শুভ জন্মদিন প্রখ্যাত কবি ও সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর

আজ ১৯ মার্চ, ৫০ দশকের অন্যতম কবি ও সাহিত্যিক সিকান্দার আবু জাফরের জন্মদিন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীত রচয়িতা, নাট্যকার ও সাংবাদিক। সাহিত্যের নানা শাখায় পদচারণা থাকলেও তিনি কবি হিসাবেই সমধিক পরিচিতি। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে  প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা সমকাল সম্পাদনার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত এই সাহিত্যিক।

প্রাথমিক ও কর্মজীবন
সিকান্দার আবু জাফরের জন্ম  ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ, খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে। তার প্রকৃত নাম সৈয়দ আল্ হাশেমী আবু জাফর মুহম্মদ বখ্ত সিকান্দার। পরবর্তীতে তিনি সিকান্দার আবু জাফর নামে পরিচিতি পান। তার বাবা সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাশেম ছিলেন পেশায় একজন কৃষক ও ব্যবসায়ী। তাদের আদি নিবাস ছিল পাকিস্তানের পেশোয়ারে। সেখান থেকে তার দাদা মাওলানা সৈয়দ আলম শাহ হাশেমী খুলনার তেঁতুলিয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন।

ম্যাট্রিক পাস করার পর কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন সিকান্দার আবু জাফর। যদিও সেখানে বেশিদিন পড়ার সুযোগ পাননি। জীবিকার তাড়নায় লিপ্ত হন অর্থ উপার্জনের সংগ্রামে। কর্মজীবনে নানা পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন এই কবি। ১৯৩৯ সালে কলকাতার মিলিটারি একাউন্টস বিভাগে পেশাগত জীবন শুরু করেন এবং পরে সিভিল সাপ্লাই অফিসে চাকরি করেন। সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘গ্লোব নিউজ এজেন্সী’নামক সংবাদ-সংস্থায়ও তিনি কিছুকাল কাজ করেন। পাশপাশি এসময় ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯৪১ সালে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ পত্রিকায় যোগ দেন। ভারত বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৪৮-৫৩  তদানিন্তন রেডিও পাকিস্তানের স্টাফ আর্টিষ্ট হিসাবে কাজ করেন বেশ কিছুদিন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত হন এবং দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মিল্লাতের মতো পত্রিকায় কাজ করেন। তবে তার উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে দেশের প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’য়ের সম্পাদক হিসাবে কাজ করা।

সাহিত্য সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর
একজন সাহিত্যিক হিসেবে সিকানদার আবু জাফরের যে খ্যাতি তার চেয়েও অনেক বেশি প্রসিদ্ধি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’য়ের প্রকাশ ও সম্পাদনা তার জীবনের একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। ১৯৫৭ সালে তিনি এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সুচারুভাবে এটির প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন সিকান্দার আবু জাফর। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের সাহিত্য আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করেছিলেন। ষাটের দশকের নামী-দামী সকল কবি ও লেখকের রচনা প্রকাশিত হয়েছে এ পত্রিকায়। লেখার সাবধানী ও নৈর্ব্যক্তিক নির্বাচন, প্রতিভাবান নতুন লেখকদের মর্যাদা প্রদান, মনোযোগী সম্পাদনা এবং মুদ্রণ পরিপাট্যের জন্য তৎকালীন সময়ে সকল কবি-লেখকের স্বপ্নের পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সমকাল পত্রিকাটি। একই সঙ্গে এটি প্রগতিশীল বাংলা সাহিত্যধারার অগ্রগামী সাহিত্য পত্রে পরিণত হয়েছিল। তার নিজরেও প্রচুর লেখা এ পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন যার মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত ‘বাংলা ছাড়’ কবিতাটি-
   ‘রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলো
    আজকে যখন হাতের মুঠোয় কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি
    কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে কেউটে সাপের ঝাপি
    আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি
    তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া’

সাহিত্যে অবদান
সাহিত্যের নানা শাখায় অবদান রেখেছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সিকান্দার আবু জাফর। তিনি ছিলেন একাধারে কবি,গীতিকার, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক। সিকান্দার আবু জাফরের গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সম্পাদকীয় সকল সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ও তার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তি, মানবতার জয়গান প্রাধাণ্য পেয়েছে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী। তাই সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষের সপক্ষে সোচ্চার ছিল তার ক্ষুরধার কলম।

সবমিলিয়ে ২৭টি গ্রন্থ রচনা করেছেন এই সাহিত্যিক। এগুলোর মধ্যে কবিতা- প্রসন্ন শহর (১৯৬৫), তিমিরান্তিক (১৯৬৫), বৈরী বৃষ্টিতে (১৯৬৫), বৃশ্চিক-লগ্ন (১৯৭১), বাংলা ছাড়ো (১৯৭১); উপন্যাস-পূরবী (১৯৪১), নতুন সকাল (১৯৪৬); ছোটগল্প মাটি আর অশ্রু (১৯৪২); নাটক সিরাজ-উদ-দৌলা (১৯৬৫), মহাকবি আলাউল (১৯৬৬), সঙ্গীত মালব কৌশিক (১৯৬৬) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

অনুবাদক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর । তার অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে বারনাড মালামুডের যাদুর কলস (১৯৫৯), সেন্ট লুইয়ের সেতু (১৯৬১), রুবাইয়াৎ ওমর খৈয়াম (১৯৬৬) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তিনি গীতিকার হিসাবেও বেশ সমাদৃত। গান লিখেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের জন্যও। এগুলোর মধ্যে আপন দুলাল চলচ্চিত্রের ‘সখা হে তোমার সাথে আজ আমার নতুন খেলা’গানটি উল্লেখযোগ্য। এই গানের সুর রচনা করেন বিখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ এবং এতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী নাহিদ নিয়াজী।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও ব্যপাক অবদান রেখেছে তার রচিত সাহিত্য। তিনি স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও বিপ্লবের চেতনাসম্পন্ন অনেক কবিতা ও গান রচনা করেন। তার একটি বিখ্যাত কবিতা- ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে বাঁচবার অধিকার কাড়তে দাস্যের নির্মোক ছাড়তে অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ চলবেই চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’ এটি পরে জনপ্রিয় গণসঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই অবিস্মরণীয় গণ-সংগীত ‘সংগ্রাম চলবেই/ জনতার সংগ্রাম চলবেই/ আমাদের সংগ্রাম চলবেই’কোটি কোটি বাঙ্গালিকে যুদ্ধ জয়ের প্রেরণা যুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে  ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সে সময়ের 'দৈনিক পাকিস্তান' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কবির অপর অবিস্মরণীয় বিদ্রোহী কবিতা 'বাংলা ছাড়ো'।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৭১-এর আগষ্ট মাসে তিনি ইয়াহিয়ার নৃশংস হত্যা ও ধবংসযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে সারা বিশ্বের বিবেকবান সরকার ও জনগনের কাছে প্রতিবাদ লিপি-আকারে 'অভিযোগ' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য আহবান জানান ৷ বিষয়টি সামরিক সরকার জানার পর তিনি কলকাতায় পালিয়ে যান। তখন পুস্তিকাটি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুনঃপ্রকাশ করা হয় এবং দেশে বিদেশে প্রচারের জন্য প্রেরণ করা হয়।

পুরস্কার ও সম্মাননা
কবিতা ও কথাসাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। এগুলোর মধ্যে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ( ১৯৬৬) এবং ১৯৮৪ সালে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

মৃত্যু
১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিকান্দার আবু জাফর। তাকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

আজ এই সাহিত্যিকের ১০৩তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/