মিলন রায়রে গল্প ‘পাইপ’

মিলন রায়

পাইপ

আজমল সাহেব খুব মন খারাপ করে বসে আছেন। ফজরের নামজ পড়েই রোজ হাঁটতে বের হন তিনি। আজও হেঁটে ফিরেছেন একটু আগে। ঘুম থেকে উঠে ফুরফুরে মেজাজেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েছেন। নিয়মিত সঙ্গী কাশেম সাহেব ও খসরু সাহেবের সঙ্গে রীতিমতো হাসিঠাট্টায় সময় পার করে বাসায় ফিরেছেন। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু মন খারাপ করে দিল তাঁর সদ্য বিলেত-ফেরত ছেলে। আজমল সাহেব গেট দিয়ে ঢুকেছেন। গেটের সামনে ছোট্ট একটি বাগান আছে তাঁর। সেখানে বেলি ফুটেছে। গেট দিয়ে ঢুকতেই নিশ্বাসের সাথে বেলির সুবাসে মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আজও তাই হয়েছে। বুক ভরে দম নিয়েছেন। চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে একটা নীরব তৃপ্তির অনুভব। ঠিক তখনই তাঁর নাকে এসে ধাক্কা দিল নিকোটিনের তীব্র একটা গন্ধ! থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন আজমল সাহেব। কিছুটা বিস্মিত হন তিনি। তাঁর বাড়িতে ধুমপানের বালাই নেই। স্বামী-স্ত্রী কারোই ধুমপান তো দূরে থাক, চা পানের অভ্যাস পর্যন্ত নেই!  তাহলে কোত্থেকে আসছে এই গন্ধ! আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে আজমল সাহেব বারান্দায় ওঠেন। আর সামনেই দেখতে পান তাঁর বিলেত-ফেরত ছেলে আরাম চেয়ারে বসে গ্রিলের উপর পা তুলে দিয়ে আপন মনে পাইপ টানছে। নিকোটিনের গন্ধটা সেখান থেকেই সারাবাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে।
আবারও থমকে দাঁড়ান আজমল সাহেব। ইচ্ছে হয়, বেয়াদব ছেলেকে কষে একটা বকুনি দেন। পরক্ষণেই মনে পড়ে, ছেলে তাঁর ইঞ্জিনিয়র। দেশের বাইরে থাকে। তাকে বকুনি দেওয়ার বয়স আর নেই! নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় তাঁর। নিঃশব্দ পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে খাটের ওপর বসে পড়েন তিনি। হঠাৎই অনুভব করেন, তাঁর শরীর থেকে সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে! সকালবেলার সমস্ত ভালোলাগার অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে! একটা অকারণ বিষণ্ণতা তাঁকে ঘিরে ধরে।
: কী হলো? কখন এলে বাইরে থেকে?
স্ত্রীর প্রশ্নে চমকে ওঠেন আজমল সাহেব। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন তাঁকে কী বলা হয়েছে!
: কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?
একটা আশঙ্কা নিয়ে স্ত্রী তাড়াতাড়ি ছুটে আসেন কাছে। কপালে-বুকে হাত দিয়ে দেখেন গা গরম কিনা।
: জ্বরটর তো দেখছি না! ঘামটামও নেই! এভাবে থ মেরে বসে আছ কেন? শুনছ?
স্ত্রীর কণ্ঠের ব্যাকুলতায় আজমল সাহেবের চৈতন্য ফিরে আসে। তিনি নড়েচড়ে বসেন।
: আমাকে কিছু বলছ? কী বলছ?
আজমল সাহেবের স্ত্রী এবার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে যান। ছেলে বিদেশ যাওয়ার পর থেকে গত পাঁচটি বছর ধরে তাঁরা একে অপরের ছায়া হয়ে আছেন। কার কখন কী লাগবে বা কার কী অসুবিধা হচ্ছে, এটি তাঁরা পরস্পরের আচরণ দেখেই টের পেয়ে যান। মনের সঙ্গে মন তাঁদের অদৃশ্য সুতোয় জোড়া। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বামীকে তাঁর কেমন অচেনা অচেনা লাগছে! তিনি স্বামীর পাশ ঘেঁষে বসেন। স্বামীর হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলেন,
: তোমার কী হয়েছে বলো তো? কাশেম ভাই বা খসরু ভাইয়ের কিছু হয়েছে?
আজমল সাহেব স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেন সেখানে গভীর একটা উৎকণ্ঠা চিকচিক করছে। ভীষণ মায়া হয় স্ত্রীর প্রতি। মনেহয় এই মানুষটি ছাড়া এই পৃথিবী তাঁর কাছে ভয়ংকর রকম শূন্য! তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন,
: তেমন কিছু না। আরাফাতকে পাইপ টানতে দেখলাম তো, তাই একটু খারাপ লেগেছে। আর কিছু না।
আজমল সাহেবের স্ত্রী হাসলেন না। স্বামীর ব্যথাটা কোথায় তা তিনি জানেন। যে ছেলে বুয়েট থেকে পাস করা অবধি চা-পান-সিগারেটের ধারেও ঘেঁষেনি, সে এখন পাইপ টানে! তাও মা-বাবার সামনে! বিষয়টি তাঁকেও আঘাত করেছে। কিন্তু তিনিও কিছু বলেননি। বয়স্ক ছেলের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা শোভন মনে হয়নি তাঁর। তিনি আজমল সাহেবকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন।
: মনে কষ্ট পেও না। আরাফাত এখন আর ছোটোটি নেই। আমরা আর ওকে শাসন করতে পারি না। তাছাড়া ও তো আমাদের কাছে থাকেও না। মাত্র কটা দিনের জন্য এসেছে, যেনতেন করে মানিয়ে নাও।
: তুমি হয়তো ঠিকই বলছ। কিন্তু যা নিজে কখনো করিনি, ছেলেকে করতে দেইনি, আজ সেসব দেখা এবং মুখবুজে সহ্য করা বেশ কঠিন, বুঝলে!
বুকের মধ্যে একটা দীর্ঘ-নিশ্বাস চেপে যেন আপন মনেই বলে ওঠেন আজমাল সাহেব,
: বাংলাদেশের বাইরে গেলেই বোধহয় ছেলেমেয়েরা বাপ-দাদার শেখানো আদব-কায়দা সব জলাঞ্জলি দিয়ে দেয়!
খাট থেকে উঠে গায়ের জামা খুলতে খুলতে আজমল সাহেব বলতে থাকেন-
: শুধু তাই-ই না, বুঝলে! আমার খারাপ লাগার আরো একটা গভীর ব্যাপার আছে। আর সেটাই মনে বেশি লেগেছে।
আজমল সাহেবের স্ত্রীর চোখে এবার একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন এসে হাজির হয়। কিন্তু মুখে কিছু বলেন না। তিনি জানেন, তাঁর স্বামী তাঁকে কিছুই লুকোবেন না। মনের সমস্ত না-বলা কথা তাঁরা দুজনেই তো ভাগাভাগি করে নেন!
: আমি যখন বারান্দায় উঠে আরাফাতকে উদাস হয়ে আপন মনে পাইপ টানতে দেখলাম, পেছন থেকে তাকে দেখে হঠাৎ করেই আরেকজনের কথা মনে পড়ে গেল!
: কার কথা বলছ? আমাদের জানাশোনা কেউ তো পাইপ খায় না!
আজমল সাহেবের স্ত্রীর মনে কৌতূহল।
: তুমি তাঁকে দেখনি। দেখবে কী করে? আমাদের তো তখন বিয়েই হয়নি!
: আমার যতদূর মনে পড়ছে, তোমার বাবা বা দাদাও ধুমপান করতেন না।
: আমি তাঁদের কথা বলছি না।
আজমল সাহেব স্ত্রীর কাছে এসে খাটের ওপর আবার বসেন। স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেন,
: আরাফাতকে দেখে তোমার আর কারো কথা মনে হয়, বলো তো?
: তোমার বাবার চেহারার সাথে খুব মেলে।
: উহু, আর কেউ? মোটা ফ্রেমের চশমা পরা অবস্থায় ওর পেছন দিক থেকে কখনো কি দেখেছ?
: তুমি আসলে কী বলতে চাইছ, ঠিক করে বলো তো? সকালবেলা হেঁয়ালি ভালো লাগছে না!
এবার আজমল সাহেবের স্ত্রী একটু অধৈর্য হন। আজমল সাহেব বলেনÑ
: এখন যদি সেই অবস্থায় বসে থাকে, একটু দেখে এসো।
: ধুর, বললে বলো; না-হলে তুমি থাকো তোমার হেঁয়ালি নিয়ে। আমাকে আবার নাস্তা বানাতে হবে।
আজমল সাহেবের স্ত্রী বসা থেকে উঠে পড়েন। আজমল সাহেব তাঁর হাত টেনে ধরে বলেন-
: বলছি শোনো। ব্যস্ত হচ্ছ কেন?
আজমল সাহেব গা এলিয়ে দেন খাটে। তারপর যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসতে থাকে তাঁর কথা। তিনি বলেন-
: তখন আমি আট ক্লাসের ছাত্র। বাবা কাজ করেন ধানম-ির বত্রিশ নম্বরে। বাবার সাথে কখনো কখনো আমিও যেতাম সেই বাড়িতে। দূর থেকে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম একজন মহামানবকে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে। বাংলার আপামর জনগণের বন্ধু- বঙ্গবন্ধুকে। অসীম সাহসী সেই মানুষটিকে দেখতাম, আর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভীষণ মুগ্ধ হতাম! বাবার কাছে শুনতাম তাঁর জীবনের ইতিহাস, উত্থান-সংগ্রামের জানা-অজানা অনেক কাহিনি। বঙ্গবন্ধুকে অনেকবার আমি পাইপ টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখেছি। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের একটি চশমা। কাঁচা-পাকা চুল ও গোঁফ। কী ভরাট আর ভারি তাঁর কণ্ঠস্বর! খুব অমায়িক তাঁর ব্যবহার। সবার সঙ্গেই তিনি হেসে কথা বলতেন। বাবা আমাকে বলতেন, বঙ্গবন্ধুকে তিনি কখনো সাধারণ মানুষের সঙ্গে রেগে কথা বলতে দেখেননি। যে-ই দেখা করতে আসত, তিনি তার সঙ্গেই দেখা করতেন, কথা বলতেন। একদিন লনে আরাম চেয়ারে বসে বঙ্গবন্ধু আনমনে পাইপ টানছিলেন। হয়তো দেশের কথা, দশের কথা ভাবছিলেন গভীরভাবে। কোনোদিকেই খেয়াল ছিল না তাঁর। আমি পায়ে পায়ে তাঁর খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম। মনে ভয় ছিল। কিন্তু অদ্ভুত এক আকর্ষণে বা তাঁকে কাছ থেকে দেখার লোভে নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারিনি। সেই যে তাঁর ছবিটি আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে, আজ পর্যন্ত সেই ছবি জ্বলজ্বল করছে। চোখ বুজে তাঁর কথা ভাবলেই আমি সেই ছবিটি স্পষ্ট দেখতে পাই। তারপরের ইতিহাস তো তোমারও জানা। উনিশশ পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট কী ভয়ানক কা- ঘটে গেল বত্রিশ নম্বরে! জাতির পিতাকে স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূসহ কী নির্মমভাবে হত্যা করা হলো! ছোট্ট সোনামনি রাসেলকে পর্যন্ত ঘাতকের দল নিস্তার দিল না! বেঁচে থাকার জন্য তাঁর সেই করুণ আর্তনাদ কতদিন পর্যন্ত যে কানে বাজত, কী বলব! চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম, বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত দেহটি বত্রিশ নম্বরের প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝামাঝি পড়ে আছে। পাশেই পড়ে আছে তাঁর প্রিয় পাইপ! অদূরেই চশমার ভাঙা কাচ। ঘরের মেঝে ও দেয়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্ত, মজগ আর হাড়ের গুঁড়ো। দেয়ালগুলো ঝাঁঝরা, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে জানালার কাচ! পবিত্র কোরআন শরিফখানি জাতির পিতার রক্তে সিক্ত হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে!
কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে আজমল সাহেবের। তবুও থামেন না তিনি। বলে চলেন,
: বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসই করতে পারেননি, স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ তাঁর আড়ালে-আবডালে তাঁকে মেরে ফেলার নীল-নকশা আঁকতে পারে! তাঁর সেই সরল বিশ্বাস ব্যর্থ হয়েছিল। যাদের তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, তারাই তাঁর চরমতম সর্বনাশ করেছিল! মিরজাফরের বংশধররা যুগে যুগে সুযোগের সন্ধানে থাকে। কাল কেউটের মতো ছোবল মেরে বিষে নীল করে দেয় দেহ। এদের পাশাপাশি সিরাজ-উদ-দৌলার মতো দেশপ্রেমিক সাহসী সেনানীও থাকেন। এ যুগের সিরাজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
একটা দম নেন আজমল সাহেব। তারপর আবার বলেনÑ
: আজ আরাফাতের বসার ভঙ্গি, হাতে পাইপ ধরে রাখার স্টাইল আমাকে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, জানো? ছেলের ধুমপানের জন্য মন যতটা খারাপ, তারচেয়েও বেশি খারাপ চোখের সামনে সেই ভয়ংকর ঘটনার ছবি ভেসে ওঠাতে। আমি যেন বঙ্গবন্ধুকেই সামনে দেখতে পেয়েছি আজ! সুদূর কোনো অশনি-সংকেতের ধ্বনি শোনার জন্য উদাস-বিষণ্ণ!
আজমল সাহেবের দুচোখ থেকে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে পানি। তাঁর বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ-নিঃশ্বাস। তাঁর স্ত্রীর চোখেও পানি। দুজন দুজনের হাত ধরে বসে থাকেন চুপচাপ। ঘরের দেয়ালে লেগে থাকা টিকটিকিটি হঠাৎ ডেকে ওঠেÑ ঠিক ঠিক ঠিক!

লেখক পরিচিতি: মিলন রায় একজন কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। মিলন রায় গল্প লিখছেন বেশ ছোটবেলা থেকেই। তার গল্পে সমসাময়িক সময় ও সমাজ বেশ স্পষ্ট। ইতিমধ্যে তার বেশ কিছু জীবনী ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়ার পর কলেজে শিক্ষকতা করছেন এই লেখক।

ওমেন্স নিউজ/