মাহমুদা আকতারের গল্প ‘ভালোবাসার ঘ্রাণ’

মাহমুদা আকতার

ভালোবাসার ঘ্রাণ

বর্ণ আর গন্ধময় এই পৃথিবী। এর প্রতিটি মানুষ, পশু-পাখি, লতাগুল্ম-বৃক্ষ এমনকি বস্তুদেরও রয়েছে নিজস্ব ঘ্রাণ। নিবিড়ভাবে এসব ঘ্রাণ অনুভব করে জেসমিন। এজন্য অনায়াসেই পৃথকভাবে অনুভব করতে পারে প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু ও প্রাণির গন্ধ। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে এক ধরনের গন্ধ বাতিকগ্রস্ত মানুষ সে। সে জানে- শীতে শরীর কুঁকড়ে ওঠা উত্তুরে বাতাসের সঙ্গে ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়ার রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। শীতের সকালে সর্ষে খেতের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সমান্তরাল সড়ক ধরে যাওয়ার সময় সে যেই অদ্ভুত গন্ধটা পায়, বিকেলে একই সড়ক দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা গন্ধে আচ্ছন্ন হয় সে। ফুল-ফল, মাঠ-ঘাট, নদী, মেঘ, রোদ আর বাতাস এমনকি সময়েরও আছে নিজস্ব গন্ধ। এ কারণেই সকাল আর বিকেলের ঘ্রাণের এতটা পার্থক্য। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেই পাল্টাতে থাকে প্রকৃতির গন্ধ- যত রাত বাড়ে ততই গভীর হতে থাকে এর ঘ্রাণ। এইসব গন্ধ নিবিড়ভাবে অনুভব করে জেসমিন। কেননা প্রতিটি গন্ধ যে সে উপলব্ধি করে মন-প্রাণ দিয়ে। সকালে খেতের পাশ দিয়ে সমান্তরাল সড়ক ধরে কলেজে যেতে যেতে, দুপুরে পুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতে, সন্ধ্যায় বাড়ির পিছনের সন্ধ্যামালতী আর দোলনচাঁপার ঝোপে জল দিতে দিতে সে অনুভব করে গন্ধময় এই পৃথিবীকে। কেবল প্রকৃতি নয়- প্রতিটি মানুষেরও আছে নিজস্ব ঘ্রাণ এবং সময়ে সময়ে তা বদলে যায়। তার স্কুলমাস্টার বাবা যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন তখন তার শরীরে কেবলই ঘামের গন্ধ। জেসমিন তখন গামছায় তার শরীর মুছতে মুছতে বলে- বাবা, আগে লেবুর শরবত খান। শরীর ঠা-া হইলে গোসল কইরেন। অথচ বিকেলে বাবা যখন বৈঠকখানায় বসে আয়েশ করে পান খেতে খেতে গ্রামের নানা মানুষের সঙ্গে গল্প করেন- তার শরীরে তখন আরেক গন্ধ। সিগ্রেট আর পান-জরদার গন্ধ মিলে তার শরীরে সেসময় একটা কদম ফুলের গন্ধ তৈরি হয়। প্রচুর পান খান জেসমিনের মা-ও। তবে পান খাওয়ার পর মায়ের মুখ থেকে যে গন্ধটা আসে সেটা তার বাবার সঙ্গে একদমই মেলে না। মায়ের গায়ে পান-জরদা সঙ্গে মিশে থাকে লাকড়ি আর নানা আনাজপাতির ঘ্রাণ- সবমিলিয়ে মায়ের গা থেকে যে গন্ধ আসে সেটা চাঁপা ফুলের মতোই মনে হয় জেসমিনের।

জেসমিন তার নিজের শরীর থেকেও অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ টের পায়। তার শরীরে কেবল ফুলের সুবাস। কেননা সে তো বুকের ভাঁজে সবসময় গুঁজে রাখে বেলি বা বকুল। এমনকি নিজের বালিশের নিচেও সে রাখে নানা ফুলের পাপড়ি আর গন্ধরাজ লেবুর কচি পাতা। কোনওদিন ফুল না মিললে কখনও বা শুধু পেয়ারা পাতাই রেখে দেয় সে নিজের বিছানায়। তাই তার ঘরজুড়েও কেবল ফুলের সুবাস। জেসমিনের এই গন্ধ বাতিকের কথা জানে তার বাড়ির লোকজন। তাই তার বাবা ঘটককে বলেন- আপা, আমার মাইয়া কিন্তু খুব শৌখিন। তার জইন্যে হাবিজাবি সম্বন্ধ আনলে কিন্তু চলবো না।
ঘটক মহিলাটি তখন বলেন- ভাইজান, আমার কাছে কিন্তু বিদেশে থাকা পোলাও আছে। অনেক পয়সাওয়ালা। আপনি কি আপনার মাইয়ারে অত দূরে বিয়া দিবেন?
-না না বিদেশি পোলার কাম নাই। তয় শহরের পাত্র দেখতে পারেন।

রাতে ঘুমানোর সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে জেসমিন ভাবে- যার সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে তার গায়ের গন্ধ কেমন হবে- পাখির মতো, নদীর মতো নাকি বাতাসের মতো? বাতাস হলে সেটা কেমন- চৈত্রের নাকি বসন্তের বাতাস? এইসব কথা মনে এলে বিছানায় গোলাপের পাঁপড়ি ছড়িয়ে দিতে দিতে সে বলে- মানুষটার গায়ের গন্ধ যেন গোলাপের মতো মিষ্টি হয়!

যদিও জেসমিনের এইসব পাগলামির কোনও অর্থ নেই বাস্তব জীবনে। তাই মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজার সময় তার বাবা ছেলের আর্থিক সচ্ছলতার দিকেই বেশি গুরুত্ব দেন। অবশেষে ঢাকায় বসবাসরত এক চাকুরিজীবী ছেলের সঙ্গে তার সম্বন্ধ পাকা হয়। ঢাকায় থাকলেও ছেলের বাড়ি তাদের একই উপজেলায়। তাদের পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান দুটোই বেশ ভালো। বাড়ির লোকজন খুব খুশি জেসমিনের এই বিয়ে নিয়ে। তারা বলে- সংসারে কোনও ঝুটঝামেলা নাই। তিন বোনেরই বিয়া হইয়া গেছে। তাছাড়া ছেলে যখন ঢাকায় থাকে তখন জেসমিনরে কি আর তারা গ্রামে রাখবো? তখন তার মা বলেন– গ্রামে রাখলে রাখবো, জেসমিন তো গ্রামেই থাকে। তাগো বউ তারা কই রাখবো না রাখবো এইটা তাগো বিষয়- আমাগো এইসব নিয়া চিন্তা করনের কাম নাই।
এইসব কথাবার্তায় জেসমিনেরও কোনও আগ্রহ নাই। তার সকল ভাবনা তার ভাবী স্বামীর গায়ের ঘ্রাণ নিয়ে। আপাতত সে খুশি মানুষটার নাম নিয়ে। তার ডাক নাম পলাশ। জেসমিন জানে আগুনের মতো লাল টকটকে পলাশ ফুলের কোনও গন্ধ নাই। কলেজে আসা-যাওয়ার পথে সড়কজুড়ে পলাশ আর মান্দার গাছের সারি। এছাড়া তার কলেজের মাঠেও আছে জোড়া পলাশ এবং একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। এইসব গাছের আগুন রঙা ফুলগুলো দেখতে সুন্দর হলেও তারা গন্ধহীন। কিন্তু আজকাল পলাশ ফুল থেকেও অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। যদিও গন্ধটাকে এখনও আলাদা করতে পারেনি জেসমিন। তার আশপাশের সমস্ত কিছুর ঘ্রাণের সঙ্গেই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে পলাশ। তাই অদেখা অজানা পলাশকে ঘিরে ক্রমাগত স্বপ্ন ছড়াতে থাকে জেসমিনের মনে। কিন্তু অকস্মাৎ দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তার। বিয়ের পরদিনই জেসমিন তার মাকে জানায়- মা, আমি এই সোয়ামির সঙ্গে থাকবো না। আমারে তোমরা ছাড়াছুট্টি করায়া লও।
উতলা হয়ে তার মা বলেন- জেসমিন এইটা তুমি কি কইলা? বিয়া কি পুতুল খেলা?
খবর পেয়ে ছুটে আসেন তার রুপা ভাবি- পাত্রের জোগানদাতা, পলাশের সঙ্গে জেসমিনের বিয়েতে যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন- জেসমিন কি সমস্যা আমারে খুইলা কও। পলাশের বয়স তোমার চাইতে একটু বেশি। এই কথা তো আমি আগেই জানাইছি তোমার আব্বা- আম্মারে। এখন সে কি তোমার লগে কিছু করতে পারে নাই?
জেসমিন তখন অবাক হয়ে জানতে চায়- মানে কি ভাবি?
-মানে হইলো সে কি তোমারে শারীরিকভাবে সুখ দিতে পারে নাই? সলাজে মাথা নাড়ে জেসমিন।
-তাইলে!
-ওইসব কিছু না। মানুষটার গায়ে বিশ্রী গন্ধ। আমার খালি বমি বমি লাগে। এই গন্ধওয়ালা মানুষটার সাথে সারাজীবন কেমনে থাকবো ভাবি? রুপা ভাবি তখন তাকে জানান- এই তুচ্ছ কারণে কখনও বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে না। সোয়ামি যদি স্ত্রীরে মারধোর করে, খাওন পরন না দিতে পারে কিংবা যৌতুক চায়- সেইসব কারণেই কেবলমাত্র তালাক হতে পারে।

অগত্যা নববিবাহিত জেসমিন তার স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় আসে। এই শহরে তার মন টিকতে চায় না। এখানকার সবকিছু কেমন বিস্বাদ, গন্ধহীন। তবে পলাশের গায়ের গন্ধ আগের মতোই আছে। ভাবির ‘শারীরিক সুখ’ শব্দ দুটি আজকাল তাকে খুব ভাবায়। আসলে একান্ত মুহূর্তে পলাশের গায়ের গন্ধে সে এতটাই আচ্ছন্ন থাকে যে অন্য কিছু অনুভব করতে পারে না। তখন তার কেবল মনে হয়- কখন এইসব শেষ হবে এবং মানুষটা তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। সকালে পলাশ অফিসের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পরও তার গায়ের গন্ধ ছড়িয়ে থাকে গোটা বাড়িতে। জেসমিন তখন বিছানাপাটি ছাট দিয়ে কাঁথা-বালিশ রোদে মেলে দেয়। চাদর বদলায় এবং পুরো বাড়ি সাবান পানি দিয়ে মুছে নেয়। এইসবই সে করে বিনাবাক্যে। কেননা এখানে তার কথা বলার মতো কোনও সঙ্গী নাই। বিকেলে অবশ্য পলাশ বাড়িতে ফিরে আসে। যদিও সে এখনও পলাশের সঙ্গে গল্প করার মতো ফ্রি হতে পারেনি। তাছাড়া এমনিতেও জেসমিন কথা কমই বলে। কিন্তু কথা না বলতে পারার কষ্ট থেকেই কিনা কে জানে- সে একদিন তার স্বামীকে বলে- আচ্ছা, এই শহরে কি কোনও পাখি নাই?
-আরে পাখি ছাড়া কি কোনও জায়গা থাকতে পারে! যেখানে মানুষ থাকতে পারে না সেইখানেও পাখি আছে।
-কিন্তু আমি তো সারাদিনে একটা কাওয়্যাও দেখি না!
-এইখানে তেমন গাছপালা নাই, ঘনবসতি- এই জইন্যে এইখানে কোনও পাখি আসে না।
এরপর পলাশ তাকে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। এমনকি আগামী শুক্রবার ছুটির দিনে সে নিজের স্ত্রীকে পাখি দেখাতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। সে তখন আরও জানায়- সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শীতের সময় প্রচুর অতিথি পাখি আসে। কিন্তু জেসমিন কোনওটাতেই আগ্রহ দেখায় না। সে কেবল বলে- আমার জন্য একটা পাখি আনতে পারবেন? যে কোনও পাখি।
সেইদিনই অফিস থেকে ফেরার পথে শাহবাগের কাঁটাবনে নামে পলাশ। অনেকগুলো দোকান ঘুরে জেসমিনের জন্য এক জোড়া লাভবার্ড ক্রয় করে সে। যদিও দাম নিয়ে তার মনের মধ্যে খচখচানি থেকেই যায়। সে ভাবে-যেহেতু পাখির দাম সম্পর্কে তার কোনও আইডিয়া নাই। এই কারণে দোকানি তাকে বেশ ঠকায় দিসে। কিন্তু পাখি জোড়া দেখে স্ত্রীর দৃষ্টিতে প্রথমবারের মতো মুগ্ধতা দেখার পর মন ভালো হয়ে যায় তার। নিজে দেখে শুনে পছন্দ করেই এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে পলাশ। কিন্তু বিয়ের পর জেসমিনের অসীম নীরবতা তাকে কষ্ট দেয়। এই বয়সী তরুণী মেয়েদের যে রকম চঞ্চলতা ও উচ্ছলতা থাকার কথা, নিজের স্ত্রীর মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নাই। এখন পর্যন্ত তার কাছে কোনও কিছু আবদারও করেনি সে। পলাশ নিজে থেকেই যেসব সাজুনি-গুজনি এনে দিয়েছে তাতেও আগ্রহ দেখায়নি জেসমিন। সেগুলো এখন অনাদরে পড়ে আছে ড্রেসিংটেবিলের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই জেসমিনের পাখি আনার আবদারে খুব খুশি হয় পলাশ।

পলাশের দেয়া এই উপহারের কারণে স্বামীর ওপর মনে মনে খুব কৃতজ্ঞ জেসমিন। এতদিনে কথা বলার সঙ্গী জুটেছে তার। সে পাখির খাঁচাটা বারান্দার গ্রিলে ঝুলিয়ে দিয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে পক্ষীদের কাছে আসে, তাদের সোহাগ করে এবং তাদের সঙ্গে নানারকম কথা বলে।-কি রে কি করস তোরা? কথা কস না কেন- মন খারাপ? আমারে একটা গান শোনা দেখি! জবাবে পাখি দুটো কিচির মিচির করে ডানা ঝাপটায়।-এইটা কোনও গান হইলো! তখন মজা করে বলে জেসমিন। একদিন পাখিদের আদর করতে করতে সে টের পায় এদের গায়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ আছে। যদিও এই গন্ধের কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পায় না জেসমিন। তার কখনও মনে হয় লেবু পাতা, কখনও বা আমের বোল, আবার কখনও বা হাঁস হাঁস গন্ধ। তবে সাদৃশ্য খুঁজে না পেলেও এই শহরে প্রথমবারের মতো কোনও কিছুর ঘ্রাণ পেয়ে বেশ খুশি হয় জেসমিন। যদিও পলাশের গায়ের বিকট গন্ধ দূর করার কোনও উপায় এখনও খুঁজে পায়নি সে। মনে মনে সে ভাবে- মানুষটার গায়ে এমন বিশ্রী গন্ধ কেন? প্রশ্রাব করে কি পানি নেয় না, নাকি গোপনাঙ্গের লোম পরিষ্কার না করার কারণে এই গন্ধ! সে কেবল পলাশকে বলে- আজ সেলুনে চুল কাটাতে গেলে সব সেভ কইরা দিতে বলবেন। তার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে পলাশ বলে- তোমার এইসব লোম পছন্দ না, আগে বলবা না? আর সেইদিনই নিজের শরীরের সমস্ত বাড়তি লোম উচ্ছেদ করে পলাশ। যদিও এরপরও তার গায়ের গন্ধের কোনও হেরফের হয় না, অন্তত জেসমিনের কাছে। তবে পলাশের গায়ের বিশ্রী গন্ধের কথাটা তো সে তাকে ভেঙে বলতে পারে না। তাই জেসমিন তাকে বলে- একটা সেন্ট আনতে পারবেন?
-তোমার জন্য?
কারণটা তো আর তাকে মুখের ওপর এভাবে বলা যায় না। তাই সে ঘুরিয়ে বলে- না, দুইজনের গায়েই দেয়া যায় এমন কিছু।
-আমি তো সেন্ট ব্যবহার করি না। তাছাড়া মেয়েমানুষের সেন্ট তো আর পুরুষমানুষ মাখতে পারে না।
-তাইলে পুরুষ মানুষ যেইটা ব্যবহার করতে পারে সেরকমই একটা আইনেন। আমার কোনও সমস্যা নাই। আমি তো সারাদিন বাসাতেই থাকি।
সেদিনই অফিস থেকে ফেরার পথে নিউমার্কেটে নেমে যায় পলাশ এবং বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে ‘পয়জন’ ব্র্যান্ডের একটা পারফিউম কিনে আনে সে। এরপর থেকে অফিসে যাওয়ার সময় জেসমিন পলাশের গায়ে সমানে স্প্রে করতে থাকে। পলাশ তখন তাকে থামিয়ে দেয়- আরে কি করো- এতগুলান না। তুমি তো দেখি একদিনেই পুরা বোতল শেষ কইরা ফালাইবা! এই বলে পলাশ জেসমিনের গায়ে খানিকটা স্প্রে করে দেখিয়ে দেয় সুগন্ধী ব্যবহারের যথাযথ কৌশল।

তবে জেসমিনের এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সে অবাক হয়ে দেখে পলাশের গায়ের বিকট গন্ধের কোনও তারতম্য হয়নি। বরং পারফিউমের সঙ্গে মিলে তার স্বামীর গায়ের গন্ধ আরও বিকট রূপ নিয়েছে। তখন সে বিছানা বালিশের ওপর সমানে পারফিউম ছিটাতে থাকে। শুধু সুগন্ধী নয়, আরও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা অব্যাহত থাকে জেসমিনের। এইসবের মধ্যে গ্রামের থেকে মায়ের অসুস্থতার খবর এলে সস্ত্রীক বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পলাশ। সেখানে গিয়ে মাকে উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। তার মা আগে থেকেই ডায়াবেটিসের রোগী। ফলে দ্রুত সুস্থ হওয়ার কথা না। তাই জেসমিনকে মায়ের সেবায় রেখে শহরে ফিরে আসে পলাশ। স্বামীর এই সিদ্ধান্তে অন্য কোনও স্ত্রী হলে অবশ্যই অভিমান করতো। কিন্তু কিছুদিন বিশ্রী গন্ধের কাছ থেকে দূরে থাকার সুযোগ পেয়ে উল্টো খুশি হয় জেসমিন।

জেসমিনদের গ্রামের বাড়ির মতো এখানেও প্রচুর গাছগাছালি আছে। বাড়ির চারপাশে নারকেল আর সুপারি গাছের সারি। বেশ কিছু তাল গাছও আছে। তবে জেসমিনের বাড়িতে যে একটা শান-বাঁধানো পুকুর ছিল, এখানে তা নেই। একই সঙ্গে নেই হাঁসের ঝাঁক, মুরগির খোঁয়াড় এবং এক পাল গরু-ছাগল যা জেসমিনদের বাড়ির প্রাণ। জেসমিনের শাশুড়ি একা মানুষ-এইসব ঝামেলা করে উঠতে পারেন না। যদিও তার মেঝ ননদ স্বামী সন্তানদের নিয়ে বর্তমানে এখানেই বসবাস করছে। পলাশের অসুস্থ মায়ের দেখভালের জন্য এই ব্যবস্থা। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ তাদের সমস্ত প্রাত্যহিক কাজকর্মে নদীর জল ব্যবহার করে। তবে নদী খানিকটা দূরে হওয়ায় গোসল ও অন্যান্য কাজকর্ম কলের পানিতে সেরে নেয় জেসমিন। জোছনা রাতে এই বাড়ির উঠোন থেকেও রুপোর থালার মতো প্রকাণ্ড চাঁদ নজরে পড়ে। তারপরও এই বাড়িটাকে নিজের মনে হয় না জেসমিনের কাছে। অনেক কিছু তার বাড়ির মতো হওয়ার পরও এখানে পুরনো ঘ্রাণ খুঁজে পায় না সে। কী অদ্ভুত মাদকতা মেশানো গন্ধ ছড়িয়ে ছিলো তাদের গোটা বাড়ি জুড়ে। কিন্তু এই বাড়িটার গন্ধ সম্পূর্ণ আলাদা, কেমন আটপৌরে আর পানসে। বিশেষ করে তার শাশুড়ির ঘরটা। এই ঘরে টেবিলের ওপর সারিবদ্ধভাবে সাজানো নানা ওষুধের শিশি আর বাক্স বোঝাই ট্যাবলেট। তাই গোটা ঘরজুড়ে কেবল ওষুধের গন্ধ। এই মেডিসিনের গন্ধ যেন ঘরের সীমানা পেরিয়ে গোটা বাড়ির বাতাসেও মিশে গেছে। শুধু তাই নয়- এসব নানা জাতের ওষুধের গন্ধ যেন-বা স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়ে এই বৃদ্ধার মুখেও। এসব কারণে গোটা বাড়িতে কেমন মনমরা বিষণ্ণতার ছড়াছড়ি। এই প্রথম জেসমিন উপলব্ধি করে তাদের বাড়ির সঙ্গে এই বাড়িটার পার্থক্য করে দিয়েছে এসব ওষুধের রাসায়নিক ঘ্রাণ। এদের ঝাঁঝালো গন্ধের কাছে হার মেনেছে এখানকার প্রকৃতির নিজস্ব গন্ধ। জেসমিন গোটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে গাছপালা, জল আর রোদের ঘ্রাণ খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু তার যাতায়াতের স্বাধীনতাই বা কদ্দুর? সে তো আর এ বাড়ির সীমানা বেষ্টনীর বাইরে যেতে পারে না। প্রকৃতির নিজস্ব ঘ্রাণ পাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সে তার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলে- আম্মা, আপনি পান খান না কেন? পান খাইলে কিন্তু আপনার মুখে রুচি আসতো।
-বউমা ডাক্তার আমারে পান খাইতে নিষেধ করছে। এইজন্য আমার মাইয়া আমার পানের বাটা লুকাইয়া রাখছে। ওরা তো আমারে খালি গাদি গাদি ওষুধ খাওয়ায়। এখন তো ওষুধ খাইতে খাইতে পুরা শরীর ডিসপেনচারি হইয়া গেছে। মুখে কেমন আঁইসটা গন্ধ। নিজের শইল্যের গন্ধে নিজেরই বমি আসতে চায়।
এরপর বৃদ্ধা জেসমিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে- বউমা, তুমি কি আমারে এক খিলি পান খাওয়াইতে পার? কেউ দেখবো না, লুকাইয়া খামু। দিবা বউমা?
শাশুড়ি এমন করে বলেন যে জেসমিন তার কথা ফেলতে পারে না। সে তার ননদ রেশমার ঘরে ঢুকে কাঠের আলমারিটা খুলে সেখানে লুকিয়ে রাখা ফুল লতাপাতা নকশা কাটা পিতলের চৌকো বাটাটা বের করে আনে। এরপর শাশুড়িকে সুপারি, খয়ের আর তামাক পাতা দিয়ে একটা খিলি বানিয়ে দেয়। নিজেও এক টুকরো পান মুখে দেয়। তার বেশ লাগে।
অনেক দিন পর মনের সুখে পান চিবোচ্ছেন পলাশের আম্মা। পানের রসে লাল হয়ে গেছে তার তোবড়ানো মুখ। দুই ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সেই লাল তরল। তিনি হাতের চেটো দিয়ে সেই রস মুছতে মুছতে বলেন- বউমা, আমার যে কী ভাল্লাগতেছে! কতদিন পর পানের স্বাদ নিলাম।
ভালো লাগছে জেসমিনেরও। অসুস্থ বাড়িটাতে এখন কিছুটা প্রাণের ছোঁয়া লেগেছে যেন! ওষুধের বদলে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পান আর জরদার মাদকতাময় গন্ধ। জেসমিন প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। ভালো লাগছে, খুব ভালো লাগছে তার। মনটা আনন্দে ভরে যায়। বিয়ের পর থেকে এতটা ভালো আর কখনই লাগেনি তার। কিন্তু এই আমেজ বেশিক্ষণ উপভোগ করার সুযোগ হয় না। দেয়াল ঘড়িটা একটা বাজার সঙ্কেত দিতেই সব ঘ্রাণ মুছে ফেলতে তৎপর হয় জেসমিনের শাশুড়ি। কেননা একটু পরই যে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবেন পলাশের মাস্টারনি বোন। তিনি জেসমিনকে ডেকে বলেন- বউমা, পানি আর চিলুমচিটা নিয়া আস। তাড়াতাড়ি কুলি কইরা পান আর জরদার সুবাস মুইছা ফেলতে হইবো। আর লেবু গাছটা থেইকা কয়টা লেবু পাতা আইনা দাও। চাবাইলে গন্ধ যাইবো। নইলে আমার মাইয়া বাড়িত আইসা দেখলে সর্বনাশ হইয়া যাইবো। কিন্তু নানা চেষ্টার পরও বাতাসে ঝুলে থাকে তাদের সুখী জীবনের ঘ্রাণটা এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে সেটা ঝুলতেই থাকে। আর তাই বুঝি বাড়িতে পা দিয়েই বিষয়টা টের পেয়ে যান শামীমের মেঝ বোন রেশমা।
-মা, তুমি আবার পান খাইছো? কে দিলো তোমারে পান! ও বউ আইনা দিছে! এরপর জেসমিনকে নিয়ে পড়ে পলাশের মাস্টারনি বোন।-তুমি জান না মায়ের কত বড় অসুখ, ডাক্তার তারে পান খাইতে নিষেধ করছে। তারপরও কোন আক্কেলে তুমি তারে পান খাওয়াইলা? ভাইজান বাড়িতে আসুক- তারে আমি সব বলবো- এইটা কি বউ বিয়া করছে সে! কোনও আক্কেল বুদ্ধি নাই!
ঠিক তখনই শহরে থাকা স্বামীর কথা মনে পড়ে জেসমিনের। এখানে আসার পর থেকে সে যে অদ্ভুত একটা শূন্যতায় আক্রান্ত হয়ে আছে- অকস্মাৎ এর কারণটা উন্মোচিত হয় তার সামনে। এইটা জানার পর নিজের কাছেই বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না জেসমিনের। শ্বশুরবাড়িতে আসার পর থেকেই সে পলাশের গায়ে লেগে থাকা গন্ধটার অভাব বোধ করছিলো নিজের অবচেতন মনে। কবে যে এই গন্ধটার সঙ্গে জেসমিনের এতটা আন্তরিকতা গড়ে উঠলো সেটা তো নিজেও জানে না। সে কেবল সোয়ামীর জন্য অধীর আগ্রহে দিন গুনতে থাকে।

অবশেষে দীর্ঘদিন পর বাড়ি আসে পলাশ। রাতে স্বামীর একান্ত সান্নিধ্যে জেসমিন জানতে চায়- আপনি গায়ে কি মাখছেন?
উত্তরে পলাশ জানায়- তার গায়ের গন্ধে যে জেসমিনের সমস্যা হতো এটা সে মাত্র সেইদিন রুপা ভাবির কাছ থেকে জানতে পেরেছে। এরপর থেকে নিজের গায়ের অস্বাভাবিক গন্ধটা দূর করতে নানা রকম প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। অবশেষে তার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। ইন্ডিয়া থেকে সে তার বন্ধু মারফত গায়ে মাখার একটা সুগন্ধী তেলের বোতল আনিয়েছিলো। সেটা ব্যবহারের পরই চিরতরে বিদায় নিয়েছে সেই গন্ধ।

পলাশের মুখে এই কথা শোনার পর জেসমিনের কি অবস্থা হয়েছিলো সেটা অবশ্য আমরা জানি না। তবে শোনা যায় এখন নাকি নিজের গায়ের সেই পুরনো গন্ধ ফিরিয়ে আনতে নানা প্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে জেসমিনের স্বামী পলাশ।

মাহমুদা আকতার: লেখক, অনুবাদক ও সাংবাদিক। প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/