আবু সাইদ কামালের গল্প ‘শোভনের বিয়ে কিংবা তার আত্মসঙ্কটের জট’

আবু সাইদ কামাল

শোভনের বিয়ে কিংবা তার আত্মসঙ্কটের জট

বিয়ে নিয়ে শোভনের আচরণ কারো কারো কবাছ রহস্যময় মনে হয়। ছত্রিশ পেরোচ্ছে, তবু বিয়ে করছে না। পরিবারের বড় ছেলে। তার ছোট আর দুটি ভাই। বড় হয়ে বাঁধ সেধে রয়েছে বলে ছোট দু’জন আটকে আছে। অবশ্য সবার ছোটভাই পবন বড় ভাই শোভনের জন্য বেশি অপেক্ষা করতে নারাজ। প্রেম করে গোপনে এঙ্গেজমেন্ট করে রেখেছে। নতুবা তার সহপাঠিনী মাস্টার্স সম্পন্ন করে কোন ভরসায় বসে থাকবে! বড় ভাইয়ের বিয়ে দিতে পারলেই বউ ঘরে তুলে আনতে পারে কনিষ্ঠ ভাইটি। ঢাকায় পড়ছে আর পারটাইম একটি চাকুরি করছে সে।
মেঝভাই ভুবন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ভারতের বাঙ্গালুরে পড়াশোনা করে দেশে চাকুরি করছে। তার প্রণয়ঘটিত কোনো ব্যাপার না থাকলেও তো বিয়ের বয়স যায় যায়। তাই অধীর হয়ে তাকিয়ে আছে বড় ভাই শোভনের দিকে। ওদের বড় তিন বোনেরই বিয়ে হয়েছে। সবাই স্বামীর বাড়িতে সন্তান-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। শোভনদের বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা। মা বার্ধক্যের কারণে আর সংসার টানতে পারছেন না। গৃহস্থালি সামলে নেবার জন্যও তাদের শহরের বাড়িতে বউয়ের চাহিদা ক’বছর আগে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শোভন ওসব বুঝে না। আবার বিদেশে যাবে বলে পাঁচ-ছ’বছর কাটিয়ে দিয়েছে। বিদেশে যাওয়া যখন হলই না, তখন তার মতো বিদেশ ফেরত আরও তিনজন অংশীদার নিয়ে শহরের ব্যস্ত এলাকায় একটি অভিজাত রেস্টোরেন্ট ব্যবসা শুরু করে। অভিজাত বলেই শহরের সচ্ছল ঘরের তরুণ-তরুণীরা এসে ভীড় করে রেস্টোরেন্টে।
ও সময়েই রেস্টোরেন্টে যাতায়াত করা একটি মেয়ের সাথে শোভনের সম্পর্ক তৈরি হয়। এ নিয়ে চলে কানাঘুঁষা। পরিবারে তরফ থেকে মেয়েটির খোঁজ নিয়ে শোভনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। সতর্ক করে বলে দেওয়া হয়, যেনো ও মেয়ের সঙ্গ ত্যাগ করে। শোভনও এক পর্যায়ে বুঝতে পেরে মনে মনে বলে, সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটানো যায়, তবে ঘর করা যায় না।
যদিও পরে কয়েকমাসের ব্যবধানে মেয়েটির সাথে তার সম্পর্ক চুকে যায়। তবে মেয়েটির সাথে মেলামেশা করার পর থেকে শোভন কেমন যেনো পাল্টে যেতে থাকে। ঐ ঘটনার পর থেকে পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের চাপ শুরু হয়। তাতে সে সায় দেয় না। বরং ব্যবসা গোছানোর অজুহাতে পার করে দেয় কয়েক বছর। এভাবে বিয়েটা পিছাতে পিছাতে একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে, তবু সে বিয়ে করে না। শেষে পরিবার আর স্বজনদের চাপে তাকে বিয়েতে মত দিতে হয়। লাগানো হয় ঘটক।
ঘটকের দেয়া তথ্য থেকে একটি মেয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। তার সাথে বয়সের সঙ্গতি আছে। দু’পক্ষে ছেলে-মেয়ের জীবন-বৃত্তান্ত বিনিময় হয়। মেয়ের বাবা অবসর প্রাপ্ত একজন সরকারি চাকুরে। শেষ জীবনে দ্বিতীয় শ্রেণির অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিন সন্তানের মাঝে দুটি মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়েটি মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে দু’বছর। মেধাবী ছাত্রী। এখনো চাকুরি হয়নি। চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরই মাঝে মেয়েটির মা হঠাৎ করে পরপারে পাড়ি জমায়। ফলে আকাশ ভেঙে পড়ে পরিবারটির ওপর।
এ ধকল সামলাতে সামলাতেই মেয়েটির বিয়ের বয়স চূড়ায় ওঠে। বাবা মেয়েটিকে পাত্রস্থ করার জন্য অস্থির হয়। ভালো পাত্র, বিশেষ করে সরকারি অফিসার বা ব্যাংকের কর্মকর্তা ইত্যাদি খুঁজতে খুঁজতে চলে যায় কয়েক বছর। তখন মেয়ের বাবা বেশ ক্লান্ত। তাই ব্যবসায়ী ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার বিষয়ও বিবেচনায় নেয়। শোভনের মতো ছেলেও মন্দ না। শহরে বাড়ি, উচ্চ শিক্ষিতও। ঘটক উভয়দিকে যোগাযোগ করে। ঘটকের কথায় আস্থা রেখে বাবা একদিন মাতৃহীন এ মেয়েটিকে নিয়ে শোভনের রেস্টোরেন্টে যায়। ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে দেখে। মেয়ের বাবাও দেখে ছেলেকে। ছেলের পক্ষ থেকে রেস্টোরেন্টে আসে তার ছোট মামা।
এভাবে ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে দেখার পর থেকে পারিবারিক পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা হয়। মেয়েটিকে ঘিরে শোভনের কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয়। দুপক্ষ থেকে পরস্পর সম্পর্কে জানাশোনার পর্ব শেষ হলে উভয়পক্ষে জোরেসোরে কথা চালাচালি চলে। আলোচনা হতে থাকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। এ পর্যায়ে শোভনের আগ্রহ কচ্ছপের গলার মতো হতে দেখা যায়। কখনো আগ্রহ বাড়ে, কখনো থিতিয়ে যায়। ঘটকের চাপে এক পর্যায়ে শোভন তার স্বজনদের পাঠায় মেয়ে দেখতে। এ পর্যায়ে একই শহরে মেয়েদের মহল্লার একটি রেস্টোরেন্টে অনানুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে যায় শোভনের তিন বোন এবং দুই বোন-জামাই। সময় দেওয়া হয় সন্ধ্যায়। নির্ধারিত সময়ে মেয়েকে নিয়ে আসে তার বাবা। মিষ্টি চেহারার মেয়েটির আন্তরিক ও অমায়িক আচরণ অল্প সময়ের মাঝে সবার মন জয় করে।
বড়বোন এবং বোন জামাইদের দল ফিরে এসে একবাক্যে তাদের পছন্দের কথা জানায় শোভনের মা-বাবাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের এ পর্ব শেষ হলে দ্বিতীয় পর্বের শুরু। পারিবারিকভাবে উভয়ের বাড়ি আসা-যাওয়ার পালা। এ পর্বে ছেলের পক্ষের সিদ্ধান্ত, মেয়েদের পক্ষ আগে ছেলেদের বাড়ি আসবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছেলেপক্ষ মেয়েদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে বউ তুলে নিয়ে আসবে। এমন মতামত পেয়েই মেয়ে পক্ষ ছেলেদের বাড়ি আসে। সফল এবং আন্তরিকভাবেই শেষ হয় এ পর্ব। পরবর্তী পর্যায় মেয়েদের বাড়ি যাবে ছেলেপক্ষ। দিন-তারিখও ঠিক হয়। সামনের শুক্রবার। তার আগে একদিন ছেলে এবং মেয়ে একান্তে সাক্ষাৎ করে পরস্পরকে বুঝে নেবে বলে ছেলের মতামত। রোববারে মেয়ের বাবার চোখের অপারেশন, এটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। শোভন সুযোগ বুঝে বাবার অপারেশনের সময় চক্ষু হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখার ছলে মেয়ের সাথে দেখা করে। চোখের হালকা অপারেশন। বৃষ্টিমুখর দিন। মুষলধারে বৃষ্টির মাঝে শোভন একান্তে মেয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ পায় । জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা তন্বী আপনার অবসর সময় কাটে কীভাবে?
একটু ভেবে মেয়েটি জবাবে বলে, কাগজের ফুল বানাই।
আপনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী?
বেসরকারি কলেজে পড়ানোর জন্য নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আশা করি কিছুদিন পরে হলেও কলেজে একটা চাকুরি হবে। এ ছাড়াও বিসিএস দিচ্ছি। আরও দু’বছর সরকারি চাকুরির বয়স আছে। সামনের সবক’টা বিসিএসসহ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতেও অংশ নিব।
তারপর আর দুয়েকটা প্রশ্ন করে শোভনের মনে হলো, আচরণে যথেষ্ট ভদ্র এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। বুদ্ধিমত্তায় যেনো কড়কড়ে পাকা মরিচ। এমন মেয়ে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনের জন্য অনুপম। কিন্তু…
এরপর বৃষ্টি কিছুটা কমে এলে শোভনই একটা অটোবাইক ডেকে রোগীকে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেয়। তন্বী তার বাবাকে নিযে বাড়ি যায়। মেয়ের সাথে কথা হওয়ার পর থেকে শোভন বেঁকে বসে। কেনো যেনো সম্মত হতে পারছে না। সে ভাবে,  গণিতে মাস্টার্স করা মেয়েটির চোখ-কান এমনিতেই খোলা। বিয়ে হলে এ মেয়ে তার জীবনে বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিতে পারে। আসলে সে খুঁজছে উচ্চ শিক্ষার সনদপ্রাপ্ত একজন সুন্দরী হাবাগোবা মেয়ে। কিন্তু গণিত শাস্ত্রে শিক্ষিতা এ মেধাবী মেয়ে তো তার দাম্পত্য জীবনের গণিতেও ভুল করবে না। বরং ভুল ধরবে। বড় কোনো গড়মিল থাকলে- উদঘাটন করতে পিছপা হবে না। তাই এ বিয়ে থেকে তার পিছু হঠা ছাড়া উপায় দেখছেনা.শোভন।
যেখানে বিয়ের কথা চূড়ান্ত, সেখানে হঠাৎ শোভনের বেঁকে বসার কারণ স্বজনদের কারো কাছে বোধগম্য নয়। কারো কারো মনে প্রশ্ন, বিয়ের সিদ্ধান্তের এমন পর্যায়ে এসে হঠাৎ শোভন রহস্য করছে কেনো? এমন প্রশ্ন ওঠা যে অস্বাভাবিক নয়, এটা সে বোঝে। আসলে শোভন এ বিষয়ে নিজের সাথে বোঝাপড়া করছে। সে ভাবছে, এখানে বিয়ে করা আদৌ ঠিক হবে কিনা!
কেনো বিয়ে করতে চাচ্ছে না, সে রহস্য আদপে সে ছাড়া আর কেউ জানে না। এদেশের প্রতি তার একটা নাক ছিটকানো মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকে। জন্মসূত্রে এদেশের মানুষ হয়েও এসমাজ ও মানুষের প্রতি তার ধারণা কিছুটা নেতিবাচক। কারণ, ক’বছরে বিদেশের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠায়, দেশের সংস্কৃতিতে খাপখাওয়াতে পারছে না সে।
জেলা শহরের একটি বেসরকারি কলেজ থেকে পাশ কোর্সে স্নাতক করে বুঝতে পেরেছিল, দেশে থেকে ভালো কোনো চাকুরির সুযোগ সে পাবে না। তাই বিদেশের প্রতি ছিল ঝোঁক। সুযোগও পেয়েছিল একটা। সে সময় পর্যটন করর্পোরেশন থেকে দু’বছর মেয়াদের একটা ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়্। প্রথম ব্যাচেই ভর্তি হয় সে। কোর্স সম্পন্ন করার সাথে সাথেই ইংল্যান্ডে স্টুডেণ্ট ভিসা নিয়ে পর্যটন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ নেয়। ইংল্যান্ডে পড়াশোনা শেষে ইন্টার্নিশীপ করতে যেতে হয় আমেরকিার এক বরফঢাকা এলাকার পাঁচতারকা হোটেলে। সেখানে প্রায় এক বছর কাটায়।
সে সময় বুঝতে পারে, এসব নিভৃত হোটেলগুলোতে নিঃসঙ্গ মেয়েদের যৌনাচারের বিষয়। টাকার বিনিময়ে একটু বয়স্কা মেয়েদের সঙ্গ দিয়ে অর্থ-উপার্জনের বিষয়টা তো সেখান থেকেই জেনেছে। সে সময়ে সে নব্য তরুণ। দুর্ভাগ্য সে ইন্টার্নিশীপের মেয়াদ শেষে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ড চলে আসতে হয়েছে। ইংল্যান্ডেও স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ শেষে বাধ্য হয়ে তাকে ফিরেতে হয় দেশে। প্রবল ইচ্ছে ছিল দেশে আসার পর ফের ভিসা নিয়ে বিদেশগামী হবে। কিন্তু তা আর হয়নি। বিদেশে যাওয়ার জন্য ক্রমাগত প্রয়াস চালায়, সফল হতে পারেনি।
কিছু টাকা বিনিয়োগ করে শহরতলীর জমি কেনায়। বিদেশ যাওয়া যেহেতু হচ্ছে না, তখন ক’জন বন্ধু মিলে রেস্টোরেন্ট-ব্যবসায় নামে। বাকি তিনজন ব্যবসায়িক অংশীদারকে সেই বেশি উৎসাহিত করেছে। ভেবেছিল, অল্প ক’দিনে সম্পর্ক গড়ে ওঠা সেই সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধবে। কিন্তু কিছুদিনের মাঝে সেই স্বপ্নও ভেঙে গেলে মেয়েদের প্রত্রি কেমন যেনো একটা বিতৃষ্ণা জন্মে। তখন থেকেই তার মনোযোগ যায় ভিন্ন নেশায়।
তাদের রেস্টোরেন্টে আসা পতিত কিংবা নিঃসঙ্গ মেয়েদের প্রতি নজর দেয়। অনুসন্ধ্যানে প্রথমেই পায় রেস্টোরেন্টে প্রায়ই খাবারের জন্য যাতায়াতকারিনী এক পরিচিতাকে। তারচে বছর দুই বড় মিসেস লিজা। অতীতের পরিচয়ের সূত্র ধরে রেস্টোরেন্টের নিভৃত টেবিলে ওরা বসে। আন্তরিকভাবে তাঁর খোঁজ-খবর নেয়। জানতে পারে তার পদস্থ স্বামী এক বছর যাবৎ বিদেশে। মহিলাও শোভনের ব্যক্তিগত বিষয়াদি জেনে নেয়। তারপর একদিন মিসেস লিজা আন্তরিক আলাপের এক পর্যায়ে বলে, বিদেশে যেহেতু হোটেল ব্যবসায় সম্পৃক্ত থেকে এসেছো, জিগোলো সম্পর্কে তো তোমার নিশ্চয় ধারণা আছে।
মুচকি হেসে শোভন বলে, কিছুটা আছে। কিন্ত ওসব সম্পর্কে আপনি জানলেন কিভাবে?
ইন্টারনেটের এ যুগে ওসব জানতে কি আর বাকি থাকে। তাছাড়া ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময়ই গুলশান-বনানী এলাকায় তখনি এসব ছিল বলে শুনেছি। এ ব্যবসা তো এখন সে এলাকাতে সীমাবদ্ধ নেই। পর্দার আড়ালে ঢাকার নানাস্থানে চলছে পুরোদস্তুর। ভারতের দিল্লি-কোলকাতা, শিলিগুড়ি প্রভৃতি শহরে এগুলো তো এখন বেশ জমজমাট। স্মার্ট বয় তুমি, ওসব খবর তো রাখো নিশ্চয়ই।
কিছুটা ধারণা আছে।
তাহলে কাজের কথায় আসি, তৃপ্তিদায়ক হোম সার্ভিস পেলে, আমি তার ন্যায্য বিনিময় দেব। যেহেতু নতুন রেস্টুরেন্ট। বলেছ -এখনো সার্ভিস দিয়েই চলছো, লাভের মুখ দেখতে পাওনি। হাতে টাকা নেই। এ বাড়তি কাজে আশা করি তোমার পুষাবে। তোমার মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে যাচ্ছি, আমারটাও দিচ্ছি। আমার বাসার ঠিকানাও লিখে দিলাম। আজ রাতেই আস। আমি অপেক্ষায় থাকব। ফোন করে এসো কিন্তু…।  
শোভন বুঝতে পারে, পুরাতন এ জেলা শহরে এমন একটি অভিজাত রেস্টোরেন্ট-ব্যবসার আড়ালে এ ব্যবসাটা গোপনে জমাতে পারলে অল্পদিনেই কাঁচা টাকার মালিক হওয়া যাবে। বিভাগীয় শহর বলে এ নগরে আছে বেশ কিছু অভিজাত পরিবার, সফল ব্যবসায়ী এবং অনেক সরকারি-বেসরকারি পদস্থ কর্মচারি। এসব পরিবারে নিশ্চয় আছে কিছু নিঃসঙ্গ মহিলা। গোপন ব্যবসাটা ওদের ঘিরেই জমে ওঠার সম্ভাবনা। তারপরও ভেতর থেকে কেনো যেনো স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পায় না শোভন। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে মনে মনে ভাবে, এটা বাংলাদেশ। এখানকার পরিবার, সমাজ- সংস্কৃতি আলাদা। তাছড়া এ কাজটি এখানে ধর্মের দিক থেকে যেমন মহাপাপ, তেমনি প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতেও অপরাধ। তাই মিসেস লিজার প্রস্তাবে রাজি হবে কিনা, সংশয়ে পড়ে। ভাবে, আজন্ম লালিত সমাজ-সংস্কৃতির শৃঙ্খল ভেঙে সে কি টাকার মোহে মিসেস লিজার আহ্বানে সাড়া দেবে? দোদুল্যমান মন তার সাড়া না দেওয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকে। সেই মানসিকতা নিয়ে রেস্টোরেন্টের কাজে মনোযোগী হয়। সময় গড়ায়। সে ফোন দেয় না। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে মিসেস লিজাই তাকে ফোন দিয়ে বলে, আমি তো অপেক্ষায়। রাত ন’টা তো কখনই পার হলো। কখন আসছো…!
শোভন আর না করতে পারেনি। বলে, একটু গুছিয়েই…।
আচ্ছা, অক্ষোয় রইলাম।
জি আচ্ছা।
শোভন ঠিক সাড়ে ন’টায় ম্যাডামের বাসায় কলিং বেলে চাপ দেয়। লিজা উন্মুখ অপেক্ষায়…। বেল বাজার সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। তারপর চকিতে শোভনের হাত ধরে ভিতরে টেনে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় লিজা। ড্রয়িং রুমে বসিয়ে বলে, খেয়ে এসেছো কি!
না। বাসায় ফিরে খাব ভাবছি।
আমার এখানে খাবার রান্না করা আছে। আগে খেয়ে নাও।
কাজের বুয়া রাত সাড়ে আটটায় চলে যায়। তাই নিজেই খাবার পরিবেশন করে। লিজার তিন বছরের শিশু মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে আগেই। দীর্ঘ এক বছরের নিঃসঙ্গ লিজা। এতদিন পর পুরুষ সঙ্গ পেয়েছে। সারা রাত কি ঘুম হয়! ভোরে এক তোড়া টাকা শোভনের হাতে তুলে দিয়ে বলে, আজ সারারাত ছিলে তাই একটু বেশি দিলাম। প্রতি সপ্তাহে তোমাকে একবার চাই। তোমার উপার্জন যাতে আরও বাড়ে তার কিছুটা ব্যবস্থা বোধ হয় করতে পারবো। নিচুস্বরে বলতে বলতে দরজা খুলে দেয়। ভোরের ট্রেনের যাত্রীর বেশে শোভন লিজার বাসা থেকে বের হয়।
আধাঘন্টা পর নিজেদের বাসায় গিয়ে গেটে কড়া নাড়ে শোভন। বাবা ততক্ষণে ভোরের হাঁটা শেষে বাসায় ফিরেছেন। শোভন বাসায় ঢোকামাত্র মা-বাবার তোপের মুখে পড়ে। মা বলে, রাতে কই আছিলি!
বন্ধুর বাসায়।
কোন বন্ধু!
শোভনের আমতা আমতা লক্ষ্য করে বাবা বলেন, বিয়ে করতে বলি, তা করবে না।  
মায়ের চোখে চোখ রেখে বাবা ফের বলেন, ও নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রথম দিনই পরিবার থেকে এমন একটা ধাক্কা খায় শোভন। তাই বাবার কথার কোনো জবাব না দিয়ে শোভন নিজের কক্ষে গিয়ে শোয়। ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাতে নয় হাজার টাকা তুলে দেয়। বাকি এক হাজার টাকা রাখে নিজের হাতে। বাবার অবসর ভাতার টাকা আর কত! মেজভাই ভূবন কিছু দেয়। এই দিয়েই তো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে  চলে সংসার। অনেকদিন শোভন বাবা-মাকে টাকা দিতে পারেনি। সকাল ন’টার দিকে মা বাজারের থলে আর টাকা হাতে দিয়ে শোভনের বাবাকে কাঁচা বাজারে যেতে বলেন। বাবা তো বাজারের টাকা পেয়ে ভালো কেনা-কাটা করতে পারলেই খুশি। টাকা পাওয়ার পর শোভনের প্রতি তাদের আর কোনো অভিযোগ রইলোনা।
লিজার জুটিয়ে দেওয়া আরও দু’জনসহ তিনজনের সাপ্তাহিক পরিষেবা দিতে হয় তার। ওদের স্বামীও বিদেশে। ধীরে ধীরে টাকাওয়ালা বিধবা, ডিভোর্সি এবং স্বামী বাইরে অবস্থান করে, এমন মহিলা মহলে তার কদর বাড়ে। প্রায় প্রতিদিন ফোন আসে। সপ্তাহে প্রায় চার-পাঁচদিন গোপনে গৃহ পরিষেবায় যেতে হয়। বাড়ে তার উপার্জন। এখবর তো সে এবং ওসব মহিলা ছাড়া আর কেউ জানে না। জানে না তার রেস্টেরেন্টের কেউ। মেয়েদের প্রতি একটু বেশি ঝোঁক দেখে সবাই ভাবে, অবিবাহিত, এজন্যই একটু বাড়তি ঝোঁক। আসলে কি তাই! এটা যেনো তার নেশা হয়ে গেছে। এভাবে মেঘে মেঘে বাড়ে বেলা। তাই পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ দিলেও কোনো একটা অজুহাতে এড়িয়ে যায় শোভন।
কিন্তু তন্বীকে ঘিরে বিয়ের সম্পর্ক আসার পর থেকে সে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত। নিজের ভেতরদেশে মহা তোলপাড়। কী করবে সে! মনে মনে তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। বিয়ে ভেঙে দেবে। ভাবে, কিছু পতিত মহিলার মনের শোকেসে কি কাগজের ফুল হয়েই থাকবে সে। নতুবা কাকতালীয়ভাবে তন্বী যে কথা বলেছে, তা কি তার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে! যদি তাই হয়, পারিবারিক-ধর্মীয় সংস্কার, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ কি জলাঞ্জলি দেবে! এ সমাজের চিরাচরিত বিয়ে-সংসার এসব থেকে কি সে বিযুক্ত থাকবে! যখন ভাবে বিয়ে করবে না, তখনি মনের চোখে ভেসে ওঠে তন্বীর মায়াবি মুখটা। কেমন যেনো অপার্থিব রোশনি ছড়িয়ে শোভনের মনের সব কালিমা দূর করে দিয়ে আলোর পথে হাতছানি দেয়। অন্যদিকে অর্থ আর নারীর নেশা। এ দুটি পক্ষের দোলাচলে পড়ে শোভনের আত্মসঙ্কটের জট খুলে না। সামনে তো বিয়ের আর দু’দিন বাকি। কী করবে সে?

লেখক পরিচিতি: থাসাহিত্যিক আবু সাইদ কামাল (জন্ম  ৫ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে, ময়মনসিংহ জেলায়) লিখছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। সত্তর দশকে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ নব্বইয়ের দশকে। নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন গল্প, উপন্যাস,  প্রবন্ধ, কবিতা, শিশুতোষ গল্প ও ছড়া। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩০টি।

ওমেন্স নিউজ/