মাহমুদা আকতারের গল্প ‘নিষ্ফলা স্বপ্নবেসাতি’

মাহমুদা আকতার

নিষ্ফলা স্বপ্নবেসাতি

তার কোনও বল নেই। নেই ঘুড়ি-নাটাই, খেলনা গাড়ি, লাটিম কিংবা সস্তা দামের দু’ চারটে মার্বেলও। ওর আছে কেবল সুবিশাল এক আবর্জনা ক্ষেত্রঅ ওই আবর্জনার স্তুুপ ঘেঁটেই সারাদিন কাটে তার। কাগজ, কাঠ, কাচ, তামা, দস্তা, লোহা, সিলভার যা কিছু কুড়িয়ে পায় দু’ হাতে সমানে সেগুলো চালান করে কাঁধের বস্তায়। ওর বিবর্ণ উদোম শরীর, তেল চিটচিটে প্যান্ট, রুক্ষ চুল আর কালি মাখা মুখের ওপর মেজাজি আকাশ তাপ ছড়ায় দিনভর। হাতের চেটোয় নাকের সর্দি মুছে কড়া রোদকে ভেংচি কেটে দু’ হাতে সে ময়লা ঘাঁটতেই থাকে। সত্যিকার অর্থে এইসব বালকদের জীবনে আনন্দ বিনোদন বলতে কিছু থাকে না। ওরও নেই। তাইতো মিউনিপ্যালিটির ময়লা বোঝাই গাড়িগুলোকে ঘিরেই ওর যত উল্লাস। ময়লা ফেলে গাড়িটা চোখের আড়াল হওয়া মাত্রই বিপুল উদ্যমে নতুন আবর্জনা স্তুপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। যদি বা ভাগ্যগুণে মূল্যবান কিছু পেয়ে যায়। কিন্তু বরাবরই ঊনকপালে সে। দাদার ভাষায় পোড়া কপাইল্ল্যা। নইলে ওদেও বস্তির কতজনে স্বর্ণের লকেট, পাঁচশ’ টাকার দোমড়ানো নোট, রূপার মল, লোহার চাকি এইসব দামি জিনিস পেয়েছে। কিন্তু ওর কপালে সেই হাবিজাবি। যা নিয়ে দিনশেষে ভাঙারির দোকানে এলিয়ে পড়া-ভাই, মাপটা ইট্টু ঠিকঠাক মতো দিয়েন।
-গেলি! বেশি কতা কইলে কিন্তু তর মাল কিনুম না। এইসব হাবিজাবি যে কিনি এইত্তো তর কপাল। দোকানি মুখ ভেংচালে চুপ হয়ে যায় সে।
ও প্রায়ই ভাবে একটা স্বর্ণের লকেট বা এ জাতীয় কিছু মূল্যবান জিনিস পেলে ওই ভাঙারির দোকানে আর যাবে না। সোজা বড় বাজারে গিয়ে জিনিসটা বিক্রি করে টাকাগুলো লুকিয়ে রাখবে। ভুলেও দাদাকে বলা যাবে না। লুকানো টাকা দিয়ে মনের সাধ মিটিয়ে বেশ কয়েকদিন মজা ফজা খাওয়া যাবে। রাস্তার ধারে সার বেঁধে বসে থাকা দোকানিদের সাজিয়ে রাখা রংবেরংয়ের খাবারের প্রতি ওর প্রচ- লোভ। আইসক্রিম, আচার, কাঠি লজেন্স, হাওয়া মিটাই, আলুর দম, চটপটি-আরও কত কি! নাম বলে শেষ করার না। আসা-যাওয়ার পথে খাবারগুলোর দিকে চোখ গেলেই জিবে পানি এসে যায়। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভাবে ভুলেও ওদিকে তাকাবে না। কিন্তু দোকানগুলোর সামনে এলেই মাথাটা আলগোছে ঘুরে যায় সেদিকে।
মাঝে-সাঝে দু একটা আধুলি সিকি লুকিয়ে রেখে আইসক্রীম-আচার-টিকটিকির ডিম-শনপাপড়ি-লাঠিওয়ালা চকলেট কিনে খায় সে। কিন্তু ল্যাংড়া বুড়োটা এমন পাজি ঠিক টের পেয়ে যায়। ওর ধারণা বুড়ো কারো মাধ্যমে খোঁজ নেয়। ও আবর্জনার ডিপোতে ঠিকঠাক মতো কাজ করছে কিনা সে দিকেও তীক্ষè নজর। অবশ্য এ নিয়ে বুড়োর তেমন কোনও অভিযোগ নেই। প্রতিদিন শুধু একটাই প্যানপ্যানানি-সারাদিন কি টোকাইলি তুই? এই কয়ডা ট্যাকা ক্যোন?
আসলে বুড়োর ভয়ে নয়, নিজের গরজেই ও ময়লার ডিপোতে টোকানির কাজ করে। এই ময়লা খোঁজাখুঁজির কাজে একটা নেশা আছে। নেশায় বুঁদ হয়ে দু হাতে আবর্জনায় সরায়-খুঁটে খুঁটে দেখে। তারপর সেখান থেকে প্রয়োজনীয় ও পছন্দের জিনিসনগুলো তুলে নেয়। দুপুরে একবার ইন্টারভেল। তখন রেলস্টেশনে ভিক্ষারত ল্যাংড়া বুড়োকে খাওয়াতে যায় ও। এই ফাঁকে নিজেও কিছু খেয়ে নেয়। এই হচ্ছে একজন অভিভাবকহীন হত দরিদ্র বালকের দিনযাপন। আবর্জনার স্তÍুপ, রেলস্টেশন, বস্তির একটা ঝুপড়ি ঘর এগুলোর বাইরে ওর জীবনে অন্য কোনও উপকরণ নেই। নেই কোনও কল্পনা বা স্বপ্নের জগত। ওর এই একঘেয়ে জীবনে অকস্মাৎ এক বৈচিত্র এসে টোকা মারে। ঘটনাটি খানিকটা বর্ণনার দাবি রাখে। কেননা এরকম একজন তুচ্ছ টোকাইয়ের জীবনে সাধারণত এ ধরনের ঘটনা ঘটে না-ঘটার কথাও না। কিন্তু ওর জীবনে ঘটে এবং যা অন্য রকম অভিজ্ঞতায় আপ্লুত করে রাখে দীর্ঘদিন ধরে।
অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বুড়োকে খাওয়ানোর পর দুপুরবেলা ফিরছিলো ও রেলস্টেশন থেকে।  রেলস্টেশন আর আবর্জনা স্তুপের ঠিক মাঝামাঝি এসে ওর পা থেমে যায়। ও দেখে একজন আগন্তুককে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা। লোকটার হাতে বাক্স বা এ জাতীয় কিছু নেই। খেলাও দেখাচ্ছে না সে। লোকটা কেবল বলছে আর তার চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষগুলো সবিস্ময়ে তা শুনছে। যেন এমন অদ্ভুত কথা আর কখনও শোনেনি তারা। ওইসব শ্রোতাদের মুখভঙ্গি ওকে কৌতুহলী করে। ও এক পা দু পা করে জটলার কাছে যায়। লোকটা কথা বলে আর টাকা নেয়। টাকা নেয় আর কথা বলে। আশ্চর্য ব্যাপার! শুধু কথা শোনার জন্য মানুষ টাকা দেয়? এগুলো আবার ক্যামন কথা যা টাকা দিয়ে শুনতে হয়! ও সব মনোযোগ ঢেলে দেয় শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের ওপর। কিন্তু বক্তার সব কথা জ্ঞানে দওে না ওর। চাকরি, বিয়ে, বাড়ি, কাজ এসব খ- বিখ- শব্দ কেবল বোঝা যায়। তবুও ও দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় জটলা ভাঙ্গে। একজন দু’জন করে উপস্থিত জনতার সকলেই ফিরে যায়। এবার মুখোমুখি হয় তারা দু’জন। একটি ভাগ্যহীন দরিদ্র বালক একজন মধ্যবয়সী রহস্যময় বাচাল পুরুষ। বালকের কৌতূহলী দৃষ্টি বা বিস্মিত মুখম-ল বক্তাকে আকৃষ্ট করে।
-কি রে, তোর কি চাই? এ কথার উত্তর না দিয়ে বালক উল্টো প্রশ্ন করে।
-তুমি কি বেচ?
-আমি স্বপ্ন বিক্রি করি।
-স্বপ্ন! এইডা আবার কি জিনিস?
-তুই কখনও স্বপ্ন দেখিস নাই?
– কি কইলেন, স্বপ্ন দেখুম! জীবনে নামই হুনি নাই।
-তুই রাতে ঘুমাস না।
-হ, ঘুমাই। নাক ডাইক্কা ঘুমাই।
-ঘুমের ভিতর কি দেখিস?
-কি আবার দেখুম। মানুষ আবার ঘুমাইলে দেহে নাকি। দুই চোখ বন্ধ থাহে না! বন্ধ চোখ দিয়া কি কিছু দেহন যায়?
-হ্যা, দেখা যায়। মানুষ চোখ বন্ধ করে যা দেখে তাই হলো স্বপ্ন। মানুষ সারাক্ষণ যা কল্পনা করে এবং মনপ্রাণ দিয়ে চায় অথচ পায় ন- ঘুমের ঘোরে সেগুলোই স্বপ্নে দেখে মানুষ। স্বপ্নই তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। যাদের জীবনে কোনও স্বপ্ন থাকে না তারা কোনোদিন বড় হয় না-সফল হয় না।
বালক তার দীর্ঘ বক্তৃতার এক বর্ণও বোঝেনি। অনেক শব্দ সে আজই প্রথম শুনতে পেলো। বালক বিড়বিড় করে শব্দগুলো আওড়ায়।
-কল্পনা, স্বপ্ন, বড় হওয়া, সফল হওয়া এসব কি কইতাছেন আপনি? আমি তো কিছুই বুঝতাছি না।
বালকের নির্বোধ সরলতায় লোকটা মজা পায়। তার দীর্ঘ ম্বপ্ন বিক্রির পেশায় নানা ধরনের মানুষ দেখেছে সে। আজ তার অভিজ্ঞতার ঝুলিটা আর একটু সমৃদ্ধ হলো এই যা! এই স্বপ্ন জিনিসটা অনেকেই বোঝে না। যারা বোঝে তাদেরও উপলব্ধিতে অনেক ভুল থাকে। এ জন্যই তার স্বপ্ন বেসাতি দিনে দিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যার ফলে এক সময়ের বেকার যুবক আজ অনেক সাহসী-আত্মপ্রত্যয়ী। নেই কোনও হতাশা বা দুঃচিন্তা। কয়েক হাজার টাকা মূল্যের একটা চাকরির জন্য আজ আর তার কারো দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দেয়া নাই। সে আজ এ শহরের একজন সফল স্বপ্নবণিক।
-তোর নাম কি?
-ফালাইন্যা।
-তোর বাপে কি করে?
-আমার বাপ-মা কেউ নাই। থাহি দাদার লগে। আপন না। পালক দাদা। ল্যাড়া। দুই ঠ্যাংই কাডা। আমি যহন খুব ছোড এক্কেরে কোলের গেদা বাচ্চা, তহন আমারে যেন কেডায় রেলস্টেশনে ফালায় গেছিলো। মাঘ মাইস্যা শীতে আমি মাটিত শুইয্যা হাত পা নাড়াইয়া কানতাছিলাম। বেবাক মানুষ খাড়াইয়া তামশা দেখতাছিলো। তহন দাদায় আমারে বুকে তুইল্ল্যা নেয়, তার চাদরের তলায় কইরা লইয়া আহে।
-আচ্ছা, খুব ভালো গল্প। এখন তোর কাছে কোনস টাকা পয়সা আছে? টাকা দিলে আমি তোকে স্বপ্ন চিনিয়ে দিতে পারি।
কৌতূহলী বালক তার কোমরের গুপ্ত স্থান থেকে দুটো টাকা বের করে আগন্তুকের হাতে তুলে দেয়। লোকটা টাকা দুটো নিজের পকেটে ভরে তাকে স্বপ্ন চেনাতে শুরু করে।
-মনে কর তোর মা আছে। মা মানে তোদের বস্তির মা না। তোরা ভদ্রলোক। তোর মা ফকফকা শাড়ি পরে। তুই রাস্তায় এসব সুন্দর সুন্দর বেটিদের দেখিস না? এনে কর সে রকম একজন বেটি তোর মা। তুই তার বড় আদরের সন্তান। প্রতিদিন সকালে মা তোকে স্কুলে নিয়ে যায়। তোর পরনে থাকে সাদা শার্ট, নীল প্যান্ট, পায়ে চকচকে জুতা, পিঠে বইয়ের ব্যাগ আর কাঁধে পানির ফ্ল্যাক্স। তুই  তোর মায়ের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাস। স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে মোছওয়ালা দারোয়ান যে তোদেও দেখে সালাম দেয়। তোর মা তোকে স্কুলের গেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।
-তারপর? বালক সাগ্রহে প্রশ্ন করে।
-মাত্র তুই টাকা। অনেক বেশি বলে ফেলেছি। আজ আর না। আবার একদিন বেশি টাকা আনিস অনেক করে গল্প শোনাবো।
-এইডা কি হইলো?
-এই হইলো স্বপ্ন।
মা, স্কুল, দারোয়ান এসব ভাওতাবাজি দিয়ে টাকা দুটো নিযে গেলো। এর চেয়ে দু টাকার আইসক্রিম আর শনপাপড়ি খাওয়াও তো অনেক ভালো ছিলো। সারা বিকেল আফসোসের সীমা থাকে না তার। সন্ধ্যায় ঝুঁপড়িতে ফিওে দাদার হাতে তুলে দেয় সারা দিনের উপার্জন। বুড়ো মুদ্রাগুলো গুণতে গুণতে প্রশ্ন করে-কি রে আইজ কয় টেকা মারছত?
-রোজ রোজ এক কতা আর ভাল্লাগে না। তুমি আমার লগে গেলেই পার, এতই যহন সন্দেহ!
-হোন তোর বালার লাইগ্যাইতো কই। এই টেহা কি আমি কব্বরে লইয়া যামু? আমি মইরা গেলে কার কাছে থাকবি? তোর মতো এতিম পোলারে কে দেখবো?
ল্যাংড়া বুড়ো কাঠের আচ্ছাদনটা সরিয়ে মাটির গর্ত থেকে টিনের কৌটাটা বের কওে আনে। ভাংতি পয়সা আর নোটগুলো এক এক করে যতেœর সঙ্গে কৌটার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর ছোট্ট একটা ঝকি দিয়ে কৌটার মধ্যে থাকায় মুদ্রাগুলোর পরিমাপ আন্দাজ করে। এটা তার রোজকার কাজ। পয়সাসমেত কৌটাটা যথাস্থানে রেখে ফালাইন্যার দিকে ফিরে বলে,
-হায় খোদা! এহন তক অর্ধেক। কবে যে ভরবো এই বাক্স। বাক্স ভরলে বেবাক টেহা দিয়া তোরে স্টেশনে একটা চায়ের দোকান লইয়া দিমু। স্টেশন মাস্টাররে ম্যালা দিন ধইরা পটাইতাছি। হারামি এহন তক রাজি হয় নাই। তয় কিছু ঘুষটুস দিলে ঠিকই রাজি হইবো। তয় স্টেশনের মাস্তানগোরেও তো কিছু দেয়ন লাগবো। নইলে স্টেশন মাস্টার রাজি অইলেও কোনো কাম অইতো না, হেরা তরে দোকান লইয়া বইতেই দিবনা।
এরপরই বুড়া তাকে শাসাতে শুরু করে,
-খবরদার ভুলেও এই বাক্সে হাত দিবি না। এই বাক্সডাই হইলো তর ভবিষ্যৎ। এইডা ভরলে আমার মতো তরে আর ভিক্কা কইরা খাওন লাগবো না। আবর্জনায় গিয়া অইসব গু-মুত লইয়াও হাতাহাতি করতে হইবো না। দোকানে বইয়া চা-বিস্কুট বেচবি। ভদ্রলোকের কাম।
এইসব একঘেয়ে বকবকানি একদম ভাল্লাগেনা। তবুও রোজ সন্ধ্যায় চুপচাপ দু’ কান দিয়ে ঢুকাতে হয়। মনে মনে বুড়োকে ভেঙায়-ইঃ চা বিস্কুট বেচবি! সারাদিন একখানে বইয়া থাকা ভদ্রলোকের কাম? গুল্লি মারি!
-অন্ধকারের মইধ্যে বইয়া দাদা নাতি কি এত রসের গল্প করে গো? কুপি হাতে ঘুরে ঢুকে আছিয়ার মা। মধ্যবয়সী এই নারীকে দেখে যেন বেঁচে যায় ফালাইন্যা।
-আহ দাদি। তেল নাই। তাই কুপি জ¦ালাই নাই। তুমি আইয়া ভালোই করছো।
বুড়ো ফালাইন্যাকে বলে-অই তুই খাইয়া লইয়া হুইত্যা থাক। আমরা দুই বুড়াবুড়ি মিল্ল্যা গপসপ করি।
ফালাইন্যা নেতিয়ে পড়া কলাটা দিয়ে শুকনো রুটি চিবোয়। তারপর ঢকঢক করে পানি খিয়ে খাটিয়ায় গিয়ে তেল চিটচিটে বালিশের গায়ে মাথা রাখে। এরপরই অন্ধকার হয়ে যায় ঝুপরিটা। নিচে বুড়োবুড়ির টুংটাং আলাপ। কুটকুট হাসি চলতেই থাকে। একসময় হাসি গল্প থামে। কেবল কানের দরজায় এসে টোকা দেয় তাদেও ভারী নিঃশ^াসের শব্দ। বালকের গা ছমছম করে। ঘুম আসে না। কয়েকটা আধুলি খোয়ানোর অনুশোচনায়্ নিজের বোকামিতে নিজের ওপরই ক্ষুব্ধ সে। বুড়োর শকুনের মতো চোখ দুটোকে  ফাঁকি তিন দিন ধরে জমিয়েছিলো কিছু মুদ্রা। সেখান থেকে দুইটা টাকা হাওয়া হয়ে গেলো। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ বুঁজে আসে তার।
প্রথমে ধোঁয়া। কেবলই ধোঁয়া। ধোঁয়ারা অসংখ্য রিঙয়ের আকারে ঝুলে থাকে। ধীওে ধীরে ধোঁয়ার আচ্ছাদন সরে যেতে থাকে। ধোঁয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে একটি মুখ। প্রথমে আবছা হলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় সেই মুখম-ল। আর তখনই অনুভব সে করে বড় মায়াবি সেই মুখ, যা এই বস্তির কোনও নারীর মধ্যেই দেখেনি সে। সেই মুখ কীভাবে যেন পূর্ণাঙ্গ মানবী হয়। মানবী হাত বাড়ায়। ফালাইন্যা উড়ে গিয়ে অদ্ভূত সেই মায়াবতীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর স্বপ্নের মধ্যেই কীভাবে যেন সে বুঝে যায় এটাই তার মা যার কথা শুনেছিলো সেই স্বপ্নবণিকের মুখে। ও মায়ের হাত ধরে হাঁটতে থাকে- এ রাস্তা থেকে সে রাস্তা-এক গলি থেকে অন্য গলি। রাস্তার পর রাস্তা-গলির পর গলি পেরুতে থাকে তারা। এভাবে কত গলি আর রাস্তা যে তারা পেরিয়ে আসে! তারপরও তারা হাঁটতেই থাকে। শেষে বিশাল এক অট্টালিকার সামনে এসে শেষ হয় তাদের দীর্ঘ যাত্রা। এইতো সেই স্কুল। মোছওয়ালা দারোয়ান। থলথলে ভুরি। হাতে মোটা লাঠি। মা তার কপালে চুমু খেয়ে বলেন- যাও আব্বু, স্কুলে যাও। স্কুল ছুটি হলেই আমি এসে তোমাকে নিযে যাব।
ফালাইন্যা খোলা ফটক দিয়ে স্কুলে ঢুকতে যেতেই পথ আগলে দাঁড়ায় দারোয়ান।
-এই ছেমড়া, তুই কই যাস?
-আমি স্কুলে যামু।
-গেলি। লাঠি হাতে নিয়ে ওকে তাড়া করে পেট মোটা দারোয়ানটা। ও কষে দৌড় দেয়। দৌড়াতে দৌড়াতে কতো গলি কতো পথ যে পার হয় সে! তবুও দারোয়ান পিছু ছাড়ে না। ফালাইন্ন্যা দিশেহারা হয়ে সিড়ি বেয়ে বেয়ে অনেক উঁচুতে উঠতে থাকে। সিড়ির শেষ মাথায় বিশাল ছাদ। সেখানেও লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে সেই দারোয়ান। সামনে শূন্যতা, পিছনে দারোয়ান। ফালাইন্যা এখন কি করে? ও শূন্যতাকে আলিঙ্গন করে দু’ হাত বাড়িয়ে ঝাঁপ দেয় এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে সে কেবল নামতেই থাকে। মনে হয় আকাশ থেকে পড়ছে সে। পতন রোধে কিছু একটা অবলম্বন খুঁজে সে। কিন্তু সেখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। অজানা আশঙ্কায় বুক ধুঁকপুক করে। ও সজোরে চিৎকার করতে চায়। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চায় না। শেষে আতঙ্কিত হয়ে দুই হাতে কিছু একটা চেপে ধরে সে। আর তখনই সে উপলব্ধি যে যেটা জড়িয়ে ধরেছে সেটা আর কিছু নয়-তার  তেল চিটচিপে বালিশ। রাজ্যের বিরক্ত নিয়ে ও চোখ মেলে তাকায়। দেখে ওর মুখের ওপর উবু হয়ে আছে ল্যাংড়া বুড়ো।
-কিরে অমুন চিক্কুর পারতাছোস ক্যান। খোয়াব দেখতাছিলি?
ফালাইন্যা কোনও জবাব দেয় না। কেবল ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যা দেখে আবার তাড়া দেয় বুড়ো।
-কিরে কথা কস না ক্যান? তরে কি কানাওয়ালায় ধরছিলো? যাাউক্কা আর হুইয়া থাকিস না। অহন উঠ, চালাক চালাক রুটি খাইয়া কামে যা।
অই বুইড়া বেশি প্যাট পেটাইছ না। আমি আইজ ময়লা গাটবার পারমু না। শইলডা খুব খারাপ।
মাত্র তো দুই টাকার স্বপ্ন! এই স্বপ্নের এত শক্তিÍ-এত ক্ষমতা! অহর্নিস ওকে বুঁদ কওর রাখে। মা, স্বপ্ন, দারোয়ান, লাঠি এসব ওকে নিদারুন যন্ত্রণায় পিষ্ট করতে থাকে। ওই স্কুলের ভিতওে না ঢুকতে পারা পর্যন্ত যেন ওর শান্তি নেই। ওইসব উঁচু প্রাচীর ঘেরা অট্টালিকাগুলোর ভেতরটা কেমন এবং সেখানে কি হয়, এইসব প্রশ্নের উত্তর ওই বস্তির কারো জানা নাই। কাজেই বালক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে স্বপ্ন বণিকের জন্য। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আবার একদিন সেই বাক যাদুকরের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাত ঘটতেই সে গতবারের মতো এবারও শরীরের গোপন স্থান থেকে কয়েকটা আধুলি বের করে স্বপ্নবণিকের হাতে দেয়। প্রসন্ন স্বপ্নবণিক স্বপ্ন বর্ণনার প্রস্তুতি নেয়।
-আজ তোকে আরও সুন্দর স্বপ্ন দেবো।
-তার আগে তুমি আমাওে কও স্কুল কি? ওইহানে কি হয়?
-স্কুল মানে বিদ্যালয়।
-বিদ্যালয় আবার কি জিনিস?
-অঃ! বিদ্যালয় হইলো বিদ্যা শিক্ষার বাড়ি। ওই বাড়িতে গিয়ে মানুষ শিক্ষিত হয়-জ্ঞান বাড়ে তাদের।
-জ্ঞান, বিদ্যা, শিক্ষা? এইসব কি কইতাছ? ওইসব দিয়া কি করে মানুষ?
-ওহ, তোকে নিয়া তো বড় বিপদ। তোর মতো আন্ধারে আমি হাতি চিনাই ক্যামনে। শোন, তুই যেমন সকালে উঠে বস্তা নিযে ময়লার ডিপোর দিকে ছুটিস, তেমনি ভদ্রলোকের পোলাপান সকালে বই খাতা নিয়ে যায় স্কুলে। এখন অবশ্য সরকারি আর বিদেশি এসজিওগুলোর দয়ায় তোর মতো ছোটলোকের পোলাপানও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তবে সবাই না, গুটিকয়েক। এই দেশে হরেক রকম স্কুল আছে। গরিবের স্কুলে একরকম পড়া-বড়লোকের স্কুলে আরেক রকমের লেখাপড়া। গরিবেরা পড়ে ক খ আর দুই তিন। বড়লোকের বাচ্চারা পড়ে এ বি সি আর ওয়ান টু থ্রি। গরিব পোলাপাইনে পড়ে আনু আর আবুর কাহিনী, বড়লোকের পোলাপান পড়ে জন আর জিসানের কাহিনী। গরিবদের স্কুলে ছোট ক্লাসে পড়তে কোনও টাকা লাগে না। বরং স্কুলে গেলে সরকার ওদেও গম আর চাল দেয়। আর বড়লোকের বাচ্চাদের পড়াশোনায় বহু খরচ। বেতন তো আছেই-তারওপর বই-খাতা, প্রাইভেট স্যারর বেতন, টিফিন এইসব হাবিজাবি মিলাইয়া একটা দুধের বাচ্চার পিছনেও কমসে কম দশ পনের হাজার টাকা লেগে যায়।
-তাইলে তো দেহা যাইতাছে এই দেশে গরিব হওয়াই ভালো।
-গরিব মাইনষের বুদ্ধি এমনই। শোন বেক্কল, সস্তার তিন অবস্থা। তাই গরিবদেও এসব মাগনা পড়া কোনও কাজে লাগে না। গ্রামের গফুর সেই গফুরই থাকে। বড়জোর চৌকিদার বা মুদি দোকানদার। আর বেশি চেষ্টা করলে না হয় মাদ্রাসা বা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আর নইলে মামা চাচা ধইরা ঘুষ টসি দিয়া সরকারি অপিসে একটা টাইপিস্টের চাকরি। এই তো মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। মাটি ছাইড়া পিড়ি, আর পিড়ি থুইয়া গদি ছাড়া শক্ত কাঠের চেয়ারে বসার সুযোগ। এই তো দরিদ্র শিক্ষিতদেও ক্ষমতা। আর এইসব ভদ্রলোকদের দেখ ওরা ভালো ভালো স্কুলে পড়ে, স্কলারশিপ নিয়া বিদেশে পড়তে যায়, গবেষণা করে, ভালো চাকরি পায় যেখাসে কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন। হাজার হাজার মানুষ তাদের কথায় উঠে বসে। কত সমাদর, কত সম্মান। এই আমাকেই দেখ না-গরীবের পোলা, সস্তা স্কুলে পড়ছি। এম এ পাস করেও ইংরেজি কইতে পারি না। ইংরেজি তো দূরের কথা, শুদ্ধ বাংলায় কথাই কইতে পারি না। ওজনদার মামা চাচাও নাই, তাই চাকরিও পাই নাই। তাই এখন স্বপ্ন বেচি। এইটা একটা স্বাধীন ব্যবসা। হাঃ হাঃ হাঃ।
এই বলে সজোরে হেসে ওঠেন স্বপ্ন বণিক।
-আপনি এইসব হাবিজাবি কি কইতাছেন, আমি তো কিছুই বুঝতাছি না।
-এত বুইঝা কাম নাই। তিন টাকার স্বপ্ন বাড়ি যা। কোথায় যেন শেষ করছিলাম? ও হ্যা, মনে পড়ছে। আজ তো তুই স্কুলে ঢুকবি।
-স্বপ্নে তুই হলি বড়লোকের ছেলে। শহরের নামী দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িস। তোর মা গাড়িতে করে তোকে স্কুলে দিয়ে আসে। স্কুলে ম্যাডাম আছে, স্যার আছে কী মিষ্টি তাদের ব্যবহার! বড়লোকের ছেলেমেয়েরা পড়ে-কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন দেয়। ওদের সাথে রাগ করবে কোন সাহসে। স্কুলের কমনরুমে কত খেলনা। টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ক্যারাম বোর্ড, পিন বোর্ড, দাবা আরও কত রকমের খেলার সরঞ্জাম। টিফিন টাইমে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে টিফিন খাবি। আহ্, কি মজা! কলা, আপেল, পিম সিদ্ধ, বার্গার, নুডলস, পিৎজা, বিরিয়ানি-একেক দিন একেক পদ। স্যান্ডউইচ চিনিস?
-আইসক্রিম নাই?
-নাই মানে? ওগুলি কি এই টাকা, দুই টাকা দামের আইসক্রিম! ওই আইসক্রিমের স্বাদই আলাদা। ছুটি হলে স্কুল থেকে বাসায় আসবি। বাড়িতে তো আরও আরাম। আরে, ওগুলি তো বাড়ি না, বেহেশতখানা। আল্লাহতালায় বেহেশতে যা যা রাখছে তার সবই আছে ওইসব বাড়িতে। পরকালের বেহেশত দিয়া ওরা কি করবো, দুনিয়াতেই তো ওরা জান্নাতের সুখ ভোগ করছে।
-অগো বাড়িতে কি কি আছে?
-অগো বাড়ি না, তোর বাড়ি। স্বপ্নবণিক আবার ওকে স্বপ্নের জগতে প্রলুব্ধ করতে তৎপর হয়।
-ওই বাড়িতে তোর খেলার জন্য আলাদা একটা আস্ত ঘর আছে। সেই ঘরে নামী দামী কত খেলনা। শোবার ঘরে গদি আঁটা দুধসাদা বিছানা। শুলেই আধ হাত ভিতওে ঢুকে যায়। ওই ফুলের মতো বিছানায় শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখবি, ল্যাপটপ বা ট্যাপ চালাবি। আর কিছু খেতে মন চাইলে বেল টিপবি। সঙ্গে সঙ্গে উর্দি পরা বেয়ারা এসে হাজির। তুই শুধু হুকুম করবি। হরেক পদের খাবার দিয়ে সাজানো থাকবে টেবিল। তোর যেইটা মন চায় সেইটাই খাবি। আহারে কী সুখ! তুই তো পাগল হয়ে যাবিরে ফালাইন্যা।
ব্যাস, এটুকু বলেই স্বপ্নবণিক বন্ধ করে তার কল্পনার ঝাঁপি।
-আর ইট্টু কওনা বাই। বালকের অনুনয়ে মন টলে না কথকের। সে নিষ্ঠুরভাবে বলে।
-আজ এ পর্যন্তই। আগামীকাল বেশি করে টাকা আনলে আরও সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দিবনে তোরে।
আজকাল আবর্জনাক্ষেত্র ওকে আর আগের মতো টানে না। এখন কেবল স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্নবণিকের জন্য প্রতীক্ষায় দিন গোণা। হাতটানও বাড়ছে সমান তালে। ওদিকে বুড়োর বিরক্তি শেষ নেই। তার অবিশ^াসের সীমানাও আকাশ ছুঁতে চলেছে। এখন তো প্রায়ই ওকে তাড়িয়ে দেবার হুমকি দেয়। এসব হুমকিতে কোন কাজ না হওয়ায় কেবল দাঁত কড়মড় করে। বালক এসব দেখে আর মনে মনে বলে-রাখ ব্যাটা, আর কয়ডা দিন। তরে তো আমি খেইল দেখামু।
অবশ্য স্বপ্নবণিকের স্বপ্নেও ওর এখন আর মন ভরছে না। পয়সার তুলনায় স্বপ্নের পরিমাণ যেন একেবারে অকিঞ্চিত। কখনও টিফিন খাবার বর্ণনা, কখনও শিশুপার্ক বা চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যাওয়া আর মায়ের ওকে ঘুম পাড়ানোর ফিরিস্তি। এসব বিষয়গুলো এতটাই অভিনব আর রোমাঞ্চকর যে এর এক একটা বিষয় নিয়েই হাজারটা স্বপ্ন তৈরি করা যায়। কিন্তু কোনও রকম পূর্ব ধারণা না থাকায় এসব নিয়ে স্বপ্ন তৈরিতে তেমন সুবিধা হয় না ফালাইন্যার। কাজেই আবারও স্বপ্নবণিকের দারস্থ হওয়া-আবারও কিছু আধুলি বিকিয়ে দেয়া।
-তুমি আমারে আর ইট্টু বেশি স্বপ্ন দিতে পার না?
-পয়সা বেশি দাও। স্বপ্ন বেশি পাবা।
-আচ্ছা, এইসব স্বপ্নগুলান তুমি কি সত্যি করবার পারো না?
-না বোকা। এইটা পারলে আমি কি আর স্বপ্ন বেচতাম? নিজের মর্জিমতো কিছু একটা হয়ে যেতাম।
প্রতিবার স্বপ্নবণিক এমন একটা জায়গায় এনে স্বপ্নটা শেষ করে যে পরের কিস্তির জন্য মন আনচান করে। তাতে কি? চাইলেই তো আর স্বপ্নবণিকের কাছে ছুটে যাওয়া যায় না। পয়সা কোথায় পাবে ও। কিছু পয়সা জমাতে কয়েকদিন তো লাগেই। এজন্য ল্যাড়াবুড়োর কত দাঁত খিচানিই না সহ্য করতে হয়। নতুন নতুন স্বপ্ন পাওয়ার জন্য ওর অস্থিরতা দিন দিন বাড়তেই থাকে। সব স্বপ্ন একসঙ্গে পেলে হয়তো এই ভাবটা আর থাকতো না-ঘোরটাও যেত কেটে। কিন্তু এত টাকা ও কোথায় পাবে?
ওদিকে দিনে দিনে বুড়োর শাসানি বেড়েই চলেছে। মতিগতিও বিশেষ ভালো ঠেকছে না আজকাল। হাবেভাবে মনে হয় যে কোনও দিন ওকে তাড়িয়ে দিতে পারে। ওর নিজেরও এখন আর এই ঝুপরিতে থাকতে ভাল্লাগছে না। বস্তি, আবর্জনা স্তুুপ, দড়ির খাটিয়া, দেড় পা বিশিষ্ট ভাঙাচোরা একজন পুরনো মানুষ-সব মিলিয়ে গোটা পরিবেশটাই অসহ্য ঠেকে। অথচ এখানেই তার জন্ম, টিকে থাকা আর এতটা বয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠা। যদিও এসব বাস্তবতা একেবারে ফালতু মনে হয় ওর কাছে। কারণ ওর যুক্তিতে এভাবে বেঁচে থাকার চাইতে পৃথিবীতে না আসাটাই অনেক বেশি অর্থপূর্ণ আর সঠিক।
ফালাইন্যা এখন রাস্তায় গাড়িতে বসে থাকা সুন্দরী নারী আর স্কুলগামী সুশীল, সুবেশী বালকদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ওদেরই মতো কি সুন্দর একটা জীবন পাওয়ার কথা ছিলো না ওর, যদি না বেজম্মা বুড়োর বদলে ওই শ্রেণিরই একজন ওকে তুলে নিতো। কিংবা ওর জন্মই হতো ওইসব বেহেশতি বাড়ির কোনও একটিতে। এইসব কথা মাথায় এলে ও কেবল বেয়ারা ভঙ্গিতে পা নাড়িয়ে বলে-
-ময়লা টোকানি আমার আর ভাল্লাগে না।
-জমিদারের পুত। ময়লা টোকাবি না। অহন তাইলে কি করবি তুই?
এই নিদারুণ বাস্তব সত্যের কোনও উত্তর জানা নেই ওর। ও গোঁয়ার ছেলের মতো মাথা গোঁজ করে বস্তা হাতে বেরিয়ে পড়ে। স্বপ্নময় চোখে ময়লা কুড়ায়। ভাঙা কাচ, জং ধরা লোহা, পুরনো দস্তা বা সিলভার, টুকরো কাগজ-এগুলোকেই মনে হয় বই-খাতা-কলম। বিস্তিীর্ণ আবর্জনা স্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আনমনে আলাপ করে। কখনও কল্পিত মা, কখনো বাবা, কখনও বা টিচার বা বন্ধুদের সঙ্গে। এভাবেই আলগোছে সূর্য ডোবে। ওর ঘোর ভাঙে এবং অনুশোচনায় দগ্ধ হয়। শূন্য বস্তা হাতে বাস্তবের ময়লার ডিপো পেরোতে পেরোতে স্বপ্নগ্রস্থ বালক ভাবে এসব ঝুটা স্বপ্নের শেষ সীমানা কি? আমার এর শেষটা জানা চাই।

অবশেষে আসে সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দিন। যেদিন সে বাস্তবতা, মায়া-মমতা, মুক্তি সবকিছু অগ্রাহ্য কওর গর্ত থেকে বের করে আনে বুড়োর যক্ষের ধন-পয়সা ভর্তি কৌটোটা। এরপর সে কৌটো হাতে ছুটে আসে রাস্তার ধারে অপেক্ষমান স্বপ্নবণিকের কাছে। স্বপ্নবণিকের চোখের সামনে কৌটাটা তুলে ধরে সে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
-স্বপ্নবণিক শুরু কর। এই ডিব্বা ভরা পয়সা সব তোমার। তুমি কেবল স্বপ্ন দিয়া আমার মনটাওে ঠাণ্ডা কর। স্বপ্নবণিকের দুই চোখে লোক চকচক করে। যেন জাদুকরের চেরাগ হাতে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বালক আলাদীন। এর আগে এক সাথে এত স্বপ্ন তো কেউ কিনতে চায়নি ওর কাছে। বণিক তুষ্ট মনে স্বপ্নের জাল বিছাতে শুরু করে।
– শোন ফালাইন্যা। ওহ, তুই ফালাইন্যা হবি ক্যান? ওইসব পরিবারের ছেলেদের নাম তো ফালাইন্যা হয় না। তুই জুয়েল, সত্যিকারের জুয়েল যেন। এমন ভালো ছেলে আর হয় না! বাবা-মায়ের কলিজার টুকরা তুই। চোখের আড়াল না হতেই মা ব্যাকুল হয়ে ডাকেন-বাবা জুয়েল, আমার জুয়েল কই? আয় সোনা, দুধটুকুন খেয়ে যা।
-স্কুলের টিচাররাও খুব আদর করে জুয়েলকে মানে তোকে। আদর করবে নাই বা কেন বল! ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তুই। ক্লাস ফাইভে বিত্তি পাইলি, একেবাওে প্রথম গ্রেডে। পেপারে তোর ছবি ছাপলো। এরপর এইটেও বৃত্তি পাইলি। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করলিভ রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকাগুলোতে বাবা-মায়ের সঙ্গে তোর ছবি ছাপা হলো।
-শোনো ভাই। এইহানে কিন্তু অনেক টেকা। এহন পর্যন্ত তুমি এই ডিব্বার টেকার চার ভাগের এক ভাগ স্বপ্ন কিন্তু কইতে পার নাই। কথাডা মনে রাইখো।
-আরে ব্যাপা, অস্থিও হস ক্যান! আমি কি স্বপ্ন কওয়া বাদ দিছি? আমি তো আস্তে আস্তে কইতাছি। তোরে আইজ আমি স্বপ্ন দিয়া পাগল বানাইয়া ফালামু, বুঝতে পারছিস। স্বপ্নবণিক আবার বালকের ওপর কথার জাদুবিদ্যার প্রয়োগ শুরু করে।
-এসএসসি মানে ম্যাট্রিক পাসের পর তুই আইএ পাস করলি। এরপর ভর্তি হলি ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে গিয়াই ছাত্র রাজনীতিতে জড়াইয়া পড়লি যেমনটা সেখানকার বেশিরভাগ পোলাপাইন করে। কয়েক দিনের ভিতর তুই বড় নেতা বনে গেলি। দলের তাবড় তাবড় নেতারা তো কমই মিনিস্টারদের কাছেও তোর কদর।
-আওে মিনিস্টার হইলো মন্ত্রী, জীবনে মিনিস্টার শোনস নাই? বালক মাথা নাড়াতেই বিরক্ত হয় স্বপ্নবণিক।
-এইভাবে মাঝখানে কথা বললে তো আমার স্বপ্ন বয়ানের তাল কাইট্টা যায়।
-আইচ্ছা তুমি শুরু করো। আমি আর মাঝখানে থামামু না তোমারে।
-জুয়েল মানে তোর ছাত্র রাজনীতিতে জড়ায়ে যাওয়ার বিষয়টা তোর বাবা-মায়ের পছন্দ না। তোকে নিয়ে তাদের খুব ভয়। তারা তোকে রাজনীতি ছাড়তে বলে। কিন্তু তুই তাদের কথা শুনতে চাস না। শেষে তারা তোকে জোর করে আমেরিকা পাঠায়ে দিলো।
-আ¤্রকিা! সেইটা আবার কি?
-আরে গাধা, তুই কখনও আমেরিকার নাম শোনস নাই? হেইটা হইলো আরেকটা দেশ। তবে বাংলাদেশের মতো না। আমেরিকা হইলো দুনিয়ার বেহেশত, এক্কেবারে জান্নাতুল ফেরদৌস। সারা দুনিয়ার মানুষ খালি আমেরিকায় যাইতে চায়। একদিন আমি তোকে আমেরিকার ছবি দেখাবোনে।
-আইচ্ছা বুঝলাম। লেহাপড়া তো অনেক হইলো, আম্্িরকাও গেলাম। হেরপর কি? অ্যালা হেইডা কও।
– আমেরিকাতে খুব ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করলি তুই। এরপর ওই দেশে বড় একটা চাকরি পাইলি। কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন। নিজের টাকায় আমেরিকার মতো দেশে বাড়ি, গাড়ি কিনলি। কি ডাট তোর! কে বলবে তুই এককালে কাগজ টোকাইতি!
-তুমি এগ্লান কি কও! আমি যদি কাগজ টোকানি হইতাম তাইলে কি এতকিছু করবার পারতাম, দুন্নিয়্যাইর বেহশত মানে আ¤্রকিা যাইবার পারতাম? তুমি না সেই কহন থেইহা কইতাছ আমার নাম জুয়েল!
-আরে হ, ভুইলা গেছিলাম। এইভাবে বার বার থামাইলে কি আর জুইত মেতা স্বপ্ন বয়ান করা যায়? কথা না কই এহন চুপ কইরা শুনতে থাক।
আসলে স্বপ্নবণিক ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলেছে। তার স্বপ্ন ভা-ার ক্রমশঃ শূন্য হওয়ার পথে। তাছাড়া এর বেশি তো সে জানেও না। নিজের জীবনেও তো তার এটুকুই স্বপ্ন ছিলো। কিছু ডিগ্রি, একটা ভালো চাকরি, এরপর কোনও রকমে দেশ ছেড়ে উন্নত দেশে পাড়ি জমানো। এর সবটাই তো বালককে উজার করে দিয়েছে। এখন আর সে কিভাবে আর প্রভাবিত করতে পাওে এই স্বপ্নখেকো বালককে!
-এবার তোর নাম, যশ, প্রতিপত্তি গোটা বিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের মানুষও তোকে দাম দেয়। গর্বে মাটিতে পা পড়ে না তোর বাবা-মায়ের। তুই হইলি এই বাঙলার গর্ব। দেশের বড় বড় মাথারা পর্যন্ত তোর কাছে পরামর্শ নিতে আসে।
-এইরকম হইয়া আমার লাভটা কি?
-আওে বেক্কল, তুই এইডা কি কস! তুই বুঝস, তুই কত বড় একখান ব্যাডা হইছস!
বালক আবার তার হাতের কৌটায় ঝাঁকুনি দেয়। কৌটার ভিতরে থাকা মুদ্রাগুলো তখন নাচতে থাকে। ঝনঝন, ঝনঝনাঝন, ঝনঝন। সেই নৃত্যের আওয়াজে স্বপ্নবণিকের রক্তচাপ বাড়ে। মুখম- দিয়ে ঝড়ে পড়তে থাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কেমন অস্থিও লাগছে তার। এতদিনের পেশা জীবনে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়নি সে। মাত্র গোটা কয়েক স্বপ্ন নিয়ে মানুষ কি সুন্দর খুশি মনে বাড়ি চলে যায়, কেউ কেউ তো গোটা জীবন পার করে দেয় এরকম একটা বা দুটো স্বপ্ন নিয়ে। আর এই স্বপ্নরাক্ষসের যেন মনই ভরছে না। আর কত স্বপ্ন চাই তার! এতো দেখা যাচ্ছে তার গোটা স্বপ্নভা-ারই খেয়ে ফেরবে। স্বপ্নবণিক এসব ভাবতে ভাবতে আবার স্বপ্ন বর্ণনায় তৎপর হয়।
-তুই এত বড় হইলে কি হবে তোকে ছেড়ে থাকতে তো তোর বাবা-মায়ের ভালো লাগছে না। তারা তো তোকে দেশে ফিওে আসতে বলে। কিন্তু আমেরিকায় এত কাজ ফেলে তুই দেশে আসবি কীভাবে। শুরু হয় নানা ঝামেলা।
এইটুকু বলে স্বপ্নবণিক থামে। একটু দম নেয়। অস্থিও বালক তাকে তাড়া দেয়।
-কও বণিক কও। এই ডিব্বা পাইতে গেলে এহনও তোমারে বহুত স্বপ্ন কইতে হইবো। এক কথা বার বার স্ক্রির মতো প্যাচাইয়া প্যাচাইয়া অনর্থক সময় নষ্ট কইরো না। স্বপ্নবণিক স্বপ্ন ছড়ায়। আগ্রহী বালক ক্রমাগত তাড়া দেয় এবং দিয়েই চলে-তারপর-তারপর-তারপর। তারপর কি হইলো কও তাড়াতাড়ি।
এভাবে এক নাগাড়ে স্বপ্ন বর্ণনা করতে করতে পুরোপুরি খেই হারায় বণিক। স্বপ্ন বর্ণনার শৈল্পিকতা নষ্ট হয়। তাল-লয় হারিয়ে সে কেবল বকে চলে। বালক এতে বিরক্ত হয়।
-ওহ, এইসব নষ্ট, পুরান, একঘেয়ে প্যানপ্যানানি আর কত! এবার নতুন কিছু থাকে তো বাইর করো। তোমার ভা-ার কি ফুরায়া গেল বণিক? আমি তোমার পুরো স্বপ্নভা-ার দেখতে চাই।
এই বলে বালক স্বপ্নবণিকের কানের কাছে তুলে মুদ্রার ডিব্বাটা ক্রমাগত বাজাতে থাকে। ঝনঝন, ঝনঝন, ঝনঝন। দিশেহারা হয়ে স্বপ্নবণিক বলতে শুরু করে
-আরে ধুর, তুই হইলি বস্তির পোলা। এইসব গাড়ি বাড়ির স্বপ্ন দেখে তোর কি লাভ! তোরে আমি অন্য একটা স্বপ্ন দিতেছি। দারুণ স্বপ্ন।
-মনে কর, সবুজ একটা গ্রাম। সেই গ্রামের এক পাশে বয়ে চলেছে কুলুকুলু এক ছোট্ট নদী। নদীর নাম ধরলা। অন্য পাশে বিরাট এক বিল। বিলজোড়া ধানক্ষেত। ধানের কী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ! ওই গ্রামেরই এক অবস্থাপন্ন বাড়ির পোলা তুই। তোর বাপের বড় গৃহস্থ। তার জমি জিরাতের অভাব নাই। শীতের দিনে উঠানে ধানের টাল।
-তুমি এইসব কি কইতাছ? ডবল, নদী, গ্রাম, ধান, জমি। আমি তো এগুলি চিনি না। জীবনে চোহেও দেহি নাই।
-তাইলে তুই কি দেখছস?
-বস্তি, ময়লাপর ডিপো, ময়লার গাড়ি, স্টেশন, রাস্তা, গাড়ি, বড় বড় বিল্ডিং, রেললাইন, ট্রেন-এইসব দেখছি আমি।
-আওে গাধা, তুই তো স্বপ্ন কি সেটাই বুঝিস না। মানুষের যা নাই অথচ মনে প্রাণে সে সেগুলো চায়-সেটাই তো স্বপ্ন।
-বুঝছি, সব ভাওতাবাজি। সব মিছা। যা আমি কোনও দিন দেহি নাই-যা চিনি না, তা নিয়া আমি ক্যান স্বপ্ন দেহুম। যা আমি এই জীবনে এক লহমার লাইগ্যাও পামু না, তা পাওনের লাইগ্যা পাগল হইয়া যামু ক্যান? স্বপ্ন দেওনের নাম কইরা তুমি আমারে কি পাগল বানাইতে চাও? আইচ্ছা, আমার মতো আর কয়জনরে তুমি ইমুন মিচা কতা কইয়া পাগল বানাইছো কও তো!
-এক চটকনা দিয়া চাপার সব কয়টা দাঁত ফেইলা দিমু। আমার সাথে টিরিকবাজি। সব স্বপ্ন শুইনা মজা নিয়া এখন পয়সা না দেয়ার ফন্দি করছো, তাই না! কৌটা দে।
স্বপ্নবণিক দু’হাতে বালকের পয়সার কৌটা সজোওে আঁকড়ে ধরে। তখন বিরক্ত বালক কৌটাটা ছুড়ে মারে রাস্তার উপর। ঢাকনা খুলে মুদ্রাগুলো ছিটকে বেরিয়ে আসে এবং রাস্তার অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্বপ্নবণিক দু’হাতে দ্রুততার সাথে মুদ্রা কুড়াতে থাকে। তার সঙ্গে যোগ দেয় আরও কিছু পথচারীও। ওদের টাকা-পয়সা কুড়াতে দেখে কৌতুকবোধ হয়। একটা ময়লার গাড়িকে কেন্দ্র কওে তার মতো অনেক দরিদ্র, ঠিকানাহীন বালক এবং কাঁক ও কুকুরদের যে রকম ব্যস্ততা, এই মুদ্রা কুড়ানোর দৃশ্যটাও অনেকটা সে রকম। কার আগে কে সবসবচাইতে বেশি ও দামী মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করতে পারবে এ যেন তারই প্রতিযোগিতা। মুদ্রা কুড়ানোর এই দৃশ্যটা দেখে বালকের প্রচ- হাসি পায়। প্রথমে সে নিজের ভিতরের হাসিগুলো গিলে ফেরার চেষ্টা করে। কিন্তু সামলাতে না পেওে এক পর্যায় উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠে সে এবং ক্রমাগত হাসতেই থাকে। হাঃ হাঃ হাঃ! হিঃ হিঃ হিঃ!

মাহমুদা আকতার: সাংবাদিক, লেখক ও অনুবাদক। প্রকাশিত প্রন্থ পাাঁচটি|

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/