত ‘নিশান’ ছবির দৃশ্য এখনো (হাসি) রিকশার পেছনে আঁকা থাকে। কমার্শিয়াল ছবি যেমন- লাইলী-মজনু, তাজ-তলোয়ার খুব ভালো চলেছে। সেগুলোর জন্য কষ্টও করেছি।

ইবনে মিজানের ‘নাগ-নাগিনীর প্রেম’-এর একটি দৃশ্যে বীণ বাজিয়ে অজগর, গোখরাসহ অনেক সাপ হাজির করব। এক সাপুড়ে সব সত্যিকারের সাপ সরবরাহ করত। অবশ্য সেগুলোর মুখ সেলাই করা থাকত। শুটিংয়ের আগে মিজান কাকা বললেন, ‘মা, চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। যতক্ষণ না বলব, চোখ খুলবে না।

সাপুড়ে বললেন, ববিতা চোখ বন্ধ করলেই সব সাপ ছেড়ে দেবে। অনেকক্ষণ ধরে বীণ বাজানোর পর চোখ খুলতে বললেন। দেখি, চারদিকে কয়েকশ’ সাপ ফোঁসফোঁস করছে। ভয়ে আমার তো জান বেরিয়ে যাচ্ছে। আর তিনি মাইক্রোফোনে বলছেন, ববিতা, প্রাউড ফিল করো যে তোমার ডাকে সব সাপ চলে এসেছে।  অভিনয় এমন এক বিষয় যে যত কষ্টই হোক, করে যেতেই হবে। বীণ বাজাচ্ছি, চারদিকে সাপ কিলবিল করছে। অনেকক্ষণ ধরে শট নেওয়া হলো। ‘ঠিক আছে, ওকে। এবার ক্লোজআপ নেব। কাট।  সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, ফ্লোরে পড়ে যাব। তারা আমাকে তুলে ফেললেন।

কোন চরিত্রগুলোর কথা মনে পড়ে?
খুব বিখ্যাত নয়, তবে খুব পছন্দের একটি চরিত্র হলো ‘টাকা আনা পাই’-এর বড়লোকের অল্পবয়সী মেয়ে যার মধ্যে পাগলামো আছে। ছবিটি রিলিজের পর বাচ্চা ছেলেরাও ববিতার ডায়ালগ বলত। এটির প্রডিউসার ছিলেন সুচন্দা আপা, পরিচালক হিসেবে বোধ হয় বাবুল চৌধুরীর নাম গিয়েছিল কিন্তু বেশির ভাগ কাজই জহির ভাই করেছিলেন। যখনই সময় পাই, ছবিটি দেখি। ভুলতে পারি না এই চরিত্র জহির ভাই আমাকে নিয়ে লিখেছিলেন। ‘বাঁদী থেকে বেগম’ এর ডাইমেনশনও খুব ভালো লেগেছে। ‘আলোর মিছিল’-এর আলোকে অদ্ভুত ভালো লাগে। অশনি সংকেত’র অনঙ্গ বউয়ের তুলনা হয় না। স্বাধীনতার পরে যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘নাদানি’তে অভিনয় করে পাকিস্তানের ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি। ‘হায় রে, হায় মিস লঙ্কা’ গানটি এই ছবির। ফয়সাল নায়ক, আমি নায়িকা।

পরিচালকদের নিয়ে কোনো স্মৃতি?
দত্তদাকে (সুভাষ দত্ত) খুব সম্মান করতাম। তিনিও খুব আদর করতেন। স্বাধীনতার পরপরই তার ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সাইন করলাম। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে শুটিং শুরু হবে। শিডিউলও নিয়েছেন। সব আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান ঠিক করেছেন; হেলিকপ্টারসহ বিশাল আয়োজন। তখন জানা গেল, সত্যজিৎ রায় আমাকে নেবেন। দাদা আবার সত্যজিৎ রায়কে খুব শ্রদ্ধা করতেন। দাদাকে বললাম, আপনার ছবির সঙ্গে তো সত্যজিৎ রায়ের ছবি ক্ল্যাশ করছে। তিনি বললেন, আমার কথা বাদ দাও। এমন একজন বড় পরিচালকের ছবিতে সুযোগ পেয়েছ। দরকার হলে শুটিং কিছুদিন পেছাব। তাও তার কাজ করো।

অনেক নায়কের নায়িকা হয়েছেন-
ঢাকার সবার সঙ্গে কাজ করেছি। ‘অশনি সংকেত’ করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সব ছবির নায়ক সৌমিত্রদা (চট্টোপাধ্যায়) আমাকে এত আপন করে নিয়েছিলেন বলেই এত সুন্দর করে কাজ করতে পেরেছি। নায়করাজ রাজ্জাকের তো তুলনাই হয় না। বুলবুল আহমেদ, সোহেল রানার সঙ্গেও কাজ করেছি। আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে অবশ্য একটু কম ছবি হয়েছে। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল। ভালো ভালো ছবি করেছি আমরা। তখন মানুষ মনে করত, ফারুক-ববিতার সম্পর্ক আছে।

জাফর ইকবালের সঙ্গে তো আপনার সম্পর্ক ছিল
দুজনই তখন তরুণ খুব মানাত আমাদের। বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। শুটিংয়ের পর ও গিটার বাজিয়ে গান শোনাত। ওর কণ্ঠ আমাকে পাগল করে দিত। মডার্ন ছেলেমেয়েরা আমাদের খুব পছন্দ করত। ও ছিল সত্যিকারের হ্যান্ডসাম ছেলে। ওর ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’ আজও মানুষ মনে করে। তারা ভাবে, ববিতা-জাফরের খুব প্রেম ছিল একে অপরের হতে পারেনি বলে জাফর এই গানটি গেয়েছে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছে, ‘উই আর রিয়েলি গুড ফ্রেন্ডস। তারপর এ নিয়ে আর কিছু ভাবিনি, অন্য কিছুও হয়নি। তবে জাফরকে খুব পছন্দ করতাম। সে তো আমার আগে বিয়ে করেছে। তার সন্তানও আগে হয়েছে।

‘অশনি সংকেত’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন কীভাবে?
স্বাধীনতার কয়েক মাস পর এফডিসিতে বহু মানুষের ভিড়ে দেখি, আউটডোরে মোটাসোটা একজন ফটোগ্রাফার আমার অসংখ্য ছবি তুলছেন। জানতে চাইলাম, এই ভদ্রলোকটি কে? একজন বললেন, ভারত থেকে এসেছেন। মনে হলো, ওদের পত্রিকায় লিখবেন বলে ছবি তুলেছেন। তখন গেন্ডারিয়া থাকতাম।
কিছুদিন পর একটি চিঠি এলো, ‘তুমি জেনে খুশি হবে, বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় তোমাকে নিয়ে ভাবছেন। তার প্রযোজক নন্দা ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করো।  

তখন আমার বয়স ১৫। চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে গেলাম। ভাবলাম, ভক্তদের কেউ হয়তো দুষ্টুমি করেছে। কিছুদিন পর ভারতীয় হাইকমিশন থেকে টিঅ্যান্ডটিতে ফোন এলো, ‘তুমি কি ববিতা?’ বললাম, জি। ওপাশ থেকে বললেন, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে বলছি। তোমাকে আমাদের বিখ্যাত পরিচালকের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তুমি কি ব্যাপারটি সিরিয়াসলি নাওনি? এই নম্বরে যোগাযোগ করো।

মানে প্রযোজক নন্দা ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হলো। সুচন্দা আপা বললেন, যোগাযোগ কর। ফোন করার পর নন্দবাবু বললেন, প্লেনের টিকিট কেটে চলে আসেন। তিনি আমাদের রিসিভ করলেন। হোটেলে উঠলাম।

নন্দবাবু বললেন, কাল সকালে সত্যজিৎ বাবুর বাসায় যেতে হবে। রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুম এলো না। তিনি আমাকে দেখবেন? সকালে মেকআপ বক্সে যত মেকআপ ছিল সবগুলো দিয়ে খুব সাজলাম। এরপর সুচন্দা আপা, নন্দবাবু আর আমি মানিকদার (সত্যজিৎ রায়ের ডাকনাম) বাসায় গেলাম। দরজায় টোকা দিতেই তিনি খুললেন। দেখি, লম্বা একটা লোক। ভয়ে মাথা নিচু হয়ে গেল, আর তাকাতে পারি না। খুব নার্ভাস হয়ে গেলাম। বসতে দিলেন।
আপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ও এত সেজে এসেছে কেন? আমাকেও বললেন,  তোমাকে তো আমি এত সাজুগুজু অবস্থায় দেখতে চাইনি। শুনে আরো চুপ হয়ে গেলাম। যা-ও বলতে পারতাম, আর পারলাম না। তিনি আপাকে বললেন, এত লাজুক, ও কি অভিনয় করতে পারবে?

আপা বললেন, দাদা, বাংলাদেশে ওর একটি-দুটি ছবি রিলিজ হয়েছে। খুব সুনামও হয়েছে। তখন ‘মানুষের মন’ রিলিজ হয়েছে। তিনি বললেন, এত লাজুক! আচ্ছা, তুমি কাল সকালে মেকআপ ছাড়া ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে চলে আসো। গেলাম।

তিনি তো অবাক, আরে আজকেই তো তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। মেকআপ ছাড়া তুমি তো অনেক সুন্দর। তিনি তার বাসায় আমাকে তিন রকমের স্ক্রিপ্ট দিয়ে বলেছিলেন, কাল মুখস্থ করে আসবে। ক্যামেরায় টেস্ট নেওয়া হবে। একটু রোমান্টিক, একটু অন্য ধরনের একটু কষ্টের এই স্ক্রিপ্টগুলোর ডায়ালগগুলো মুখস্থ করে সকালে গেলাম।

মানিকদা স্টুডিওর ক্যামেরাম্যানকে বললেন, আটপৌরে করে শাড়ি পরিয়ে দাও। সিঁথিতে সিঁদুর থাকবে, মেকআপ ছাড়া। লাইট জ্বলল। তখন আমি আরেক ববিতা। যখন ক্যামেরার সামনে গেছি, লজ্জা-ভয় কিচ্ছু নেই। ডায়ালগ বলে যাচ্ছি। তিনি ক্যামেরায় লুক থ্রু করলেন। লুক থ্রু করলেই তো বোঝা যায়, আমার ক্যামেরা ফেস কেমন আসবে। অভিনয় কেমন পারি। তিনি দেখেই বলে ফেললেন, ইউরেকা, ইউরেকা, আমি অনঙ্গ বউ পেয়ে গেছি। সুচন্দা এই ববিতাই হবে আমাদের অনঙ্গ বউ।

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা?
যা-ই অভিনয় করতাম, তিনি বলতেন, হ্যা ভাই, খুব সুন্দর হয়েছে। এটি আরেকবার নিই? তখন বুঝতাম, দাদার মনমতো হয়নি। এটিই ছিল তার টেকনিক। তিনি কখনোই বলবেন না, তোমার অভিনয় হয়নি। কী অভিনয় করলে? তিনি ভাই, সুন্দর করেছ। এটি আরেকবার নিই? বললে বুঝতে হবে আরেকটু সুন্দর করে অন্যভাবে অভিনয় করতে হবে। নিজে লুক থ্রু করতেন। তার আরো ব্যাপার দেখলাম, বাঁ দিকে নিজের হাতে ক্লোজআপ, মিডশট, লংশট, ট্রলি সব এঁকে দিতেন। আর ডান দিকের পাতায় ডায়ালগ লিখে দিতেন। আমাদের এখানে যেমন প্রখর রোদের মধ্যে রিফ্লেক্টর বোর্ড দিয়ে শুটিং করা হয় তিনি তা কখনো করতেন না। মেঘের আড়ালে সূর্য ডুবলে সেই সফট লাইটে শুটিং করতেন। সকাল-বিকাল শুটিং করতেন। সূর্য যখন মাথার ওপরে থাকত, আমরা খাওয়াদাওয়া করতাম।

অভিনয়ের বাইরের কোনো স্মৃতি?
ঈদের দিনও পুরো ইউনিটের সঙ্গে শুটিং করতে হয়েছে। কোথায় ঈদ করব, মজা করব; সেখানে শুটিং করতে হচ্ছে এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি বলে কান্না চলে এলো। সেদিন সন্ধ্যায় ইউনিটে বলে দেওয়া হলো, ববিতার জন্য সেমাই রান্না করো। সন্দীপদাকে (রায়) দেখি, লাইট, আগরবাতি, তারাবাতি জ্বালিয়ে আমাকে চিয়ার আপ করছেন। তখন থেকে মানিকদাকে খুব আপন মনে হলো। আর ভয় পেতাম না।

কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি?
বীরভূম, শান্তিনিকেতনের জঙ্গলে শুটিং প্যাকআপের পর কটেজে ফিরে আসব। আমার পায়ে স্যান্ডেল, পরনে শাড়ি। একটি ছোট্ট ডোবা লাফ দিয়ে ওপারে যেতে হবে। সবাই লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি বেশ পেছনে। স্যান্ডেল পায়ে দিলে কাদায় আটকে যেতে পারে বলে খুলে লাফ দিয়ে চলে আসতে পারলাম কিন্তু স্যান্ডেল ওপারে পড়ে রইল। আবার লাফ দিয়ে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সত্যজিৎ রায় এটি দেখেছেন। তিনি কিন্তু চলে গিয়েছিলেন।

আবার ওই পারে এসে স্যান্ডেলটা তুলে নিয়ে আমার হাতে দিলেন। হেসে বললেন, এই নে। তার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ ছিল। যখনই ভারতে যেতাম, মানিকদার জন্য ইলিশ, চিংড়ি নেবই নেব। তার বাসায় ঢুকেই বলতাম, দাদা, ভালো ইলিশ এনেছি। মৃত্যুর আগে দাদা যখন হাসপাতালে ছিলেন, গিয়ে দেখা করেছি। অনেকক্ষণ বউদির সঙ্গে কথা হয়েছে।

একসময় শাবানা-ববিতার ছবি পাল্টাপাল্টি চলেছে
কোনো দিন আমাদের মধ্যে লড়াই ছিল না। অত্যন্ত ভালো বন্ধুত্ব ছিল দুজনের। তার অসুখ হলে হাসপাতালে দেখতে যেতাম। আমি তো খুব বিদেশে যেতাম তিনি বলতেন, ‘ববিতা, তুই তো বিদেশে যাস। আমার জন্য শাড়ি নিয়ে আসিস। কলকাতা থেকে শাড়ি এনে তাকে উপহার দিতাম। আমাদের মধ্যে কখনো গ-গোল ছিল না।

ব্যক্তিগত জীবন একটু জানব-
১৯৮২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। বাবা (এএসএম নিজাম উদ্দিন) তখন মৃত্যুশয্যায়। বললেন, তোমার বিয়েটা দেখে যেতে চাই। তখন সিনেমা নিয়ে খুব ব্যস্ত। কথা বলারও সময় নেই। বাবা খুব দুশ্চিন্তা করতেন। বললেন, যদি কাউকে ভালো লাগে, বেছে নাও। বললাম না, কেউ নাই। আপনারা যদি বিয়ে দিতে চান ছেলে দেখেন। আত্মীয়স্বজন ইফতেখারুল আলমের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। তিনি জাহাজ ব্যবসায়ী ছিলেন। আমার বাচ্চার (অনীক ইসলাম) বয়স যখন তিন বছর তিনি মারা গেলেন। আর বিয়ে করিনি।

চলমান সময় চলছে কেমন?
একমাত্র ছেলে অনিককে নিয়েই এখন আমার সকল ব্যস্ততা। ছেলে পড়াশোনা শেষ করে ইতিমধ্যে দেশের বাইরে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরিতে যোগদান করেছে। মাঝে মাঝেই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে বিদেশে যাচ্ছি। আবার কিছুদিন পর ফিরে আসছি। এভাবেই কাটছে আমার চলমান সময়।

বর্তমানে ফেসবুক বিড়ম্বনায় আছি। আমার নিজের কোনো ফেসবুক আইডি না থাকলেও কিছু অসাধু চক্র আমার নামে ফেসবুক আইডি খুলে মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা খুব দুঃখজনক।

নতুন চলচ্চিত্রে…
অভিনয় তো আমার পেশা। কিন্তু পেশা হলেও আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা গল্প পছন্দ না হলে কাজ করব না। এখনও প্রতিনিয়ত প্রস্তাব পাচ্ছি।

বিদেশে সম্মাননা…
বিদেশের চেয়ে আমার কাছে দেশের সম্মামনা বেশি প্রিয়। কারণ এটি আমার দেশ, এটি আমার মাতৃভূমি। কেননা এই দেশের মানুষের জন্য আমি সম্মানিত হয়েছি। সব থেকে আগে আমার দেশ। আর বিদেশে গিয়ে যখন আমি সম্মাননা পাই তখন আমার কাছে মনে হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এক বিরাট স্বীকৃতি। এটি আমাকে নয় এই সম্মান আমার দেশকে দিচ্ছে। এটা আমার কাছে সব থেকে বেশি প্রাপ্তির হয়ে থাকে।

মধুময় স্মৃতি…
স্মৃতির তো শেষ নেই। এই মুহূর্তে একটি ঘটনা মনে পড়ছে, সেটি হলো নব্বই দশকের শুরুর দিকে আমি খুব ব্যস্ত একজন অভিনয়শিল্পী। এক সন্তানের মা। তা-ও আবার সিঙ্গেল মাদার। অনিকের বাবা যখন মারা যান তখন ওর বয়স তিন বছর। শুটিংও ফেলে রাখা যাবে না। তবে এর মধ্যে ভালো ভালো ছবি করার প্রস্তাব ছাড়তে হয়েছে। ঢাকার বাইরের শুটিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছু ভাবতে হতো। আর ঢাকায় যেসব ছবির শুটিং হতো সেগুলো করার ক্ষেত্রেও অনেক চিন্তা-ভাবনা করতাম। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় গাড়িতে বসে থাকতাম। কখন আমার ছেলে নিচে নামবে। আর ভাবতাম আমি তো চিত্রনায়িকা ববিতা! এসব ভাবতাম আর নিজে নিজের কাছে হাসি পেত।

পছন্দের নায়ক…
আমি বিভিন্ন দেশের অনেক বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। তবে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আমার স্বপ্নের বা পছন্দের নায়ক ছিল জাফর ইকবাল। সবার সঙ্গে কাজ করেই ভালো লেগেছে। কেউ কেউ আমাকে নিয়ে গর্ব করেছেন। আমাদের নায়করাজ রাজ্জাক ভাই, ফারুক, সোহেল রানাসহ আরও অনেকের অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব আমাকে আজাও মুগ্ধ করে রেখেছে। ভারতের সৌমিত্র দা'র মতো নায়কের সঙ্গেও আমি কাজ করেছি।

]

ছেলের সঙ্গে ববিতা

চলচ্চিত্রের প্রাপ্তি…
যে চরিত্রে কাজ করে দর্শককে মুগ্ধ করতে পারব বলে ধারণা করেছি, সেই চরিত্রের জন্য টাকা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। অভিনয় আমার পেশা। অবশ্যই এখানে আমাকে রোজগার করতে হবে। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার সঙ্গে মূল্যও বাড়াতে হবে। তবুও এটা একটি শিল্প। শিল্পী হিসেবে নিজের মনের কিছু খোরাক থাকে। সেই খোরাক মিটায় এমন চরিত্রের জন্য কম্প্রোমাইজ করতেই হবে। আজ তো চলচ্চিত্রে আসার পর এত যশ খ্যাতি আর প্রতিটি সিনেমাপ্রেমি দর্শকরা আমাকে চেনে, ভালোবাসে এমন কি অনেকে শ্রদ্ধাও করে। এর চেয়ে জীবনে আর কি প্রাপ্তি থাকতে পারে। আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, সততার সঙ্গে কাজ করেছি, পরিশ্রম করেছি। এমনও হয়েছে প্রযোজকের আর্থিক দিক বিবেচনা করে আমি অনেক সুপারহিট ছবিতে কাজ করেছি কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক নেইনি। সব সময় নিজের চরিত্রটাকে প্রাধান্য দিয়েছি।

বর্তমান সময়ের শিল্পীদের নিয়ে…
ইন্ডাস্ট্রি এখন শাকিবনির্ভর। মূল্যায়নের কথা খুব বেশি জানাতে চাচ্ছি না। এসব না বলাই ভালো। অনেকেই বলে থাকেন সিনিয়ররা কেবল সমালোচনা করেন। কেন করেন সেটা তারা উপলব্ধি করেন না। এটা ভালো কোনো কথা নয়। যেখানে রাজ্জাক ভাই ছিলেন সেখানে আলমগীর, জসীম, উজ্জ্বল, সোহেল রানারাও কাজ করেছেন। জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনরা একসঙ্গে ছবিতে অভিনয় করেছেন। শাহরুখ খানের প্রতিদ্বন্দ্বী সালমান-আমির। আসলে সব খানেই একটা গণতন্ত্রের চর্চা থাকা চাই। নতুনদের নিয়ে নির্মাতা ও প্রযোজককে কৌশলী হতে হবে।

অনেক নতুনরা আশা জাগাচ্ছেন। নতুন অনেকের অভিনয়ও ভালো তাদেরও তো একটু সুযোগ প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশই ছবির গল্প চরিত্র নিয়ে না ভেবে পারিশ্রমিক নিয়ে আগে চিন্তা করছেন। এটা কোনো শিল্পীসুলভ আচরণ না।

আনজুমান আরা শিল্পী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক। প্রকাশিত গ্রন্থ চারটি।

ওমেন্স নিউজ/