করোনাসহিষ্ণু হেমনগর ও স্বেচ্ছাব্রতী উদ্যোগ

আনজু আনোয়ারা ময়না

আনজু আনোয়ারা ময়না

বৈশ্বিক মহামারীর মহাবিপর্যয়ে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। অদৃশ্য জীবাণুশক্তির কাছে পরাজিত আজকের মানব সভ্যতা। এর থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে মানুষ ছুটছে দিগ্বিদিক। বিশ্বসাস্থ্য সংস্থার যেন ঘুম নেই চোখে। তারা  নিয়মনীতি বাতলে দিলেন কোভিড-১৯ থেকে পরিত্রাণের। গত ৮ মার্চ ২০২০ বাংলাদেশেও শুরু হল কোভিডের প্রভাব। জনবহুল এই দেশের মানুষের বড় একটা অংশ বাস করে গ্রামে।  তাদের অধিকাংশই বেশ অসচেতন। আর এই অসচেতনতাই তাদের মুক্তির পথরোধ করে থাকে সবসময়।

এরকমই ১৪ টি গ্রাম নিয়ে হেমনগর ইউনিয়ন। টাঙ্গাইল জেলাধীন গোপালপুর উপজেলার এই ইউনিয়নটি যমুনা নদী ভাঙ্গনকবলিত। দরিদ্র পীড়িত। এতদ্বসত্বেও এই ইউনিয়নের কিছু মানুষ বেশ সংগঠিত। তারা যে কোন বিষয়কে নিবিড়ভাবে দেখার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে। তাদের মাঝে এই দক্ষতা গড়ে তুলতে The Hunger Project বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে। করোনা পরিস্থিতিকে সামাল দিতে তারা প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তোলে শুরু থেকেই। প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে  স্বেচ্ছাব্রতী নারী নেত্রী,  ইয়ুথ সদস্য,  উজ্জীবক, গণগবেষণা সদস্য। নেতৃত্বে রয়েছে গ্রাম উন্নয়ন দল (( village development team), সংক্ষেপে  VDT।  এই VDT’র সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তারা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পৃথিবী  সহজেই এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে না। করোনা সহিষ্ণু হয়েই টিকে থাকতে হবে এই লড়াইয়ে। তাই তারা দুটো বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেন।  এক-প্রতিকার ব্যবস্থা,  দুই-প্রতিরোধ ব্যাবস্থা। প্রতিকার ব্যাবস্থার সাথে কিছু প্রতিষ্ঠান এবং এর সক্ষমতা জড়িত। বর্তমান বাস্তবতা যথেষ্ট নির্মম। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সকলকে চিকিৎসার আওতায় আনার মত প্রস্তুতি হাসপাতালগুলোতে নেই।  আবার যোগাযোগ দূরত্বের কারণে আক্রান্ত রোগীকে সহজেই হাসপাতালে নেওয়াতেও রয়েছে নানান প্রতিবন্ধকতা। সঠিক চিকিৎসা  সেবা পেতে টাঙ্গাইল জেলার জেনারেল হাসপাতালে ৫০ সিটের বিপরীতে কোভিড আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছে শতাধিক। প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল না থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে  ডাক্তার,  নার্সসহ সকলেই হিমশিম খাচ্ছে। তারাও আক্রান্ত হচ্ছে আশংকাজনক হারে।  নেই পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ।  সব মিলিয়ে প্রতিকার ব্যবস্থা সহজসাধ্য কোন বিষয় নয়। অন্তত এই দুঃসময়ে।

অপরদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত নিয়মাবলী অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ উদ্যোগে সচেতন হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সম্ভব। হেমনগর ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের "গ্রাম উন্নয়ন দল" নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে প্রতিটি গ্রামের মানুষকে সংগঠিত করে। তারা অনলাইন এবং অফ লাইনে স্বাস্থ্য বিধি মেনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে।  ছোট ছোট টিমে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়।  সচেতনতামূলক প্রচারণা চালায়। SDG অর্জনের নিমিত্তে সহায়কের অবস্থান থেকে  দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাওয়া এই "গ্রাম উন্নয়ন দল " নিজেদের গ্রামে "করোনা প্রতিরোধ কমিটি" গড়ে তোলে।  "করেনাসহিষ্ণু গ্রাম" গড়ে তুলতে এই কমিটি ইউনিয়নব্যাপী  স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিম্নরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করে গত বছরের মার্চথেকেই।

#  www  ক্যাম্পেইন এর কার্যকর বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা।
# হাত ধোয়ার অনুশীলন।
# হ্যান্ডওয়াশব্লক স্থাপন।
# জনসমাগম হয় এমন স্থানে শারীরিক দূরত্বের চিহ্ন আঁকা।
# গ্রামের প্রবেশমুখের পথ গুলোতে বহিরাগত সনাক্তকরণ ব্যবস্থা নেওয়া।
# আক্রান্ত এলাকা থেকে আগত মানুষদের তালিকা প্রণয়ন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে অবহিত করণ।
# লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া ব্যাক্তিদের কোভিড পরীক্ষা করানোয় উদ্বুদ্ধ ও সহযোগিতা করা।
# পথচারীদের হাত ধোয়ার অনুশীলন করানো।
# ব্যাবসায়ীদের মাঝে হ্যান্ডগ্লবস, ও স্যানিটাইজার  বিতরণ।
# গ্রামে -গ্রামে,  বাজারে জীবানুনাশক ছড়ানো।
# তিন স্তরের সুতী কাপড়ের মাস্ক পরিধানে সকলকে উদ্বুদ্ধ করা।
# মায়েদের নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উঠান বৈঠক করা।
# দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের দ্বারা তৈরি সুতি কাপড়ের মাস্ক বিনামূল্যে বিতরণ।
# নিরাপদ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা ও সবজি বীজ বিতরণ করা।
# সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ।
# মাইকিং করা।
# অন লাইন গ্রুপ গঠন ও সচেতনতামূলক প্রচার করা।
# প্রতিরোধ টিকা গ্রহনে রেজিস্ট্রেশন কাজে সহায়তা করা।
# কোভিড সংক্রান্ত গুজব ও কুসংস্কার প্রতিরোধ ব্যাবস্থা করা।
# সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে লকডাউন সফল করতে উদ্বুদ্ধ করা।
# আরও বেশি মানুষকে এসব কাজে যুক্ত করে এই মহা সংকটের বিরূদ্ধে নতুন এক শুভশক্তি উদ্ভব ঘটানো।
# স্থানীয় প্রশাসনকে পরিকল্পনার বিষয়ে অবহিতকরণ।
# সরকারি সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিতে পরামর্শ প্রদান ও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন । এক্ষেত্রে শতাধিক মানুষকে সরকারি নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার ব্যাবস্থা করা।
# শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাব্রতী কাজে যুক্ত করার মাধ্যমে কাজটা সহজ করে তোলার ব্যাবস্থা গ্রহন।
# স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতনতাবোধ তৈরিতে উঠান বৈঠক করা।
# বাল্যবিয়ে প্রতিরোধেও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহন।
# মা ও শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় গর্ভবতী ও প্রসুতি মায়ের যত্নে প্রশিক্ষিত টিমের নেতৃত্বে বিশেষ পরামর্শ প্রদান ও পুষ্টি র ব্যবস্থা ছিল উল্লেখযোগ্য।

এই মহাবিপর্যয়ে হেমনগর ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রাম উন্নয়ন দল এলাকার মানুষকে ঘরে রাখতে কর্মহীন মানুষের তালিকা প্রস্তুত করে।
পাশাপাশি এলাকার মেধাবী কৃতী সন্তান, বেশ কিছু ধনাঢ্য ব্যাক্তি, ও মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনের সাথে সার্বক্ষণিক  যোগাযোগ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকল কর্মকাণ্ড প্রচার করে। কর্মহীন মানুষের জীবন জীবিকার জন্য community philanthropy ব্যবস্থায় সহযোগিতা করে।  এক্ষেত্রে নারীপ্রধান পরিবার ও প্রতিবন্ধী  সদস্যের পরিবারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। গত এক বছরে নিপীড়িত  মানুষকে ,  খাদ্যসামগ্রী,  সাবান,  পোশাক,  টয়লেট,  টিউবওয়েল,  গৃহহীনের ঘর,  জীবিকার জন্য গরু ছাগল,  পানিবন্দীদের জন্য নৌকা,  নিরাপদ পুষ্টির জন্য সবজি বীজ ইত্যাদি বিতরণ করা হয়। এছাড়াও জীবন মান উন্নয়নের লক্ষে ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য সহযোগিতা করা হয় প্রতিবন্ধী পরিবারে । মাস্ক বিতরণ করা হয় প্রায় বিশ হাজার, আর্থিক মূল্যমানে যার পরিমান প্রায় তিরিশ লক্ষ টাকা। উপকার ভোগীর সংখ্যা প্রায় চার হাজার।  এসময় স্থানীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সহযোগিতায় ছিল YAP FOUNDATION,  THE HUNGER PROJECT , DORIDRO CHARITY FOUNDATION  এবং আমরা গোপালপুরবাসী ফেসবুক গ্রুপ। এছাড়াও  হেমনগর ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য ।  স্বেচ্ছাব্রতী সহযোগিতায় ছিল 'শুভশক্তি বাংলাদেশ" ।

ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে অত্র ইউনিয়নের মানুষের মাঝে করোনা প্রতিরোধী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার হার আশাব্যঞ্জক। তারা নিজের তাগিদেই নিজ নিজ গ্রামের সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। এসকল উদ্যোগ বাস্তবায়নে গ্রাম উন্নয়ন দল জোরালো ভূমিকা রাখলেও স্বেচ্ছাব্রতী বন্ধুরা রয়েছে অগ্রণী ভূমিকায়।

তৃণমূলের মানুষগুলোকে নিয়ে এ কাজগুলো করা সহজসাধ্য ছিল না কখনও।  অসচেতন মানুষগুলোর চিন্তাজগতের এই পরিবর্তনে ছিল অনেক বাধা। প্রচলিত বিশ্বাস, আর নেতিবাচক ধারণার উত্তোরন ঘটাতে মুখোমুখি হতে হয়েছে স্থানীয় গোঁয়ার বুদ্ধির মানুষের সাথে যৌক্তিক বিশ্লেষণে। এছাড়াও দুর্নীতি দূবৃত্তায়নের পরোক্ষ প্রত্যক্ষ চাপ এড়িয়ে কাজ করা ছিল কষ্টসাধ্য।
তদুপরি নিরলস এবং সমন্বিত প্রচেষ্টায় হেমনগর ইউনিয়নবাসী করোনা প্রতিরোধে একাত্মতা ঘোষণা করে।  ফলশ্রুতিতে আক্রান্তের হার অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক কম এবং পরীক্ষা করানো ও টিকা গ্রহনের হার অপেক্ষাকৃত বেশি। যা করোনা সহিষ্ণু ইউনিয়ন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

গ্রাম উন্নয়ন দলের ( VDT)এই কার্যকর উদ্যোগকে আরও আধুনিক করে গড়ে তুলতে, শতভাগ মানুষকে  স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আওতায় আনতে প্রয়োজন  VDTসদস্যদের  সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। করোনাকালীন  সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা। সেই সাথে সহযোগী  সংগঠনের  নিবিড় প্রশিক্ষণের মধ্যদিয়ে একদল দক্ষ মানুষ তৈরি করা যার মাধ্যমে  করোনা সহিষ্ণু ইউনিয়ন গঠনে সহজতর সুফল বয়ে আনতে  যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।

লেখক পরিচিতি: আনজু আনোয়ারা ময়না একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তিনি আর্থ সামাজিক নানা বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমূলক সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক, জেলা শাখা টাঙ্গাইলের সভাপতি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/