রুমানা সোবহান পরাগের গল্প ‘অন্তরের পাপ’

রুমানা সোবহান পরাগ

অন্তরের পাপ

শরীফ এই বাসায় প্রায় আঠারো বছর যাবৎ কাজ করছে। সে পাকা ড্রাইভার। কোনোদিন গাড়ির স্পিড বাড়ায়নি অপ্রয়োজনে। নিজের ওপর তার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। এই আঠারো বছরে ট্রাফিক আইন অমান্যর জন্য একটা কেস ও সে খায়নি। গাড়ি চালানোর সময় কখনও মুখ খারাপ করে না শরীফ। পরহেজগার মানুষ সে। তার সবচেয়ে ভালো গুন সে যখন গাড়ি চালায় তখন বোবার মতো গাড়ি চালায়, একটা উচ্চবাচ্চও করেনা। গাড়িতে বসা স্যার ম্যাডামের কথার মধ্যে কখনও  কথা বলে না। আর একটা ভালো গুন আছে ওর,  ও কোনোদিন যেচে ছুটি নেয়নি ওর স্যারের কাছ থেকে।  

ও ফারুক সাহেবের বিশ্বস্ত অনুচর বলতে গেলে। স্যারের কোনো কিচ্ছু ম্যাডামকে আগ বাড়ায়ে কোনোদিন বলেনি। এমনকি স্যারের একমাত্র মেয়ে যেদিন কলেজে না গিয়ে বন্ধুদের সাথে ক্যাফেতে গিয়েছে সেটাও বলেনি। শুধু তার ছোট ম্যাডাম রিন্তিকে বলেছে,' ছোটো ম্যাডাম আপনি যদি এরপর থেকে কলেজে না গিয়ে অন্য কোথাও নামেন তাহলে আমি বড় ম্যাডামকে বলে দেব। এই রিন্তি যেদিন হয়েছে সেদিন শরীফই বড় ম্যাডামকে ড্রাইভ করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। রিন্তির প্রতি তার অনেক মমতা অথচ কখনও তুমি বলে সম্মোধন করেনি রিন্তিকে। শরীফ নিজের সীমানার বাইরে কোনোদিন যায়নি।

শরীফের স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে সংসার। বেতন যা পায় তা দিয়ে সুখেই কেটে যাচ্ছে জীবন। আর ওর মালিকও মাসিক বেতনের বাইরে অনেক সাহায্য করে, ফলে চাকরি আর সংসারে কোনো অশান্তি নাই শরীফের। কিন্তু ইদানিং শরীফের মনটা স্যারের ফ্লাটের পাশের ফ্লাটের বুয়া জোবেদার জন্য যেন কেমন করে।

জোবেদা বিবাহিত এবং গর্ভবতী। দুই তিন বছর যাবৎ জোবেদার সাথে তার পরিচয়। জোবেদার বাড়ি শেরপুরে। স্বামী আর এক সন্তান ওর । জোবেদা মেয়েটা ভালো। কোনো বদনাম নেই ।তবে রগ চটা। কখন যে রেগে যায় তা বোঝা যায় না। বিল্ডিং এর দারোয়ান ড্রাইভাররা কখনও টিটকারি করার সাহস পায় না জোবেদার সাথে।

তবে শরীফ জানে ওকে দেখলে জোবেদা ভেতর থেকে খুশী হয়। সবসময় আঁচলে বাঁধা পান-শুপারি থেকে সে শরীফকে খেতে দেয়। কেমন যেন একটা সুখ হয় শরীফের জোবেদার হাতের পান খেতে। দিনে একবার হলেও জোবেদা শরীফের সাথে দেখা করে যায় নিচে এসে।

সেদিন শরীফ জোবেদাকে ফোন করে বলল,'জুবেদা ময়লা ফেলে যওয়ার সময় আমার সাথে দেখা করে যাস। ' ফোন রেখে শরীফ ভাবে এই মেয়েটা তাকে এতো টানে কেন। সারাক্ষন জোবেদাই তার চিন্তার মধ্যে আনাগোনা করে। মেয়েটা পোয়াতি। কতো কি না  খেতে ইচ্ছা করে ওর। আজকে রিন্তি ম্যাডাম কলেজ থেকে ফেরার সময় অনেক গুলো টিফিন হাতে দিয়ে বলল কাকু এগুলো কিনেছিলাম টিফিনে, আর খেতে ইচ্ছা করছে না। আপনি খেয়ে ফেলেন।' প্রায়ই রিন্তি ম্যাডাম, বড় ম্যডাম এরকম অনেক খাবার দিয়ে দেন। আমার এসব খেতে ভালো লাগেনা। আমি বাসায় নিয়ে যাই বাচ্চাদের জন্য।'

 'আজকের  খাবার গুলো জোবেদাকে দেবো। পোয়াতি মেয়েটা, ওর স্বামীটা একটুও খেয়াল করে না ওর। ভালো মন্দ কিছু কিনেও দেয়না ওকে। সেদিন কি গরম পরিছিল। তরকারি কিনতে নীচে  আসছিল জোবেদা । আমি একটা আইসক্রিম কিনে দিয়ে বললাম নে ধর ঠান্ডা খা। ওর কোনো সঙ্কোচ দেখলাম না।  রাস্তার পাশে আইল্যান্ডে ওপর বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল আর আমাকে বলল তুমি কেমনে জানলা যে আমার খুব আইসক্রিম খাতি মন চাচ্ছিলো।' মাথার ওপর টোকা দিয়ে বললাম,'পাগলী! তোর মনের কথা আমি না জানলে কে জানবে?'

'পাগলীটার অনেক রাগ। একদিন ফোন না করলেই সে মনখারাপ করে শরীফের ওপর। একবার শরীফ বাপের মৃত্যুর খবর পেয়ে দশদিনের ছুটি নিয়ে পরিবারের সাথে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। এতো  দুঃখ, এতো ঝড় ঝাপ্টা, ওয়ারিশের লাঠালাঠি এতো কিছুর মধ্যেও সে এক মুহুর্তের জন্য জোবেদার কথা ভুলতে পারেনি সেখানে । নিজেকেই প্রশ্ন করে শরীফ এ কেমন প্রেম যে পিতৃ শোক ও এর কাছে হালকা হয়ে যায়! কিচ্ছু ভালো লাগেনা শরীফের। ঢাকা থেকে স্যার ফোন করে বলেছিল,' তুই আরো দশদিন ছুটি কাটা আমি অফিসের ড্রাইভার দিয়ে ম্যানেজ করে নিবো। '

কিন্তু শরীফ ছুটি শেষ না করেই চলে এসেছিল সেবার । স্যার, ম্যডাম তো খুব খুশী শরীফকে দেখে, কারণ তারা আশাই করেনি এতো তাড়াতাড়ি শরীফ ফিরবে। আসলে শরীফের মন ছটফট করছিল জোবেদাকে দেখার জন্য। পরদিন সকালে জোবেদা যখন কাজে আসে শরীফ ওকে দেখে চিনতেই পারেনি। টবের ফুল গাছগুলো পানির অভাবে যেমন মরমর হয়। জোবেদার মুখটাও তেমনি শুকিয়ে গিয়েছিল। শরীফকে দেখে জোবেদা দৌড়ে এসেছিল। চোখে মুখে সেকি রাজ্জের জিগ্যাসা! " তুমি কই ছিলা এতোদিন, ফোনে কি হইছিল? ফোন কাটলা কেন বারবার ? আর কয়টা দিন দেরী করে ফিরলে আমার লাশ দেখতা তুমি। চলো লেকের পাড়ে গিয়ে বসে কথা বলি শরীফ ভাই।
'তোর ভাবী সবসময় পাশে ছিল, কেমনে তোর সাথে কথা কই? তোর জন্য আমারও পরান পুড়িছে রে পাগলি। '
আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসে শরীফ ভাই। আমার তোমার কাছে থাকতি মন চায়। জানি এটা ঠিক না। তোমার আমার দুজনেরই সংসার আছে। আমার ছাওয়াল ,শাশুড়ি সবাই আমাক ভালোবাসে। আমাক চায়। আমার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু আমার তো মন পরি থাকে তোমার কাছে। আমি সারাদিন মনে মনে তোমার সাথে কথা কই। একলাই হাসি আবার  কাদি। কেউ বুঝবারও পারেনা গোপনে আমি যে তোমাক কতো ভালোবাসি। তুমি আমার সাথে বিয়ে বসবা শরীফ ভাই!"

শরীফ মৃদু হেসে জোবেদার বেনীতে হালকা টান দিয় বলে,' পাগলী ধর্ম মানিস? তুই তো পরের বউ। তোর সংসার আছে। তারপর তুই পোয়াতি। তোকে আমি ভালো বাসি সেটা ঠিক, কিন্তু আমারও তো সংসার আছে। বউ পোলাপান আছে। ওদের আমি ছাড়া আর কিচ্ছু নাই। যদিও সেই সংসারে আমার দেহটা থাকলেও  মনটা পরে থাকে তোর কাছে। '

'তুমি যে এতো নামাজ কালাম পড়ো তাতে তোমার কি লাভটা হইলো! তোমার আল্লায় তো তোমারে দিয়া বান্দর খেলা খেলাইতেছে। ঘর বান্দাইছে একজনের লগে আর মন বান্দাইছে আরেকজনের লগে। শান্তি তো পাইতেছোনা। আচ্ছা একটা কথা সত্যি করে কবা! এ কয়দিন তোমার মন পোড়েনি আমার জন্য? '

'আচ্ছা তোর স্বামী যদি তোকে খুব মায়া করতো তাহলে কি তুই আমারে ভালোবাসতি পারতি জোবেদা?'

'মনে হয় পারতাম। কারন তোমার বউ তো তোমাকে কম ভালোবাসেনা তারপরেও তো সে তোমার অন্তরে জায়গা পায়নি! এক মনে দুইজনকে ভালোবাসা যায় বলো?'

শরীফ কোনো উওর না দিয়ে লেকের পানিতে ঢিল ছোড়ে। স্থির পানিতে ঢিল ছুড়ে দেয়ায় যে আচমকা তরঙ্গ সৃষ্টি হয় শরীফ সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। জোবেদার কথায় আর সে মনোযোগ দিতে পারে না।

'আমার খুব কষ্ট হয় গো। আল্লাহর কাছে কইতে পারোনা আল্লাহ আপনি আমার দেহের মালিকানা যারে দিছেন মনের মালিকানাও তারে দেন। তুমি হয় আমারে ভুলে থাকো না হয় আমারে কাছে রাখো। আর এটা তো পাপ তাই না! মনের পাপ তো বড় পাপ তাই না শরীফ ভাই। আচ্ছা কাউরে ভালোবাসাও কি পাপ? তোমার কন্ঠ আমারে পাগল করে শরীফ ভাই। তুমি আমারে ঐ গানটা আর একবার শোনাবা, আমার অন্তরায় আমার কলিজায়। '

' চল জোবেদা।  আজকে আর গান গাওয়ার মন নাই রে। আমি ছোট ম্যডামকে কলেজ থেকে আনতি যাবো। বাকিটা পথ আর কেউ কারো সাথে কথা বলেনা। শুধু হাটার ফাকে ফাকে জোবেদা তার চোখ মোছে।

বাড়ির কাছাকাছি আসতে শরীফ আস্তে করে বলে, 'বউ তোর আচলে বাধা পান থেকে একটা পান দে। কতোদিন তোর হাতে বানানো পান খাই না। '

জোবেদা পান বানায় ঠিকই কিন্তু চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা।

সেদিন ওদের আর দেখা হয় নি। শরীফ আসর নামাজের পর মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যায়। সে সব খুলে বলে ইমাম সাহেবকে। ইমাম সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,' আপনি গরহিতকর অপরাধ করছেন, অন্যর স্ত্রীকে আপনি পোয়াতি করেছেন।এটা কবীরা গুনাহ। '

'হুজুর আমি তারে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি, তার গর্ভে তার স্বামীর সন্তান। তার সাথে আমার অন্তরের সম্পর্ক। আমি তারে ভুলে থাকতে পারিনা এক মুহূর্তের জন্য হুজুর ।

' মনের পাপই বড় পাপ শরীফ মিয়া। এই মহিলার সন্তান প্রসবের পর তার স্বামীর কাছ থেকে তালাক নেবার পর আপনি তাকে বিয়ে করে আপনার ঘরে তুলতে পারেন। এতে শরীয়ত মোতাবেক আপনার ভালোবাসা জায়েজ হবে। তবে একটা কথা বলি, কিছু দিন গেলেই এই ভাব ভালোবাসা আর থাকবেনা। তখন অযথাই দুই সংসারের ভার বহন করতে হবে। আর দুই স্ত্রীর কাইজ্জা সামলানোর চাইতে দোজখের আগুনও অনেক শীতল মনে হবে তখন। আপনি বরং তার থেকে দূরে থাকেন। আল্লাহর কাছে পানা চান। কিছুদিন মনের কষ্টে ভুগবেন তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। পৃথিবীতে সব শোক সামলানোর শক্তি আল্লাহ পাক মানুষকে দিয়েছেন। বেশি বেশি করে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। যা আল্লাহ আপনার জন্য বরাদ্দ করেনি তার জন্য ব্যকুল হইয়েন না অযথাই।'

শরীফ সে রাতে আর ঘুমাতে পারেনি। তার নিজের সংসারে কোনো অশান্তি নেই। বউটা ভীষণ ভালো আর সংসারী। বাচ্চাদের যত্ন করে, সংসারকে যত্ন করে, শরীফের যত্ন করে। সবই ভালো তার। তার কোনো দোষ চোখে পরেনি শরীফের। কিন্তু তার জন্য মনটা যে কেনো ব্যকুল হয়  না তাই ভেবে পায় না শরীফ। বার বার জোবেদার মুখটা চোখে ভাসছিলো তার। সে সিদ্ধান্ত নেয় এই চাকরি টা আর করবে না।

পরদিন সকালে সে তার স্যার ফারুক সাহেবকে জানায় তার আর কাজ করতে ভালো লাগছেনা। সে গ্রামের বাড়ি চলে যাবে পারমানেন্টলি। ফারুক সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। সে প্রথমে ধাতস্থ হতে পারেনি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,' তুই কি বেশি বেতনে অন্য কোথাও অফার পাইছিস! আমাকে বল আর কতো বাড়ালে এই চাকরি করবি?'

শরীফ হাটু মুড়ে ফারুক সাহেবের পায়ের কাছে বসে পরে। বলে স্যার আমার টাকার দরকার পরলে আমি আপনার কাছে চেয়ে নিতাম। এতো বছর ধরে আছি আপনি আমাকে চিনেন নাই!'

তোর ম্যডাম কি তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করছে?রিন্তি কি বেয়াদবি করছে? তুই কি মনে কষ্ট নিয়ে চলে যাচ্ছিস? তোকে আমি অনেক স্নেহ করি। তোর কি সমস্যা আমাকে বল।

শরীফ কোনো উওর দেয়না। ফারুক সাহেব শরীফকে বলে তোর যেদিন মনে হবে আর পারতেছিস না সেদিন চলে যাস। তোর জন্য সব নিয়ম শিথিল। শরীফ চুপচাপ বেড়িয়ে যায় স্যারের রুম থেকে ।

সে মনে মনে সংকল্প করে জোবেদা যখন বাচ্চা হবার জন্য ছুটিতে যাবে তখনই সে স্যার কে বলবে কাজ না করার কথা। হুট করে এখন চলে গেলে জোবেদা দিশাহারা হয়ে পরবে। একদিন ওকে না দেখলেই কেমন মন খারাপ করে মেয়েটা।

সে মন থেকে দোয়া করে জোবেদা যেন নতুন সন্তানের স্পর্শে পৃথিবীর সব না পাওয়াকে ভুলে যায়। জোবেদা যেন সব সময় ভালো থাকে তার সংসারে। অথচ তার নিজের সামনের দিন গুলো কিভাবে কাটবে তা আর ভাবতে পারেনা শরীফ। সে একা একা রাস্তায় হাটে আর ভাবে যেখানে নিয়ম মাফিক সব কিছু দিলা খোদা সেখানেই কেন এই প্রেমটা দিলানা…।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/